০৮. ছোট ঘরটির ধাতব টেবিল ঘিরে

ছোট ঘরটির ধাতব টেবিল ঘিরে বারোজন নারী পুরুষ বসে আছে, দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই যে এরা সবাই রবোমানব। কঠিন চেহারার মানুষটি টেবিলে থাবা দিতেই সবাই তার দিকে তাকাল। সে একটু হাসার ভঙ্গি করে বলল, আগে যতবার এই ঘরটিতে তেমাদের নিয়ে বসেছি, প্রত্যেকবার আমার ভেতরে এক ধরনের চাপা ভয় কাজ করেছে। যদি মানুষেরা খবর পেয়ে যায়–যদি তারা আমাদের ধরতে চলে আসে! মানুষটি তার আঙুল দিয়ে টেবিলে একটু শব্দ করে বলল, এই প্রথমবার আমার ভেতরে কোনো ভয় নেই। আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে নেটওয়ার্কটি এখনো দখল করি নি, কিন্তু নেটওয়ার্কটির গুরুত্বপূর্ণ সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতে চলে এসেছে। এখন হঠাৎ করে নিরাপত্তাবাহিনীর কেউ আর আমাদের ধরতে চলে আসবে না!

লালচে চুলের মেয়েটি বলল, তোমাকে অভিনন্দন!

আমাকে অভিনন্দন দেবার কিছু নেই। আমরা সবাই মিলে করেছি।

কিন্তু তোমার নেতৃত্বে করেছি। তুমি অসাধারণ একটি পরিকল্পনা করেছ। নেটওয়ার্কে যখন প্রথমবার তোমার ছবি আর নামটি চলে আসবে, যখন সবাই জানবে নতুন পৃথিবীর নতুন নেতা তুমি-তখন পৃথিবীর গোবেচারা মানুষগুলোর কী অবস্থা হবে কল্পনা করেই আমার শরীরে শিহরণ হতে থাকে!

কঠিন চেহারার মানুষটি হাসি হাসি মুখে বলল, তোমার শিহরণকে আর দুটি দিন আটকে রাখ। এখন থেকে ঠিক দুইদিন পর আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে নেটওয়ার্ক দখল করব।

কমবয়সী একজন মানুষ ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করল, নেটওয়ার্ক দখল করার পর, সবচেয়ে প্রথম আমরা কী করব?

সবকিছু ঠিক করা আছে। সময় হলেই দেখতে পাবে?

আমাদের আগে থেকে বলবে না?

বলব। তোমাদের নিয়ে কাজ করেছি, তোমাদের না বললে কাকে বলব? কঠিন চেহারার মানুষটার মুখ হঠাৎ করে আরো কঠিন হয়ে যায়, সবার প্রথম আমরা বিজ্ঞান আকাদেমীর এগারোজনকে ধরে আনব। সত্যি কথা বলতে কী ধরে আনা হবে না, যেখানে যাকে পাওয়া যাবে সেখানেই তাকে শেষ করে দেয়া হবে। তবে পৃথিবীর গোবেচারা মানুষদের আমরা সেটা জানাব না। তাদেরকে জানাব ওদের ধরে আনা হয়েছে বিচার করার জন্যে। তারপর আমরা ওদের বিচার করে শাস্তি দেব।

হাসিখুশি একটি মেয়ে জিজ্ঞেস করল, কোন অপরাধের জন্যে আমরা তাদের শাক্তি দেব?

কঠিন চেহারার মানুষটি বলল, অপরাধের কী আর শেষ আছে? মানব সভ্যতাকে ধ্বংস করার অপরাধ। রবোমানবদের প্রতি অবিচার করার অপরাধ? পৃথিবীর সম্পদ ধ্বংস করার অপরাধ! এমন কী তাদের বিরুদ্ধে শিশু হত্যার অপরাধ পর্যন্ত আনতে পারি?

লাল চুলের মেয়েটি বলল, সেটা কী কেউ বিশ্বাস করবে? এই দুর্বল কাপুরুষ অথব কিছু মানুষ-তারা শিশু হত্যা করতে পারে সেটা কেউ বিশ্বাস করবে না।

কঠিন চেহারার মানুষটি টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, একশবার বিশ্বাস করবে। পুরো নেটওয়ার্ক আমাদের দখলে, সেই নেটওয়ার্কে হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য সংরক্ষিত করে রাখা হবে। আমরা দিনকে রাত রাতকে দিন করতে পারব। সূর্যকে চাদ, চাঁদকে সূর্য করে ফেলতে পারব। বিজ্ঞান আকাদেমীর সভাপতি থুলকে সবচেয়ে বড় ভণ্ড হিসেবে দেখানো হবে। মানুষটি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আর এই বুড়োটিকে আমি নিজের হাতে খুন করতে চাই।

লাল চুলের মেয়েটি খিল খিল করে হেসে বলল, আমাকে সেই দৃশ্যটি নিজের চোখে দেখতে দেবে?

কেন?

দুটি কারণে, প্রথমত, এসব দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। দ্বিতীয়ত, তোমর মনে আছে আমার ঘরে একটা ছেলের মস্তিষ্ক আমি বাঁচিয়ে রেখেছি?

মনে আছে।

আমি তাকে এই ঘটনাটি নিজের মুখে বর্ণনা করতে চাই। যখন একজন মানুষের একটা মস্তিষ্ক ছাড়া আর কিছু থাকে না তখন তার থেকে অসহায় আর কিছু নেই। সেই অসহায় মানুষটির মস্তিষ্ক যখন আকুলি বিকুলি করতে থাকে সেটি দেখার চাইতে বড় বিনোদন আর কিছু হতে পারে না!

কঠিন চেহারার মানুষটি বলল, ঠিক আছে, আমি তোমাকে সেই দৃশ্যটি দেখতে দেব।

ধন্যবাদ! তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। অনেক অনেক ধন্যবাদ!

কঠিন চেহারার মানুষটি বলল, আজকে আমরা একত্র হয়েছি তোমাদের কিছু তথ্য জানতে। এখন পৃথিবীর সবকিছু পরিচালনা করে বিজ্ঞান আকাদেমীর এগারোজন মানুষ। নেটওয়ার্কটি দখল করে নেবার পর বিজ্ঞান আকাদেমীর জায়গায় চলে যাব আমরা এগারোজন মানুষ।

ধাতব টেবিল ঘিরে বসে থাকা মানুষগুলো হঠাৎ করে পাথরের মতো স্থির হয়ে গেল। কঠিন চেহারার মানুষটি হাসি হাসি মুখে বলল, কী হল, তোমরা হঠাৎ করে এতো শান্ত হয়ে গেলে কেন?

কেউ কোনো কথা বলল না। মানুষটি তার মুখের হাসিটিকে আরো বিস্তৃত হতে দিয়ে বলল, কী হল, তোমরা কেউ কথা বলছ না কেন?

সুদর্শন একজন মানুষ তার কপাল থেকে ঘাম মুছে বলল, আমরা এখানে বারোজন আছি, কিন্তু তুমি বলেছ আমরা এগারোজন!

তার মানে কী?

তার মানে এই বারোজনের একজন–

বারোজনের একজন?

থেকেও নেই।

চমৎকার বিশ্লেষণ! চমৎকার! তুমি যখন এতো চমৎকার বিশ্লেষণ করতে পার তোমাকে তাহলে আরো একটু বিশ্লেষণ করতে দিই। তুমি বল কোন মানুষটি এখানে থেকেও নেই?

সুদর্শন মানুষটি সবার মুখের দিকে তাকাল তারপর ঘুরে কঠিন চেহারার মানুষটির দিকে তাকিয়ে বলল, এখানে যারা আছে তাদের কেউই কখনো গুরুত্বপূর্ণ কোনো সিদ্ধান্ত নেয় নি। শুধু আমি তোমার সাথে পাশাপাশি কাজ করেছি। তুমি আর আমি মিলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছি।

তার অর্থ কী?

তার অর্থ আমাদের এই বারোজনের মাঝে কাউকে যদি মারা যেতে হয়, তাহলে সেটি হবে তুমি না হয় আমি।

চমৎকার, তাহলে তুমিই বল। মানুষটি কী তুমি না আমি?

সুদর্শন চেহারার মানুষটি একদৃষ্টে কঠিন চেহারার মানুষটির দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মুখে একটা বিষণ্ণ হাসি ফুটে ওঠে–সে ফিস ফিস করে বলল, দোহাই লাগে, আমাকে তুমি মেরে ফেলো না। আমি কী করেছি শুনলে তুমি অবাক হয়ে যাবে!

কী করেছ?

কথা দাও তুমি আমাকে মেরে ফেলবে না।

রবোমানবেরা মানুষ নয়, তাদের কথার কোনো মূল্য নেই।

তবু কথা দাও!

না, আমি নাটকীয়তা পছন্দ করি না। তুমি বল।

সুদর্শন মানুষটি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, পৃথিবীর সাতজন মহাচারীকে নিয়ে একটি মহাকাশযান মহাকাশে যাত্রা করেছে। সেই সাতজন মহাকাশচারীর মাঝে দুইজন রবোমানব ঢুকিয়ে দিয়েছি।

কঠিন চেহারার মানুষটি বলল, কেমন করে সেটা করেছ?

নেটওয়ার্কের গভীরে আমার নিজস্ব যোগাযোগ আছে–

সুদর্শন মানুষটির কথা শেষ হবার আগেই কঠিন চেহারার মানুষটি তার পকেট থেকে একটা রিভলবার বের করে সুদর্শন মানুষটিকে পরপর অনেকগুলো গুলি করল। সুদর্শন মানুষটি কাত হয়ে মেঝেতে পড়ে গেল, তার চোখে এক ধরনের অবিশ্বাসের দৃষ্টি।

কঠিন চেহারার মানুষটি ফিসফিস করে বলল, যে বিজ্ঞান আকাদেমীর সবচেয়ে গোপন প্রজেক্টে নিজের নাক গলাতে পারে তাকে বিশ্বাস করা ঠিক না।

সবাই মাথা নাড়ল, বলল, না। ঠিক না।