০৮. চিকিৎসার জন্যে ঢাকা

হাবীবুর রহমান সাহেব চিকিৎসার জন্যে ঢাকা চলে এসেছেন। খালি হাতে আসেন নি-তিন কেজি মাষকলাইয়ের ডাল, পাঁচ কেজি কালিজিরা পোলাওয়ের চাল, দুটা বিশাল সাইজের মিষ্টিকুমড়া নিয়ে এসেছেন। তিনি হাত বাড়িয়ে মাহতাব সাহেবের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলেন। হ্যান্ডশেকের পর কোলাকুলি করলেন। মাহতাব সাহেবের বাড়িঘর দেখে বেচারা পুরোপুরি হকচকিয়ে গেছেন। এই জিনিস তাঁর কল্পনাতেও ছিল না। বসার ঘরের মেঝের অর্ধেকটা মার্বেলের, বাকি অর্ধেক মনে হচ্ছে কাচের, নিচ থেকে সবুজ আলোর আভা আসছে। হাবীবুর রহমান সাহেব বললেন, ভাইসাহেব, ভালো আছেন?

মাহতাব উদ্দিন বললেন, ভালো আছি।

যাকে পাঠিয়েছিলাম, খলিলুল্লাহ, সে কেমন আছে?

সেও ভাল আছে।

তার মাধ্যমেই আপনার সঙ্গে পরিচয়, জগতের কী অদ্ভূত লীলা।

অদ্ভূত লীলা তো বটেই!

জনাব, আপনি বলেছিলেন আমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করবেন।

মাহতাব উদ্দিন শুকনো গলায় বললেন, চিকিৎসার ব্যবস্থা অবশ্যই করা হবে। আপাতত বিশ্রাম করুন। আপনাকে গেস্টম দেখিয়ে দেবে।

শুকরিয়া। জনাব, খলিলুল্লাহর সঙ্গে একটু কথা বলি। সে আছে কোথায়?

সে ভালো মতেই আছে। তার সঙ্গে আপনার কথা বলার প্রয়োজন দেখছি। না।

না না, কোনো প্রয়োজন নাই। সে থাকবে তার মতো। আমি থাকব আমার মতো। আমার খুবই ভালো লাগছে যে আপনার আশ্রয়ে এসে দরিদ্র মানুষটার একটা গতি হয়ে গেল। সবই আল্লাহর ইচ্ছা। আমরা উপলক্ষ মাত্র। জনাব, কেবলা কোনদিক? তিন ওয়াক্ত নামাজ কাজা হয়েছে। মাগরেবের ওয়াক্তও হয়ে গেছে।

আপনি আপনার ঘরে যান। কেবলা কোনদিকে তা আপনাকে দেখিয়ে দেবে জায়নামাজ এনে দেবে।

জায়নামাজ আমার সঙ্গেই থাকে জনাব। জায়নামাজ আর কোরান শরিফ। এই দুটা জিনিস ছাড়া আমি ঘর থেকে বের হই না। ছোটবেলার অভ্যাস।

মাহতাব উদ্দিন বসার ঘর থেকে বের হলেন। এখন সন্ধ্যা হয় হয়। বাসায় যখন থাকেন সন্ধ্যাবেলা ছাদে হাঁটাহাঁটি করেন। সূর‍্যাস্ত দেখেন। গ্রামে সূর‍্যাস্ত দেখার একরকম আনন্দ। শহরে দালানকোঠার ঘরে খলিলুল্লাহকে নিয়ে আসা হয়েছে। এই ঘরটিও তালাবন্ধ। তাতে খলিলুল্লাহর কোনো সমস্যা হচ্ছে না। সে নিজের মনেই আছে। এই ঘরটা বেশ বড়। ঘরের মেঝেতে পাটি বিছানো। পাটিভর্তি হাজারো খুঁটিনাটি যন্ত্রপাতি। দুটা কম্পিউটারের মাদারবোের্ড। একটা মনিটর। ইলেকট্রিকের তার। সোল্ডারিং গান। খলিলুল্লাহ যা যা চেয়েছে জালাল খাঁ খবই জোগাড় করে দিয়েছেন। তাকে নিয়ে ইলেকট্রনিকের দোকানে ছেড়ে দিয়েছেন। সে যা যা চেয়েছে সবই তাকে দেয়া হয়েছে। প্রায় পাঁচ কেজি ওজনের একটা মোমের টুকরার উপর জিনিসগুলি বসেছে। মোমের টুকরাটি মনে হয় মূল বেস। প্রতিদিন তাকে প্রচুর বরফ দিতে হচ্ছে। বরফ কী জন্যে লাগছে কে জানে। বরফের আপাতত কোনো ব্যবহার দেখা যাচ্ছে না।

মাহতাব উদ্দিন খলিলুল্লাহর ঘরের জানালার কাছে এসে দাঁড়ালেন। জানালায় টোকা দিয়ে বললেন, কেমন আছ খলিলুল্লাহ?

খলিলুল্লাহ মুখ তুলল না। কাজ করতে করতেই বলল, ভালো আছি।

যন্ত্র তৈরি হচ্ছে?

জ্বি।

এই যন্ত্রে অতীতের কথা শোনা যাবে?

জ্বি। শুধু কথা শোনা যাবে না। ছবিও দেখা যাবে।

বলো কী! ছবিও দেখা যাবে?

জ্বি। যন্ত্রটা এই ঘরে ফিট করা হয়েছে, কাজেই এই ঘরে পনেরো বিশ কুড়ি বছর আগে কী হয়েছিল সেটা দেখা যাবে।

এমন যন্ত্র সত্যি তৈরি হবে?

জ্বি হবে। হবে না, হয়েছে। আমি পরীক্ষাও করেছি।

মাহতাব উদ্দিন আগ্রহের সঙ্গে বললেন, পরীক্ষায় কী দেখলে?

দেখলাম এই ঘরে একজন মহিলাকে তালাবন্ধ করে রাখা হতো। মহিলার চোখ নীল।

তাই দেখলে?

জ্বি।

খুব ভালো যন্ত্র। পুরোপুরি তৈরি হোক, তারপর আমাকে খবর দিও। আমি এসে দেখে যাব।

জ্বি আচ্ছা।

অন্ধকারে কাজ করছ কীভাবে?

আমার অসুবিধা হয় না।

অসুবিধা না হলে তো ভালোই।

মাহতাব উদ্দিন আবার হাঁটতে শুরু করলেন। পুরোপুরি অন্ধকার না হওয়া। পর্যন্ত তিনি ছাদের এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত হটলেন। এশার নামাজের। আজানের পর তিনি নিচে নামলেন। আজ সারাদিন টুনটুনির সঙ্গে দেখা হয় নি মেয়েটির সঙ্গে দেখা হওয়া দরকার। বারেক খবর দিয়েছে টুনটুনির জ্বর। চারদিকে ভাইরাস ফিভার হচ্ছে। টুনটুনিকেও কোনো একটা ভাইরাসে ধরেছে কিনা কে জানে।

টুনটুনি ঘর অন্ধকার করে শুয়েছিল। মাহতাব উদ্দিন ঘরে ঢুকে বাতি জ্বালালেন। টুনটুনি চাদর গায়ে বিছানায় শুয়ে আছে। তার চোখ লাল। মাহতাব উদ্দিন বললেন, জ্বর কি খুব বেশি রে মা?

টুনটুনি বাবার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল, বাবা, তুমি আমাকে অরণ্যের সঙ্গে দেখা করতে দিচ্ছ না কেন? তাকে নিয়ে ছাদের চিলেকোঠায় আটকে রেখেছ। আমাকে কেউ ছাদে যেতে দিচ্ছে না।

মাহতাব সাহেব বললেন, খলিলুল্লাহ হোর জন্যে কী একটা যন্ত্র বানাচ্ছে। যন্ত্রটা পেয়ে তুই খুব সারপ্রাইজড হবি। সেই সারপ্রাইজটা যেন নষ্ট না হয় সে জন্যেই তোকে যেতে দিচ্ছি না।

যন্ত্রটা দিয়ে কী হয়?

কী হয় আগে বললে তো সারপ্রাইজ থাকবে না।

টুনটুনি বিছানায় উঠে বসতে বসতে বলল, বাবা, মানুষকে তালাবন্ধ করে রাখতে তুমি খুব মজা পাও—তাই না?

তার মানে?

চিলেকোঠার ঐ ঘরে তো তুমি আমার মাকেও তালাবন্ধ করে রাখতে।

মাহতাব সাহেব শান্ত গলায় বললেন, টুনটুনি, তোমাকে আমি বলেছি তোমার মা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তাকে তালাবন্ধ করে রাখা ছাড়া আমার দ্বিতীয় পথ ছিল না।

টুনটুনি তাকিয়ে আছে। তার চোখ রক্তাভ।

মাহতাব সাহেব বললেন, এভাবে তাকিয়ে আছ কেন? আর কিছু বলতে চাও?

টুনটুনি বলল, না।

 

রাত একটা।

মাহতাব উদ্দিন তাঁর ঘরে বসে আছেন। তার সামনে মাথা নিচু করে বারেক দাঁড়িয়ে আছে। মাহতাব সাহেব বললেন, হাবীবুর রহমান সাহেবকে কাল ভালো ডাক্তার দেখাবার ব্যবস্থা করবে।

বারেক বলল, জ্বি করব।

মাহতাব উদ্দিন সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে শান্ত গলায় বললেন, খলিলুল্লাহর একটা ব্যবস্থা আজ রাতেই করতে হবে। কী ব্যবস্থা বুঝতে পারছ?

পারছি।

আর যাই করে তাকে পানিতে ফেলবে না। পানিতে ফেলে কিছু করা যাবে না। এ অন্য জিনিস।

বারেক চাপা গলায় বলল, স্যার এই বিষয় নিয়া আপনি মোটেই চিন্তা করবেন না। আমাদের ইটের ভাটা আছে।

ঠিক আছে, এখন যাও।

 

রাত দুটা কুড়ি মিনিটে খলিলুল্লাহকে হাত-পা বেঁধে ইটের ভাটায় ফেলে দেয়া হলো।

রাত দুটা পঁচিশ মিনিটে টুনটুনির জ্বর খুব বাড়ল। গা দিয়ে রীতিমতো আগুন বের হচ্ছে। মাহতাব উদ্দিন মেয়েকে বাথটাবে শুইয়ে দিয়ে নিজেই গাড়ি নিয়ে ডাক্তার আনতে ছুটে গেলেন। জ্বরের ঘোরে টুনটুনি পানির নিচে চলে গিয়েছে। তখন খুব অদ্ভুত একটা ব্যাপার হলো। টুনটুনি লক্ষ করল সে পানির নিচে ডুবে থাকতে পারছে, তার কোনো সমস্যা হচ্ছে না। সে একসঙ্গে অসংখ্য নারী পুরুষের গলা শুনছে। সবাই বলছেটুনটুনি, দ্বিতীয় মানব সম্প্রদায়ের জগতে স্বাগতম। তুমি এখন আমাদের একজন।