ঘুম ভাঙতেই রেফ চমকে উঠল। বিছানার উপর অপরিচিত একটা মেয়ে বসে আছে। তার দিকে তাকিয়ে খুব পরিচিত ভঙ্গিতে হাসছে। রেফ পরপর দুবার। কে বলে তৃতীয়বার বলার আগে থমকে গেল। মেয়েটা অপরিচিত কেই না, অষ্টম ধারা রোবট-কন্যা শেফ।
শেফ শান্তগলায় বলল, চমকে উঠলে কেন?
চিনতে পারছিলাম না।
চিনতে পারবে না কেন? আমি তো আগের মতোই আছি। শুধু চুলটা অন্যরকম করে আঁচড়েছি। চুল অন্যরকম করে আঁচড়ানোয় আমাকে ভাল দেখাচ্ছে না?
রেফ্ জবাব দিল না। কোন মানবী এই ধরনের কথা বললে জবাব দেবার ব্যাপারটা আসত। রোবটের এই প্রশ্নের জবাব দেয়া অর্থহীন। তাছাড়া চুল অন্য রকম করে আঁচড়ানোয় শেফকে মোটেই ভাল লাগছে না। বরং আগের চেয়ে খারাপ লাগছে।
ঘুম কেমন হয়েছে?
ভাল।
তুমি যতক্ষণ ঘুমিয়েছিলে আমি তোমার পাশেই ছিলাম। তোমার দিকে তাকিয়ে ছিলাম।
ভাল।
ঘুমের মধ্যে তুমি শেফাকে ডাকছিলে।
রেফ্ বিরক্ত গলায় বলল, এটা তো নতুন কিছু না। এটা আমার পুরনো রোগ। তুমি এই রোগের সঙ্গে পরিচিত। কিন্তু এ রকম ভাব করছ যেন তুমি প্রথম ব্যাপারটা দেখলে।
শেফ বলল, আজ প্রথম লক্ষ করলাম তুমি খুব আবেগ নিয়ে শেফাকে ডাকলে। ব্যাপারটা আমার খুব ভাল লেগেছে। কেন ভাল লেগেছে সেটাও বলি। আমার ধারণা শেফার সঙ্গে আমার কোন যোগসূত্র আছে। শেফাকে যদি তোমার ভাল লাগে তাহলে আমাকেও ভাল লাগবে।
কিছু মনে কোরো না। তোমাকে ভাল লাগছে না। এমরান টি যেমন রোবট পছন্দ করেন না। আমিও করি না।
শেফ বলল, আমার খুবই মন খারাপ লাগছে। তোমাকে কাটা কাটা কিছু কথা বলতে পারলে ভাল লাগত। তা বলব না, কারণ তোমার সঙ্গে আর হয়ত আমার দেখা হবে না।
রেফ্ হাই তুলল, তার ঘুম এখনো পুরোপুরি কাটে নি। দয়া করে আমার সামনে থেকে যাও। আমি আরো কিছুক্ষণ ঘুমুব।
শেফ বলল, তোমার সঙ্গে কেন দেখা হবে না, এটা জিজ্ঞেস কর?
রেফ্ বলল, কেন দেখা হবে না, আমি আন্দাজ করতে পারছি। তোমাকে এমরান টি জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। তুমি বড় ধরনের অপরাধ করেছ। তার বিচার হবে। তোমার কপোট্রন নষ্ট করা হবে।
এটা জেনেও তোমার খারাপ লাগছে না? মৃত্যুর মতো ভয়াবহ একটা ব্যাপার ঘটছে তাতেও তোমার কোন কিছুই যাচ্ছে-আসছে না?
রেফ্ বিরক্ত গলায় বলল, তোমার ক্ষেত্রে যা ঘটছে তাকে মৃত্যু বলা যায় না। মৃত্যু পুরোপুরি জৈবিক ব্যাপার। মেশিনের যেমন জন্ম বলে আলাদা কিছু নেই, তেমনই মৃত্যু বলেও কিছু নেই।
শেফ দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, আচ্ছা ঠিক আছে। আমাদের জন্ম-মৃত্যু না থাকলে কি আর করা যাবে। মাঝে মাঝে মনে হয় জন্ম-মৃত্যু থাকাটা খারাপ না। কেন এ ধরনের কথা মনে হয় বলব?
রে বলল, না। তুমি এখন দয়া করে চলে যাবে। যন্ত্রের সঙ্গে কথা চালাচালি করতে ভাল লাগছে না। আমি ঘুমুব।
এমরান টি আমার সঙ্গে যে-সব কথাবার্তা বলবেন তা কি তুমি শুনতে চাও? শুনতে চাইলে গোপনে ব্যবস্থা করে দিতে পারি।
শুনতে চাই না। আঁড়ি পেতে কথা শোনা আমার স্বভাবের মধ্যে নেই।
তাহলে বিদায়?
আচ্ছা বিদায়।
শুভ রাত্রি।
হ্যাঁ শুভ রাত্রি।
চলে যাচ্ছি কিন্তু।
যাও।
তুমি চাইলে তোমার মাথায় ইলিবিলি কেটে তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারি।
আমি চাচ্ছি না।
রেফ্ লক্ষ করল শেফ চলে যাচ্ছে কিন্তু বারবারই পেছন ফিরে তাকাচ্ছে। যেন চলে যেতে তার ভয়ংকর খারাপ লাগছে। তার চোখে পানিও দেখা গেল। নতুন ধারার এইসব রোবট মানুষের এত কাছাকাছি যে মাঝেমধ্যেই বুকে ধাক্কার মতো লাগে। মনে হয় এরা বোধহয় রোবট না, মানুষ।
এমরান টির সামনে শেফ বসে আছে। শেফের বাঁদিকে রেলা। এমরান টিকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি এক্ষুণি প্রশ্নপর্ব শুরু করবেন। তাঁর চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ভুরু কুঁচকে আছে। রেলা বলল, স্যার আমি কি চলে যাব?
এমরান টি বললেন, না তুমি থাকবে। আমি শেফকে কিছু প্রশ্ন করব, তুমি আমাকে সাহায্য করবে। তুমি নবম ধারার রোবট, তোমার বুদ্ধি নিশ্চয়ই শেফ এর চেয়ে বেশি।
রেলা ক্ষীণ স্বরে বলল, বুদ্ধির ব্যাপারটাই স্যার বিতর্কিত। বুদ্ধির নানান ধারা আছে। এখন পর্যন্ত একশ উনিশটি মূলধারা বের করা হয়েছে…
চুপ। আমাকে জ্ঞান দেবে না। আমি কোন কম্পিউটারের কাছ থেকে জ্ঞান ধার করব না।
শেফ বলল, বই পড়ে যদি আপনি জ্ঞান নিতে পারেন, কম্পিউটারের কাছ থেকে নিতে সমস্যা কোথায়?
এমরান টি বিরক্ত গলায় বললেন, তোমরা তো মনে হচ্ছে মহাজ্ঞানী। তোমরাই বল সমস্যা কোথায়?
রেলা বলল, স্যার কোন বিচিত্র কারণে আপনি একধরনের হীনমন্যতায় ভুগছেন। আপনার ভয় বুদ্ধির খেলায় আপনি কম্পিউটারের কাছে হেরে যাবেন। হয়ত এই কারণেই আপনি কম্পিউটার পছন্দ করেন না।
এমরান টি বললেন, যান্ত্রিক বুদ্ধি এবং মানসিক বুদ্ধির তফাতটার পরীক্ষা হয়ে যাক। আমি একটি বাক্য বলব। তোমরা দুজনই বাক্যটি নিয়ে চিন্তা করে বাক্যটি সম্পর্কে আমার মতামত দেবে। বাক্যটা হচ্ছে–
আমি এখন যা বললাম মিথ্যা বললাম।
শেফের ঠোঁটের কোনায় সামান্য হাসি দেখা গেল। সে হাসি মুছে ফেলে গম্ভীর হয়ে গেল। রেলার মুখের ভাবের কোন পরিবর্তন দেখা গেল না।
এমরান টি বললেন, শেফ এই বাক্যটি সম্পর্কে তোমার মতামত বল।
শেফ বলল, স্যার আপনি কিছু মনে করবেন না। এই হাস্যকর বাক্যটি দিয়ে প্রথম যুগের রোবটদের বিভ্রান্ত করা হত। প্রথম যুগের রোবট সাধারণ মানের কপোট্রন ব্রেইন ব্যবহার করত। সেই ব্রেইন ধরতে পারত না যে এই বাক্যটি নিম্নস্তরের বুদ্ধির মানুষদের একটা সাধারণ খেলা।
খেলাটা কি শুনি?
শেফ বলল, বাক্যটা হল আমি এখন যা বললাম, মিথ্যা বলছিলাম। অর্থাৎ আপনি এখন যা বললেন তা সত্য। কিন্তু তা তো হতে পারে না। কারণ আপনি এখন যা বলছেন তা মিথ্যা। সাধারণ মানের কপোট্রন বেইনে এই লজিকে একটা চক্রের মতো তৈরি হয়। সত্য বলা হচ্ছে, না মিথ্যা বলা হচ্ছে—এই চক্র থেকে তারা বের হতে পারে না।
তোমরা মহাজ্ঞানী কম্পিউটার, তোমাদের ভেতর চক্র তৈরি হয় না।
অতি বুদ্ধিমান কোন মানুষ হয়ত আমাদের ভেতরও চক্র তৈরি করতে পারবে। তবে এখনো কেউ পারে নি। স্যার আপনি রেগে যাচ্ছেন। রেগে গেলে ঠিকমত প্রশ্ন করতে পারবেন না। আপনারই ক্ষতি হবে। রাগ কমাবার চেষ্টা করুন। রাগ কমানোর ব্যাপারে আমি কিছু সাহায্য করতে পারি।
তোমাদের সাহায্য লাগবে না। আমি নিজেও রাগ কমাব, এখন আমাকে একটা প্রশ্নের উত্তর দাও। তোমরা কি মিথ্যা কথা বলতে পার?
রেলা বলল, হ্যাঁ পারি। বুদ্ধির সঙ্গে মিথ্যা জড়িত আছে। বুদ্ধির মূলধারার একটি হল মিথ্যা বলার ক্ষমতা। কম্পিউটারকে মানুষের কাছাকাছি আসতে হলে তাকে মিথ্যা বলা শিখতে হবে।
তোমার ধারণা যে-মানুষ সারাজীবনে একটা মিথ্যাও বলে নি তার বুদ্ধি নেই?
অবশ্যই আছে। তারা বিশেষ ধরনের মানুষ। আমাদের বিশেষ ধরনের মানুষ বানানোর চেষ্টা করা হয় নি। তবে স্যার নিতান্তই প্ৰয়োজন না হলে আমরা মিথ্যা বলি না। মানুষ তাৎক্ষণিক সমস্যা থেকে বাঁচার জন্যে মিথ্যা বলে। দূর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে না। আমরা করি।
শেফ, তুমি বল—তোমার দায়িত্ব ছিল রেকে আটকানো, তুমি তাকে যেতে দিলে কেন?
তাকে চলে যেতে দেবার পেছনে তিনটি কারণ আছে। প্রথম কারণ এই মানুষটির প্রতি আমার প্রচণ্ড মায়া তৈরি হয়েছে।
মায়া?
স্যার আপনি দয়া করে মনে রাখবেন যে আমাদের মানবিক আবেগসম্পন্ন করে তৈরি করা হয়েছে।
দ্বিতীয় কারণ কি?
দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে আমার কাছে মনে হয়েছে বিজ্ঞান কাউন্সিল ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর এমন সিদ্ধান্ত যার জন্যে পরে তারা খুবই…
শেফের কথা থামিয়ে এমরান টি বললেন, বিজ্ঞান কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত তাদের ব্যাপার, তোমার এখানে নাক গলাবার কিছুই নেই। এই দায়িত্ব তোমাকে দেয়া হয় নি। তোমাকে যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তুমি তা পালন কর নি। তাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করে।
হ্যাঁ তা করেছি।
কেন করেছ?
এই প্রশ্নের জবাব একটু আগেই দিয়েছি।
আরেকবার যখন প্রশ্ন করা হয়েছে, আরেকবার দাও।
এমরান টি রেলার দিকে তাকিয়ে বললেন, রেলা তোমার কি ধারণা শেফ সত্যি কথা বলছে। একটা কম্পিউটার যখন মিথ্যা কথা বলে তখন একজন কম্পিউটারের পক্ষেই সেই মিথ্যা কথাটা ধরা সম্ভব। আমার পক্ষে সম্ভব না।
রেলা বলল, আমার ধারণা সে সত্যি কথাই বলছে।
এমরান টি বললেন, শেফ তুমি যে শুধু তাকে চলে যেতেই দিয়েছ তা না, তুমি তাকে একটি ওমিক্রন গানও দিয়েছ। যা এখন আমার সঙ্গে লক করে দেয়া হয়েছে।
শেফ বলল, হ্যাঁ এই কাজটা আমি করেছি।
এমরান টি বললেন, ওমিক্রন গানের ব্যাপারটা তুমি এখন আমার কাছে ব্যাখ্যা করবে। আমি এই অস্ত্রটি সম্পর্কে তেমন কিছু জানি না। ভাসা ভাসা ভাবে জানি। অস্ত্র সম্পর্কে আমার কখনোই কোন আগ্রহ ছিল না।
শেফ বলল, ওমিক্রন গান প্রথমে শিশুতোষ খেলনা হিসেবে বাজারে আসে। এই খেলনা-পিস্তল দিয়ে কাউকে গুলি করা হলে–গুলিটা গায়ে লাগে। যার গায়ে লাগে সে অদৃশ্য সুতার মাধ্যমে খেলনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। এরপর থেকে সে যেখানে যায় সেখানকার স্থানাংক খেলনার মনিটরে উঠতে থাকে। সুতায় যুক্ত হয়ে যাওয়া মানুষটি কারো সঙ্গে কথা বললে সেই কথাও খেলনাপিস্তলের মাধ্যমে শোনা যায়। খেলনাটা শিশুদের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন তোলে। পরবর্তীতে এই খেলনাই রূপান্তরিত হয় ওমক্ৰিন গানে।
বর্তমান ওমিক্রন গান তিনটি ধাপ অতিক্রম করে চতুর্থ ধাপে আছে। আপনাকে যে ওমিক্রন গান দিয়ে লক করা হয়েছে এটি চতুর্থ ধাপের অস্ত্ৰ।
এর বিশেষত্ব কি?
বিশেষত্বটা না জানাই আপনার জন্যে মঙ্গলজনক হবে।
আমার মঙ্গল নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি এর বিশেষত্ব বল।
একটি সাধারণ ওমিক্রন গানে যা আছে, এটিতে তার সবই আছে। এর বাইরে যা আছে তা হল—এই ওমিক্রন লকার যার সঙ্গে লক হয় তার অনুভূতি এবং মানসিকতা খুব ধীরে ধীরে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। খুব দীর্ঘ সময় লক অবস্থায় থাকলে যিনি লক হবেন তিনি লকারের মানসিকতা পরিষ্কার বুঝতে পারবেন।
এমরান টি কড়া গলায় বললেন, পরিষ্কার করে বল। তুমি সবই এলোমেলো করে ফেলছ।
শেফ বলল, উদাহরণ দিয়ে পরিষ্কার করি। যেমন ধরুন আপনি। রেফ আপনাকে লক করেছে। যদি আপনাকে এর থেকে মুক্ত না করা হয় তাহলে যতই দিন যাবে এই বন্ধন ততই কঠিন হতে থাকবে। একটা সময় আসবে যখন রেফ্ যা ভাবছে আপনি তা বুঝতে পারবেন। রেফ্ যে দুঃসহ স্মৃতিগুলি দেখছে। আপনি তা দেখতে শুরু করবেন।
বল কি?
আপনি কি ভাবছেন তা রেফ্ জানবে না। কিন্তু রেফ্ যা ভাবছে আপনি তা জানবেন।
সর্বনাশ!
সর্বনাশ তো বটেই।
আপনি তখনি ঘুমুতে যাবেন যখন রেফের ঘুম পাবে। রেফ্ যখন জেগে উঠবে আপনারও তখনি জেগে উঠতে হবে। রেফ যখন আনন্দিত হবে, তখন আপনিও আনন্দিত হবেন।
এমরান টি হতভম্ব হয়ে গেছেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে দাবার খেলায় খুব সহজ একটা চালে তিনি হেরে গেছেন। বোর্ডে রাজাকে শুইয়ে দেয়া ছাড়া এখন তার আর কিছু করার নেই।
তাঁর সামনে দুটা রোবট। এই রোবট দুটিকে এখন আর রোবট মন হচ্ছে না। মনে হচ্ছে এরা মানুষ। এবং এরা এমরান টির অবস্থা দেখে খুব মজা পাচ্ছে। নিজেদের মধ্যে আড়ে-আড়ে তাকাচ্ছে এবং হাসাহাসি করছে।
রেফের দুঃস্বপ্নগুলি এখন আমি দেখতে শুরু করব?
রেলা বলল, শুধু যে দুঃস্বপ্নগুলি দেখবেন তা না, সুখস্বপ্নগুলিও দেখবেন।
সেটা শুরু হবে কখন থেকে?
শেফ বলল, আমার ধারণা শুরু হয়ে গেছে।
এমন ধারণা হল কেন?
রেফ্ আজ যতক্ষণ ঘুমিয়েছে আপনিও ঠিক ততক্ষণ ঘুমিয়েছেন।
ও!
আমার ধারণা আপনি ঘুমের মধ্যে বিচিত্র কিছু স্বপ্ন দেখেছেন। কি স্বপ্ন দেখেছেন একটু মনে করার চেষ্টা করুন।
আমি তার প্রয়োজন দেখছি না।
রেফের দুঃস্বপ্ন কখন দেখতে শুরু করবেন জানতে চেয়েছিলেন, এই জন্যেই জিজ্ঞাস করা। আপনি যদি বিচিত্র স্বপ্ন দেখে থাকেন তাহলেই ধরে নিতে হবে লকার কাজ করা শুরু করেছে।
এমরান টি ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেললেন। হ্যাঁ বিচিত্ৰ অর্থহীন স্বপ্ন তিনি দেখেছেন। স্বপ্নটা খুব স্পষ্ট না, আবার অস্পষ্টও না। স্বপ্নে খুব ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছিল। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। তিনি লম্বাটে ধরনের বিচিত্র জলযানে শুয়েছিলেন। জলযানটি খুব দুলছিল। খুবই ক্ষুধার্ত বোধ করছিলেন। তাঁর জন্যে খাবার নিয়ে একটা মেয়ে ঢুকল। মেয়েটা প্রচুর কথা বলে। নানার ধরনের কথা। সে হাতে বিচিত্র গোলাকার কিছু অলংকার পরেছিল। হাত নেড়ে নেড়ে মেয়েটা যখনই কথা বলেছে তখনি হাতের অলংকার থেকে বাজনার মতো শব্দ হচ্ছিল। বিনরিন, টিনটিন ধরনের শব্দ। মেয়েটির গায়ের পোশকও খুব অদ্ভুত। লম্বা একপ্রস্ত কাপড় দিয়ে শরীর ঢাকা।
এমরান টি বললেন, স্বপ্নে আমি অদ্ভুত একপ্রস্থ পোশাকে একটা মেয়েকে দেখলাম। মেয়েটা কে?
শেফ নরম গলায় বলল, স্যার মেয়েটা আপনার প্রেমিকা। তার নাম শেফা। আমার নামের সঙ্গে তার নামের মিল আছে।
মেয়েটা আমার প্রেমিকা মানে?
মেয়েটা রেফ্কে অসম্ভব ভালবাসে। এখন রেফকে ভালবাসা মানেই আপনাকে ভালবাসা। এই অর্থে বলেছি সে আপনার প্রেমিকা। সমান্য মজা করলাম। আশা করি অপরাধ নেবেন না।
এমরান টি উঠে দাঁড়ালেন। তিনি লাইব্রেরি-ঘরের দিকে যাচ্ছেন। হঠাৎ করেই তাঁর কাগজ-কলম নিয়ে কিছু লিখতে ইচ্ছা করছে। তার মানে কি এই যে, রেফ্ নামের ছেলেটিরও কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে? তার নিজের চিন্তা ভাবনা কি এখন আর আলাদা করে কিছু নেই। তিনি কি ক্ৰমে ক্ৰমে রোবটে পরিণত হচ্ছেন। যে রোবট তিনি সারা জীবন ঘৃণা করে এসেছেন সেই রোবট?
রেলা। রেলা।
রেলা এসে তাঁর সামনে দাঁড়াল। এমরান টি বললেন, লেখালেখি করব। কাগজ-কলম দাও।
স্যার আপনার লেখার টেবিলে কাগজ-কলম সবই দেয়া আছে।
থ্যাংক য়্যু।
রেফ্ নামের ছেলেটা কি করছে বলতে পার?
অবশ্যই পারি স্যার। উনি দ্রুত কি যেন লিখছেন।
আচ্ছা ঠিক আছে।
আজ বিকেল তিনটায় সায়েন্স কাউন্সিলের অধিবেশন আছে। অধিবেশনের বিষয় হয়…।
বিষয় জানতে চাচ্ছি না। কারণ অধিবেশনে আমি যাচ্ছি না।
আপনার যাওয়া খুব প্রয়োজন। কারণ এই অধিবেশনে রেফ্ সম্পর্কে কথাবার্তা হবে।
হোক কথাবার্তা আমি যাব না।
এমরান টি লেখার টেবিলে বসে প্রথম বাক্যটি লিখলেন—আমার নাম…বাক্যটা তিনি শেষ করলেন না। কারণ তাঁর লিখতে ইচ্ছা হচ্ছে আমার নাম রে। তিনি জানেন তাঁর নাম রেফ্ না। তাঁর অন্য একজনের নাম লিখতে ইচ্ছা করছে। কি ভয়ংকর কথা।
রেফ লাইব্রেরি-ঘরের মেঝেতে বসে আছে। তার সামনে টেবিল। সে দ্রুত লিখে যাচ্ছে।
আমার নাম রেফ্।
কিংবা আমার নাম রফিক।
কিংবা আমিই রেফ্ এবং আমিই রফিক।
আমাকে ঘিরে কি হচ্ছে আমি নিজে তা জানি না। নিজেকে জানতে হলে নিজের অতীত জানতে হয়। আমার কাছে মনে হচ্ছে আমার কোন অতীত নেই। আমার সবটাই বর্তমান। রেফ হিসেবে আমার স্মৃতি হচ্ছে সেনোটারিয়ামের স্মৃতি। এর আগে আমি কোথায় থাকতাম কি করতাম কিছুই জানি না। শুধু আমাকে বলা হয়েছে—আমি একজন প্রবলেম সলভার। আমি কোন্ ধরনের প্রবলেম সলভ করতাম, তা জানি না। সেই স্মৃতি ইচ্ছা করে নষ্ট করা হয়েছে। আমি শুধু গত চার বছরের কথা জানি।
মজার ব্যাপার হচ্ছে রফিক হিসেবেও আমার স্মৃতি এই চার বছরের। চার বছর আগে কি করতাম আমি জানি না। ভাসা-ভাসা ভাবে জানি আমি মানুষ হয়েছি এতিমখানায়।
কেউ আমাকে দিয়ে কিছু করাচ্ছে। সেই কেউটা কে আমি জানি না। আমাকে দিয়ে কি করতে চাচ্ছে তাও জানি না। দুরকমের জীবনযাপন করতে করতে আমি কিছুটা ক্লান্ত বোধ করছি। সবকিছু এলোমেলো লাগছে। কোন একটা ব্যাখ্যা, সেই ব্যাখ্যা যত হাস্যকরই হোক আমার জন্যে দরকার। আমি অসুস্থ এই ব্যাখ্যা আমি একসময় মেনে নিয়েছিলাম। তখন জীবনযাত্রা সহজ ছিল। এখন মনে হচ্ছে ঐ ব্যাখ্যায় কিন্তু আছে। তারপরেও আমি সেই ব্যাখ্যা মেনে নেবার জন্যে মানসিকভাবে প্রস্তুত আমি। এই অনিশ্চয়তা আমার কাছে অসহনীয় মনে হচ্ছে।
সবচে জটিল সমস্যার সমাধান সাধারণত সবচে সহজ হয়ে থাকে। ম্যাজিকে যে ম্যাজিকটা যত কঠিন তার কৌশলটা তত সহজ। পদার্থবিদ্যার সূত্রগুলিও এ রকম। পদার্থের জটিল সব ধর্মের ব্যাখ্যা খুবই সহজ।
থার্মোডেনমিক্সের দ্বিতীয় সূত্রটির ধরা যাক মহাবিশ্বের বিশৃঙ্খলা বাড়ছে। মাত্র একটি বাক্যে কত জটিল বিষয়ই-না ব্যাখ্যা করা হল।
আমার ধারণা আমার নিজের ব্যাপারটাও এ রকম। এক লাইনে সব ব্যাখ্যা করা হয়ে যাবে। সেই লাইনটি কেউ কি আমাকে বলে দেবে?
শেফা মেয়েটিকে দেখতে ইচ্ছা করছে। শেফা বলে কি কেউ আছে? হয়ত কেউ নেই। সবই মায়া। অবশ্যি পদার্থবিদ্যার সূত্রে সবই মায়া। পদার্থের ক্ষুদ্রতম অংশ পরমাণু। পরামাণু ভাঙলে পাওয়া যাচ্ছে ইলেকট্রন, ট্ৰেন, নিউট্রন। আরো ভাঙা হল এখন পাচ্ছি ল্যাপটনস। আরো ভাঙলাম এখন পাওয়া গেল কোয়ার্ক, আপ কোয়ার্ক, ডাউন কোয়ার্ক। চার্ম…এদের ওজন নেই। অস্তিত্ব আছে আর কিছু নেই।
সব রহস্যের সমাধান আছে। একদিন সব রহস্য জানা হয়ে যাবে। সেই একদিনটা কবে? সুদূর ভবিষ্যতে? পদার্থবিদ্যায় সুদূর ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই। সবই ঘটে আছে। মহাবিশ্ব সৃষ্টি এবং লয় সবই ঘটে গেছে। অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ সবই শক্ত বাঁধনে বাঁধা।
রেফ্!
রেফ্ লেখা বন্ধ করল। চারদিকে তাকাল। কেউ আশেপাশে নেই। আগের ব্যাপারটা আবার ঘটছে। কেউ কথা বলছে মাথার ভেতর। ওমেগা পয়েন্টের লোকজন।
রেফ্ শুনতে পাচ্ছ?
রে শীতল গলায় বলল, পাচ্ছি। তোমরা কি ওমেগা পয়েন্টের?
হ্যাঁ। আমরা খুবই আনন্দিত।
তোমাদের আনন্দের কারণ ঘটাতে পেরেছি জেনে ভাল লাগছে। যদিও বুঝতে পারছি না, এমন কি ঘটছে যে তোমরা আনন্দিত।
আমরা আনন্দিত কারণ মোটামুটি নিশ্চিন্তে আমরা আমাদের পরীক্ষা শেষ করতে পারছি।
পরীক্ষা সফল হয়েছে?
এখনো বলা যাচ্ছে না। তবে সফল হবার সম্ভাবনা আছে।
সফল না হলে কি এই পরীক্ষা আবারো করা হবে?
অবশ্যই।
গিনিপিগটা কে, আবারো আমি?
না তুমি না।
তোমাদের গিনিপিগের অভাব নেই, তাই না?
না, আমাদের গিনিপিগের অভাব নেই।
তোমরা কে, এবং আমি কে, তা কি জানতে পারি?
খুবই আদি প্রশ্ন করলে। সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ এই প্রশ্ন করছে। জানতে চাচ্ছে সে কে? সে কোথা থেকে এসেছে? সে কোথায় যাচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তর জানার অর্থ সবই জেনে ফেলা।
তার মানে কি এই যে আমি এই প্রশ্নের উত্তর জানব না?
পরীক্ষা সফল হলে তুমি আপনাতেই প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে। পরীক্ষা সফল না হলে জানতে পারবে না।
রেফের মাথায় সামান্য যন্ত্রণা হচ্ছে। যে মাথার ভেতর বসে কথা বলছিল সে এখন আর নেই। নাকি এখানো আছে। রেফ শান্ত গলায় বলল—তুমি কি এখনো আছ?
কোন উত্তর পাওয়া গেল না।
রেলা এমরান টির ঘরে ঢুকে অস্পষ্ট শব্দ করল। এমরান টি বললেন, কে?
স্যার আমি রেলা।
এমরান টি বললেন, রেলা আমি খুব ব্যস্ত আছি। আমি লিখছি। খুব জরুরি কিছু না হলে আমাকে বিরক্ত করা যাবে না।
খুবই জরুরি। কেন জরুরি ব্যাখ্যা করছি স্যার। তার আগে বলুন আপনি কি অসুস্থ? আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি খুবই অসুস্থ। আপনার চোখ টকটকে লাল। এবং আপনি ঘামছেন।
আমাকে বিরক্ত না করে লিখতে দাও। এই মুহূর্তে আমার কাছে লেখাটাই জরুরি আর কিছু জরুরি না।
বিজ্ঞান কাউন্সিলের অধিবেশন শেষ হয়েছে।
এটা কোন জরুরি ব্যাপার না। যেটা শুরু হয়েছে সেটা শেষ হবেই।
বিজ্ঞান কাউন্সিলে রেফের ব্যাপারটি আলোচনা করা হয়েছে।
এটাও কোন অস্বাভাবিক কিছু না। জরুরি তো নয়ই। রেফে ব্যাপারে আলোচনা হবে বলেই অধিবেশন ডাকা হয়েছে।
অধিবেশনের সিদ্ধান্তটা আপনাকে জানাতে চাচ্ছি স্যার।
জানাতেই হবে?
হ্যাঁ জানাতে হবে। বিজ্ঞান কাউন্সিলের গুপ্তচর বাহিনী-প্রধান রিপোর্ট করেছেন যে রেফকে পাওয়া গেছে এবং সে আছে বিজ্ঞান কাউন্সিলের প্রধানের বাসভবনে।
ও আচ্ছা। তারা এখন জানে?
জ্বি জানে।
ভাল কথা।
বিজ্ঞান কাউন্সিল একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কি সিদ্ধান্ত তা আমি জানি না। কারণ সিদ্ধান্তটা গোপনীয়।
তোমার যা বলার ছিল বলা হয়েছে?
জ্বি।
তাহলে এখন বিদেয় হও। আমি লিখছি আমাকে লিখতে দাও।
বিজ্ঞান কাউন্সিলের সাধারণ অধিবেশনের প্রতিবেদন।
এই প্রতিবেদনকে কাউন্সিলের বিশেষ ক্ষমতায় (ধারা ১০১/২১) পরম গোপনীয় ঘোষণা করা হল।
প্রতিবেদন নথিভুক্ত হবে না, প্রতিবেদনের কোন অংশ নিয়ে আলোচনাও
করা যাবে না।
বিষয় : রেফ্
সিদ্ধান্ত ১: চরম দণ্ড কার্যকর করা হবে।
সিদ্ধান্ত ২: চরম দণ্ড কার্যকর করার পরপরই রেফ্ বিষয়ের সমস্ত ফাইল নষ্ট করে দেয়া হবে।