০৮. ঘুম থেকে জেগে উঠে

ঘুম থেকে জেগে উঠে ঝা দেখল তার পাশে একজন অপরিচিত মানুষ শুয়ে আছে। ঝা ভাল করে তাকাল এবং হঠাৎ করে বুঝতে পারল মানুষটি টুকি, কেউ একজন তার বিশাল গোঁফ জোড়া নিখুঁত ভাবে চেছে দিয়েছে বলে চিনতে পারছিল না। ঝা ধরমর করে উঠে বসল, হঠাৎ করে তার সবকিছু মনে পড়ে গেছে।

তারা ছোট একটা পাথরের ঘরে শুয়ে আছে, বুক পর্যন্ত কম্বল দিয়ে ঢাকা। ঝ কম্বল ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে উঠে বসে টুকিকে একটা ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে তোলার চেষ্টা করল। টুকি বিড় বিড় করে কিছু একটা বলে পাশ ফিরে ঘুমানোর চেষ্টা করছিল কিন্তু ঝা আবার তাকে ধরে একটা ঝাকুনী দিল। এবারে টুকি চোখ খুলে তাকিয়ে বলল, কে? কী হয়েছে?

আমি।

টুকি চোখ বড় বড় করে বলল, ঝা? তোমার একি অবস্থা? চুল কোথায় তোমার?

ঝা মাথায় হাত দিয়ে দেখল তার মাথা কেউ পারিষ্কার করে কামিয়ে দিয়েছে। টুকি দাঁত বের করে হেসে বল, তোমাকে পুরোপুরি গবেটের মত দেখাচ্ছে, মাথাটা কামিয়েছ কেন?

আমি কামাই নি। তোমার গোঁফ যে কামিয়েছে আমার মাথাও সে কামিয়েছে।

গোঁফ? আমার গোঁফ? টুকি লাফিয়ে উঠে বসে নাকের নিচে হাত দিয়ে হঠাৎ করে একবারে ঠাণ্ডা মেরে গেল। এই জগতে তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস ছিল তার গোঁফ।

ঝা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, এখান থেকে পালানোর সময় হয়েছে।

টুকি নির্জীব গলায় বলল, কিন্তু আমার গোঁফ?

গোঁফ নিয়ে পরে চিন্তা কর। এখন উঠ। জেট প্যাক আর লেজার প্যাক খুঁজে বের কর।

টুকি মনমরা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে নিজেদের জিনিসপত্র খোঁজাখুঁজি করতে লাগলো। তাদের ঘুমের মাঝে কেউ একজন পোশাক পাল্টিয়ে ঢলঢলে আলখাল্লার মত কিছু একটা পরিয়ে গেছে, কাপড় জামাগুলোও এ ঘরে নেই।

ঘরের মাঝে শব্দ শুনে খুট করে দরজা খুলে গেল, টাইরার স্বামী উঁকি দিয়ে বলল, তোমরা উঠে গেছ?

টুকি কোন কথা না বলে চোখ পাকিয়ে তাকাল, তার দৃষ্টিকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে মানুষটি বলল, তোমাদের জন্যে ভাল খবর আছে।

আমার ভাল খবরের দরকার নেই। টুকি মেঘ গলায় বলল, আমাদের জামাকাপড় জেট প্যক লেজার গান কোথায়? এক্ষুণি নিয়ে আস।

তোমাদের জামা কাপড় ধুয়ে দিয়েছি, যা নোংরা হয়েছিল।

জেট প্যাক আর লেজার গান?

ওই বিদঘুটে যন্ত্রগুলো? ওগুলো কী পুরুষ মানুষকে মানায়? সব ফেলে দিয়েছি?

ঝা গর্জন করে বলল, ফেলে দিয়েছ?

হ্যাঁ! মানুষটা মুখে হাসি ফুটয়ে বলল, তোমাদের ভাল খবর কী শুনবে?

না। টুকি ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলল, ভাল খবরের কোন দরকার নেই। আমার গোঁফ কেন কেটেছ?

সেটাই তো বলতে যাচ্ছিলাম। তোমাদের বিয়ে ঠিক করেছি।

বিয়ে ঠিক করেছ?

হ্যাঁ! তোমরা যখন ঘুমাচ্ছিলে তখন তোমাদের দেখে পছন্দ করে গেছে। তবে তোমাদের মুখে নাকি বেশি চুল। তাই কেটে কিছু কামিয়ে দিয়েছি।

টুকি দাতে কিড়মিড় করে বলল, তাই কেটে কমিয়ে দিয়েছ!

তোমাদের কারা পছন্দ করল শুনবে না?

টুকি রাগে ফেটে পড়ে বলল, না, আমার শোনার কোন দরকার নেই।

ঝা নিচু গলায় বলল, একটু শুনে দেখলে হয় না?

টুকি চোখ লাল করে ঝায়ের দিকে তাকাল এবং সেই দৃষ্টির সামনে ঝা কেমন জান মেইয়ে গেল।

টাইরার স্বামী মুখে হাসি ধরে রেখে বলল, তোমাদের কোন আপনজন নেই, অভিভাবক নেই, ভারী ভাবনা হয় আমার। সে জন্যেই তো খুঁজে পেতে দুজন মেয়ে বের করেছি। ঠিক মেয়ে নয় মহিলাই বলা উচিত। মধ্য বয়স্কা মহিলা—খুব শক্ত ধরনের।

টুকি আবার গর্জন করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ঠিক তখন বাইরে নারী কণ্ঠ শোনা গেল। টাইরার স্বামীর চোখ মুখ হঠাৎ আনন্দে ঝলমল করে উঠে, সে মধুর ভঙ্গীতে হেসে বলল, আমার স্ত্রী তোমাদের যাদের সাথে বিয়ে হবে তাদের তাদের নিয়ে এসেছে। বিয়ের আগে একটু পরিচয় হওয়া ভাল। তোমরা চাদর দিয়ে শরীর ঢেকে নেবে?

টুকি এবং ঝা চাদর দিয়ে শরীর ঢেকে নেবার কোন আগ্রহ না দেখিয়ে টাইরার স্বামীকে একরকম ঠেলে ঘর থেকে বের হয়ে এল। বাইরে দুজন মধ্যবয়স্কা মহিলা টাইরার পিছনে দাঁড়িয়েছিল, তাদের চুল ছোট করে ছাঁটা, ক্রুর দৃষ্টি এবং মুখে সৈনিক সুলভ কাঠিন্য। টুকি এবং ঝাকে দেখে দুজনে কেমন যেন আঁৎকে উঠে। টুকি কঠোর গলায় বলল, এখানে এসব কী হচ্ছে? আমাদের জিনিসপত্র কোথায়? কে তোমাদের আমাদের চুল দাড়ি গোঁফে হাত দিতে বলেছে? কত বড় সাহস আমাদের খাবারে ঘুমের ওষুধ দিয়েছ?

টাইরা অবাক হয়ে বলল, ছিঃ ছিঃ! পুরুষ মানুষ এভাবে কথা বলে কখনো?

টুকি দাঁত কিড়মিড় করে বলল, এখন তো শুধু কথা বলছি, যখন রদ্দা লাগানো শুরু করব, তখন বুঝবে মজা

টাইরা বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়েছিল। মধ্যবয়স্কা একজন মহিলা তার কঠিন মুখে কুটিল একটা হাসি ফুটিয়ে বলল, এক সপ্তাহের মাঝে আমি ওকে সিধে করে দেব। শুধু বিয়েটা হয়ে নিক।

ঝা টুকির হাত ধরে বলল, এখানে চেচামেচি করে লাভ নেই। চল আমরা যাই।

টাইরা জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবে?

যেখান থেকে এসেছি সেখানে যাব।

এখন বাইরে যেয়ো না। আধপাগলা একটা রবোট ঘুরে বেড়াচ্ছে, কোথা থেকে এসেছে কে জানে, সবাইকে সমানে গালিগালাজ করে যাচ্ছে।

রোবি!

তোমরা চেনো সেটাকে?

চিনি। কোন্ দিকে গেছে?

উত্তরে-পাহাড়ের দিকে।

টুকি ঝায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, চল ঝা।

কেউ কিছু বলার আগে টুকি এবং ঝা ঘর থেকে বের হয়ে এল। তাদের পিছু পিছু মধ্যবয়স্কা মহিলা দুজন বের হয়ে বলল, সে কী! কোথায় যাচ্ছ তোমরা? তোমাদের জন্যে কত যৌতুক দিয়েছি জান?

টুকি ঝাকে বলল, পা চালিয়ে চল।

দেখা গেলে মহিলা দুজন এত সহজে তাদের যৌতুক দেওয়া স্বামীদের ছেড়ে দিতে রাজী না। তারা পিছু পিছু ছুটতে লাগলো। ঝা পিছনে তাকিয়ে বলল, দৌড়াও।

টুকি এবং ঝা পাহাড়ের দিকে ছুটতে লাগল পিছু পিছু ধাওয়া করে এল দুজন কঠিন চেহারার মহিলা, তাদের পিছু পিছু মজা দেখার জন্যে আরো অসংখ্য শিশু, কিশোরী, তরুণী, মধ্যবয়স্কা মহিলা এবং বৃদ্ধা। পিছন থেকে একটা দুইটা ঢিল এসে পড়ল তাদের গায়ে, টুকি এবং ঝা তখন উধ্বশ্বাসে ছুটতে শুরু করে। চুরি করাকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ার জন্যে তাদের শরীরের যত্ন নিতে হয়, দৌড়াদৌড়ি, ছোটাছুটিতে দুজনেই দক্ষ। কাজেই প্রাণপণে ছুটে সবার নাগালের বাইরে চলে যাওয়া তাদের জন্যে খুব কঠিন হল না। লাল রংয়ের পাহাড়টায় উঠেই তারা তাদের মহাকাশযানটাকে দেখতে পায়, বাইরে রোবি দাঁড়িয়েছিল, টুকি এবং ঝাকে কষে বকুনী দিতে যাচ্ছিল কিন্তু পিছনে বিশাল মহিলা বাহিনী দেখে সে সুড় সুড় করে মহাকাশযানের ভিতরে ঢুকে গেল। ছুটতে ছুটতে এসে টুকি আর ঝাও খোলা দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ে শক্ত করে দরজাটা বন্ধ করে দেয়। কিছুক্ষণেই মহিলা বাহিনী এসে মহাকাশযানটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ইটপাটকেল ছুড়তে শুরু করে।

টুকি গলা উঁচিয়ে বলল, রোবি, মহাকাশযানটা উড়িয়ে নিয়ে চল।

রোবি বলল, ঠিক আছে, যাচ্ছি। এক সেকেন্ড অপেক্ষা করে বলল, কিন্তু ভেবো না তোমাদের কাজকর্মের কথা আমি ভুলে গেছি–মহাকাশে নিয়ে গিয়ে তোমাদের বোঝাচ্ছি মজা।

প্রচণ্ড গর্জন করে যখন মহাকাশযানটা উপরে উঠতে থাকে ঝা তখন জানালা দিয়ে নিচে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ভাবী স্ত্রীকে ফেলে রাখার দুঃখে নাকি একটু পরেই রোবি তাদের যে শাস্তি দেবে সেই ভয়ে সেটা ঠিক বোঝা গেল না।