খাবার টেবিলে শামীম জিজ্ঞেস করল, “কী ব্যাপার সেরিনা? তুই আজকে এতো চুপচাপ কেন?”
“না। আব্বু এমনি।” সেরিনা একবার ভাবল আব্বুকে সব কিছু খুলে বলে, কিন্তু আব্বুর মুখ দেখে তার মায়া হল। ব্যাপারটা শোনা মাত্রই আব্বু এমন দুশ্চিন্তায় পড়ে যাবেন যে চিন্তা করেই সেরিনার মন খারাপ হয়ে গেল। স্কুলের তিন বন্ধুর কাছে ব্যাপারটা বলে মনটা একটু হালকা হয়েছে, আগে তাদের সাথে পরামর্শ করে দরকার হলে অন্যদের বলা যাবে। আর সত্যি সত্যি একজন মানুষকে কিডন্যাপ করা এতো সোজা না কী?
শামীম জিজ্ঞেস করল, “স্কুলের লেখাপড়ার কী খবর?”
“ভালো আব্বু। কিন্তু লেখাপড়া খুব বেশী।”
“আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন লেখাপড়ার চাপ এতো বেশী ছিল। তোদের মনে হয় চাপ খুব বেশী।”
“সেই জন্যেই তো লেখাপড়ার ইচ্ছে করে না।”
“লেখাপড়া না করে করবি কী?”
সেরিনা হাসি হাসি মুখ করে বলল, “পানির নিচে নিচে ঘুরে বেড়াব।”
“একা একা?”
“তুমিও থাকবে।”
“আমি? আমি কীভাবে তোর সাথে পানির নিচে থাকব?”
“তুমি থাকবে একটা নৌকায়। উপরে, আমি পানির নিচে ঘুরে ঘুরে তোমার জন্যে আজব আজব ফলমূল মাছ, শামুক ঝিনুক এই সব নিয়ে আসব।”
শামীম একটু অবাক দৃষ্টিতে সেরিনার দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটা আজকাল মাঝে মাঝেই বলে যে তার পানির নিচে নিচে ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছে করে। একবার সত্যি সত্যি তাকে নিয়ে কোনো একটা সমুদ্রে গেলে হয়। ঠিক কী কারণ জানা নেই বিষয়টা চিন্তা করেই শামীমের বুকের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এল।
.
রাতে সেরিনার ঘুম আসছিল না। ভেতরে একটা চাপা দুশ্চিন্তা, বিছানায় অনেকক্ষণ শুয়ে এপাশ ওপাশ করেছে। আব্বু খাবার টেবিলে বসে তার লেখাপড়া করছেন। বাইরে ঝি ঝি ডাকছে, মাঝে মাঝে হঠাৎ একটা মাছ পুকুরে ঘাই মারে–বিছানায় শুয়ে সেরিনা অনুমান করতে পারে ঠিক কোন মাছটা ঘাই মেরেছে।
শেষ পর্যন্ত সে ঘুমিয়ে পড়ল। গভীর রাতে হঠাৎ তার ঘুম ভেঙ্গে যায়, ঘুম ভাঙ্গার পর সেরিনার অনেকক্ষণ ঘুম ঘুম ভাব থাকে কিন্তু এখন কী হল কে জানে সেরিনা পুরোপুরি জেগে গেল। ঘরের ভেতর আবছা অন্ধকার, হঠাৎ করে সেরিনার মনে হল সেই অন্ধকারে কয়েকটা ছায়ামূর্তি নিঃশব্দে নড়াচড়া করছে। আতংকে একটা চিৎকার দিতে গিয়ে সেরিনা থেমে গেল। সেরিনা বিছানায় কাঠ হয়ে শুয়ে কী হয় দেখার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে।
সেরিনা দেখল একটা ছায়ামূর্তি তার বিছানার কাছে এগিয়ে আসছে, মশারিটা তুলে হঠাৎ করে তার একটা ফ্ল্যাশ লাইটের আলো মুহূর্তের জন্যে তার চোখ ধাধিয়ে দেয়। আলোটা সাথে সাথে নিভে গেল, কেউ একজন বলল, “পেয়েছি।”
সেরিনা টের পেল, পাথরের মতো একটা হাত খপ করে তার মুখ। চেপে ধরে বলল, “একটা শব্দ করেছ তো গুলি করে ঘিলু বের করে দেব।”
সেরিনা তার কপালে শীতল একটা ধাতব নলের স্পর্শ পেল। নিশ্চয়ই রিভলবার। ভয়ংকর আতংকে সেরিনার সারা শরীর শীতল হয়ে যায়। ঠিক করে সে চিন্তাও করতে পারে না।
অন্ধকার ঘরের ভেতর থেকে ভারী একটা গলা বলল, “বাপটাকে নিউট্রলাইজ কর। মনে রেখো নো ব্লাড শেড।”
সেরিনা দেখল তার ঘর থেকে কয়েকটা ছায়ামূর্তি বের হয়ে গেল এবং কয়েক সেকেন্ড পরেই সে তার আব্বুর গলার স্বর শুনতে পায়, একটা ধস্তাধস্তির শব্দ হয় এবং একজন মানুষ যন্ত্রণার মতো একটা শব্দ করল। সেরিনা শুনল পাশের ঘরে কেউ একজন চাপা গলায় বলছে “খবরদার কোনো শব্দ করবে না। একটা শব্দ করলে তোমার মেয়ের মগজ ফুটো করে ফেলব।” তখন হঠাৎ করে ধস্তাধস্তির শব্দ কমে গেল। সেরিনা শুনল তার আব্বু জিজ্ঞেস করছে, “তোমরা কারা? কী চাও?”
কেউ কোনো উত্তর দিল না? শুধু একটা চাপা হাসির শব্দ শোনা গেল।
ঠিক তখন কেউ একজন হাতের টর্চ লাইট জ্বালালো, সেরিনার ঘরটা মোটামুটি আলোকিত হয়ে যায়। সেরিনা দেখল তার ঘরের মাঝখানে একজন দাঁড়িয়ে আছে। দুজন মানুষ তার আব্বুকে দুই পাশ থেকে ধরে রেখে টেনে টেনে আনছে।
শামীম হাহাকারের মতো শব্দ করে জিজ্ঞেস করল, “সেরিনা! মা, তুই ঠিক আছিস?”
সেরিনার মুখ চেপে ধরে রেখেছে বলে সে ঠিক করে কথা বলতে পারল না, অস্পষ্ট একটা শব্দ করল। শামীম ছুটে আসতে চাচ্ছিল কিন্তু মানুষ দুইটা তাকে আসতে দিল না, শক্ত করে ধরে রাখল। শামীম আবার জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কারা? কী চাও?”
ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা শামীমের মুখে টর্চ লাইটের আলো ফেলে বলল, “আমরা তোমার সহযোগিতা চাই।”
কথাটা এমনভাবে বলল যে শুনে ঘরের সবাই হেসে উঠল যেন খুব মজার একটা কথা বলেছে!
শামীম জিজ্ঞেস করল, “কী সহযোগিতা?”
“আমরা তোমার মেয়েকে নিয়ে যেতে এসেছি। তুমি সেই ব্যাপারে সহযোগিতা কর। একটা শব্দ না করে এই চেয়ারটাতে বস। আমরা তোমাকে বেঁধে রেখে যেতে চাই।”
শামীম প্রায় হাহাকারের মতো শব্দ করে বলল, “কেন? তোমরা কেন আমার মেয়েকে নিতে চাও?”
মানুষটা বলল, “আমরা ছোট মানুষ, বড় ব্যাপার জানি না। শুধু টের পেয়েছি এটা ইন্টারন্যাশনাল প্রজেক্ট। তোমার মেয়ে ছোট হলেও খুব গুরুত্বপূর্ণ। তার প্রতি তোলা রক্ত নাকি মিলিওন ডলারে বিক্রি হবে!”
একজন বলল, “শুনে মনে হচ্ছে আমরাও কয়েক তোলা রক্ত রেখে দিই।”
ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা বলল, “খবরদার। ঠাট্টা করেও এরকম কথা বলবে না। কড়া নির্দেশ এই মেয়ের যেন কোনো ক্ষতি হয়।”
যে মানুষটা সেরিনাকে ধরে রেখেছিল সে এবারে তাকে ধরে বিছানা থেকে নিচে নামাল, সেরিনা ভাঙ্গা গলায় ডাকল, “আব্বু।”
শামীম নিচু গলায় বলল, “মা, আমার।”
শামীম বলতে চাইল, সব ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু বলতে পারল না। সে আবছা অন্ধকারে সেরিনার দিকে তাকিয়ে রইল।
মানুষগুলো ধাক্কা দিয়ে শামীমকে চেয়ারে বসিয়ে দেয়। তারপর একজন তার মুখে একটা চওড়া মাস্কিং টেপ লাগিয়ে দেয়। তারপর হাত দুটো পিছনে নিয়ে শক্ত করে বাঁধতে থাকে।
সেরিনা দৃশ্যটি দেখতে পারছিল না, হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আবু সব আমার জন্যে হচ্ছে। সব আমার দোষ! আমার!”
শামীম বলতে চাইছিল, “তোর কোনো দোষ নেই!” কিন্তু সে কিছুই বলতে পারল না, সেরিনার দিকে তাকিয়ে রইল।
সেরিনাকে ধরে যখন পুরো দলটি ঘর থেকে বের হয়েছে তখন রাত তিনটা বাজে। বাইরে একটা গাড়ী অপেক্ষা করছিল সেখানে সেরিনাকে ঠেলে ঢুকিয়ে দিয়ে মানুষগুলো গাড়ীর সামনে পিছনে উঠে যায়। সাথে সাথেই গভীর রাতের নির্জন রাস্তা দিয়ে গাড়ীটা ছুটে যেতে থাকে। কিছুক্ষণের মাঝেই গাড়ীটা শহরের এক পাশে দেওয়াল দিয়ে ঘেরা বড় একটা বিল্ডিংয়ের ভেতরে ঢুকে গেল। গাড়ী থামার সাথে সাথে ভেতর থেকে আরো কয়েকজন মানুষ বের হয়ে আসে, তারা গাড়ীর দরজা খুলে সেরিনাকে ধরে টেনে বিল্ডিংয়ের ভিতরে নিয়ে যায়।
দোতলার একটা বড় ঘরে হাসপাতালের বিছানার মতো একটা বড় বিছানা তার চারপাশে নানা ধরনের যন্ত্রপাতি। সেরিনাকে বিছানায় শুইয়ে দেয়ার সাথে সাথে তার দুই হাত আর পা এক ধরনের স্ট্র্যাপ দিয়ে বিছানার সাথে বেঁধে ফেলা হল।
একটু পরে ঘরে একজন বিদেশী মানুষ এসে ঢুকল। সেরিনা তাকে দেখেই চিনতে পারল। এই মানুষটিকেই সে তার ক্লাশ রুম থেকে মাইক্রোবাসে বসে থাকতে দেখেছে। সে যখন তার আব্বুর সাথে বিলে গিয়েছিল তখন এই মানুষটাই স্পীডবোটে করে তার নৌকাটার চারপাশে ছুটে বেড়িয়েছিল। মানুষটা সেরিনার কাছে এসে মাথা ঘুরিয়ে দেখল, তারপর ইংরেজীতে বলল, “তুমিই সেই রহস্যময়ী মেয়ে যে পানির নিচে থাকতে পার!”
ইংরেজী উচ্চারণটা একটু অন্যরকম, তারপরও সেরিনা কথাটা বুঝতে পারল। সে কিছু বলল না, মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইল, মানুষটা এরপর হড়বড় করে আরও অনেক কিছু বলল যার সে বিশেষ কিছু বুঝতে পারল না। পাশে দ্রলোকের মতো দেখতে একটা বাঙালি মানুষ দাঁড়িয়েছিল সে বলল, “স্যার বলছেন, তোমার এতো বিস্ময়কর ক্ষমতা। তুমি কেমন করে এই পোড়া দেশে পড়ে থাকবে। তোমাকে নিয়ে বিলিওন ডলারের রিসার্চ হবে ট্রিলিওন ডলারের ব্যবসা হবে।”
সেরিনা বলল, “আমি ওসব কিছু চাই না। আমাকে ছেড়ে দেন আমি বাসায় যাব।”
বিদেশীটা মাথা এগিয়ে জানতে চাইল সেরিনা কী বলছে, মানুষটি তখন তাকে সেরিনার কথাটা ইংরেজীতে অনুবাদ করে দিল। সেটা শুনে বিদেশী হা হা করে হেসে উঠল যেন কথাটা খুবই মজার কথা এবং মানুষটাকে হাসতে দেখে অন্যেরাও হাসতে শুরু করল। সেরিনা অবাক হয়ে মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল, তাদের হাসি থামার পর বলল, “আপনারা আমার আব্বুকে বেঁধে রেখেছেন, আমাকে জোর করে ধরে এনেছেন, এটা আপনারা করতে পারেন না।”
ভদ্রলোকের মতো দেখতে বাঙালি মানুষটা বলল, “আমরা সবকিছু করতে পারি। পৃথিবীর কেউ আমাদের কিছু করতে পারবে না। তোমার ওপর মায়া করে, তোমার বাবাকে আমরা মারি নাই! তোমার আমাদের উপর অনেক কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ। বুঝেছ?”
সেরিনা বুঝল না, অবাক হয়ে মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইল। একটু পরে জিজ্ঞেস করল, “আমাকে আপনারা কী করবেন?”
“তোমাকে এই সাহেব তাদের দেশে নিয়ে যাবেন।”
“কীভাবে নিয়ে যাবেন?”
“তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে একটা বাক্সে করে নিয়ে যাবে। তুমি কিছু জানতেই পারবে না। ঘুম ভাঙার পর দেখবে তুমি বিশাল একটা ল্যাবরেটরিতে। শত শত সায়েন্টিস্ট তোমকে নিয়ে গবেষণা করবে।”
সেরিনা কেঁদে ফেলল, বলল, “আমি যেতে চাই না। প্লীজ আমাকে ছেড়ে দেন। প্লীজ! প্লীজ!”
বিদেশী মানুষটা মুখে একটা হাসি নিয়ে এক পাশে সরে গেল তারপর একজনকে জিজ্ঞেস করল, “আমাদের পরিকল্পনাটা কী? হেলিকপ্টার কখন। আসবে।”
“সকাল দশটায়। দশটায় ক্যাপসুলটা নিয়ে যাবে।”
“মেয়েটাকে ক্যাম্পসুলে ঢোকাবে কখন?”
“সকাল নয়টার দিকে।”
“বাবাটা যদি তার আগে শহরে হই চই শুরু করে দেয়?”
“করবে না, ওর বাসায় মেয়েটার বাবা ছাড়া আর কেউ নেই। কাজের একটা মহিলা আসে বেলা দশটার দিকে, বাপটা তখন ছাড়া পেয়ে হই চই করতে শুরু করলেও আমরা ততক্ষণে হাওয়া হয়ে যাব। তা ছাড়া বেশী হই চই করতে পারবে না। আমরা ডলার দিয়ে, সবার মুখ বন্ধ করে রেখেছি। কেউ তার কোনো কথা শুনবে না।”
“গুড। কিন্তু–” বিদেশীটা একটু ইতস্তত করে। “কিন্তু কী?”
“তারপরও আমার মনে হয় বাপটাকে মেরে ফেলে আসা উচিৎ ছিল। একজন জীবন্ত মানুষ মানেই বাড়তি যন্ত্রণা!”
ভদ্রলোকের মতো দেখতে মানুষটা মাথা নাড়ল, বলল, “না। আমরা শুধু শুধু একজন মানুষকে মারতে চাই না। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো, কোনো রক্তপাত ছাড়াই আমরা প্রজেক্টটা শেষ করব।”
বিদেশীটা বলল, “ঠিক আছে। আমাদের হাতে এখন চার থেকে পাঁচ ঘন্টা সময় আছে, এই সময়ের ভিতর মেয়েটার পুরো বায়োলজিক্যাল প্রোফাইলটা বের করে ফেল।”
“হ্যাঁ। বের করে ফেলব।“
“তোমরা পুরো প্রজেক্টটা ঠিক করে বের করে দাও, আমাদের এজেন্সি তোমাদের খুশী করে দেবে!”
“তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। তোমার প্রজেক্ট আমরা এখান থেকে বের করে দেব। তোমার দেশে তোমরা কী করবে সেটা নিয়ে তুমি মাথা ঘামাও!”
“একবার আমার দেশে নিতে পারলে পুরোটা হবে একট টুকরা কেকের মতো সোজা!”
তারপর দুইজনই হা হা করে হাসতে লাগল। সেরিনা শূন্য দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মনে হতে থাকে তার মাথার ভেতরে সবকিছু বুঝি শূন্য হয়ে যাচ্ছে!