খাজুরাহো মন্দির দেখতে যাওয়ার পথে কাকাবাবু অংশুর পরীক্ষা নিলেন। ভোর থেকেই ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। আকাশের অবস্থা দেখলে মনে হয়, সহজে এ বৃষ্টি থামবে না। আজকের দিনটা ঠিক মন্দির দেখতে যাওয়ার পক্ষে উপযুক্ত নয়, কারণ খাজুরাহো মন্দিরের এলাকাটা অনেকটা বড়। বেশ কয়েকটা মন্দির আছে, সেইসব মন্দিরের দেওয়ালের কারুকাজ দেখতেই দেশ-বিদেশ থেকে পর্যটকরা আসে। ভেতরে গাড়ি নিয়ে যাওয়া যায় না, পায়ে হেঁটে ঘুরতে হয়। বৃষ্টিতে একদম ভিজে যেতে হবে।
কিন্তু সকালবেলা আর কিছুই করার নেই। কামাল সকালে আসতে পারবেন।, তাই আফগানিস্তানের গল্পও জমবে না। সেইজন্য কাকাবাবু সদলবলে স্টেশন-ওয়াগন নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন। চলন্ত গাড়ি থেকে দুপাশের সবুজ গাছপালার বৃষ্টিতে স্নান করার দৃশ্য দেখতেও ভাল লাগে।
খানিকটা যাওয়ার পর কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, অংশু সেই কবিতাটা মুখস্থ হয়েছে?
অংশু বলল, হ্যাঁ সার। তবে আমার মনে হয়, কবিতাটায় ভুল আছে। একটু বাদ পড়ে গেছে।
কাকাবাবু চোখ বড়-বড় করে বললেন, তাই নাকি? বাদ পড়ে গেছে? কী বাদ পড়েছে?
অংশু বলল, আপনি ফার্স্ট লাইনটা বলেছিলেন, শুনেছো কী বলে গেল সীতারাম বন্দ্যো, তাই না? ওটা সার বন্দ্যোপাধ্যায় হবে না?
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, বন্দ্যোপাধ্যায় হতে পারে, ব্যানার্জি হতে পারে। এমনও হতে পারত, শুনেছ কী বলে গেল সীতারাম বন্দ্যোপাধ্যায়। আকাশের গায়ে নাকি টকটক গন্ধ পাওয়া যায়। কিন্তু কবি তো তা লেখেননি! কবি যেরকম লিখেছেন, সেরকমই মনে রাখতে হবে।
অংশু বলল, তা হলে বলছি, শুনুন।
শুনেছ কী বলে গেল সীতানাথ বন্দ্যো
আকাশে খুব টক টক গন্ধ
সেরকম টক টক থাকে না যদি হয় বৃষ্টি
তখন চেটে দেখো, ইয়ে, তখন চেটে দেখেছি
চিনির মতন মিষ্টি।
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, অনেকটা হয়েছে। কিন্তু পুরোটা ঠিক হয়নি।
জোজো প্রবল প্রতিবাদ করে বলে উঠল, অনেকটা মানে কী? কিচ্ছু হয়নি। কবিতাটা মার্ডার করে দিয়েছে। কবিতার একটা শব্দও বদলানো যায় না। একটা শব্দ ভুল হলেই পুরো কবিতাটা নষ্ট হয়ে যায়। চিনির মতন মিষ্টি, গুড়ের মতন মিষ্টি, না জিলিপির মতন মিষ্টি, তা কি আছে কবিতার মধ্যে?
জোজোর রাগ দেখে কাকাবাবু হেসে ফেললেন।
সন্তু অংশুর ফ্যাকাসে মুখ দেখে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে বলল, আহা, অনেকটা তো চেষ্টা করেছে। আর একটু চেষ্টা করলেই ঠিক-ঠিক মুখস্থ হয়ে যাবে।
জোজো বলল, কবিতায় শব্দ ভুল করলেই সেটা খুব বাজে হয়ে যায়। সেরকম কবিতা শুনলে আমার গা কিরকির করে।
কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে জোজো, তুমি আমাদের একটা ভাল কবিতা শোনাও বরং।
জোজো অমনই শুরু করল!
অপূর্বদের বাড়ি
অনেক ছিল চৌকি টেবিল, পাঁচটা সাতটা গাড়ি!
ছিল কুকুর, ছিল বিড়াল, নানান রঙের ঘোড়া
কিছু না হয় ছিল ছসাত জোড়া;
দেউড়ি ভরা দোবে-চোবে, ছিল চাকর দাসী,
ছিল সহিস বেহারা চাপরাশি
—আর ছিল এক মাসি …
সন্তু বলল, এটা যে খুব লম্বা কবিতা রে!
কাকাবাবু বললেন, তা হোক, শুনি। মন দিয়ে শোনো অংশু, এটা রবীন্দ্রনাথের কবিতা …
প্রায় ছপাতার কবিতা নির্ভুল মুখস্থ বলে গেল জোজো। কাকাবাবু তার পিঠ চাপড়ে বললেন, চমৎকার। সত্যি, জোজো খুব ভাল আবৃত্তি করে। ওর অনেক গুণ আছে।
জোজো বলল, বাবার সঙ্গে একবার সুইডেনে গিয়েছিলাম, রাজা রানির সামনে এই কবিতাটা আবৃত্তি করে শোনাতে হল। রানি তো শুনে কেঁদেই ফেললেন।
সন্তু নিরীহভাবে জিজ্ঞেস করল, সুইডেনের রানি বুঝি বাংলা জানেন?
জোজো সগর্বে বলল, তুই জানিস না? রবীন্দ্রনাথ নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পর সুইডেনের সব শিক্ষিত লোকই বাংলা পড়ে।
সন্তু বলল, ইস, তোকে একটা নোবেল প্রাইজ দিল না?
জোজো বলল, আমি যখন লিখতে শুরু করব, তখন দেবে, দেখে নিস!
কাকাবাবু বললেন, জোজো লিখতে শুরু করলে গল্পের কোনও অভাব হবে না!
অংশু সাধারণত অন্যদের কথার সময় চুপ করে থাকে। এখন সে বলল, সার, একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
কাকাবাবু বললেন, তুমি সবসময় আমাকে সার-সার করো কেন? সন্তু-জোজোর মতন তুমিও কাকাবাবু বলতে পারো। আমার সমান বয়েসীও অনেকে এখন আমাকে কাকাবাবু বলে!
অংশু উৎসাহিত হয়ে বলল, আপনি আমাকে পারমিশান দিচ্ছেন? আমিও আপনাকে কাকাবাবু বলতে পারি সার? আচ্ছা কাকাবাবু, এখানে এসে শুনছি, আপনার অনেক শত্ৰু। কেন?
কাকাবাবু বললেন, কেন? আচ্ছা, তোমার কথাই ধরা যাক। তুমি ট্রেনে ডাকাতি করতে এসেছিলে, তোমাকে ধরে যদি আমি পুলিশের হাতে তুলে দিতাম, তা হলে তোমার অন্তত তিন-চার বছর জেল হত। জেলে বসেবসে তুমি ভাবতে, ওই খোঁড়া লোকটার জন্যই আমি ধরা পড়লাম। ঠিক আছে, ব্যাটাকে দেখে নেব! জেল থেকে বেরিয়ে তুমি আমার সঙ্গে শত্রুতা করতে। সেরকম অনেক ভয়ঙ্কর-ভয়ঙ্কর লোককে আমি ধরে ফেলেছি, শাস্তি দিয়েছি, আবার ক্ষমাও করেছি। তারা অনেকেই আমার শত্রু হয়ে আছে। আমার ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করে। এ পর্যন্ত কেউ কিন্তু আমাকে মারতে পারেনি।
জোজো বলল, আমার বাবা আপনার নামে একটা যজ্ঞ করেছেন। তার ফল কী হয়েছে জানেন কাকাবাবু? আপনার এখন ইচ্ছামৃত্যু। আপনাকে অন্য কেউ মারতে পারবে না।
কাকাবাবু বললেন, আমি যদিও যজ্ঞ-টজ্ঞতে বিশ্বাস করি না, তবু যাই হোক, তোমার বাবাকে ধন্যবাদ!
অংশু বলল, যদি আপনাকে কেউ গুলি করে দেয়?
কাকাবাবু বললেন, তোমার কাছেও তো পাইপগান ছিল, তুমি তো গুলি করতে পারলে না?
অংশু সন্তুর দিকে তাকাল। তারপর বলল, সন্তুকে দেখলে কিছুই বোঝা যায় না। ও যে হঠাৎ অতটা লাফিয়ে উঠতে পারে—
জোজো মাঝে-মাঝে পেছন ফিরে তাকাচ্ছে। এবার বলল, কাকাবাবু, কালকের সেই নীল রঙের ফিয়াট গাড়িটা আজও পেছন পেছন আসছে–
কাকাবাবুও মুখ ঘোরালেন, কিন্তু গাড়িটা দেখতে পেলেন না।
জোজো বলল, এইমাত্র আড়ালে চলে গেল। দিনের বেলা পুলিশের গাড়িটাকে সঙ্গে আসতে বারণ করে দেওয়া হয়েছে। বৃষ্টির জন্য রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়া খুব কম। বৃষ্টি ক্রমশই বাড়ছে। একটু পরে বৃষ্টির এমন তোড় হল যে, সামনের কিছু দেখাই যায় না।
কাকাবাবু ড্রাইভারকে বললেন, গাড়ি থামাও, এখন চালাবার দরকার নেই। অ্যাসিডেন্ট হয়ে যেতে পারে।
গাড়িটা থামানো হল রাস্তার একপাশে।
কাকাবাবু বললেন, সন্তু, ফ্লাস্কে করে চা আনা হয়েছে না? বার কর, এখন একটু চা খাওয়া যাক।
জোজো বলল, অনেক স্যান্ডউইচও দিয়ে দিয়েছে। আমার একটু খিদে-খিদে পাচ্ছে।
বাইরে ঝমঝম করছে বৃষ্টি। গাড়ির সব কাচ তোলা। সবাই স্যান্ডউইচ আর চা খেতে লাগল, ড্রাইভারকেও দেওয়া হল।
একটা জিপগাড়ি এই গাড়িটা ছাড়িয়ে চলে গিয়ে থেমে গেল। তারপর আবার পিছিয়ে এল। মনে হল, এই গাড়িটাও যেন এখানে একটা বড় গাছের নীচে দাঁড়িয়ে থাকতে চায়।
জিপ থেকে নেমে দৌড়ে এল দুজন লোক। এ-গাড়িটার দুপাশে দাঁড়াল। জোজো একটা জানলার পাশে বসে আছে, তার কাছে দাঁড়িয়ে একজন লোক কী যেন বলতে লাগল। কাচ বন্ধ বলে কিছু শোনাই যাচ্ছে না।
কাকাবাবু বলল, জোজো, কাচটা খোলো। দেখো তো, ওরা কী চাইছে।
জোজো কাচ খুলতেই সেই লোকটি জোজোর বুকের দিকে একটা রিভলভার তুলল। অন্য লোকটির হাতেও রিভলভার।
এদিকের লোকটি হিন্দিতে বলল, নামো, নেমে এসো গাড়ি থেকে।
কাকাবাবুর এক হাতে চায়ের কাপ, অন্য হাত কোমরের কাছে। লোকটি কাকাবাবুর দিকে তাকিয়ে কর্কশ গলায় বলল, হাত তুলবে না, ওই অবস্থায় নেমে এসো।
কাকাবাবু সরলভাবে জিজ্ঞেস করলেন, এই বৃষ্টির মধ্যে নামব কেন?
লোকটি বিশ্রী একটা গালাগালি দিয়ে বলল, শিগগির নাম, নইলে মাথার খুলি উড়িয়ে দেব!
কাকাবাবু বললেন, এ কী কাণ্ড, এ যে দেখছি দিনে ডাকাতি!
হঠাৎ কোথা থেকে একটা গুলি এসে লাগল সেই লোকটির কাঁধে। সে পড়ে গেল মাটিতে। অন্য লোকটি ছুটে চলে গেল একটা গাছের আড়ালে। সেও গুলি চালাল, এই গাড়ির দিকে নয়, পেছন দিকে।
কাকাবাবুরা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন, খানিক দূরে থেমে আছে একটা নীল রঙের ফিয়াট গাড়ি। তার জানলা দিয়ে বেরিয়ে আছে একটা রাইফেলের নল।
এ-গাড়ির ড্রাইভার আর বিন্দুমাত্র দেরি না করে হুস করে স্টার্ট দিয়ে দিল। পেছন দিকে শোনা গেল দু পক্ষের গুলি বিনিময়ের শব্দ।
কাকাবাবু বেশ অবাক হয়ে বললেন, ব্যাপারটা কী হল বল তো, সন্তু। কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কারাই বা আমাদের ধরতে এল, কারাই বা তাদের মারতে গেল?
সন্তু কিছু বলার আগেই জোজো বলল, আমার মনে হয়, আপনার কোনও পুরনো শত্রুর দল আমাদের ধরে নিতে এসেছিল। এই সময়ে এসে পড়ল সূরপ্রসাদের দল। তারা আমাদের বাঁচিয়ে দিল। আমি ওই নীল ফিয়াট গাড়িটার কথা আগে বলিনি? ওতে সূর্যপ্রসাদ নিজে কিংবা ওর কোনও সহকারী সবসময় আমাদের পাহারা দিচ্ছে।
কাকাবাবু বললেন, সূর্যপ্রসাদের এত কী দায় পড়েছে আমাদের বাঁচাবার? ক্রিমিনালরা কারও জন্য তো নিজেদের মধ্যে মারামারি করে না।
সন্তু বলল, ফিয়াট গাড়ির লোকটার হাতের টিপ খুব ভাল।
গাড়িটা বেশ খানিকটা দূরে চলে এসেছে। কাকাবাবু আবার ড্রাইভারকে বললেন, এবার থামাও। গাড়ি ঘোরাতে হবে। আজ আর খাজুরাহো মন্দিরে গিয়ে কাজ নেই। কামালকে এই ঘটনাটা জানানো দরকার।
অংশু জিজ্ঞেস করল, আমরা এই রাস্তা দিয়েই আবার ফিরব?
কাকাবাবু বললেন, কেন, ভয় করছে নাকি? দিনের বেলা বড় রাস্তার ওপর মারামারি পাঁচ মিনিটের বেশি চলে। এখন গিয়ে দেখবে কিছু নেই।
ড্রাইভার গাড়িটা ঘুরিয়ে নিয়ে ভয়ে-ভয়ে আস্তে চালাতে লাগল।
একটু পরেই দেখা গেল, নীল রঙের ফিয়াটটা এদিকেই আসছে। কাকাবাবুদের গাড়িটাকে দেখতে পেয়েই সে-গাড়িটা ঝট করে থেমে গিয়ে সাঁ করে ঘুরিয়ে নিয়ে পালাতে লাগল।
কাকাবাবু উত্তেজিতভাবে বললেন, জোরে চালাও তো, গাড়িটা ধরো। ওতে কে আছে, আমি দেখতে চাই।
শুরু হল দুটো গাড়ির দৌড় প্রতিযোগিতা। কিন্তু ফিয়াট গাড়িটা ছোট, স্পিড়ও বেশি। তাকে ধরা গেল না, মিলিয়ে গেল চোখের আড়ালে।
আগে যেখানে চা খাওয়ার জন্য থামা হয়েছিল, সেখানে গোলাগুলি চালাবার চিহ্নমাত্র নেই। একটা লোকের কাঁধে তো গুলি লেগেছিলই, নিশ্চিত অনেক রক্ত পড়েছিল, বৃষ্টিতে তা ধুয়ে গেছে।
কাকাবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, নীল গাড়িটা যদি আমাদের পাহারাই দিতে চায়, তা হলে আমাদের দেখে পালিয়ে গেল কেন?
সন্তু বলল, দূর থেকে উপকার করতে চায়। পরিচয় জানাতে চায় না।
অংশু জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা কাকাবাবু, নীল গাড়িটা যদি না আসত, তা হলে তো এই লোকদুটোর কথায় গাড়ি থেকে নামতেই হত। তখন আপনি কী করতেন?
কাকাবাবু বললেন, তা তো জানি না। আমি আগে থেকে কিছু ভেবে রাখি। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।
অংশু বলল, লোকদুটোকে যেমন হিংস্র মনে হল, আমাদের মেরে ফেলতেও পারত।
কাকাবাবু বললেন, যারা মারতে চায়, তারা প্রথমেই গুলি চালায়। ওরা আমাদের কোথাও ধরেটরে নিয়ে যেত বোধ হয়।
কাকাবাবু আর কথাবার্তায় উৎসাহ দেখালেন না। আপনমনে দুবার বললেন, উপকারী বন্ধু, উপকারী বন্ধু, তারপর গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়লেন।
গাড়ি ফিরে এল শহরে। কামালকে তাঁর বাড়ির একতলাতেই একটা দোকানঘরে পাওয়া গেল। সেখানে আরও লোক রয়েছে। কথা বলা যায় না। সবাই চলে এলেন ভেতরের বৈঠকখানায়।
সব শুনে কামাল খুব উত্তেজিত হয়ে বললেন, এ তো সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার। দিনের বেলায় এরকম কাণ্ড তো এখানে কখনও শুনিনি! বাইরে থেকে এসেছে? লোক দুটোকে চিনতে পারলেন? আপনার পুরনো শত্রু?
কাকাবাবু বললেন, দুজনেরই মুখ দাড়ি-গোঁফে ঢাকা। জীবনে কখনও দেখেছি বলে মনে হয় না। খুব সম্ভবত ভাড়াটে গুণ্ডা। অন্য কেউ পাঠিয়েছে। ওদের নিয়ে মাথা ঘামাবার কিছু নেই। কিন্তু নীল রঙের ফিয়াট গাড়িটাতে কে ছিল? তোমার কি মনে হয়, সূর্যপ্রসাদ আমাদের পাহারা দিচ্ছে?
প্রবল বেগে দুদিকে মাথা নেড়ে কামাল বললেন, আমার তা বিশ্বাস হয় না। সূর্যপ্রসাদ অতি নিষ্ঠুর প্রকৃতির লোক। মায়া-দয়া, কৃতজ্ঞতাবোধ, এসব কিছু তার নেই। আপনি তাকে নাকেখত দিইয়েছিলেন, সে-কথা এখানে
অনেকেই জানে। সে অপমানের সে শোধ নেবে না?
কাকাবাবু বললেন, আমি তার উপকারও করেছিলাম। খাজুরাহো মন্দিরের মূর্তিগুলো সব সে ফেরত দিয়েছিল, তাই তাকে পুলিশের হাতে তুলে দিইনি। তোমার সঙ্গে তার কবে দেখা হয়েছে?
কামাল বললেন, সূরপ্রসাদকে তিন-চার বছর দেখা যায় না। পুলিশও তার খোঁজ রাখে না। শরীর তেমন ভাল নয় বলে সে এখন কোথাও লুকিয়ে থাকে। সেখান থেকেই দল চালায়।
কাকাবাবু বললেন, হয়তো তার পরিবর্তন হয়েছে। অপমানের কথা ভুলে গিয়ে উপকারটাই মনে রেখেছে। নইলে ওরকম চিঠি পাঠাবে কেন?
কামাল বললেন, কী জানি! কাকাবাবু বললেন, কী ঝামেলা, কোথাও কি একটু শান্তিতে থাকা যাবে?
কামাল বললেন, আপনারা কি এখন গেস্ট হাউসে ফিরে যাবেন? দুপুরে খাওয়ার কথা তো বলে আসেননি।
জোজো বলল, খাজুরাহোর কোনও হোটেলে খেয়ে নেওয়ার কথা ছিল, সেখানে তো যাওয়াই হল না।
কামাল বললেন, বৃষ্টির দিন, আমাদের বাড়িতে আজ খিচুড়ি রান্না হচ্ছে। আপনারা এখানেই খেয়ে নিন না। খিচুড়ি আর চিংড়িমাছ ভাজা। এইসব জায়গায় ইলিশমাছ পাওয়া যায় না।
জোজো প্রায় লাফিয়ে উঠে বলল, খিচুড়ি আমি খুব ভালবাসি!
কাকাবাবু বললেন, রোজ মোগলাই খানা খাচ্ছি, আজ খিচুড়ি খেলে মুখবদল হবে। আজ তোমার বউয়ের হাতের রান্নাও খেয়ে দেখা যাবে!
কামাল ভেতরে গিয়ে খবর দিয়ে এলেন। বৃষ্টি এখনও পড়েই চলেছে। ঠিক যেন বাংলাদেশের বর্ষা।
আধঘণ্টার মধ্যেই খাওয়ার টেবিলে বসা হল। শুধু খিচুড়ি আর চিংড়িমাছ নয়, তার সঙ্গে বেগুনভাজা, আলুভাজা, আলুবোখরার চাটনি, দই, তিনরকম মিষ্টি। খিচুড়িটা সত্যিই অতি উপাদেয় হয়েছে।
খেতে-খেতে কামাল বললেন, দাদা, দিনের বেলা এইরকম কাণ্ড হল, এবার থেকে আপনাদের সব সময় পুলিশের গাড়ি নিয়ে ঘুরতে হবে। আজ আপনাদের একটা বিপদ ঘটে গেলে আমি নরেন্দ্র ভার্মার কাছে কী কৈফিয়ত দিতাম? উনি আমাকে বারবার বলে দিয়েছেন, এখানে আপনাদের বিপদের আশঙ্কা আছে।
কাকাবাবু ঠোঁট বেঁকিয়ে বললেন, সবসময় পুলিশ নিয়ে ঘোরা আমার একেবারেই পছন্দ নয়। এখানে আমার শরীরটা বেশ ভাল আছে, অসুখ-টসুখ সেরে গেছে। ভেবেছিলাম, এখানে সবাই মিলে গল্প করব আর বেড়াব। এর মধ্যে নরেন্দ্র আর খোঁজখবর নিয়েছিল?
কামাল বললেন, না। সেটাই একটু আশ্চর্যের ব্যাপার। উনি আপনার জন্য এত চিন্তিত ছিলেন, কিন্তু এর মধ্যে আর ফোন করলেন না। কোনও সাড়াশব্দই নেই।
কাকাবাবু বললেন, কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে কে জানে! হয়তো আন্দামান চলে গেছে, কিংবা লাদাখ। ওকে বহু জায়গায় যেতে হয়।
কামাল বললেন, এরকম বুদ্ধিমান আর সুদক্ষ অফিসার আর দেখা যায় না! দারুণ লোক। আপনাকে খুব ভালবাসেন।
কাকাবাবু বললেন, নরেন্দ্র আমার খুব ভাল বন্ধু। দুজনে একসঙ্গে অনেক কাজ করেছি। অনেক বিপদেও পড়েছি। আফগানিস্তানেও তো শেষপর্যন্ত নরেন্দ্রই এসে—
জোজো বাধা দিয়ে বলল, না, না, শেষটা আগে বলে দেবেন না! আমরা পুরো গল্পটা এখনও শুনিনি! কাকাবাবু, আমার আর রাত্তির পর্যন্ত অপেক্ষা করার ধৈর্য থাকছে না। খেয়ে ওঠার পর বাকি গল্পটা আপনাদের বলতে হবে।
কামাল বললেন, এই দুপুরবেলা কি গল্প জমবে?
সন্তু বলল, কেন জমবে না? এটা কি ভূতের গল্প নাকি? ভূতের গল্প রাত্তিরে শুনতে হয়!
কামাল হেসে বললেন, নাঃ, এর মধ্যে ভূতটুত কিছু নেই।