০৮. ক্যাপ্টেনের ঘর অন্ধকার

ক্যাপ্টেনের ঘর অন্ধকার।

তাঁর ঘরের বাইরে তারকাকৃতির দুটি লালবাতি জ্বলছে। যার মানে হচ্ছে, দ্বিতীয় শ্রেণীর জরুরি অবস্থা না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে ডাকা যাবে না। ক্যাপ্টেন বিছানায় শুয়ে আছেন। তাঁর ঘুম আসছে না। স্নায়ু উত্তেজিত হয়েছে। ঘুম আসবার কথা নয়। অনেকগুলি বড় বড় ঝামেলা সৃষ্টি হয়েছে। কোনোটিরই কিনারা হচ্ছে না।

সন্ধানী স্কাউটশিপ থেকে এখনো কোনো খবর পাওয়া যায় নি। নিওলিথি ধ্বংসস্তূপের কাছাকাছি থাকলে খবর পাওয়া যাবে না তা ঠিক, কিন্তু এত দীর্ঘ সময় সেখানে তারা থাকবে কেন? দ্বিতীয় অনুসন্ধানী জাহাজ পাঠানোর ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

এদিকে প্রাণী তিনটিকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। না পারার যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে। প্রাণীগুলি অসাধারণ বুদ্ধিমান। স্পষ্টতই বোঝ যাচ্ছে এই নির্জন মৃত গ্রহে তারা যে কোনোভাবেই হোক আটকা পড়েছিল। গ্যালাক্সি-ওয়ান হচ্ছে তাদের একমাত্র মুক্তির পথ। একটি বুদ্ধিমান প্রাণী নিজের মুক্তির জন্যে যতদূর সম্ভব নিষ্ঠুরতা অবলম্বন করবে। প্রাণীর ধর্মই তাই। যে শ্ৰেষ্ঠ সে-ই টিকে থাকবে। এই সুবিশাল নক্ষত্রপুঞ্জ দুর্বলের জন্যে নয়। প্রাণীগুলি মানুষের তুলনায় উন্নত, এটি তিনি মানতে রাজি নন। তাদের মানসিক বুদ্ধিবৃত্তি উন্নত হতে পারে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে মানুষের সঙ্গে এদের তুলনা করা ঠিক হবে না। কিন্তু যদি ওরা সত্যিই মানুষের চেয়ে উন্নত হয়, তাহলে? সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না।

ক্যাপ্টেন চিন্তিত মুখে সুইচ টিপে সিডিসির সঙ্গে যোগাযোগ করলেন।

হ্যালো ক্যাপ্টেন।

হ্যালো।

ঘুম আসছে না?

না।

এক হাত খেলবেন?

তা খেলা যেতে পারে। ত্রিমাত্রিক পর্দায় দাবার গুটি ভেসে উঠল। ক্যাপ্টেন ক্লান্ত স্বরে বললেন, আমি আমার পুরান খেলা খেলব। পন কুইন ফোর।

কম্পিউটার সিডিসি বলল, নতুন পরিস্থিতে নতুন খেলা খেলতে হয় ক্যাপ্টেন।

তার মানে?

যখন পারিপার্শ্বিকতা বদলায়, তখন নিজেকেও বদলাতে হয়। আসুন, আজ আমরা নতুন খেলা খেলি।

সিডিসি, তুমি হেঁয়ালিতে কথা বলছ।

স্যার, আমি একটি যন্ত্রবিশেষ। যন্ত্রের মধ্যে আছে যুক্তি, হেঁয়ালি নয়। হেঁয়ালি আপনাদেরই একচেটিয়া।

ক্যাপ্টেন সুইচ টিপে সিডিসির সঙ্গে কাসেকশন কেটে দিলেন। তাঁর আর দাবা খেলতে ইচ্ছা হচ্ছে না। মাথা ধরেছে। ঘুমানো দরকার।

কিন্তু ঘুম এল না। দীর্ঘ সময় কাটল এপাশ-ওপাশ করে।

কিছুক্ষণ কেবিনের এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত পায়চারি করলেন। কেবিনের তাপমাত্রা নামিয়ে দিলেন দুডিগ্রি। তবু ঘুমের কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। তিনি সুইচ টিপে আবার ডাকলেন সিডিসিকে, হ্যালো সিডিসি।

হ্যালো ক্যাপ্টেন। খেলাটা তাহলে শুরু করবেন?

না, আমি তোমাকে ডেকেছি ভিন্ন কারণে।

বলুন।

তুমি যদি গ্যালাক্সি-ওয়ানের ক্যাপ্টেন হতে, তাহলে কী করতে?

আমি ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করতাম।

ক্যাপ্টেনের ভ্রূ কুঞ্চিত হল। খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললেন, প্রাণীগুলিকে নিয়ে কী করতে?

ওদেরকে এই গ্রহে নামিয়ে দিয়ে ফিরে যেতাম।

কেন? নামিয়ে দিতে কেন?

যে সব প্রাণীদের ওমিক্রন রশি দিয়েও কাবু করা যায় না, তারা গ্যালাক্সি-ওয়ানের নিরাপত্তার এক বিরাট হুমকি।

কিন্তু এরা বুদ্ধিমান প্রাণী।

বুদ্ধিমান প্রাণী বলেই এরা বিপজ্জনক।

এদেরকে এই গ্রহে নামিয়ে দিতে চাইলে ওরা রাজি হবে?

না, এরা রাজি হবে না। এই প্রান্তহীন গ্রহে এদের কিছু করার নেই। আমাদের সঙ্গে এসে এরা নতুন জীবন ফিরে পেয়েছে বলা চলে।

প্রাণীগুলিকে তোমার কেমন লাগছে সিডিসি?

চমৎকার! এদের দাবা খেলা শিখিয়ে আমি একবার বুদ্ধির শক্তি পরীক্ষা করিয়ে দেখতে চাই।

সিডিসি।

বলুন স্যার।

তুমি এ জাহাজের ক্যাপ্টেন হলে কী করতে?

আমি এদের মেরে ফেলতে চেষ্টা করতাম।

এদের মেরে ফেলবার পেছনে তোমার কী কী যুক্তি আছে?

আমার তিনটি যুক্তি আছে। কিন্তু আপনাকে একটি শুধু বলব।

বল।

স্যার, আপনি জানেন না যে আরো দুজায়গায় মানুষের সঙ্গে কল্পনাতীত বুদ্ধিমান প্রাণীর দেখা হয়েছে। সেখানেও নিওলিথি সভ্যতা ছিল। দুজায়গাতেই মহাকাশযানের নাবিকরা বুদ্ধিমান প্রাণীগুলিকে জাহাজে তুলে নিয়ে আসছিল। এবং দুটি ক্ষেত্রেই হাইপারডাইভের আগে আগে মহাকাশযান দুটি বিনষ্ট হয়েছে। আমাদের সঙ্গে ওদের মিল লক্ষ করেছেন?

ঐ ক্ষেত্রেও প্রাণীগুলি মাকড়সা জাতীয় ছিল?

না, তা ছিল না।

নিওলিথি সভ্যতার সঙ্গে প্রাণীগুলির কী সম্পর্ক?

আপনার প্রশ্নের উত্তর দেবার মতো যথেষ্ট তথ্য আমার জানা নেই।

সিডিসি।

বলুন স্যার। নিওলিথি সভ্যতা সম্পর্কে আরো জানতে চাই।

আমাদের লাইব্রেরিতে একটি মাইক্রোফিল্ম করা বই আছে–অজানা সভ্যতা—সেটি পড়ে দেখতে পারেন। তাছাড়া যা যা জানতে চান, আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন।

ক্যাপ্টেন সুইচ টিপে সিডিসির সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করলেন। বেরিয়ে এলেন হলঘরেলাইব্রেরি থেকে বইটি নিতে। লাইব্রেরি তৃতীয় স্তরে। অনেকখানি হাঁটতে হবে।

তৃতীয় স্তরে ঢাকবার মুখেই তাঁর দেখা হল লীর সঙ্গে। তিনি সহজ স্বরে বললেন, হ্যালো।

ক্যাপ্টেন।

কিছু বলবেন?

আপনি মনে হচ্ছে একটি বইয়ের খোঁজে যাচ্ছেন?

ক্যাপ্টেন ইতস্তত করে বললেন, কোত্থেকে জানলেন।

আপনার মস্তিষ্কের কম্পন থেকে। আমি তো আপনাকে আগেই বলেছি, আমরা আপনাদের চিন্তার ধারা বেশ খানিকটা বুঝতে পারি।

হ্যাঁ, তা অবশ্যি বলেছেন।

আপনি যে বিষয় সম্পর্কে জানতে চাচ্ছেন, আমিও সে বিষয়ে জানতে চাই।

আপনি নিশ্চয়ই মাইক্রোফি পড়তে জানেন না। নাকি জানেন?

না, জানি না। তবে আপনি যখন পড়বেন, তখন আমি যদি আশেপাশে থাকি, তাহলেই সব বুঝতে পারব।

নিওলিথি সভ্যতা সম্পর্কে আপনার আগ্রহের কারণ কি?

আমরা কোত্থেকে এসেছি তা জানতে চাই। ক্যাপ্টেন, আমরা এই গ্রহের অধিবাসী নই। আমাদের অন্য কোনো জায়গা থেকে এনে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে। আমাদের গরণা, নিওলিথি সভ্যতার সঙ্গে এর সম্পর্ক আছে।

আপনি কি ঘরগুলির ভেতর কখনো গিয়েছেন?

না, তবে নীম একবার গিয়েছিল।

যান নি কেন?

আমাদের উপর নিষেধ ছিল। আমাদের মা নিষেধ করেছিলেন, যেন কখনো তার আশপাশে না যাই।

আপনার মায়ের কথা তো কখনো বলেন নি।

বলবার সুযোগ হয় নি।

ক্যাপ্টেন খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললেন, আসুন আমার সঙ্গে। আমি লাইব্রেরিতে বসেই পড়ব। আপনি থাকুন আমার পাশে।

ক্যাপ্টেন, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

এ বইটি ছাড়াও অন্য কোনো বই যদি আপনার পড়তে ইচ্ছা হয়, আপনি বলবেন, আমি ব্যবস্থা করব।

অসংখ্য ধন্যবাদ, ক্যাপ্টেন। আপনার জন্যে আমি কি কিছু করতে পারি?

ক্যাপ্টেন খানিকক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন, আছে, আমার একটি সমস্যা আছে। আমি যথাসময়ে আপনাকে সমাধান করতে দেব।

আমরা তিন জন মিলে সে সমস্যার সমাধান করব। নিশ্চয়ই আমরা করব।