কিছু বোঝার আগেই য়ুহা মহাকাশযানের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় গড়িয়ে গেল, হাত দিয়ে নিজেকে থামানোর চেষ্টা করল, পারল না, মহাকাশযানের দেয়ালে গিয়ে সে সজোরে একটা ধাক্কা খেল। পুরো মহাকাশযানটা থরথর করে কাঁপছে, মনে হচ্ছে এটা বুঝি যে কোনো মুহূর্তে টুকরো টুকরো হয়ে উড়ে যাবে। য়ুহা ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে থাকে, তীচ স্বরে একটা এলার্ম বাজছে। এলার্মের তীব্র শব্দটি শুনলেই মনে হয় বুৰিা ভয়ঙ্কর একটা বিপদ নেমে আসছে। একটা লাল আলো থেকে থেকে জ্বলে উঠছে, সেটা বুকের মাঝে একটা কাঁপুনির জন্ম দেয়। য়ুহা উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল, পারল না। তার মনে হলো অদৃশ্য একটা শক্তি বুঝি তাকে দেয়ালে চেপে ধরে রেখেছে। সে মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকানোর চেষ্টা করল, মহাকাশযানের ভেতরে সবকিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। কমান্ডের ক্রুরা চারদিকে ছিটকে পড়ছে। কেউ আর উঠে দাঁড়াতে পারছে না। ভেতরে কর্কশ এক ধরনের ভয় জাগানো শব্দ, সেই শব্দ ছাপিয়ে ইঞ্জিনের চাপা গুম গুম শব্দ ভেসে আসছে। য়ুহা মহাকাশযানের দেয়াল ধরে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। হঠাৎ পুরো মহাকাশযানটি একটা জীবন্ত প্রাণীর মতো ঝটকা দিয়ে ওঠে, য়ুহা কিছু বোঝার আগেই দেখে সে শূন্যে ছিটকে উঠেছে—নিচে পড়ার আগেই সে অন্য পাশে ছুটে গেল—নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করল, পারল না। মুহূর্তেই তার চারপাশের জগৎটা অন্ধকার হয়ে যায়। অন্ধকারে ড়ুবে যাবার আগে য়ুহার মনে হলো, তাহলে এটাই কি মৃত্যু?
ভয়ঙ্কর এক ধরনের দুঃস্বপ্ন দেখছিল য়ুহা, পাহাড়ের খাড়া ঢাল বেয়ে সে গড়িয়ে যাচ্ছে, নিজেকে থামানোর চেষ্টা করছে, পারছে না। নিচে লকলক আগুন, সেই আগুনের প্রচণ্ড তাপে তার শরীরের চামড়া গলে গলে পড়ে যাচ্ছে, ভয়ঙ্কর কিছু প্রাণী তাকে ঘিরে ফেলেছে, শরীরটাকে ছিঁড়ে ছিড়ে খাচ্ছে আর সে প্রচণ্ড যন্ত্রণায় চিৎকার করছে। এর মাঝে ভাসা ভাসাভাবে তার জ্ঞান ফিরে এসেছে। তীব্র আলোর ঝলকানি, মানুষের আর্তচিৎকার আর ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণের শব্দ শুনে সে আবার জ্ঞান হারিয়েছে। অচেতন অবস্থায় সে টের পেয়েছে তার দেহটা মহাকাশযানের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় ছিটকে গেছে, আঘাতে আঘাতে তার সারা শরীর ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে।
য়ুহার জ্ঞান ফিরে পাবার পরও সে বুঝতে পারল না কোথায় আছে। চারপাশে অসংখ্য জঞ্জাল ভেসে বেড়াচ্ছে, তার মাঝে সে নিজেও ভাসছে। য়ুহা হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, তার মাঝে এক ধরনের আতঙ্ক এসে ভর করে, সে কি হঠাৎ করে নিচে পড়বে, শরীরের সবগুলো হাড় গুঁড়ো হয়ে যাবে? কিন্তু য়ুহা পড়ল না, সে মহাকাশযানের ভেতরে ভাসতে লাগল।
য়ুহা মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকালো, একটা লাল আলো একটু পরে পরে ঝলকানি দিচ্ছে কিন্তু সেই কর্কশ এলার্মের শব্দটি নেই। চারপাশে এক ধরনের নীরবতা, সেই ভয়ঙ্কর নৈঃশব্দ বুকের মাঝে এক ধরনের ভয়ের কাপুনি ছড়িয়ে দেয়। য়ুহা নিজের অজান্তেই সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল, পারল না কিন্তু হঠাৎ করে তার সারা শরীরটা বিচিত্রভাবে ওলটপালট খেতে থাকে। শরীরের কোথাও কোথাও ভয়ঙ্কর এক ধরনের বেদনা–কে জানে হাড়গোড় কিছু ভেঙেছে কি না। য়ুহা দাঁতে দাঁত কামড়ে ব্যথাটুকু সহ্য করল। নিজেকে থামানোর জন্যে সে হাত বাড়িয়ে কিছু একটা ধরার চেষ্টা করল, হঠাৎ করে যেটা ধরল সেটা হাত থেকে ছুটে বেরিয়ে যায়–একজন মানুষের শীতল দেহ! রুহা ভয় পাওয়া গলায় চিৎকার করে উঠে চারদিকে তাকায়, সবাই কি মারা গেছে?
ঠিক এ রকম সময় রুহা মহাকাশযানের এক পাশে আলো হাতে কয়েকজনকে ভেসে যেতে দেখে। অত্যন্ত ব্যস্তভাবে দ্রুতগতিতে তারা ছুটে যাচ্ছে। য়ুহা তাদেরকে ডাকতে গিয়ে থেমে গেল, মানুষগুলো খুব ব্যস্ত, এখন হয়তো তাদের বিরক্ত করা ঠিক হবে না। য়ুহা মহাকাশযানের ভেতরে অসহায়ভাবে ঝুলে আছে, সামনে-পিছে যেতে পারছে না। একজন ক্রুয়ের দেহ ভেসে ভেসে আসছে, সেটাকে টেনে ধরে সে ছেড়ে দিতেই সামনের দিকে এগিয়ে গেল। দেয়ালের কাছে পৌঁছাতেই সে শক্ত করে দেয়ালটা খামচে ধরার চেষ্টা করতে থাকে। বাম হাতটা ব্যথায় টনটন করছে, মাথার ভেতরেও যন্ত্রণার এক ধরনের অনুভূতি দপ দপ করছে। য়ুহা সেই অবস্থায় দেয়ালটা ধরে নিচে নামতে থাকে।
ঠিক এ রকম সময়ে য়ুহা দেখল তার সামনে দিয়ে হিসান দ্রুত ভেসে যাচ্ছে–ভঙ্গিটা এত সাবলীল যে দেখে মনে হয় পানির ভেতর দিয়ে কোনো একটি জলচর প্রাণী ভেসে যাচ্ছে। য়ুহা গলা উঁচু করে ডাকল, হিসান। এই যে হিসান।
হিসান য়ুহার গলার আওয়াজ শুনে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই এক পাক ঘুরে গেল, হাত দুটো পেছনের দিকে ধাক্কা দিয়ে সে অত্যন্ত দক্ষ ভঙ্গিতে য়ুহার কাছে হাজির হলো, য়ুহা?
হ্যাঁ। কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার দেখেছ? পুরো মহাকাশযানটা একেবারে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে।
হিসান শুকনো গলায় বলল, হ্যাঁ।
তুমি বিশ্বাস করবে না। আমি দেখেছি একঙন মনে হয় মারা গেছে। উপরে ভাসছে।
একজন নয়, বেশ কয়েকজন।
সর্বনাশ।
কিছু আসে-যায় না। কেউ একটু আগে আর কেউ একটু পরে।
য়ুহা ভুরু কুঁচকে বলল, তার মানে?
আমরা এই মহাকাশযানটা ধ্বংস করে ফেলছি।
য়ুহা অবাক হয়ে বলল, কী করছ?
মহাকাশযানটা ধ্বংস করে ফেলছি।
কী বলছ তুমি? য়ুহা চিৎকার করে বলল, কী বলছ?
হ্যাঁ। আমরা মহাকাশযানটা ধ্বংস করে ফেলছি।
কেন?
ক্যাপ্টেন ক্ৰবের আদেশ। এই মহাকাশযানটা হচ্ছে মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রযুক্তি। এটা যেন কিছুতেই অন্য কোনো বুদ্ধিমান প্রাণীর হাতে না পড়ে।
য়ুহা চিৎকার করে বলল, কিন্তু এটা রক্ষা করার জন্যে তোমরা চেষ্টা করবে না? আগেই মহাকাশযানটা ধ্বংস করে ফেলবে? সবাইকে মেরে ফেলবে?
হিসান শান্ত গলায় বলল, আমার এখন সেটা নিয়ে কথা বলার সময় নেই য়ুহা। আমরা সবাই সামরিক কমান্ডের ক্রু। আমরা মরতে ভয় পাই না।
য়ুহা চিৎকার করে বলল, কিন্তু আমি সামরিক কমান্ডের ক্রু না! আমি মরতে ভয় পাই। আমি তোমাদের সাথে মরতে চাই না। আমি বেঁচে থাকতে চাই।
হিসান য়ুহার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে মেঝেতে পা দিয়ে ভেসে যেতে যেতে বলল, বিদায় য়ুহা। আশা করছি তোমার জীবনটা সুন্দর ছিল।
য়ুহা হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। সত্যিই এই মহাকাশযানটাকে ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে? সে মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকালো। মহাকাশযানের মাঝে আবছা এক ধরনের অন্ধকার, একটা ঘোলাটে লাল আলো জ্বলছে আর নিভছে। বিশাল মহাকাশযানে অসংখ্য জঞ্জাল ঘুরে বেড়াচ্ছে, এর মাঝে কয়েকজন ক্রুয়ের দেহও আছে। মানুষগুলো মারা গেছে—হিসান বলেছে তাতে কিছু আসে-যায় না। একটু পরে অন্য সবাইও মারা যাবে। কেউ আগে, কেউ পরে।
য়ুহার ভেতরে হঠাৎ প্রচণ্ড ক্রোধ ফুসে উঠতে থাকে। সে চিৎকার করে ডাকল, ক্যাপ্টেন ক্ৰব! তুমি কোথায় ক্যাপ্টেন ক্ৰব?
য়ুহা শেষ পর্যন্ত ক্যাপ্টেন ক্রবকে কন্ট্রোলঘরে খুঁজে পেল। ঘরের মাঝখানে একটা অসম্পূর্ণ হলোগ্রাফিক স্ক্রিন মাঝে মাঝে এসে আবার অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। ক্যাপ্টেন ক্রব অন্যমনস্কভাবে সেদিকে তাকিয়ে আছে। তাকে দেখে মনে হয় সে বুঝি মেঝের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু ভাল করে তাকালে বোঝা যায় সে আসলে মেঝে থেকে বেশ খানিকটা উপরে সোজা হয়ে ভাসছে! ক্যাপ্টেন ত্রুবকে দেখে য়ুহী চিৎকার করে বলল, ক্যাপ্টেন ক্ৰব।
ক্যাপ্টেন ক্রুব শান্ত ভঙ্গিতে বলল, বল য়ুহা।
এটা কি সত্যি যে তুমি এই মহাকাশযানটাকে উড়িয়ে দিচ্ছ?
হ্যাঁ, এটা সত্যি।
তুমি এই মহাকাশযানের সবাইকে মেরে ফেলবে?
আমরা সামরিক কমান্ডের ক্রু। আমাদেরকে প্রয়োজনে মত শেখানো হয়েছে।
তোমাদের শেখানো হয়েছে—আমাকে তো শেখানো হয়নি।
সেটা তোমার দুর্ভাগ্য—
না। হা চিৎকার করে বলল, তুমি এটা করতে পার না। তোমাকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বেঁচে থাকার চেষ্টা করতে হবে।
ক্যাপ্টেন ক্রুব শান্ত গলায় বলল, চেষ্টা করার বিশেষ কিছু নেই। আমি সবার সাথে কথা বলেছি, সবার সাথে কথা বলে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই মুহূর্তে আমরা একটা গ্রহের আকর্ষণে আটকা পড়ে আছি–কালো অন্ধকার একটা গ্রহ। এই গ্রহে কোনো একটা মহাজাগতিক প্রাণী থাকে তারা আমাদের ধরে এনেছে। আমাদের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করছে। আমাদের বিশেষ কিছু করার নেই। আমি সব কিছু ভেবে দেখেছি।
য়ুহা বলল, হয়তো দেখনি। হয়তো তুমি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছ। আমি যখন বলেছিলাম মহাকাশযানটা গতিপথ পরিবর্তন করছে তখন তুমি আমার কথাও বিশ্বাস করনি। মনে আছে? তুমি যদি আমার কথা বিশ্বাস করতে তাহলে হয়তো অবস্থা অন্য রকম হতো!
সেটা সম্ভবত সত্যি। কিন্তু আমাকে তো যুক্তির ভেতরে থেকে কাজ করতে হবে। আমি তো অযৌক্তিক কাজ করতে পারি না।
য়ুহা হিংস্র গলায় বলল, হয়তো খুব জটিল অবস্থায় একটা অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়
ক্যাপ্টেন ক্রুব একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেয়ার কোনো প্রক্রিয়া আমার জানা নেই য়ুহা। তবে তুমি নিশ্চিত থাক আমি সবার সাথে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
তুমি আমার সাথে কথা বলনি?
তুমি আমার কমান্ডের কেউ নও! তোমার সাথে কথা বলার কথা। নয়।
কিন্তু হতে পারে আমি তোমাকে খুব ভালো একটা সিদ্ধান্ত দিতে পারতাম।
ক্যাপ্টেন ক্ৰব ভুরু কুঁচকে বলল, দিতে পারতে?
হ্যাঁ।
ঠিক আছে দাও দেখি।
এই মহাকাশযানে এগারোজন বিদ্রোহীকে শীতলঘরে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। তাদের ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে তাদের সাথে পরামর্শ কর।
তাদের নিয়ে একটা সিদ্ধান্ত নাও।
ক্যাপ্টেন ক্ৰব আনন্দহীন এক ধরনের হাসি হেসে বলল, তোমার নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়ে গেছে—তা না হলে কেউ এ রকম কথা বলে? তারা বিদ্রোহী গেরিলা দল, তাদের হেডকোয়ার্টারে পৌঁছে দেবার জন্যে এই অভিযান–আর আমি তাদের ছেড়ে দেব?
হ্যাঁ। ছেড়ে দেবে। অবশ্যই ছেড়ে দেবে—
কোন যুক্তিতে?
য়ুহা জ্বলজ্বলে চোখে বলল, কারণ আমরাও মানুষ, তারাও মানুষ। একটা মহাজাগতিক প্রাণীর হাত থেকে বাঁচার জন্যে আমরা মানুষেরা এক সাথে থাকব! আমাদের পার্থক্যের কথা আমরা ভুলে যাব-
ক্যাপ্টেন ক্ৰব শব্দ করে হেসে বলল, এটা একটা অত্যন্ত আজগুবি প্রস্তাব। এ ধরনের কিছু করা হলে সামরিক কমান্ডে আমাকে বিচার করা হবে।
না, করা হবে না। এতগুলো মানুষের প্রাণ বাঁচানোর জন্যে তোমাকে পদক দেয়া হবে।
না। হবে না। আমি সামরিক কমান্ডের মানুষ—আমি জানি। আমাদের নিয়ম মেনে চলতে হয়।
য়ুহা চিৎকার করে বলল, তোমার নিয়মের আমি নিকুচি করি! আগে মানুষের জীবন তারপর জীবন।
ক্যাপ্টেন ত্রুব কঠিন মুখে বলল, না। সবার আগে নিয়ম।
য়ুহা কাতর গলায় বলল, দোহাই লাগে তোমায় ক্যাপ্টেন ক্ৰব, এগারোজন যোদ্ধাকে তুমি শীতলঘরে শীতল করে রেখেছ! তাদের ব্যবহার কর।
না। ক্যাপ্টেন ত্রুব মাথা নেড়ে বলল, য়ুহা। আমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আর কঠিন সিদ্ধান্তটি নিয়েছি। আমার ক্রুরা এই মুহূর্তে মহাকাশযানের নির্দিষ্ট জায়গায় বিস্ফোরক লাগাচ্ছে। ক্যাপ্টেন ত্রুব হাতে ধরে রাখা একটা সুইচ দেখিয়ে বলল, কিছুক্ষণের মাঝে আমি এই সুইচ টিপে পুরো মহাকাশযানটি উড়িয়ে দেব। আমি আমার জীবনের শেষ মুহূর্তটি একটু একা থাকতে চাই। নিজের সাথে শেষ বোঝাঁপড়া করতে চাই।
য়ুহা স্থির দৃষ্টিতে ক্যাপ্টেন ক্ৰবের দিকে তাকিয়ে ছিল। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার কারণে ক্যাপ্টেন ক্ৰব ভরশূন্য পরিবেশে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, য়ুহা একেবারেই পারে না, তাকে এক জায়গায় থাকার জন্যে এটা-সেটা ধরতে হয়—একটু আগে একটা ভাসমান ধাতবদণ্ড ধরেছে, সেটা এখনো তার হাতে আছে। য়ুহা একবার ক্যাপ্টেন ক্ৰবের দিকে তাকালো তারপর তার হাতের দণ্ডটির দিকে তাকালো। তার মুখের মাংসপেশি হঠাৎ করে শক্ত হয়ে যায়। সে দুই হাতে শক্ত করে ধাতবদণ্ডটি ধরে রেখে নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়ায়। তার এ জীবনে কখনোই কোনো মানুষের গায়ে হাত তোলেনি—একজন মানুষকে কেমন করে আঘাত করতে হয় সে জানে না। বহুদিন আগে কোথায় শুনেছিল মাথার পেছনে ঘাড়ের কাছাকাছি আগত করলে মানুষ নাকি অচেতন হয়ে যায়। য়ুহা তা-ই চেষ্টা করল, পুরো ঘটনাটি ঘটল চোখের পলাকে এবং অত্যন্ত স্থূল ভাবে, এ ধরনের ব্যাপারে একেবারেই অভ্যস্ত নয় বলে আঘাত করার ধাক্কা সামলাতে গিয়ে সে নিজে শূন্যে হুঁটোপুটি খেতে থাকে। অনেক কষ্টে নিজেকে যখন সামলে নেয় তখন সে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে ক্যাপ্টেন ক্রলের অচেতন দেহ ভাসতে ভাসতে নিচে নেমে মেঝেতে ধাক্কা খেয়ে আবার উপরে উঠে যাচ্ছে। তার হাতে এখনো শক্ত করে একটা সুইচ ধরে রাখা আছে, এই সুইচে কিছু গোপন সংখ্যা প্রবেশ করিয়ে একটু পরে পুরো মহাকাশযানটিকে উড়িয়ে দেয়ার কথা ছিল।
য়ুহা মেঝেতে ধাক্কা দিয়ে ক্যাপ্টেন ক্ৰবের কাছে পৌঁছে তার হাতের মুঠি থেকে সুইচটা খুলে নেয়। সুইচটা পকেটে রেখে সে তার গলায় ঝোলানো স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটিও খুলে নিল। তারপর ক্যাপ্টেন ক্ৰকের দেহটিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়, মহাকাশযানের অসংখ্য জঞ্জালের ভেতর সেটিও ঘুরপাক খেতে খেতে ভাসতে থাকে। ক্যাপ্টেন ক্ৰবের জ্ঞান ফিরে না আসা পর্যন্ত কেউ তাকে খুঁজে পাবে না।
এখন তাকে শীতলঘরে গিয়ে এগারোজন বিদ্রোহীকে জাগিয়ে তুলতে হবে। আগে সে কখনো এটা করেনি কিন্তু সেটা নিয়ে তার খুব একটা দুশ্চিন্তা নেই। আগে সে অনেক কিছুই করেনি। একটা ধাতবদণ্ড দিয়ে আঘাত করে সে আগে কখনো কোনো মানুষকে অচেতন করেনি।