কাকাবাবুর জ্ঞান ফিরলেও চোখের সামনে শুধু অন্ধকার দেখতে পেলেন। বুঝতে পারলেন না, কোথায় আছেন, কী অবস্থায় আছেন। একটু নড়াচড়া করতে গিয়ে বুঝতে পারলেন, দাঁড় করানো অবস্থায় কিছুর সঙ্গে বাঁধা। পা মাটি ছোঁয়নি। কোনও গাছটাছের সঙ্গেই বেঁধে রাখা হয়েছে মনে হয়।
এটাই কি সেই হ্রদের ধারে লায়ন্স ডেন?
এখন কত রাত কে জানে? কোথাও কোনও শব্দ নেই।
নাইলনের দড়ি দিয়ে এত জোর বাঁধা হয়েছে যে, সারাগায়ে জ্বালা করছে। নড়াচড়া করতে গেলে আরও জোরে লাগছে।
একবার তিনি শব্দ করে উঠলেন, উঃ!
সঙ্গে সঙ্গে কেউ তার নাম ধরে ডাকল, রাজা, রাজা!
কাকাবাবু দারুণ চমকে উঠলেন।
এ গলার আওয়াজ তো তাঁর চেনা। সত্যি কেউ তাঁকে ডাকল, না স্বপ্ন দেখছেন তিনি?
তবু বললেন, পওয়ন পওয়ন, তুমি কোথায়? এবার পাশ থেকেই উত্তর এল, আমি তোমার খুব কাছেই আছি। একাই আছি।
কাকাবাবু খানিকটা নিরাশভাবে বললেন, তুমিও ধরা পড়েছ? আমি আশা করেছিলাম, তুমি কোথাও লুকিয়ে আছ। ওরা তোমার সন্ধান পাবে না।
পবনরতন লোহিয়া বললেন, আমি তো পালাবার সময়ই পেলাম না। আমার একজন খুব বিশ্বস্ত বডিগার্ড ছিল। এখানে তো ঘুষের রাজত্ব চলে। কিন্তু কেউ হাজার হাজার ডলার খাইয়েও তাকে দলে টানতে পারত না। কিন্তু সে দুদিন অসুস্থ ছিল। আর-একজন ভার নিয়েছিল। অমনি সেই সুযোগে ওরা নতুন লোকটিকে হাত করে ফেলে।
তোমার বাড়িতে আগুন লেগেছে, তুমি জানো? অত সুন্দর বাড়িটা একেবারে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে?
জানব না কেন? ঘুমের মধ্যে তিন-চারজন আমার মুখ বেঁধে, কাঁধে তুলে বাইরে নিয়ে যায়। তারপরেই বাড়িটায় আগুন লাগায়।
সেই থেকে তুমি এখানেই আছ?
হ্যাঁ, রাজা। মাঝে মাঝেই ইঞ্জেকশন দিয়ে অজ্ঞান করে রেখেছে। কিছু খেতেও দেয়নি।
তোমাকে যে মাঝেমধ্যে অন্য কোথাও একা-একা দেখা গিয়েছিল, সেসব কি এদেরই রটনা?
হ্যাঁ, পুলিশকে হাত করে রটিয়েছে নিশ্চয়ই! ঘুষে এখানে কী না হয়? এমনকী, নিজের ভাইকেও অনেক সময় বিশ্বাস করা যায় না। আমার একটা ভাই, আপন ভাই নয়। সেও বোধহয় আমার সম্পত্তির লোভে এদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। তুমি কী করে ধরা পড়লে?
পওয়ন, আমি একজন পুলিশকে বিশ্বাস করেছিলাম। সে ছেলেটির প্রথম থেকেই ভদ্র ব্যবহার, বিশ্বাস না করে উপায়ই ছিল না। আমি একটুও সন্দেহ করিনি।
সত্যিই, এক-একজনকে দেখলে একটুও সন্দেহ করা যায় না। রাজা, তোমার আর দুদিন আগে আসবার কথা ছিল, তুমি ঠিক সময় এলে আমরা দুজনে একসঙ্গে থাকতাম। আমাদের ধরা অত সহজ হত না বোধহয়।
কী করব, আগে আসা গেল না! নানারকম কাণ্ড হল। সেসব তো পরে বলব!
পরে বলবে মানে? কখন? আমরা কি আর এখান থেকে বেঁচে ফিরতে পারব? অবশ্য এখন আর কিছু বলা বলা সমান। আর কতটুকু সময় পাব জানি না!
কেন পওয়ন, আমরা কি এত সহজে মরব নাকি? না না। তুমি ওসব ভেবো না। একটা কিছু ব্যবস্থা হবে!
এখন আর কী ব্যবস্থা হতে পারে? এই দড়ির বাঁধন ছেঁড়া অসম্ভব।
মনে করো, এতদিন পর এই আগ্নেয়গিরি আজই আবার জেগে উঠল। প্রথম প্রথম তো একটু একটু আগুন জ্বলবে। সেই আগুনে আমরা দড়ি পুড়িয়ে ফেলব। তারপর দৌড়োব। ওঃ হো, আমি তো আবার খোঁড়া পায়ে দৌড়োতেও পারব না। সেটা একটা মুশকিল!
রাজা, তোমার মাথায় এসবও আসে? আগ্নেয়গিরি জেগে উঠে আমাদের বাঁচাবে?
তুমি যাই বলো পওয়ন, সিংহের পেটে আমি মরব না, এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
তুমি কি জ্যোতিষ ট্যোতিষে বিশ্বাস করো নাকি?
না না, সেসব নয়। কিন্তু এত দেশ ঘুরলাম, এতরকম বিপদ কাটিয়ে এলাম, শেষ পর্যন্ত এই গোরোংগোরোর মধ্যে সিংহ আমায় খেয়ে ফেলবে, এ আবার হয় নাকি?
সিংহ না খাক, চিতা যদি আসে, সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়বে। কিংবা সাপ কামড়াতে পারে।
সিংহের চেয়ে বোধহয় সাপ ভাল, তাই না? কষ্ট কম হবে!
রাজা, এই সময়েও তুমি হাসছ?
মরতে যদি হয়, তবে কাঁদতে কাঁদতে মরার চেয়ে হাসতে হাসতে মরাই তো ভাল!
কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছেন না, অন্ধকারে কথা বলছেন দুজনে। খানিক পরে কীসের যেন শব্দ হল। নিশ্চয়ই কোনও জন্তু আসছে। দেখা গেল দুটো জ্বলজ্বলে চোখ। বেশ উঁচুতে। অর্থাৎ কোনও বড় জানোয়ার। দুজনেই নিশ্বাস বন্ধ করে চুপ করে রইলেন। জন্তুটা একটু ঘুরে এসে বসে রইল। কয়েক মিনিট পরে পবন লোহিয়া ফিসফিস করে বললেন, মনে হয় ওটা গন্ডার। তাই কাছে। আসছে না।
কাকাবাবুও ফিসফিস করে বললেন, না, ওটা সিংহই।
তুমি কী করে বুঝলে?
চোখের রং দেখে। লাল চোখ। সিংহের চোখে আয়নার মতো একটা ব্যাপার থাকে, তাকে বলে টেপটার্ন। তাতে শুধু লাল রংটাই প্রতিফলিত হয় অন্ধকারে। রাত্তিরে এক-একটা জন্তুর চোখের রং এক-এক রকম। শিয়ালের চোখ সবুজ।
তুমি এত সব জানলে কী করে, রাজা?
একসময় বনে-জঙ্গলে অনেক ঘুরেছি। তা ছাড়া বইতেও পড়েছি।
সিংহ যদি হয়, আমাদের কামড়াতে আসছে না কেন?
অন্ধকারে তো বুঝতে পারছি না, ওটা সিংহনা সিংহী। সাধারণত সিংহরা শিকার করে না, তারা বসে থাকে, সিংহীই এসে শিকার করে। এটা যদি সিংহ হয়, তা হলে নিশ্চয়ই সিংহীর জন্য অপেক্ষা করছে!
সিংহ এলে সিংহী তো বেশি দূরে থাকবে না। এসে পড়বে এক্ষুনি।
আসুক আগে, তারপর দেখা যাবে। এর মধ্যে যদি একটা হরিণ কিংবা জেব্রা এসে পড়ে, তা হলে ওরা সেটাকেই খাবে, আমাদের দিকে আর তাকাবে না।
সেজন্য কি ভগবানকে ডাকবে, এদিকে একটা জেব্রা পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য?
ভগবান এখন ঘুমোচ্ছেন। আমাদের ডাক শুনতে পাবেন না। আমরা কথা বলছি, নিশ্চয়ই শুনতে পাবে সিংহটা।
শুনতে না পেলেও গায়ের গন্ধ তো এতক্ষণে পেয়ে যাওয়া উচিত। পেয়েছে নিশ্চয়ই।
সিংহ সাধারণত ডাকে না। এই সময় হঠাৎ ডেকে উঠল। সে ডাক শুনে যত বড় সাহসীই হোক, তারও বুক কাঁপবে। কাকাবাবুরও বুক কেঁপে উঠল। তবু তিনি ভয় কাটিয়ে হালকা গলায় বললেন, দেখলে, দেখলে তো, চোখ দেখে বুঝেছিলাম, সিংহ!
পবন লোহিয়া কথাই বলতে পারছেন না আর।
সিংহটা গরগর করতে করতে এগিয়ে আসতে লাগল এদিকে।
আর নিস্তার নেই। এবার সিংহটা কার উপর আগে লাফিয়ে পড়বে?
কাকাবাবুর দিকে না এসে সিংহটা গেল পবন লোহিয়ার দিকে।
পবন কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, গুড বাই, রাজা। সরি, আমিই তোমায় এবার ডেকে এনেছিলাম। তবে, তোমার এখনও আশা আছে। সিংহটা আমায় খেলে ওর পেট ভরে যাবে, তখন আর তোমাকে খাবে না।
কাকাবাবু বললেন, এর পর সিংহীটা পেটে খিদে নিয়ে আসবে।
সিংহটা এসে পড়ল পবন লোহিয়ার খুব কাছে। গর-র গর-র করেই চলেছে।
কাকাবাবু এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না যে, তাঁর আগে পবন। লোহিয়ার মৃত্যু হবে। তাঁকেই আগে খাওয়া উচিত ছিল। পবনের মৃত্যু আর্তনাদ তিনি সহ্য করবেন কী করে?
তাঁর চোখে জল এসে গেল।
একটুক্ষণ পরে পবন লোহিয়া মৃত্যু-চিৎকারের বদলে অন্যরকমভাবে চিৎকার করে বলল, আরে, এ তো সিম্বা!
কাকাবাবু বুঝতে না পেরে বললেন, তার মানে?
পবন বললেন, এটা তো আমার পোষা সিংহ। আমার নিজস্ব চিড়িয়াখানায় থাকে।
কাকাবাবু তবু একটু অবিশ্বাসের সুরে বললেন, তোমার চিড়িয়াখানা? আগুন লাগার পর জন্তু-জানোয়াররা পালিয়েছে। কিন্তু মাত্র তিন-চারদিনের মধ্যে এই সিংহটা তো কেনিয়ার বাড়ি থেকে এত দূরে এই গোরোংগোরোর মধ্যে চলে এল? তা কি সম্ভব?
পবন বললেন, না, তা নয়। এই সিম্বাটা খুব ছোট ছিল। যথেষ্ট বড় হওয়ার পর আমি ওকে সেরেংগেটি জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে গিয়েছি নমাস আগে। সেখান থেকে এখানে চলে এসেছে। আমাকে ঠিক মনে রেখেছে। দ্যাখো, আমি ওর গলায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। গর-র গর-র শব্দটা করছে, সেটা আনন্দের।
কাকাবাবুর বুক থেকে একটা বিরাট স্বস্তির নিশ্বাস বেরিয়ে এল। যেন। সাক্ষাৎ মৃত্যুর গ্রাস থেকে ফিরে আসা।
তিনি বললেন, দ্যাখো পওয়ন, বলেছিলাম কিনা সিংহের পেটে আমার মৃত্যু হবে না?
পবন বললেন, সত্যিই, এটা আশ্চর্যভাবে মিলে গিয়েছে। কিন্তু এই দড়ির বাঁধন থেকে মুক্তি পাব কী করে?
কাকাবাবু বললেন, এটা যদি হিন্দি সিনেমা হত, তা হলে তোমার পোষা সিম্বা দাঁত দিয়ে কামড়ে দড়িগুলো সব কেটে দিত। কিন্তু সিম্বা বেচারা তো হিন্দি সিনেমা দেখেনি, ও জানবে কী করে যে দড়িটড়ি কাটতে হবে।
এবারে পবন লোহিয়াও হেসে ফেলে বললেন, সিংহটা হিন্দি সিনেমা দেখবে, তোমার মাথাতেও আসে বটে!
কাকাবাবু বললেন, একটা সিংহ যখন কামড়ায়নি, তখন অন্য সিংহরাও আমাদের কামড়াবে না ধরে নিতে পারি। ওরা সব জেনে যাবে। এর পর কী হয় দেখা যাক! সিম্বা চলে গিয়েছে?
চলে গেল এইমাত্র।
যেখানে সিংহ আসে, সেখানে অন্য হিংস্র জানোয়ার সহজে আসে না। হাতি আসতে পারে। হাতির পাল এলে সবাই জায়গা ছেড়ে দেয়।
হাতির পাল এলে আমাদের কিছু সুবিধে হতে পারে?
হতে পারে। যে গাছের সঙ্গে আমরা বাঁধা, হাতি হয়তো সেই গাছ উপড়ে ফেলে দিতে পারে।
তারপর পা দিয়ে আমাদের পিষে দেবে?
হঠাৎ শোনা গেল গুলির শব্দ। কতটা দূরে তা বোঝা গেল না। পাহাড়ের দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হলে সেই শব্দ খুব জোর মনে হয়। পায়রারা উড়ে গেল কয়েকবার। তারপর আবার সব নিঃশব্দ!
পবন জিজ্ঞেস করলেন, রাজা, কিছু বুঝলে? কী হল ব্যাপারটা?
কাকাবাবু বললেন, চোরাশিকারিদের কাণ্ড? কোনও জানোয়ার মারছে? তবে শুনেছিলাম, পুলিশ এখানে খুব কড়া পাহারা দেয়?
পবন বললেন, পুলিশের নাকের ডগাতেই এসব হয়। হাতির দাঁত, গন্ডারের শিং, চামড়া, এসবের প্রচুর দাম আছে।
আবার সব চুপচাপ। কত সময় কেটে যাচ্ছে কে জানে। দু-একবার শুধু শোনা গেল হায়েনার ডাক।
কাকাবাবু আর পবনের কথা প্রায় ফুরিয়ে গিয়েছে। দুজনেরই ঘুমঘুম চোখ।
একসময় উপরের আকাশে ফুটে উঠল একটু একটু আলো। ডাকতে লাগল পাখি। একটা পাখির ডাক অনেকটা ময়ূরের মতো জোরালো, কিন্তু ঠিক ময়ূর নয়।
সেই পাখির ডাকেই সজাগ হলেন কাকাবাবু। এবার আবছা সোনালি আলোয় দেখতে পেলেন, পবন সাদা প্যান্ট আর গলাবন্ধ কোট পরা, মুখে কয়েকদিনের খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখ দুটো ঢুকে গিয়েছে। কত বড় বড় কোম্পানির মালিক, কত লোকের উপকার করেন, তার আজ এই অবস্থা!
কোথা থেকে অনেক প্রজাপতি ফরফর করে উড়ে এল। লেকটার ধারে ধারে অজস্র ফুল। কোথাও কোনও হিংসার চিহ্ন নেই। কাকাবাবুর মনে হল, পৃথিবী কী সুন্দর!
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আবার শোনা গেল দুমদুম করে শব্দ। এবারে দূরে নয়। গুলির শব্দও নয়। একদিকটা দেখা গেল ধোঁয়ায় ভরে গিয়েছে।
কাকাবাবু বুঝতে পারলেন, এগুলো স্মোক বম্ব। এই বোমায় জন্তুজানোয়ার সব দূরে সরে যায়।
এই বোমা ফাটাতে ফাটাতে কারা আসছে?
নিশ্চয়ই রবার্ট আর তার লোকজন। সিংহের পেটে এই দুজন গিয়েছে কি না, তাই দেখতে আসছে। যখন দেখবে দুজনেই বেঁচে আছে, তখন কি এখানেই গুলি করে মারবে, না আবার সেই তাবুতে নিয়ে যাবে?
দিনেরবেলা আজ কিছু টুরিস্ট আসতে পারে এখানে, সুতরাং এখানে এই অবস্থায় বেঁধে রেখে যাবে না।
কাকাবাবু দেখতে পেলেন, ধোঁয়া ভেদ করে বেরিয়ে আসছে মানুষ। প্রত্যেকেরই হাতে রাইফেল। প্রথম লোকটিই বিল, তার লাল শার্ট দেখে চেনা যায়।
বাকি দশ হাজার ডলার পাওয়ার জন্য বি এখন ওদের হয়ে গিয়েছে।
পবন বললেন, ওই যে ওরা আসছে রাজা, এবার মৃত্যুর জন্য তৈরি হও। আর ওরা আমাদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য পরিশ্রম করবে না।
কাকাবাবু বললেন, কিছুই বলা যাবে না। আমাদের বাংলায় একটা কথা আছে, যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ। আশ মানে আশা। দেখা যাক।
একেবারে কাছে এসে বিল্ বলল, গুড মর্নিং সা! আমি একটা ছুরি দিয়ে আপনাদের বাঁধন কেটে দেব। কিন্তু তারপরই আপনারা আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বেন না। এখন আমি আপনাদের শত্রু হিসেবে আসিনি। বন্ধু হয়ে এসেছি।
কাকাবাবু বললেন, তাই নাকি? হঠাৎ আবার ডিগবাজি? কাল বিকেল পর্যন্ত আমার বন্ধু ছিলে, তারপর টাকার লোভে আমাকে বিক্রি করে দিলে। এখন আবার বন্ধু সাজতে চাইছ কেন?
বিল্ বলল, বুঝিয়ে দিচ্ছি। টাকার লোভেই আপনাকে কাল বিক্রি করেছিলাম। এখন আবার টাকার লোভেই আপনাদের মুক্তি দিতে এসেছি।
পবন লোহিয়া এবার প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বললেন, হেঁয়ালি না করে, আসল কথা বলো! রবার্ট আমার কাছে টাকা চাইছে? এক পয়সাও দেব না।
বিল্ বলল, মাপ করবেন স্যার। রবার্ট গুরুতর আহত। টাকা চাইবার মুখ তার আর নেই। টাকা পাব আমরা, আমি আর এই তিনজন পুলিশ।
ছুরি দিয়ে সে পবন ও কাকাবাবুর দড়ির বাঁধন কেটে দিল। তারপর বলল, স্যার, আপনাদের জন্য কফি আর ব্রেকফাস্ট তৈরি করে রেখেছি। তারপর বেলুনেই ফিরে যাবেন। সোজা নাইরোবি। সব ব্যবস্থা হয়ে আছে।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, হঠাৎ এত খাতির শুরু করলে কেন, ঠিক করে বলো তো?
বিল বলল, আপনি তো কাল দেখলেন স্যার, রবার্টটা কীরকম নিমকহারাম। তিরিশ হাজার ডলার দেবে বলেছিল, কথার খেলাপ করে দিল কুড়ি হাজার। তখন থেকেই আমি রাগে ফুঁসছিলাম। পুলিশক্যাম্পে গিয়ে অন্যদের সঙ্গে সেই কথা আলোচনা করেছি। ওদের একজন একটা দারুণ কথা বলল। এই পবন লোহিয়া সম্পর্কে কোনও সংবাদ জানাতে পারলে একটা বিরাট পুরস্কার ঘোষণা করেছে ওঁর এক ভাই। আমরা যদি পবন লোহিয়াকে রবার্টদের কাছ থেকে উদ্ধার করে নিরাপদে পৌঁছে দিয়ে আসতে পারি, তা হলে সেই পুরস্কারের টাকা অনায়াসে আমরা চারজনে ভাগ করে নিতে পারি। সেটা হবে অনেস্ট উপার্জন, তাই না?
পবন বললেন, সেটা তো আগেই করতে পারতে?
বিল্ বলল, আগে ঠিক জানতাম না আপনাকে কোথায় রেখেছে। কাল রাত্তিরে সব জানলাম। তাই আমরা চারজন প্ল্যান করে শেষ রাত্তিরে আজ রবার্টের ডেরায় গিয়ে হানা দিলাম। ওরা তৈরি ছিল না, আমাদের দেখে প্রথমে কোনও সন্দেহ করেনি।
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, আমরা গোলাগুলির আওয়াজ শুনেছি।
বিল্ বলল, ওরা সবকটা দারুণ আহত। বেঁধে রেখে এসেছি। আপনাদের খুবই কষ্ট হয়েছে স্যার, সেজন্য আমি ক্ষমা চাই। এর মধ্যেই যে কোনও সিংহ এসে আপনাদের উপর থাবা বসায়নি, সেজন্য ভগবানকে ধন্যবাদ!
এতক্ষণ ধরে বেঁধে রাখার জন্য সারা শরীর আড়ষ্ট হয়ে গেছে। কাকাবাবু আর লোহিয়া দুজনেই দুহাত ওপরে আর নীচে করলেন কয়েকবার।
বিল্ যাতে বুঝতে না পারে, এজন্য কাকাবাবু হিন্দিতে লোহিয়াকে বললেন, এই বিল নামের লোকটা আমাদের মুক্তি দিল বটে, কিন্তু ওর দিকে তাকাতেই আমার ঘেন্না হচ্ছে।
লোহিয়া একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কেন?
কাকাবাবু বললেন, লোকটা দারুণ অর্থলোভী। ও ন্যায়-নীতি কিছু বোঝে না। শুধু টাকা আর টাকা। আগের দিন কত ভাল ব্যবহার করেছিল আমার সঙ্গে। কী বিনীত ভাব। আমি তখন একটুও বুঝতে পারিনে যে ও লোকটা পুরো ছক কষে আমাকে এখানে টেনে এনেছে রবার্টের কাছে বিক্রি করে দেবার জন্য। কী নির্লজ্জ। রবার্ট ওকে কিছু টাকা কম দিয়েছে বলে এখন আবার রবার্টকে মেরে আমাদের মুক্তি দিতে এসেছে, আরও বেশি টাকা পাবার জন্য। আপনাকে ফেরত পাবার জন্য ভাই অনেক টাকার পুরস্কার ঘোষণা করেছে। সেই টাকাটা এই বিল পাবে ভেবে আমার খুব খারাপ লাগছে!
লোহিয়া বললেন, তুমি ঠিকই বলেছ। এদের বিবেক বলে কিছু নেই। কিন্তু পুরস্কারের টাকা যখন ঘোষণা করা হয়ে গেছে, তখন তো এদের দিতেই হবে। অস্বীকার তো করা যাবে না!
কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে। টাকাটা ওকে দেওয়া হোক। তারপর আমি সবার সামনে ওর দুগালে দুটো থাপ্পাড় কষাব। ও আমাকে অপমান করেছে। আমাকে কেউ অপমান করলে আমি প্রতিশোধ না নিয়ে ছাড়ি না।
লোহিয়া বললেন, এখন অন্তত তোমার রাগটা একটু সামলে রাখো। আগে আমাদের বিশ্রাম নেওয়া দরকার।
বিল্ কাছে এসে বললেন, চলুন স্যার। আজই আমরা এখান থেকে চলে যাবার ব্যবস্থা করব।
কাকাবাবুর দিকে ফিরে সে বলল, মি. রায়চৌধুরী, এখান থেকে খানিকটা হেঁটে যেতে হবে। এদিকে গাড়ি আসে না। আপনার কষ্ট হবে। কিন্তু কোনও উপায় নেই।
কাকাবাবু বললেন, আমার ক্রাচদুটো থাকলে কোনও অসুবিধে হত না–?
লোহিয়া বললেন, তাই তো ক্রাচ ছাড়া তুমি হাঁটবে কী করে? দুজন লোক যদি তোমাকে ধরে ধরে নিয়ে যায়—
বিল বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, সে ব্যবস্থা করতে পারি। আমি ডাকছি।
কাকাবাবু তাকে বাধা দিয়ে বললেন, আমার লোক দরকার নেই। আমি এক পায়ে লাফিয়ে লাফিয়েই যাব। চলো—
বি বললেন, তাড়াতাড়ি এ জায়গাটা পার হতে হবে। কখন আবার সিংহ টিংহ এসে পড়ে।
ভোরের আলো ভাল করে ফুটো গেছে। আকাশটা যেন বেশি বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে আজ।
সবাই মিলে হ্রদের ধার দিয়ে লাইন করে এগোতে লাগল। এক পায়ে লাফাতে লাফাতে এগোতে কাকাবাবুর যে কত কষ্ট হচ্ছে, তা অন্য কারুকে তিনি বুঝতে দিলেন না।
মিনিট পাঁচেক যাবার পরই একটা দারুণ কোলাহল শোনা গেল। কারা যেন এই দিকেই ছুটে আসছে।
হয়তো আহত রবার্টসই অন্য লোকজন জোগাড় করে আসছে। বিলের সঙ্গী পুলিশ তিনজন রাইফেল বাগিয়ে দাঁড়াল।
দু-এক মিনিট পরেই দেখা গেল, পুলিশ নয়, একদল মাসাই ছুটে আসছে। এদিকে। অন্তত পঁচিশ-তিরিশজন তো হবেই। তাদের সকলেরই হাতে বর্শা আর ঢাল।
দারুণ ভয় পেয়ে বিল বলে উঠল, ওরে বাবা রে! ওরা কেন আসছে!
একজন পুলিশ বলল, বোধহয় কোনও সিংহকে তাড়া করেছে।
কিন্তু কোনও সিংহ কিংবা আর কোনও প্রাণীকে দেখা গেল না। মাসাইরা দুর্বোধ্য ভাষায় চিৎকার করতে করতে এসে ঘিরে ফেলল এই দলটাকে।
পুলিশরা বন্দুক চালাতে সাহস করল না। সবাই জানে, একজন মাসাইকে মারলে শত শত মাসাই এসে প্রতিশোধ নিতে চাইবে।
এখন চুপচাপ থাকাই ভাল। দেখাই যাক না এরা কী চায়।
মাসাইরা তিনজন পুলিশ আর বিলকে টানতে টানতে এক জায়গায় নিয়ে দাড় করাল। বিল কিছু বলতে যেতেই ওদের যে সর্দার সে বিলের চুলের মুঠি ধরে ঝাকানি দিল একবার। তারপর সেই সর্দার এসে দাঁড়াল কাকাবাবুর সামনে। সর্দারটি যেমন লম্বা, তেমনই চওড়া। একটা আলখাল্লা পরা, গলায় অনেক পুঁতির মালা।
সে কাকাবাবুর দিকে অপলক ভাবে তাকিয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত।
কাকাবাবুর বুকটা কেঁপে উঠল একবার। এই বিশাল চেহারার মানুষটি যদি তাকে মারতে শুরু করে কিংবা বুকে বর্শা বিঁধিয়ে দেয়, তিনি আত্মরক্ষা করবেন কী করে?
সর্দারটি কী যেন বলল কাকাবাবুকে। দুর্বোধ্য ভাষা, তিনি কিছুই বুঝলেন না।
তিনি তাকালেন লোহিয়ার দিকে।
লোহিয়া সোয়াহিলি ভাষা জানেন। তিনি এবার সর্দারকে কিছু বললেন।
সর্দার সরে গেল লোহিয়ার দিকে। তারপর দুজনে বেশ কিছুক্ষণ কথা হল। কাকাবাবু দাঁড়িয়ে রইলেন নিঃশব্দে।
হঠাৎ একসময় কথা থামিয়ে সর্দারটি আবার কাকাবাবুর কাছে এসে হাত রাখল তার ঘাড়ে।
কাকাবাবু চমকে পিছিয়ে যাবার চেষ্টা করতেই লোহিয়া বললেন, নড়বেন না, নড়বেন না।
সর্দারটি কাকাবাবুর ঘাড়ে দুবার চাপড় মেরে ঘুরে দাঁড়াল। তারপর চিৎকার করে কিছু বলতেই সবাই ফিরতে শুরু করল। সঙ্গে করে নিয়ে গেল বিল্ আর অন্য পুলিশদের।
এক মিনিটের মধ্যে জায়গাটা পুরো ফাঁকা হয়ে গেল।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপারটা হল বলুন তো লোহিয়াজি? লোহিয়া হাসিমুখে বললেন, আমরা মুক্ত! আমাদের আর কেউ বিরক্ত করবে না।
কাকাবাবু বললেন, মুক্ত? ফ্রি? কী করে হল?
লোহিয়া বললেন, এই জায়গাটায় কোনওরকম গোলাগুলি চালানো নিষেধ। আগ্নেয়গিরির মধ্যে বেশি আওয়াজ হলে পরিবেশ নষ্ট হতে পারে। শেষ রাতে রবার্ট আর বিলের দলের মধ্যে গুলি চলেছে, সে আওয়াজ তো আমরাও শুনেছি। মাসাইরা এই আওয়াজ সহ্য করতে পারে না। সেইজন্য ওরা বিলের দলকে ধরে নিয়ে গেল, এখন ওদের বিচার আর শাস্তি হবে।
কাকাবাবু বললেন, আর আমাদের ছেড়ে দিল?
লোহিয়া বললেন, আমি সব ঘটনাটা জানালাম। আমাদের তো কোনও দোষ নেই। আমরা বিদেশি বলে, আমাদের খাতির করে গেল। আপনার কঁধ চাপড়ানো সেই জন্য! শুধু তাই নয়, আপনার হাঁটতে কষ্ট হবে বলে ও আমাদের জন্য দুটো ঘোড়া পাঠিয়ে দেবে বলল। একটু বাদেই ঘোড়া দুটো এসে যাবে!
কাকাবাবু দুহাত ছাড়িয়ে বললেন, আঃ, কী ভাল লাগছে। তার মানে, ওই হতভাগা বিটাকে আপনার পুরস্কারের টাকা দিতে হবে না?
লোহিয়া বললেন, না! আর কেন ও টাকা পাবে? ও তো আমাদের উদ্ধার করে নাইরোবি পৌঁছে দিচ্ছে না। তা ছাড়া, মাসাইদের হাতে ওরা এখন কী শাস্তি পাবে কে জানে।
কাকাবাবু বললেন, বেশ হয়েছে।
তারপরই আবার সঙ্গে সঙ্গে বললেন, আপনার এই পুরস্কারের টাকাটা এই মাসাইদের দেওয়া উচিত। ওরাই তো আমাদের সম্মানের সঙ্গে মুক্তির ব্যবস্থা করল!
লোহিয়া বললেন, আমি ওদের জন্য একটা হাসপাতাল বানিয়ে দেব, আগেই ঠিক করেছি।
কাকাবাবু বললেন, হাসপাতাল করে দেবেন, তা ভাল কথা। আপনার পুরস্কারের টাকাটাও এই মাসাইয়ের দলটাকে ভাগ করে দেওয়া উচিত।
লোহিয়া বললেন, ঠিক আছে। তাও দেব!
কাকাবাবু বললেন, আমার পা খোঁড়া, না হলে এখন একটু নাচতাম।
পবন লোহিয়া লেকের কাছে গিয়ে এক আঁজলা জল তুলে নিয়ে বললেন, পৃথিবীতে এত হিংসে, হানাহানি, তবু পৃথিবীটা বড় সুন্দর!
পাশে দাঁড়িয়ে কাকাবাবু বললেন, বেঁচে থাকাটাই বড় সুন্দর। ইট ইজ ওয়ান্ডারফুল টু বি অ্যালাইভ!
————-
সমাপ্ত
————
পুনশ্চ: রবার্ট কিকুইউ-কে খুবই আহত অবস্থায় ভরতি করা হয় হাসপাতালে। সেখানে পরের দিনই তার মৃত্যু হয়। কাকাবাবু আর পবন লোহিয়া নাইরোবিতে পৌঁছোবার পর, দুদিন পরেই শুরু হয় ফিলিপ কিকুইউ-এর নামে মামলা। নদিন বিচার চলে। তারপর তার সারা জীবনের জন্য কারাদণ্ড হয়।
তখন কেউ কেউ সেই দণ্ড শুনে বলেছিলেন, ও মোটেই সারা জীবন জেলে থাকবে না। নানা জায়গায় ঘুষ দিয়ে ঠিক বেরিয়ে আসবে। কিন্তু বিচার শেষ হওয়ার পাঁচদিন পরেই সে জেলের মধ্যে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে।
এই দুই দুর্দান্ত অপরাধীর মৃত্যুর পর কেনিয়া-তানজানিয়ায় চোরাশিকার আর পশুচালান প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশও অনেক সংযত হয়েছে।
————-