৮ম অধ্যায়
কর্ণবধে ধৃতরাষ্ট্রবিলাপ
জনমেজয় কহিলেন, হে তপোধন! মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র মহাবীর কর্ণ ও সমরে অপরাঙ্মুখ পুত্রগণকে নিহত শ্রবণে, আত্মীয়নাশ ও পুত্রবিয়োগজনিত দুঃখে নিতান্ত কাতর হইয়া যাহা কহিয়াছিলেন, আপনি তাহা কীৰ্ত্তন করুন; উহা শ্রবণ করিতে আমার অতিশয় অভিলাষ হইতেছে।
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! রাজা ধৃতরাষ্ট্র অদ্ভুত ব্যাপারের ন্যায় নিতান্ত অশ্রদ্ধেয়, ভূতসংমোহন, সুমেরুসঞ্চারণের ন্যায়, মহামতি শুক্রাচার্য্যের বুদ্ধিবিভ্রমের ন্যায়, মহাবলপরাক্রান্ত ইন্দ্রের শক্তহস্তে পরাজয়ের ন্যায়, মহাতেজস্বী সূর্য্যের ভূতলপতনের ন্যায়, অনন্তের সলিলযুক্ত মহাসাগর শোষণের ন্যায়, ভূমণ্ডল, নভোমণ্ডল, দিঙ্মণ্ডল ও সলিলরাশির অত্যন্তাভাবের ন্যায় এবং পুণ্য ও পাপের বৈকল্যের ন্যায় নিতান্ত অদ্ভুত ও অশ্রদ্ধেয় কর্ণবিনাশবৃত্তান্ত একান্তমনে চিন্তা করিয়া, ‘সৰ্ব্বনাশ হইল, অবশিষ্ট সৈন্যগণও বিনষ্ট হইবে’ বলিয়া স্থির করিলেন, এবং শোকসন্তপ্তচিত্তে শিথিলকলেবরে দীনভাবে ‘হা হতোস্মি’ বলিয়া দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বকবিলাপ ও পরিতাপ করিয়া কহিলেন, “হায়! যাহার বলবিক্রম সিংহ ও মাতঙ্গের ন্যায় এবং স্কন্ধ ও চক্ষু বৃষভের ন্যায়; যাহার জ্যানির্ঘোষ, তলধ্বনি ও শরবর্ষণশব্দে রথী, অশ্ব ও মাতঙ্গগণ রণস্থলে অবস্থান করিতে অসমর্থ হইত; যে বীর বৃষভের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত বৃষভের ন্যায় দেবরাজ ইন্দ্রের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইয়াও প্রতিনিবৃত্ত হইত না এবং জিগীষাপরবশ দুর্য্যোধন যাহার বাহুবল অবলম্বনপূর্ব্বক পাণ্ডবগণের সহিত বৈরানল প্রজ্বলিত করিয়াছে, সেই দুঃসহপরাক্রম পুরুষপ্রবর মহাবীর কর্ণ সহসা কিরূপে অর্জ্জুনশরে নিহত হইল? যে স্বীয় ভূজবীর্য্যে গর্ব্বিত হইয়া বাসুদেব, অর্জ্জুন এবং বৃষ্ণিবংশীয় ও অন্যান্য ভূপালগণকে লক্ষ্যই করিত না, যে বীর ‘আমি কৃষ্ণ ও অর্জ্জুনের অন্যতরকে রথ হইতে নিপাতিত করিব’ বলিয়া রাজ্যলোলুপ লোভবিমোহিত ভয়ার্ত্ত দুর্য্যোধনকে বারংবার আশ্বাস প্রদান করিত, হে মহাবীর দুৰ্য্যোধনের অভ্যুদয়ের নিমিত্ত নিশিত শরনিকরে কাম্বোজ, অবন্তি, কেকয়, গান্ধার, মদ্রক, মৎস্য, ত্রিগৰ্ত্ত, অঙ্গন, অশক, পাঞ্চাল, বিদেহ, কুলিন্দ, কৌশল, কাশি, সুহ্ম, অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, নিষাদ, পুন্ড্র, চীন, বৎস, তরল, অশ্বক ও ঋষিকদিগকে পরাজয় করিয়া আমাদের অধীন ও করপ্রদ করিয়াছিল, সেই দিব্যাস্ত্রবেত্তা সেনাপতি কর্ণ কিরূপে পাণ্ডবগণকর্ত্তৃক নিহত হইল? দেবগণমধ্যে ইন্দ্র ও মনুষ্যগণমধ্যে কর্ণই শ্রেষ্ঠ; এই ত্রিলোক মধ্যে আর তৃতীয় শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি নাই। অশ্বগণমধ্যে উচ্চৈঃশ্রবা, ভূপালগণমধ্যে বৈশ্রবণ [কুবের], দেবগণমধ্যে মহেন্দ্র ও শস্ত্রবর্ষীদিগের মধ্যে কর্ণই শ্রেষ্ঠ। তিনি দুৰ্য্যোধনের উন্নতির নিমিত্ত বলবীৰ্য্যশালী পার্থিবগণের সহিত সমগ্র পৃথিবী জয় করিয়াছিলেন। মগধরাজ জরাসন্ধ যাঁহাকে মিত্রভাবে প্রাপ্ত হইয়া যাদব ও কৌরবগণ ব্যতিরেকে আর পৃথিবীস্থ সমস্ত ক্ষত্রিয়কে সমরে আহ্বান করিয়াছিলেন, আমি সেই মহাবীর কর্ণকে দ্বৈরথ যুদ্ধে অর্জ্জুনহস্তে নিহত শ্রবণ করিয়া সাগরমধ্যে বিদীর্ণ নৌকার ন্যায় ও সমুদ্রমধ্যস্থ প্লবহীন [নৌকাদি আশ্রয়] মনুষ্যের ন্যায় শোকার্ণবে নিমগ্ন হইতেছি। হে সঞ্জয়! যখন আমি ঈদৃশ দুঃখ প্রাপ্ত হইয়াও বিনষ্ট হইলাম না, তখন বোধ হইতেছে, আমার হৃদয় বজ্র অপেক্ষাও কঠিন ও দুর্ভেদ্য। হায়! আমা ভিন্ন কোন্ ব্যক্তি জ্ঞাতি, সম্বন্ধী ও মিত্রগণের এইরূপ পরাভব শ্রবণ করিয়া প্রাণ পরিত্যাগ না করে? আমি আর এই সমস্ত কষ্ট সহ্য করিতে পারি না; এক্ষণে বিষভক্ষণ, অগ্নিপ্রবেশ বা পর্ব্বতশিখর হইতে পতনদ্বারা প্রাণত্যাগ করিবার বাসনা করি।”