ওদের সকলের পৌঁছাবার আগেই কিরীটী সুশীল নন্দীর ওখানে পৌঁছে গিয়েছিল। কিরীটী সুশীল নন্দীকে আগেই ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিল, থানার মধ্যে নয়—সম্ভব হলে ঐ বিলডিংয়েরই দোতলায় সুশীল নন্দীর কোয়ার্টার্স-এ সে সকলের সঙ্গে দেখা করতে চায়। সুশীল নন্দী বলেছিল, তাতে কোন অসুবিধা হবে না, কারণ তার স্ত্রী কিছুদিনের জন্য বাপের বাড়ি গিয়েছেন–তার কোয়াটার্স খালি।
কিরীটী ও সুব্রত সুশীল নন্দীর দোতলার বসবার ঘরে ঢুকে দেখলো—দুটি যুবকের সঙ্গে বসে সুশীল নন্দী কি সব আলোচনা করছেন!
কিরীটীদের ঘরে ঢুকতে দেখে সুশাল নন্দী বললেন, আসুন মিঃ রায়, সকলে এখনো এসে পৌঁছাননি, মাত্র দুজন এসেছেন—মণিময়বাবু, ক্ষিতীশবাবু—ইনি কিরীটী রায়, সরকারের পক্ষ থেকেই উনি আপনাদের সকলের সঙ্গে মিত্রানী দেবীর হত্যার ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে চান।
মণিময় দত্ত ও ক্ষিতীশ চার্ক যুগপৎ একসঙ্গে সুশীল নন্দার কথায় কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল, কিরীটীও ওদের দিকে তাকিয়েই আছে তখন, দুজনারই বয়স বত্রিশ থেকে চৌত্রিশের মধ্যে। মণিময়ের গায়ের রংটা কালো হলেও চোখে মুখে একটা আলগা শ্ৰী আছে—বেশ বলিষ্ঠ, সুগঠিত চেহারা। উচ্চতায় মাঝারি। মাথায় বড় বড় চুল। ঘাড়ের . দিকে যেন একটু বেশীই, লংস ও একটা হাওয়াই শার্ট পরনে। পায়ে কালো চপ্পল।
ক্ষিতীশ চাকী একটু বেঁটেই-তবে রোগা পাতলা চেহারার জjj তেমন বেঁটে মনে হয় না, গায়ের রং তামাটে, মনে হয় কোন এক সময় গৌর ছিল, এখন রোদে জলে ঘুরে ঘুরে তামাটে বর্ণ ধারণ করেছে, তৈলহীন রুক্ষ একমাথা চুল–কিছু কিছু চুলে পাক ধরেছে। ইতিমধ্যে। নাকটা একটু চাপা, ছোট কপাল, গালের হাড় দুটো প্রকট। বুদ্ধিদীপ্ত চঞ্চল দুটো চোখের দৃষ্টি।
কথা বললে ক্ষিতীশ চাকীই, সুশীলবাবু একটু আগেই বলছিলেন, আপনি আমাদের সঙ্গে কথা বলতে চান বলেই বিশেষ করে আমাদের সকলকে আজ এখানে ডাকা হয়েছে। কিন্তু আমরা যা জানি সবাই তো সেদিনই বলে ওর খাতায় সই করে দিয়েছি! কথার মধ্যে একটা ঝাঁঝ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
কিরীটী মৃদু হেসে বললো, ঠিকই ক্ষিতীশবাবু, আমি ঠিক সেজন্য আপনাদের এখানে আজ আসবার জন্য ওঁকে বলতে বলিনি–
তবে? ক্ষিতীশের প্রশ্ন।
দেখুন আমি একটু ভিতরের কথা জানতে চাই। কিরীটী বললে।
ভিতরের কথা মানে? প্রশ্নটা করে ক্ষিতীশ চাকী কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল।
আপনাদের সকলের পরস্পরের সঙ্গে তো দীর্ঘদিনের পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা—তাই—
কি তাই? বলুন, থামলেন কেন?
মিত্রানী সম্পর্কে আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়ত এমন অনেক কথা জানেন যেটা জানাতে পারলে আপনাদের কাছ থেকে মিত্রানীর হত্যারহস্য উদঘাটনের ব্যাপারে আমার কিছুটা সাহায্য হতে পারে। যেমন ধরুন মিত্ৰানী এতদিন বিয়ে করেনি কেন? তার বাবাকে বিয়ের কথায় সে বলেছে সময় হলে জানাবো
ক্ষিতীশ চাকী বললে, তাই নাকি-তা সেরকম কিছু আমি শুনিনি। তাছাড়া ওটা তার তো পার্সোনাল ব্যাপার–
ঠিকই—আমার জিজ্ঞাস্য হচ্ছে, কিরীটী বললে, মিত্রানী কাউকে ভালবাসত কিনা জানেন? কিংবা অন্য কেউ মানে আপনাদের মধ্যে তাকে কেউ ভালবাসত কিনা বা তার। প্রতি কোনরকম দুর্বলতা ছিল কিনা কারো
ক্ষিতীশ চাকী বললে, কাউকে মিত্রানী ভালবাসতো কি বাসত না আমি জানি না—তা নিয়ে কোনদিন আমার কোন মাথাব্যথা ছিল না। আর দুর্বলতার কথা যদি বলেন, আমার তার প্রতি এতটুকুও দুর্বলতা ছিল না, কলেজ ছাড়বার পরও বড় একটা দেখাসাক্ষাৎ-ই হতো না।
আচ্ছা ক্ষিতীশবাবু, ক্ষি তীশের কথাগুলো শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেন প্রশ্নটা করলো হঠাৎ কিরীটী-মিত্রানীর হত্যার ব্যাপারে কাউকে আপনি সন্দেহ করেন?
ব্যাপারটা এত অবিশ্বাস্য ও বিস্ময়কর যে, ঐ ব্যাপারে কোন কিছু মাথায়ই এখনো আসছে না। না মশাই, কাউকে আমি সন্দেহ করি না!
আচ্ছা ক্ষিতীশবাবু, আপনাকে আর আমাদের প্রয়োজন নেই। আপনি যেতে পারেন।
ধন্যবাদ। ক্ষিতীশ চাকী সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল এবং দরজার দিকে এগুতেই কিরীটীর শেষ কথাটা তার কানে এলো।
পুলিসের কিন্তু ধারণা—আপনাদেরই মধ্যেই একজন সেদিন—
কি, কি বললেন! চকিতে ঘুরে দাঁড়ায় ক্ষিতীশ।
কিরীটী কথাটা তার শেষ করে, মিত্রানীকে—না—কিছু না-আপনি যান।
ইউ মীন সাম ওয়ান অব আস মিত্রানীকে হত্যা করেছি!
তাই।
বলিহারি বুদ্ধি! বরাবরই আমার ধারণা, বেশীর ভাগ পুলিসের লোকেরই বুদ্ধি বলে কোন পদার্থ নেই। এখন দেখছি–
সুশীল নন্দী বাধা দিলেন গম্ভীর গলায়—ক্ষিতীশবাবু, আপনি যেতে পারেন।
প্রথমে সুশীল নন্দী ও পরে কিরীটীর প্রতি ক্রুদ্ধ দৃষ্টি হেনে ক্ষিতীশ চাকী ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
মণিময় এতক্ষণ চুপ করে বসেছিল। এবারে সে কিরীটীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, সত্যি কিরীটীবাবু! তার গলায় রীতিমত একটা উদ্বেগ যেন প্রকাশ পেল।
কি সত্যি মণিময়বাবু? মৃদু হেসে কিরীটী প্রশ্ন করে। বস্তুত এতক্ষণ সে মৃদু মৃদু . হাসছিল।
ঐ যে ক্ষিতীশ বলে গেল, আ–আপনাদের তাই ধারণা নাকি?
কিরীটী শান্ত গলায় এবারে জবাব দিল, তা যদি ধরুন হয়ই, সেটা কি খুব একটা অপ্রত্যাশিত কিছু–
না, না—কিরীটীবাবু, এ হতেই পারে না, আপনি বিশ্বাস করুন।
আপাতত ঐ কথা থাক, আগে আমার প্রশ্নটার জবাব দিন। মিত্রানীকে আপনাদের মধ্যে কেউ ভালবাসততা কি না আপনি কিছু জানেন? বা তার আপনাদের কারোর প্রতি কোন আকর্ষণ বা দুর্বলতা ছিল কিনা—
দেখুন কিরীটীবাবু, আমি ঠিক জানি না—আমি তার সঙ্গে কখনো সেরকম ভাবে মিশিনিসহপাঠিনী হিসাবে সামান্য যা পরিচয়—
মণিময়ের কথা শেষ হলো না, সিঁড়িতে অনেকগুলো পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলেরই দৃষ্টি একসঙ্গেই যেন খোলা দরজার উপর গিয়ে পড়লো। অমিয় রায়, সতীন্দ্র সান্যাল সর্বপ্রথমে এবং তাদের পশ্চাতে কাজল বোস, পাপিয়া চক্রবর্তী ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করলো।
সুশীল নন্দীই সকলকে আহ্বান জানালেন—আসুন আসুন, তা বিদ্যুৎবাবু আর সুহাসবাবুকে দেখছি না! তারা এলেন না?
জবাব দিল সতীন্দ্র সান্যাল, তাদেরও আসার কথা নাকি!
হ্যাঁ—আমি তো সকলকেই লোক মারফৎ চিঠি দিয়ে পাঠিয়েছি আলাদা আলাদা ভাবে আসবার জন্য।
কিন্তু চিঠিতে তো সে কথা লেখা ছিল না, শুধু আমাকেই আসবার কথা লেখা ছিল, সতীন্দ্র বললে।
সুশীল নন্দী বললেন, তা আপনারা সব একত্রে এলেন কি করে?
সুশীল নন্দীর কথায় ওরা সবাই পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়। তখন অমিয়ই বললে, হাওড়া ব্রীজের কাছে একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়ে বিশ্রী জ্যাম হয়েছে—তাই সকলেই আমরা যে যার যানবাহন ছেড়ে হাঁটতে হাঁটতে ব্রীজের উপর দিয়ে একে অন্যের দেখা পাই—পরে ব্রীজ পার হয়ে হাওড়া ময়দান পর্যন্ত হেঁটে এসে সকলে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে আসছি–
ও তাই বলুন—তা আপনারা দাঁড়িয়ে কেন, বসুন—
সকলের দৃষ্টিই তখন মণিময়ের প্রতি নিবন্ধ—মনে হচ্ছে সকলের মনের মধ্যেই যেন একটা সংশয় দেখা দিয়েছে, কিন্তু কেউ কিছু বললো না, ঘরের মধ্যে সকলের জন্যই আসনের ব্যবস্থা ছিল, একে একে সব চেয়ার টেনে বসে পড়ল।