ঐদিনই সন্ধ্যার দিকে।
বাংলোর পিছনদিকে পশ্চিমের বারান্দায় মিঃ ডিবরাজ, মিঃ রামিয়া ও কিরীটী বসে গল্প করছিলেন।
কৃষ্ণাও এতক্ষণ ছিল, এইমাত্র ভিতরে গিয়েছে ডিনারের ব্যবস্থা করতে।
পূর্ণিমার রাত বোধ হয়।
মস্ত বড় চাদ উঠেছে।
সামনে যতদূর দেখা যায় চন্দ্রালোকিত সাগর মাতামাতি করছে। ঢেউয়ের মাথায় মাথায় চাঁদের আলো যেন পিছলে পড়ছে।
কিরীটী বললে, মিঃ ডিবরাজ, পরশু আমরা ঠিক করেছি সন্ধ্যার পরই এখানে আসব।
কিন্তু ওদের ডিমাণ্ড মত টাকা না দিলে—
দিলেও ওদের আপনি নিবৃত্ত করতে পারবেন না। বরং দেখবেন ঐ ড্রাগনের লোভ আরো বেড়েই গিয়েছে। হলুদ শয়তানকে আপনি চেনেন না!—কিরীটী বললে।
হলুদ শয়তান!
হ্যাঁ, ডাঃ ওয়াং-লোকটা শুধু ক্রিমিন্যালই নয়—মূর্তিমান শয়তান।
কিন্তু–
আপনি কিছু ভাববেন না।
হঠাৎ ঐ সময় সিজারের ক্রুদ্ধ ডাক শোনা গেল দূরে।
সিজার-সিজার অমন করে ডাকছে কেন, বলতে বলতে তাড়াতাড়ি উঠে পড়লেন মিঃ ডিবরাজ এবং দ্রুতপায়ে বাড়ির পিছনদিককার বাগানের দিকে চলে গেলেন।
কিরীটীও সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়ে ওঁকে অনুসরণ করে।
সিজারের ডাক শোনা যাচ্ছে–
কিরীটী ডিবরাজকে বেশীদূর অনুসরণ করতে পারে না, তার আগেই একটা সিনামোনের ঝোপের আড়ালে তিনি চলে গেছেন।
তবু কিরীটী এগুতে থাকে।
মিঃ ডিবরাজ-মিঃ ডিবরাজ যাবেন না—ফিরুন! কিরীটী চেঁচিয়ে ডাকল।
কোন সাড়া পাওয়া গেল না মিঃ ডিবরাজের।
সিজারের কুদ্ধ গর্জন আর একবার শোনা গেল।
তারপরই হঠাৎ যেন সব স্তব্ধ।
কিরীটী তবু এগিয়ে যায়।
হঠাৎ ঐ সময় রাত্রির স্তব্ধতাকে দীর্ণ করে পর পর দুটো গুলির আওয়াজ শোনা গেল।
ইন্সপেক্টার মিঃ রামিয়াও ততক্ষণে তার পিস্তলটা মুঠোয় চেপে ঐদিকে ছুটে আসছেন।
গাছগাছালিতে একেবারে জায়গাটা যেন বেশী দুর্ভেদ্য।
মাথার উপর আবছা আলো থাকলেও নিবিড় গাছ-গাছালির জন্য ঐ জায়গাটায় একটা আবছা আলোছায়া।
ভাল করে নজরে পড়ে না।
কিরীটী তথাপি এগিয়ে যায়।
হঠাৎ সামনে পড়ল একটা দীঘি।
দীঘির চারপাশে বড় বড় ঘাস গজিয়েছে। দুরে সীমানায় তারের বেড়া।
কিরীটী এদিক-ওদিক তাকায়, কিন্তু কোথাও মিঃ ডিবরাজকে দেখতে পায় না।
কুকুরের ডাকও আর শোনা যাচ্ছে না তখন।
কেবল একটানা ঝিঁঝির ডাক।
হঠাৎ নজরে পড়ল কিরীটীর, ডানদিকের ঝোপ থেকে কে একজন বের হয়ে আসছে।
কে? মিঃ ডিবরাজ না? হ্যাঁ, তিনিই—
মিঃ ডিবরাজ? দুপা এগিয়ে গিয়ে কিরীটী ডাকল।
মিঃ রায়?
সিজার-সিজার কোথায়?
আসুন। ভাঙা গলায় মিঃ ডিরাজ জবাব দিলেন।
কোথায়?
He is dead!
Dead? কে?
সিজার। ডিবরাজের সঙ্গে এগিয়ে গেল কিরীটী সামনের দিকে কিছুটা।
একটা পাম-ট্রির নীচে এগিয়ে এসে মিঃ ডিবরাজ বললেন, ঐ যে—
কিরীটী দেখল, সিজারের দেহটা মাটিতে পড়ে আছে।
কিরীটী আরও এগিয়ে গেল।
নীচু হয়ে দেখল।
চাঁদের আলোয় এবারে তার নজরে পড়ল, মৃত সিজারের পেটে একটা লোহার সরু শলার মত কি বিঁধে আছে। পকেট থেকে রুমাল বের করে কিরীটী সিজারের মৃতদেহ থেকে শলাটা টেনে বের করে চাঁদের আলোয় চোখের সামনে তুলে ধরল।
দেড়বিঘৎ পরিমাণ, লোহার শলা নয়—একটা তীর, অগ্রভাগটা সামান্য চেপ্টা, কিন্তু ছুঁচলো।
কিরীটী বললে, মনে হচ্ছে বিষের তীর এটা—
বিষের তীর! ডিবরাজ শুধালেন।
হ্যাঁ, খুব সম্ভব তীরের ফলায় কোন তীব্র মারাত্মক বিষ মাখানো ছিল, যে বিষের ক্রিয়াতেই আপনার সিজারের সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় মৃত্যু হয়েছে। চলুন, আর এখানে থেকে কি হবে, ভিতরে চলুন।
মিঃ ডিবরাজকে নিয়ে কিরীটী পশ্চিম দিককার বারান্দায় ফিরে এল।
মিঃ রামিয়া আর কৃষ্ণা দুজনেই বারান্দায় উৎকণ্ঠিত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।
কি হয়েচে ড্যাডি? কৃষ্ণা শুধায়।
কৃষ্ণা, সিজার মারা গেছে! কান্না-ধরা-গলায় মিঃ ডিবরাজ বললেন।
মারা গেছে?
হ্যাঁ।
কী করে?
কিরীটী হাতের তীরটা তুলে ধরে বললে, এই বিষাক্ত তীরে।
কোথা থেকে এল এটা?
সম্ভবত রক্তমুখী ড্রাগনের কোন অনুচরেরই কাজ এটা। কিরীটী বললে।
রক্তমুখী ড্রাগন!
হ্যাঁ কৃষ্ণা, মিঃ ডিবরাজ ভাঙা গলায় বললেন, তোমাকে জানাইনি, রক্তমুখী ড্রাগন আমাকে চিঠি দিয়েছে
কবে? কখন?
দিনকয়েক আগে।
আহারে আর কারুরই রুচি ছিল না।
সবাই খাদ্যবস্তু নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল যেন।
সিজারের আকস্মিক মৃত্যুর বিষণ্ণতা যেন সকলের মনকেই আচ্ছন্ন করে ফেলছিল।
কিরীটী একসময়ে বললে, সিজার থাকলে তাদের সুবিধা হবে না, তাই তারা সিজারকে হত্যা করেছে মিঃ ডিবরাজ!
আর আমার সাহস হচ্ছে না মিঃ রায়। মিঃ ডিবরাজ বললেন।
মিঃ রামিয়া বললেন, ভয় পাবেন না মিঃ ডিবরাজ-আমাদের প্রহরা কাল থেকে আরো কড়া হবে।
কিরীটী কোন কথা বলে না, চুপ করে কি যেন ভাবে।
কৃষ্ণাও চুপচাপ একেবারে।
অনেক রাত্রে ওরা বিদায় নিল।