সুশান্ত বলে, বিশ্বাস করুন, বিশ্বাস করুন মিঃ রায়, তাকে আমি হত্যা করিনি। সে আমার স্ত্রী–
আমি বিশ্বাস করলেই কিছু হবে না মিঃ চ্যাটার্জি। আইনকে বিশ্বাস করাতে হবে।
আইন?
হ্যাঁ, আপনি বলুন—কেন এসেছিলেন?
বলতে পারলে আমি বলতাম মিঃ রায়, কিন্তু—
ঠিক আছে, বলবেন না। কিন্তু এ কথাটা তো আর অস্বীকার করবেন না যে মিত্ৰাণী দেবীকে আপনি ভালবাসেন?
না, না—এ কি বলছেন?
আপনি ভালবাসেন মিঃ চ্যাটার্জি, অস্বীকার করে লাভ নেই।
আপনি বিশ্বাস করুন মিঃ রায়–
একটা কথা কি জানেন মিঃ চ্যাটার্জি, কিরীটী শান্ত গলায় বলে, স্ত্রীলোকের চোখে অনেক কিছুই ফাঁকি দেওয়া গেলেও, তারই প্রিয়জনের অন্য এক নারীর প্রতি আকর্ষণকে ফাঁকি দেওয়া শুধু দুঃসাধ্যই নয়, অসম্ভবও।
কিন্তু মিঃ রায়, আমার স্ত্রী–
হয়ত আপনার স্ত্রীর মধ্যে রোগে ভুগে ভুগে কিছুটা হিস্টিরিয়া ডেভেলাপ করেছিল, কিন্তু তবু আমি বলব—তাঁর হিস্টিরিয়াটা ষোল আনাই হয়ত হিস্টিরিয়া ছিল না।
কিন্তু আপনি বিশ্বাস করুন মিঃ রায়, কুন্তকে সত্যিই আমি ভালবাসতাম, প্রতি মুহূর্তে সারাটা অন্তর দিয়ে তার আরোগ্যকামনাই করতাম। সে ভাল হয়ে উঠুক, সুস্থ হয়ে উঠুক, আমাদের সংসার আবার আনন্দের হয়ে উঠুক-ঈশ্বরের কাছে সর্বদা মনে মনে ঐ প্রার্থনাই জানিয়েছি।
মিঃ চ্যাটার্জি, মানুষের মন বিচিত্র আর মানুষের প্রবৃত্তিটাও অতিশয় বিচিত্র! ঐ বিচিত্র আকাঙ্ক্ষা বা প্রেরণা মানুষকে যেমন সময়বিশেষে এক ধরনের সর্বনাশের পথে টেনে নিয়ে যায়, তেমনি তাকে সাধারণ থেকে অসাধারণের পর্যায়েও নিয়ে যেতে পারে। প্রতিভা দুঃসাহস ও অনন্যতাও অনেক ক্ষেত্রে ঐ বোধ থেকেই পূর্ণ বিকাশলাভ করে। কিন্তু যাক সে কথা, মিত্ৰাণী দেবীকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে চাই। তাঁকে যদি এখানে একটিবার পাঠিয়ে দেন।
সুশান্ত ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল।
ক্লান্ত শিথিল পায়ে নিঃশব্দে অন্দরে গিয়ে প্রবেশ করল।
কিরীটীবাবু! অবনী ডাকেন।
বলুন।
আপনি তাহলে মিঃ চ্যাটার্জিকে সন্দেহ করছেন?
তা করছি বৈকি।
তাহলে—
কি তাহলে?
ওকে আমরা—
ব্যস্ত হবেন না অবনীবাবু।
কিন্তু হত্যাকারীকে হাতের মুঠোর মধ্যে পেয়েও যদি রশি আলগা দিই–
ভুলে যাচ্ছেন কেন একটা কথা অবনীবাবু, শুধু জানাই নয়—কাউকে পেনাল কোডের আওতায় ফেলতে হলে প্রমাণ চাই সর্বাগ্রে। সেই প্রমাণই এখনও কিছু আপনার হাতে আসেনি। তাছাড়া একটা কথা আপনাকে আমি জোর গলায় বলতে পারি–
কি?
সুশান্ত চ্যাটার্জি আর যাই করুক, পালাবে না।
কিন্তু নিশ্চিন্ত থাকুন, তার ঐ ছেলে রাহুলকে ফেলে সে কোথায়ও যাবে না।
কি করে বুঝলেন?
তাই আমার ধারণা।
ইতিমধ্যে অত্যন্ত লঘু পদসঞ্চারে কখন যে ওদের পাশে এসে মিত্ৰাণী দাঁড়িয়েছে নিঃশব্দে ওরা টেরই পায়নি।
হঠাৎ কিরীটীর নজর পড়ে।
এই যে মিত্ৰাণী দেবী, আপনি এসেছেন-বসুন—
মিত্ৰাণী একটা চেয়ারে উপবেশন করল।
মনে হচ্ছে কিছুক্ষণ আগে সে স্নান করেছে।
সিক্ত চুলে একটা স্নিগ্ধ কেশতৈলের সুবাস পাওয়া যায়।
পরনে আজ একটা হালকা আকাশ-নীল রঙের চওড়াপাড় মিলের শাড়ি।
মিত্ৰাণী দেবী!
মিত্ৰাণী নিঃশব্দে মুখ তুলে তাকাল। সেই চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ-চঞ্চল।
মিত্ৰাণী দেবী, সেদিন আপনার জবানবন্দিতে একটি কথা আমাদের কাছে স্বীকার করেননি–
কি কথা?
সে রাত্রে অর্থাৎ যে রাত্রে দুর্ঘটনাটা ঘটে, সেই রাত্রে আপনার ঘরে আপনার জামাইবাবু বাদে কে তৃতীয় ব্যক্তি এসেছিল?
কেউ তো আসেনি।
এসেছিল।
আপনি দেখছি এখনও কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেন না আমার কথাটা।
না মিত্ৰাণী দেবী, বিশ্বাস করা সম্ভব নয় বলেই পারছি না। কিন্তু আমিও সত্য বুঝতে পারছি না, কেন আপনি কথাটা এখনও স্বীকার করছেন না?
কারণ কথাটা মিথ্যা বলে।
মিথ্যা?
হ্যাঁ।
তাহলে কেউ আসেনি বলতে চান?
হ্যাঁ। শান্ত গলায় জবাব দেয় মিত্ৰাণী। তার কণ্ঠস্বরে কোথায়ও ত্রুটির দ্বিধা বা কম্পন পর্যন্ত নেই যেন।
একটা সহজ সত্য কথাকে যেন অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে বলছে মিত্ৰাণী।
কিরীটী মিত্ৰাণীর মুখের দিকে ক্ষণকাল চেয়ে রইল। তার চোখের দৃষ্টিতে যেন একটা চকিত বিদ্যুৎ স্ফুরণ।
এবং পুনরায় কিরীটী কথাটা যেন পুনরাবৃত্তি করল। বললে, তাহলে বলতে চান কেউ আসেনি সে রাত্রে আপনার ঘরে?
হ্যা!
হঠাৎ ঐ সময় কিরীটীর নজরে পড়ল ও-পাশের জানালার পাশ থেকে কে যেন চকিতে সরে গেল।
কিরীটী কিন্তু ব্যাপারটা দেখেও দেখল না।
কতকটা যেন না দেখার ভান করে ব্যাপারটা, তাকায়ও না সেদিকে।
মিত্ৰাণী দেবী। কিরীটী আবার প্রশ্ন করে। বলুন।
দেখুন সূর্যের আলোকে যেমন চাপা দেওয়া যায় না, তেমনি সত্যকে চাপা দেওয়া যায় ণা। সত্য যা, আজ হোক বা দুদিন পরে হোক প্রকাশ পাবেই। তাই বলছিলাম–
আপনাকে আমি মিথ্যা বলিনি কিরীটীবাবু।
সেই শান্ত স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর মিত্ৰাণীর।
কিন্তু আমি বলছি–
কী?
আপনি সত্য গোপন করছেন।
কী বললেন?
আপনি সত্য গোপন করছেন।
না।
কিরীটী মৃদু হাসল। তাপরা শান্ত গলায় বললে, থাক ও কথা। তবে একটা কথা বোধ হয় আপনার জানা প্রয়োজন মিত্ৰাণী দেবী–
মিত্ৰাণী কোন কথা না বলে কিরীটীর মুখের দিকে চোখ তুলে তাকাল।
চোখে চোখ রেখে কিরীটী বললে, আপনার দিদি মিসেস শকুন্তলা চ্যাটার্জি কিন্তু আত্মহত্যা করেননি, আমরা জানতে পেরেছি।
সে মালিশের ঔষধের বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেনি বলতে চান?
হ্যাঁ, তিনি আত্মহত্যা করেননি। ব্যাপারটা এমনই স্বেচ্ছামৃত্যু নয়—তাকে হত্যা করা হয়েছে।
কী বললেন?
দু চোখ তুলে তাকাল মিত্ৰাণী একবার কিরীটীর মুখের দিকে।
হ্যাঁ মিত্ৰাণী দেবী, তাকে হত্যা করাই হয়েছে। কিরীটী আবার পুনরাবৃত্তি করল।
তবে ঐ মালিশের ঔষধ তার ঘরে তার বিছানার উপর এল কি করে?
কিরীটী হেসে ফেলল।
ওটা একটা eye-wash মাত্র। হত্যাকারীর একটা চাল বা অন্যের চোখে ধুলো নিক্ষেপ করবার একটা প্রয়াস বলতে পারেন।
না, না—
হ্যাঁ, তাই। তাকে—মানে এক অসুস্থ ভদ্রমহিলাকে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে।
হত্যা!
হ্যাঁ, হত্যা। আর কি করে হত্যা করা হয়েছে, জানেন?
কিরীটীর কণ্ঠস্বর তীক্ষ্ণ।
মিত্ৰাণীর চোখে যেন ভীত বোবা দৃষ্টি।
কেমন যেন অসহায় ভাবে মিত্ৰাণী তখন তাকিয়ে আছে কিরীটীর মুখের দিকে।