০৮. আমি যখন ঘরে ঢুকেছি

আমি যখন ঘরে ঢুকেছি তখন ইয়োরন রিসি জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়েছিলেন। ঘরে নুবা আর হিশানও আছে, য়োমিকে কোথাও দেখা গেল না। আমাদের পায়ের শব্দ শুনে ইয়োরন রিসি ঘুরে তাকালেন, সাথে সাথে তার মুখে সহৃদয় একটা হাসি ফুটে উঠল। বললেন, রিকি তোমাকে ঘুম থেকে তুলে ফেললাম!

আমি অভিবাদন করে বললাম, সেটি আমার জন্যে একটি অকল্পনীয় সম্মান।

শুনে খুশি হলাম। আমাকে কেউ যদি মাঝরাতে ঘুম থেকে তুলে ফেলে আমার খুব মেজাজ গরম হয়ে যায়। যাই হোক, রিকি আমি তোমাকে নিতে এসেছি।

আমাকে?

হ্যাঁ। আমি অন্যদের সাথে কথা বলেছি, তারা বলেছে আমি তোমাকে নিতে পারি। তুমি আর য়োমি একসাথে কাজ করছিলে?

জি, মহামান্য ইয়োরন রিসি।

য়োমি সম্ভবত একাই করতে পারবে, তোমার সাথে তো কথা হয়েছে?

জি, মহামান্য ইয়োরন রিসি।

সে তো ছোটাছুটি করছে দেখছি। তুমি চল আমার সাথে। তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।

মহামান্য ইয়োরন রিসি আমার সাথে যে কথাটি বলতে চেয়েছেন সেটি নিঃসন্দেহে খুব জরুরি কথা কিন্তু সারা রাস্তা তিনি আমার সাথে হালকা কথা বলে কাটিয়ে দিলেন। আমি কী খেতে পছন্দ করি, ক্লাসিক্যাল সঙ্গীত পছন্দ করি কি না, বিমূর্ত শিল্প তুলে দিলে কেমন হয়– আমাদের কথাবার্তা এই ধরনের বিষয়ের মাঝেই সীমাবদ্ধ থেকে গেল। মানুষটির মাঝে এক ধরনের বিস্ময়কর সারল্য রয়েছে যেটি নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হতে চায় না।

তার ঘরে পৌঁছানোর পর একটা বড় টেবিলের দুপাশে আমরা মুখোমুখি বসলাম। তিনি দীর্ঘ সময় আমার দিকে বিষণ্ণ চোখে তাকিয়ে রইলেন তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, তোমার কী মনে হয় রিকি, পরিকল্পনাটি কি ঠিক করে কাজ করবে?

নিশ্চয়ই করবে। মহামান্য রিসি। নিশ্চয়ই করবে।

তুমি জান যে পরিকল্পনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটুকু নির্ভর করছে তোমার ওপর।

আমার ওপরে?

হ্যাঁ। তোমার ওপরে। কারণ ত্রিনিত্রি রাশিমালাটি নিয়ে যাবে তুমি।

আমি নিজের অজান্তেই একটু শিউরে উঠি। ইয়োরন রিসি আমার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে থেকে বললেন, তোমার কি ভয় করছে?

আমি মাথা নাড়লাম, করছে মহামান্য ইয়োরন রিসি।

ইয়োরন রিসি একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, কিন্তু তবু তোমাকেই যেতে হবে।

আমি জানি।

তুমি সম্ভবত একমাত্র মানুষ যে শ্যালক্স গ্রুনের সাথে পাল্লা দিতে পারবে। তার অসম্ভব ধূর্ত চোখকে ধোঁকা দিতে পারবে। শুধু তুমিই তাকে একটি অসম্পূর্ণ ত্রিনিত্রি রাশিমালা ধরিয়ে দিতে পারবে।

আমি আগে কখনো কাউকে মিথ্যা কথা বলি নি।

আমি জানি।

ইয়োরন রিসি আমার দিকে নরম চোখে তাকালেন, বললেন, তুমি পৃথিবীর মানুষের মুখ চেয়ে একবার একটি মিথ্যে কথা বলবে। সেটিকে মিথ্যা জেনে নয়–সেটাকে সত্যি জেনে বলবে!

আমি একটা নিশ্বাস ফেলে বললাম, আমি বলব মহামান্য রিসি। আমি আমার শেষ শক্তি দিয়ে এই মিথ্যাটুকু বলব।

আমাকে তুমি কথা দাও।

আমি কথা দিচ্ছি।

ইয়োরন রিসি এগিয়ে এসে আমার হাত স্পর্শ করলেন।

.

পরের কয়েক ঘণ্টা আমাকে ত্রিনিত্রি রাশিমালা সম্পর্কে শেখানো হল। আমি ব্যাপারটি ভাসা ভাসাভাবে জানতাম, এবার প্রথমবার সেটির ঘুঁটিনাটি জানতে পারলাম। পৃথিবীর সভ্যতা যেন পরস্পরবিরোধী হয়ে গড়ে না ওঠে তার নিশ্চয়তা বিধান করার জন্য সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গণিতবিদ ত্রিনিত্রি এই রাশিমালাটি দিয়েছিলেন। সময়ের সাথে এই রাশিমালাটির পরিবর্তন হয়, ব্যবহারের সাথেও এর পরিবর্তন হয়। পুরোপুরি এই রাশিমালাটি কখনো কেউ জানতে পারে না। কেউ যদি জানার চেষ্টা করে সে একটি অংশ জানতে পারে কিন্তু অন্য অংশ তার কাছে অস্পষ্ট হয়ে আসে। পদার্থবিজ্ঞানের অনিশ্চয়তার সূত্রের মতো এই রাশিমালাতেও এক ধরনের অনিশ্চয়তা লুকানো রয়েছে, শ্যালক্স গ্রুনের বিরুদ্ধে সেটাই হচ্ছে। আমাদের একমাত্র অস্ত্র। সে যখন রাশিমালাটি পরীক্ষা করে দেখবে। যতই তার গভীরে যাবার চেষ্টা করবে ততই একটা অংশ তার কাছে অস্পষ্ট হয়ে আসতে থাকবে। তার নিজের নিরাপত্তার জন্যেই সে কোনো একটি বিষয়ের খুব গভীরে যেতে চাইবে না।

ত্রিনিত্রি রাশিমালা সম্পর্কে আমার একটা ধারণা হয়ে যাবার পর পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ একদল বিজ্ঞানী আর গণিতবিদ আমাকে নিয়ে বিভিন্ন কলকারখানা, সামরিক প্রতিষ্ঠান, মহাজাগতিক ল্যাবরেটরি, যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কক্ষে ঘুরে বেড়ালেন। ত্রিনিত্রি রাশিমালা

কেমন করে ব্যবহার করা যায় সেটা শেখালেন, আমি সেটা ব্যবহার করে একটা মহাকাশযানকে তার কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত করে দিলাম, একটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে খানিকক্ষণের জন্যে একটি শহরকে অন্ধকার করে রাখলাম। আমি এখন ইচ্ছে করলে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটাতে পারি। যুদ্ধজাহাজ পাঠাতে পারি। উপগ্রহদের ধ্বংস করে দিতে পারি। ক্রিস্টাল ডিস্কে সাজিয়ে রাখা কিছু সংখ্যার যে এত বড় ক্ষমতা হতে পারে সেটি বিশ্বাস করা কঠিন।

ত্রিনিত্রি রাশিমালায় অভ্যস্ত হতে প্রায় ছত্রিশ ঘণ্টা কেটে গেল। এক সময় বিজ্ঞানী এবং গণিতবিদেরা তাদের যান্ত্রিক কাজে পারদর্শী রবোটদের নিয়ে বিদায় নিলেন। আমাকে নিয়ে যাওয়া হল একটি ঘরে, সেখানে আমার জন্যে অপেক্ষা করছেন মহামান্য ইয়োরন রিসি। আমাকে দেখে মৃদু হেসে বললেন, খুব খাটুনি গিয়েছে, তাই না।

আমি মাথা নাড়লাম, হ্যাঁ। কিন্তু পরিশ্রমটির প্রয়োজন ছিল। ত্রিনিত্রি রাশিমালা কী এখন আমি জানি।

হ্যাঁ। কিন্তু তুমি যে রাশিমালাটি নিয়ে যাবে সেটি সত্যিকারের নয়। সেটি প্রায় তৈরি হয়ে গেছে, এই মুহূর্তে তোমাদের অন্য চার জন সেটি পরীক্ষা করে দেখছে।

কখন সেটি সম্পূর্ণ হবে?

আমার মনে হয় আর কিছুক্ষণের মাঝেই।

আমি কখন সেটি নিয়ে যাব?

তোমার যখন ইচ্ছা। আমার মনে হয় এখন তোমার খানিকক্ষণ বিশ্রাম নেয়া দরকার। তুমি কোথায় বিশ্রাম নিতে চাও?

আমি কি আমার নিজের বাসায় নিতে পারি?

ইয়োরন রিসি মৃদু হেসে বললেন, কিটির কাছে?

হ্যাঁ, মহামান্য ইয়োরন রিসি। আমার স্নায়ু খুব উত্তেজিত হয়ে আছে। কিটির সাথে কথা বললে আমার স্নায়ু সবসময়ই শীতল হয়ে আসে।

তুমি তাহলে যাও। যখন সময় হবে আমরা তোমাকে নিয়ে আসব।

আমি উঠে দাঁড়ালাম, ইয়োরন রিসি এগিয়ে এসে আমাকে গভীর ভালবাসায় আলিঙ্গন করলেন।

.

আমাকে দেখে কিটি কোনো ধরনের উত্তেজনা প্রকাশ করল না। কয়েকবার আমার চারপাশে ঘুরে বলল, তোমার কাপড় জামা পান্টানোর সময় হয়েছে। আমি কি নূতন কাপড় নিয়ে আসব?

তার কোনো প্রয়োজন নেই।

তোমার খাবার কি গরম করব?

আমি খেয়ে এসেছি কিটি।

তোমার টেলি জার্নাল চিঠিপত্র—

এখন দেখতে ইচ্ছে করছে না।

কিটি এক মুহূর্ত দ্বিধা করে বলল, তুমি কি মানসিক ভারসাম্যহীন?

আমি হেসে বললাম, বলতে পার আমি এখন এক ধরনের মানসিক ভারসাম্যহীন! আমার ওপর খুব বড় একটা দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, সেই বড় দায়িত্বটি এত বড় যে তার তুলনায় অন্য সবকিছু এখন গুরুত্বহীন মনে হয়। সবকিছু হাস্যকর ছেলেমানুষি এবং অর্থহীন মনে হয়।

কিটি কী বুঝল আমি জানি না কিন্তু এক ধরনের গাম্ভীর্য নিয়ে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, আমি তোমার জন্যে দুঃখিত রিকি। আমি কি কোনোভাবে তোমাকে সাহায্য করতে পারি?

তুমি কীভাবে আমাকে সাহায্য করতে চাও?

প্রয়োজন হলে আমি তোমার জন্যে সেই বড় দায়িত্বটি করতে পারি।

আমি হেসে ফেললাম, না, কিটি তুমি সেটা করতে পারবে না।

কেন নয়?

কারণ আমাকে একজন মানুষের সামনে একটি খুব বড় মিথ্যা কথা বলতে হবে। সে যদি বুঝতে পারে আমি মিথ্যা কথা বলছি তাহলে খুব ভয়ঙ্কর একটি ব্যাপার হবে।

মিথ্যা মানে কী?

আমি হেসে বললাম, তুমি সেটা জানতে চেয়ো না কিটি! আমি যদি বলি তবুও তুমি বুঝবে না। কোনো পশুপাখি মিথ্যাচার করে না, কোনো যন্ত্রও মিথ্যাচার করে না। মিথ্যাচার করে শুধু মানুষ–কখনো ইচ্ছে করে, আর কখনো করে যখন তার আর কোনো উপায় থাকে না। আমার আর কোনো উপায় নেই কিটি।

আমি তোমার জন্যে দুঃখিত রিকি। আমি স্পষ্ট অনুভব করছি আমার কপোট্রনের চতুর্থ অংশের তৃতীয় পিনটিতে ভোল্টেজের পরিবর্তন ঘটছে। এটি নিশ্চিত দুঃখের অনুভূতি।

আমি এক ধরনের স্নেহের চোখে এই পরিপূর্ণ নির্বোধ রবোটটির দিকে তাকিয়ে থাকি। আমি বুঝতে পারছি আমার স্নায়ু শীতল হয়ে আসছেকিছুক্ষণের মাঝেই আমি গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে যেতে পারব।