‘‘অসংখ্য সমুদ্র বয়ে যাচ্ছে।
সময়ের স্রোত
এবং কেই বা বিখ্যাত হতে চায় এবং অটোগ্রাফ সই করতে চায়
সিনেমা স্টারদের মত…
…আমি জানতে চাই আমার মৃত্যুর পর কী হবে…’
-অ্যালেন গিনসবার্গ
অ্যালেন গিনসবার্গ আমাকে জানিয়েছিল যে ওর তখনও কোনও নির্দিষ্ট বাসস্থান নেই, গ্রিনিচ ভিলেজে একটি বিশেষ বইয়ের দোকানে ওর খোঁজ করতে। নিউ ইয়র্ক শহরে আমি তখন কোনও বাঙালিকেই চিনতাম না। আর কারুর বাড়িতে আতিথ্য নেওয়ার প্রশ্নই নেই, বাক্স-প্যাটরা নিয়ে আমি এসে উঠলাম ওই গ্রিনিচ ভিলেজেরই একটা সস্তার হোটেলে। হোলেটটা আমাদের শিয়ালদা স্টেশানের কাছাকাছি হোটেলগুলোরই মতন, বেশ নোংরা, সরু একচিলতে ঘর, খাট-বিছানা আর ওয়ার্ডরোব ছাড়া আর কিছুই নেই, ভাড়া তখনকার হিসেবে বারো ডলার, অর্থাৎ ষাট টাকা।
সেই ঘরে জিনিসপত্র রেখে, তালা দিয়ে, বেরিয়ে পড়লাম বইয়ের দোকানটির সন্ধানে। দোকানটির নাম এইটথ স্ট্রিট বুক শপ। নিউ ইয়র্কে রাস্তা খোঁজা বেশ সহজ, আমার হোটেল পাঁচ নম্বর রাস্তায়, মাত্র তিনটে ব্লক হেঁটে যাওয়া কিছুই না।
অগাস্ট মাসের দুপুর, বাতাসে শীত নেই, ঝকঝক করছে রোদ, রাস্তায় প্রচুর মানুষজন, কত বিচিত্র রকমের পোশাক। গ্রিনিচ ভিলেজে চব্বিশ ঘণ্টাই মানুষের চলাচল। আমাদের দেশের জনতার সঙ্গে তফাত এই যে, নারী ও পুরুষের সংখ্যা সমান সমান তো বটেই, হয়তো নারীদের সংখ্যা বেশি।
দোকানটা বেশ বড়, ভেতরে প্রচুর অল্প বয়েসি ছেলেমেয়েদের ভিড়, আমি প্রথমে ঘুরে-ঘুরে দেখলাম, সেখানে শুধু আধুনিক লেখকদের বই-পত্র রাখা আছে। ‘ভিলেজ ভয়েস’ এবং ‘এভার গ্রিন রিভিউ’ আধুনিকদের নামকরা পত্রিকা, সেগুলিও রয়েছে গাদা গাদা। একসময় আমি কাউন্টারের যুবকটিকে জিগ্যেস করলাম, অ্যালেন গিনসবার্গ এখন কোথায় আছে বলতে পারো?
যুবকটি মুখ তুলে বলল, তোমার নাম কী? তুমি কি ভারতীয়?
আমার নাম শুনে সে বলল, ‘হ্যাঁ, অ্যালেন তোমার কথা বলে রেখেছ। তুমি এই পাশের সিঁড়ি দিয়ে তিন তলায় উঠে যাও!
তিন তলায় এসেই আমার সর্বাঙ্গে একটা শিহরন হল। ডান দিকের একটা ঘরে একটা গান বাজছে, সেটা শুধু যে বাংলা গান তাই-ই নয়, সেটা একটা লোকসঙ্গীত, ফান্দেতে পড়িয়া বগা কান্দে রে…।
এক বছর আমি কোনও বাংলা গান শুনিনি। এরকম একটা লোকসঙ্গীত নিউ ইয়র্কে এসে শুনব, আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।
ঘরের দরজা খোলা, একটা খাটের ওপর আধ-শোওয়া হয়ে অ্যালেন পা নাচাচ্ছে, পাশের টেবিলের ওপরে রেকর্ডে প্লেয়ারে বাজছে সেই গান।
অ্যালেন গিনসবার্গের বয়েস তখন চল্লিশের কাছাকাছি, আমার চেয়ে প্রায় দশ বছরের বড়। তার মুখভর্তি দাড়ি, দু-একটিতে পাক ধরেছে, মাথায় বাবরি চুল। সবচেয়ে চমকপ্রদ তার পোশাক, সে একেবারে মিলিটারি সেজে আছে, সেইরকমই প্যান্টকোর্ট, শুধু মাথায় টুপিটা নেই।
আমাকে দেখেই অ্যালেন তড়াক করে খাট থেকে নেমে এসে জড়িয়ে ধরল, ফটাফট দু’গালে চুমো দিয়ে বলল, এসেছ? এসেছ তা হলে? খুব ভালো করেছ! ক’দিন থাকবে? আবার কবে আয়ওয়া ফিরতে হবে?
আমি বললাম, আর আয়ওয়াতে ফিরছি না।
অ্যালেন বলল, চমক্কার! চমৎকার! ওই মিড ওয়েস্টে মানুষ থাকতে পারে? শুধু গমের খেত! মানুষগুলো সব সেকেলে!!
আমার কিন্তু আয়ওয়ার নিন্দে পছন্দ হল না। আয়ওয়ার প্রকৃতি আমার ভালো লেগেছে, মানুষেরা সহৃদয়, আয়ওয়ার এক বছর আমার জীবনে একটা রূপান্তর ঘটিয়ে দিয়েছে।
অ্যালেন খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে শক্তি, তারাপদ, জ্যোতি, শরকুমার, সন্দীপন, উৎপল, মতি নন্দী এই সব বন্ধুদের খবর জিগ্যেস করতে লাগল। শক্তির সঙ্গে অ্যালেনের খুবই ভাব হয়েছিল, সে বলল, আই মিস শাকটি!
কলকাতার গল্প করতে-করতে তন্ময় হয়ে গিয়েছিলাম, হঠাৎ একসময় অ্যালেন বলল, এই রে, ভাত পুড়ে গেল বুঝি!
পাশের রান্না ঘরে অ্যালেন ভাত চাপিয়েছিল, বেশ ফুটে উঠেছে এর মধ্যে।
অ্যালেন বলল, আমি রান্না করছি, তুমি আমার সঙ্গে খাবে? আমি খুব ভালো ডাল রান্না করতে শিখছি।
রান্নার প্রসঙ্গে আমার একটা ঘটনা মনে পড়ল। কলকাতায় একদিন একটা কলা খেতে-খেতে অ্যালেন একটা কথা খুব সুন্দর করে বলেছিল।
সেটা ছিল মর্তমান কলা, ঠিক ঠিক পাকা, হলুদ রঙের খোসাটা বড় স্নিগ্ধ। খোসা ছাড়িয়ে কলায় এক কামড় দিয়ে অ্যালেন বলেছিল, অতি চমৎকার, নিখুঁত স্বাদ, দোকানের কোনও খাবারের সঙ্গে এর তুলনা হয় না। ঈশ্বর খুব ভালো রাঁধুনি। একটু থেমে অ্যালেন আবার বলেছিল, গড ইজ দা বেস্ট কুক!
খেতে বসে আবার চলল নানারকম গল্প। কিন্তু অ্যালেনের পোশাকটা আমার দৃষ্টিকটু লাগছিল। অ্যালেন ঘোরতর যুদ্ধবিরোধী আমি জানি, অথচ তার অঙ্গে সামরিক সাজ! অ্যালেন যখন কলকাতায় ছিল, সেই সময় কিউবার সঙ্গে আমেরিকার যুদ্ধ বাধার উপক্রম হয়েছিল, আমেরিকা কিউবার দিকে পাঠিয়েছিল গানবোট, ওদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নও যুদ্ধজাহাজ পাঠাবার হুসিয়ারি দিয়েছিল, কয়েকটা দিনের জন্য আর একটা বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনায় কেঁপে উঠেছিল পৃথিবী। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট তখন কেনেডি, অ্যালেন তাঁকে গুণ্ডার সর্দার, মাথা মোটা প্লে-বয় ইত্যাদি যাচ্ছেতাই গালাগাল দিয়েছিল আমাদের সামনে। পৃথিবীর যে-কোনও যুদ্ধেরই বিরোধী অ্যালেন। এই প্রসঙ্গে সে প্রখ্যাত ফরাসি ঔপ্যাসিক সিলিন-এর সঙ্গে পরিচয় করিয়েছিল আমাদের। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়েও সিলিন ছিলেন প্যাসিফিস্ট, এ জন্য অনেক গঞ্জনা সইতে হয়েছে তাঁকে। এক রেস্তোরাঁর মধ্যে দাঁড়িয়ে সিলিন চিৎকার করে বলেছিলেন, হ্যাঁ, আমি একজন কাওয়ার্ড। যুদ্ধের বিরোধিতা করা যদি কাপুরষতা হয়, তবে আমি নির্লজ্জভাবে কাপুরুষ!
আমি অ্যালেনকে জিগ্যেস করলাম, তুমি এই বিদঘুঁটে পোশাক পরে আছ কেন?
অ্যালেন হেসে বলল, কেন, আমাকে মানায়নি? ব্যাপারটা কী হয়েছে জানো, আমার এক বন্ধু আর্মিতে ছিল, সে মারা গেছে। তার বিধবা তার সব পোশাক-আশাক আমাকে দিয়ে দিয়েছে, আমার জামাকাপড় ছিল না, বেশ কাজে লেগে যাচ্ছে। আমার থাকার জায়গাও নেই, এক একদিন এক এক বন্ধুর অ্যাপার্টমেন্টে থাকি। তবে, এবার আমরা একটা ঘর ভাড়া নিয়েছি, সেটা সারানো হচ্ছে। পিটার আসুক, সেটা আমরা দেখতে যাব!
একটু বাদেই পিটার এসে উপস্থিত। পিটার অরলভস্কি, অ্যালেনের স্ত্রী। অ্যালেন ঘোষিত সমকামী এবং পিটারের মতন একজন লম্বা-চওড়া পুরুষকে প্রকাশ্যে নিজের স্ত্রী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতে তার কোনও দ্বিধা নেই। এই নিয়ে আমেরিকেও তখন হুলুস্থুলু পড়ে গিয়েছিল, আমাদের দেশ কেউ তো এ ব্যাপার সহ্যই করতে পারবে না। পরবর্তী যুগে সমকামীদের একত্র বাস অনেক দেশে বৈধ হয়েছে, কিন্তু সেই আমলে এটা ছিল অভিনব, বহু নিন্দিত ব্যাপার। কবি হিসেবে অ্যালেন গিনসবার্গ তখন আমেরিকায় সবচেয়ে জনপ্রিয়, লক্ষ লক্ষ যুবক-যুবতী তার ভক্ত কিন্তু মার্কিন সরকার বা বিভিন্ন এস্টাব্লিশমেন্ট তাকে দু-চক্ষে দেখতে পারে না। অ্যালেন আমেরিকার অনেক রাষ্ট্রীয় নীতিরও কড়া সমালোচক। তার ‘আমেরিকা’ নামের বিখ্যাত কবিতাটির প্রথম কয়েকটি লাইন এরকম সাংঘাতিক :
America I’ve given you all
and now I am nothing
America two dollars and
twenty seven cents January 17, 1956
I can’t stand my own mind
America when will we end
the human war?
Go fuck Yourself with your atom bomb…
পিটারের মতন এমন সরল, বিশুদ্ধ অন্তঃকরণের মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি। অ্যালেন বুদ্ধিজীবী, প্রচুর পড়াশুনো করেছে, সব সময় সে একটা সাহিত্য-শিল্পের ঘোরের মধ্যে থাকে। পিটার সব কিছুই নিজের অনুভূতি দিয়ে বোঝে। তার শরীরে রাগ বলে কোনও বস্তু নেই, সে ভুলেও অন্য কারুর গায়ে একটা আঁচড়ও কাটবে না। অনেক সময় অ্যালেনের চেয়ে পিটারের সঙ্গে কথা বলতেই বেশি ভালো লাগে।
পিটার আমাকে দেখে কোনওরকম উচ্ছ্বাস প্রকাশ করল না। শান্তভাবে বলল, ও, সুনীল, সুনীল, ইয়েস, ইয়েস, খাচ্ছ, খেয়ে নাও, আমার খাওয়া হয়ে গেছে…। যেন কালই দেখা হয়েছে তার সঙ্গে।
পরের দিনই হোটেল থেকে পিটার আমার মালপত্র তুলে নিয়ে চলে এল ওদের নতুন বাড়িতে।
আমরা সাধারণভাবে নিউ ইয়র্ক বললেও মূল শহরটির নাম ম্যানহাটান। দ্বীপটাকে যদি একটা মাছের সঙ্গে তুলনা করা যায়, তা হলে এর লেজের দিকটা গরিব পাড়া। বিশাল বিশাল চওড়া কয়েকটি রাজপথ চলে গেছে শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে, সেগুলির নাম এভিনিউ, আর এগুলিকে সমান্তরালভাবে কাটাকুটি করে গেছে বহু রাস্তা, এগুলিকে বলে স্ট্রিট। ঠিকানা শুনলেই বোঝা যায় কে কোন পাড়ায় থাকে। তিনি নম্বর, পাঁচ নম্বর রাস্তায় বেকার, ভবঘুরেদের বাস, আর পঁয়ষট্টি কিংবা ঊনআশি নম্বর রাস্তার অধিবাসী মানেই রীতিমতন ধনী।
এই নীচের দিকের পাড়াগুলো, যাকে বলে লোয়ার ইস্ট সাইড কিংবা লোয়ার ওয়েস্ট সাইড, এরই কাছাকাছি গ্রিনিচ ভিলেজ। একসময়, ষাটের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এখানে ছিল যত রাজ্যের কবি-শিল্পী-সাহিত্যকদের আখড়া, অনেকটা এককালের প্যারিসের মমার্ত-এর মতন। পরে অবশ্য ওই দুই অঞ্চলই টুরিস্টদের ভিড়ে চরিত্র নষ্ট করে ফেলে।
ম্যানহাটানের গরিব এলাকা নিয়ে সেই সময় একটা চমৎকার ফিলম তোলা হয়েছিল, ‘ওয়েস্ট সাইড স্টোরি’। হলিউড প্রচুর নিকৃষ্ট ফিলম উৎপাদন করে। কিন্তু কিছু কিছু মিউজিকাল ছবি তুলনাহীন। আমেরিকার মিউজিকালস অনেকগুলিই সারা পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ। ‘ওয়েস্ট সাইড স্টোরি’ একটি ক্লাসিক ছবি হিসেবে গণ্য হওয়ার যোগ্য। অসামান্য বুদ্ধির প্রয়োগ আছে এর কাহিনি নির্মাণে। শেকসপিয়রের রোমিও-জুলিয়েট-এর গল্পটিকেই যেন হুবহু বসিয়ে দেওয়া হয়েছে এক আধুনিক পটভূমিকায়। রোমিও-জুলিয়েটে দুই প্রতিবেশি বনেদি পরিবারের ঝগড়া, এক পরিবারের ছেলের সঙ্গে অন্য পরিবারের মেয়ের প্রেম, প্রেমিক কর্তৃক প্রেমিকার ভাইকে অনিচ্ছাকৃতভাবে হত্যা, সবই অবিকল রয়েছে এখানে। তবে বনেদি পরিবারের বদলে গরিব পোঠুরিকান আর সেইরকমই গরিব আর বেকার শ্বেতাঙ্গদের দু’টি পাড়ার বিবাদ রয়েছে কাহিনির কেন্দ্রে। ঘটনাগুলি সমকালীন বাস্তবতার সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায়, কিন্তু ছবিটির আরও বড় আকর্ষণ, এর সংলাপ সবই গানের সুরে বাঁধা, প্রত্যেকটি চরিত্রের পদক্ষেপে আছে নাচের ছন্দ।
ফিলমটা আমি আগেই দেখেছি দুবার, তাই অ্যালেনদের নতুন বাড়ির তিন নম্বর লোয়ার ওয়েস্ট সাইড পাড়াটা আমার খুব চেনা লাগে। পোটুরিকান, কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গ ছেলেমেয়েরা রাস্তায় ঘুরছে, এখানে সেখানে ভাঙা বোতল, রকে বসে এক একটা দঙ্গল বিয়ার পান করছে কিংবা গাঁজা টানছে, হঠাৎ হঠাৎ মারামারিও লেগে যাচ্ছে দুই দলে, তারপরই শেয়ালের ডাকের মতন শব্দ তুলে ছুটে আসছে পুলিশের গাড়ি।
অ্যালেনদের অ্যাপার্টমেন্টটা পাঁচতলায়। লিফট নেই। ক্ষয়ে যাওয়া সিঁড়ি, দেওয়ালে কাঠ-কয়লা দিয়ে কত যে খারাপ কথা লেখা, তার আর ইয়ত্তা নেই। পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশেও এরকম বাড়ি দেখলে আমার বেশ আরাম লাগে।
অ্যাপার্টমেন্টটাও বড় বিচিত্র। একখানাই মাত্র ঘর, সেটা টানা, লম্বা, প্রায় চারখানা ঘরের সমান, তার একদিকে রান্নার জায়গা, তারপর বসার জায়গা, তারপর শোওয়ার জায়গা, মাঝখানে দেওয়ালের কোনও বালাই নেই। এই ঘরখানিতেও খানিকটা জীর্ণ ভাব আছে, ওয়াল পেপার স্থানে স্থানে ছেঁড়া, রান্নার জায়গায় সিংকটা ফুটো, ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ে, সেটার তলায় একটা গামলা রাখতে হয়েছে।
কয়েকদিনের মধ্যেই আমি অ্যালেনের সংসারে বেশ একাত্ম হয়ে গেলাম। সংসার তো নয়, হট্টমেলা। কত লোক যে আসছে-যাচ্ছে, তার কোনও ইয়ত্তা নেই, যার যখন খুশি রান্না করে নিয়ে খাচ্ছে, রাত্তিরেও শুয়ে পড়ছে দশ বারোজন।
ফ্লাওয়ার চিলড্রেন কিংবা হিপিদেরও আগের সময়কার কথা। তখন বিট জেনারেশনের আন্দোলন চলছে, লোকে এদের বলত বিটনিক। এটা ছিল মূলত লেখক-শিল্পী সঙ্গীতকারদেরই আন্দোলন, তখন এর প্রধান দুই নেতা ছিল জ্যাক কেরুয়াম এবং অ্যালেন গিনসবার্গ।
অ্যালেনের তত্ব ছিল এই যে, শিল্প-সাধনা একটা চব্বিশ ঘণ্টার কাজ, লেখক শিল্পীদের কোনও চাকরি-বাকরি করা উচিত নয়। সরকার কিংবা অন্য কোনও প্রতিষ্ঠান থেকেও তারা কোনওরকম সাহায্য গ্রহণ করবে না। নিজেদের সাহিত্য-শিল্প সামগ্রীর বিনিময়ে পাঠক-দর্শক-শ্রোতাদের কাছ থেকে যা পাবে, তা দিয়েই গ্রাসাচ্ছাদন করতে হবে। সেজন্যই জীবনযাত্রার মানও হবে অতি সরল, পেট ভরাতে হবে অতি সাধারণ খাবারে, যে-কোনওরকম পোশাকে কাজ চালিয়ে নিতে হবে। এমনকি দাড়ি কামাবার পয়সাও বাঁচানো যেতে পারে। আমেরিকার সমাজে সেই প্রথম ছেঁড়া-খোঁড়া পোশাক পরা শিক্ষিত যুবক-যুবতীদের আবির্ভাব। অ্যালেন গিনসবার্গ যথেষ্ট শিক্ষিত, সে একসময় ‘নিউজ উইক’ পত্রিকায় চাকরি করছে, ইচ্ছে করলেই সে দামি গাড়ি হাঁকিয়ে, সাজানো অ্যাপার্টমেন্টে থেকে, উচ্চ মধ্যবিত্ত জীবনযাপন করতে পারত, কিন্তু সে ইচ্ছে করেই এরকম ত্যাগের জীবন বেছে নিয়েছিল।
অ্যালেনের কাছে অনেকেই আশ্রয় নিতে লাগল, তার কারণ অন্যদের তুলনায় অ্যালেনেরই কিছু রোজগার ছিল। তরুণ কবি-লেখকদের বই বিশেষ বিক্রি হয় না, গায়ক-শিল্পীরা আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু গিনসবার্গ তখন অসম্ভব জনপ্রিয়। সে কবিতা ছাড়া আর কিছু লেখে না, তার কবিতার বই হাউলা তখনই এক লক্ষ কপির বেশি বিক্রি হয়ে গেছে। সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘কাডিস’ও বিক্রি হচ্ছে হু হু করে। এর থেকে প্রাপ্য সব অর্থই অ্যালেন খরচ করে অন্যদের জন্য।
অ্যালেনের বন্ধু এবং বিটনিকদের অপর গুরু জ্যাক কেরুয়াম-ও তখন গদ্য লেখক হিসেবে খুব সার্থক। কেরুয়াক তখন বছরে তিন-চারখানা করে উপন্যাস লিখছে। তার উপন্যাসে প্লট খোঁজার কোনও ঝামেলা নেই, অধিকাংশই তার নিজের ও বন্ধু-বান্ধবের জীবনের খণ্ড খণ্ড ঘটনা। কিন্তু সেই সময় জ্যাক কেরুয়াক খানিকটা রেকলুজ বা একা চোরা ধরনের হয়ে পড়েছিল, অ্যালেনের মতন সবাইকে এক সঙ্গে নিয়ে চলার সে পক্ষপাতী ছিল না। সে একা একটা ফ্ল্যাট নিয়ে থাকত লং আয়ল্যান্ডে। তার এরকম ব্যবহারে বন্ধু-বান্ধবরা অনেকেই কিছুটা ক্ষুব্ধ, তার সমসাময়িক অপর বিখ্যাত কবি গ্রেগরি করসে একদিন খুব রাগারাগি করল। ঈষৎ মত্ত অবস্থায় গ্রেগরি ফোন করে বলল, এই জ্যাক, তুই আমাদের নিয়ে উপন্যাস লিখছিস, আমাদের চরিত্র বানাচ্ছিস, তা হলে তুই তোর রয়ালটির ভাগ আমাদের দিবি না কেন রে? দে, টাকা দে!
টেলিফোনের ওপাশ থেকে জ্যাক কেরুয়াক কী উত্তর দিয়েছিল, তা আমার শোনা হয়নি।
অ্যালেনের এই অ্যাপার্টমেন্টে সর্বক্ষণ হইচই। দলে দলে ছেলেমেয়ে এসে, কেউ ওখানেই ছবি আঁকতে বসে যাচ্ছে, কেউ গিটার বা ভায়োলিন বাজিয়ে গান জুড়ে দিচ্ছে, কেউ জোর করে কবিতা শোনাবেই। অ্যালেন নিজেও তখন গানের চর্চা শুরু করেছে। এর আগে সে উইলিয়াম ব্লেকের কিছু কবিতায় সুর দিয়ে গান গাইত, এই সময় সে শুরু করল হরে কৃষ্ণ নাম গান। কলকাতা থেকে অ্যালেন একটা ছোট হারমোনিয়াম কিনে নিয়ে গিয়েছিল, ওই বস্তুটি আমেরিকায় কেউ কখনও দেখেনি। সেই হারমোনিয়াম বাজিয়ে হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে, হরে রাম, হরে রাম, হরে রাম, হরে হরে গাইতে গাইতে অ্যালেন জিগ্যেস করত, সুনীল দ্যাখো তো, সুরটা ঠিক হচ্ছে কি না!
এই গান আমরা ছেলেবেলায় অনেক শুনেছি, গ্রামের অনেক মানুষ সকালে এই গান গাইত, ভিখিরিরাও এই গান গেয়ে ভিক্ষে করতে আসত। কিন্তু আমার জানা সুরের সঙ্গে অ্যালেনের ঠিক মেলে না। অ্যালেন এই গান শিখেছিল বেনারস থেকে, সুতরাং হিন্দি আর আমেরিকান উচ্চারণ মিলে মিশে সে এক অন্যরূপ ধরেছিল। অ্যালেনের মুখে গানটা এইরকম শোনাত : হ্যাঁ-রে কৃষ-ষ-না, হ্যাঁ-রে কৃষ-ষ-না, হ্যারে রা–ম-মাঃ, হ্যারে রাম মাঃ…ইত্যাদি। আমি খুব হাসতাম বলে অ্যালেন জোর করে আমাকে গেয়ে শোনাতে বলত, তারপর সবাই মিলে এক সঙ্গে গলা মেলাত। ম্যানহাটানের সেই অ্যাপার্টমেন্টে বসে যেত এক সঙ্কীর্তনের আসর।
শুধু গান-বাজনা আর কবিতাই নয়, এখানে মাদক সেবন এবং সহবাসও চলত অবাধে। গাঁজা-চরস ওদেশে সাংঘাতিকভাবে নিষিদ্ধ, ধরা পড়লেই পাঁচ বছর জেল, তবু ছেলেমেয়েরা জোগাড় করে আনত যে-কোনও উপায়ে। অল্প বয়েসিদের এই মাদক সেবনের অভ্যেস ছাড়াবার নানারকম চেষ্টা চলছে, স্যালেভশন আর্মি গ্রিনিচ ভিলেজে কফি পার্লার খুলেছে, যাতে ছেলেমেয়েরা কফি খেয়ে অন্য বদ অভ্যেস ছাড়ে। অনেকেই সেই বিনা পয়সার কফি দু’তিন কাপ খেয়ে নিয়ে তারপর যেত গাঁজা টানতে। সেই সঙ্গে এল এস ডি!
কলকাতাতেই শক্তি ও আমি একদিন এল এস ডি খেয়ে দেখেছি। তারাপদ রায়ের বাড়িতে শক্তি ও আমি সেই এল এস ডি খেয়ে চার ঘণ্টা আচ্ছন্ন হয়েছিলাম, অপূর্ব সেই অভিজ্ঞতা, শেষের দিকে শক্তির মৃত্যুভয় এসে পিয়েছিল, তবু সে হাসছিল, হা-হা করে, আমি বারবার দেখতে পাচ্ছিলাম একটি সাত-আট বছরের রক্তমাংসের বালককে, যার মুখ ঠিক আমার বাল্যের ওই বয়েসের। আমেরিকায় গিয়ে কিন্তু আমি আর এল এস ডি খাইনি। যে-কোনও নতুন জিনিসই একবার চেখে দেখতে কিংবা পরীক্ষা করতে আমার কোনও আপত্তি নেই, কিন্তু কোনও কিছুরই দাস হওয়া আমার স্বভাবে নেই। অ্যালেনের ঘরে নব্য লেখক-লেখিকারা আমাকে মাদক গ্রহণের জন্য বারবার পেড়াপিড়ি করলেও আমি রাজি হইনি কিছুতেই।
নেশার ঘোরে যুবক-যুবতীরা পরস্পরকে প্রবলভাবে জড়াজড়ি শুরু করত একসময়। যেহেতু লম্বা ঘরের মধ্যে কোনও আব্রু নেই, তাই একদিকের আলো নিভিয়ে দেওয়া হত, অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে গল্প করত আর একটি দল। অনেক মেয়েরই খুব পছন্দ ছিল পিটারকে। পিটার একদিকে যেন অ্যালেনের স্ত্রী, আবার অন্য দিকে মেয়েদের প্রেমিক। কোনও কিছুতেই তার আপত্তি নেই, সে এমনই নিরাসক্ত। অ্যালেনের কি ঈর্ষা হত না এ জন্য? পিটার কোনও মেয়ের সঙ্গে বেরিয়ে গেলে অ্যালেন আপত্তি করত না বটে, কিন্তু অমি লক্ষ করতাম, সেই সময় অ্যালেনের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। হঠাৎ অন্যদের বকাবকি শুরু করে দেয়। এ যেন, ‘আমার বঁধুয়া আন বাড়ি যায় আমারই অঙিনা দিয়া…।’
পিটারের একটি বান্ধবী ছিল প্রকৃতই অসাধারণ। তার নাম রোজ মেরি। সে নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির দর্শনের অধ্যাপিকা, কাব্য-সাহিত্যেও প্রচুর উৎসাহ, অন্য অনেক বিষয়েই প্রভূত জ্ঞান। কিন্তু এ হেন বিদুষী রোজ মেরির দুর্ভাগ্য তার চেহারা নিয়ে। সে ছ’ফিট দু’ইঞ্চি লম্বা, শুধু টিং-টিঙে লম্বাই নয়, সেই অনুপাতে চওড়া, অর্থাৎ সে একটি নারী দৈত্য, আমি গোপনে তার নাম দিয়েছিলাম হিড়িম্বা। এত লম্বা-চওড়া বলেই রোজ মেরির কোনও পুরুষ বন্ধু জোটেনি, তার বিবাহের কোনও আশাই নেই। তবে, এই দর্শনের অধ্যাপিকাটিরও রক্ত-মাংসের ক্ষুধা ছিল, সে জন্য সে বেছে নিয়েছিল পিটারকে। দুজনের মনের মিলের কোনও প্রশ্নই নেই, শুধু শারীরিক ভালোবাসা। ওদের দেশে লাভ আর লাভ মেকিং-এর মধ্যে অনেক তফাত। এই রোজ মেরির রান্নার হাত ছিল চমৎকার, আড্ডা মারতে মারতে উঠে গিয়ে একসময় সে আমাদের জন্য রান্না করে দিত। রাঁধতে গিয়ে তার পোশাকটা যাতে নষ্ট না হয়, সে জন্য সে খুলে রাখত তার গাউনটা, সম্পূর্ণ নগ্ন। তখন তার দিকে এক পলক তাকালেই মাথা ঘুরে যাওয়ার মতন অবস্থা, যেন ববডিংনাগদের দেশ থেকে কোনও রমণী সেখানে দৈবাৎ এসে পড়েছে। তখনই হয়তে অ্যালেন সেদিকে পিঠ ফিরিয়ে আমাকে উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়াম-এর কবিতা বোঝাচ্ছে, কিন্তু আমার পক্ষে মনঃসংযোগ রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ত খুবই।
রোজ মেরি নাম্নী এক বিশাল রমণী শরীর দাঁড়িয়ে আছে একটু দূরে, বার গায়ে একটা সুতোও নেই, তার দিকে বারবার আমার চোখ চলে যাবে না?
কয়েক দিনের মধ্যে অ্যালেন এই সব হইহল্লায় তিতিবিরক্তি হয়ে উঠল। সর্বক্ষণ ঘরের মধ্যে হট্টগোল, সে নিজের লেখাপড়ারও সময় পায় না। তখন অ্যালেন নিয়ম করে দিল, সকাল বারোটার আগে কেউ আসতে পারবে না। তাতেও লাভ হল না বিশেষ, প্রত্যেক রাতেই আড্ডা চলে প্রায় ভোর তিনটে-চারটে পর্যন্ত, তার ফলে ঘুমোতে হয় বেলা বারোটা পর্যন্ত। সবাই অ্যালেনের পয়সায় খাচ্ছে-দাচ্ছে, তাই অ্যালেন হুকুম দিল সবাইকেই কিছু না কিছু করত হবে, পালা করে কেউ বাজার করবে, কেউ বাসন মাজবে, কেউ কাপড় কাচবে। আমার ওপর দায়িত্ব পড়েছিল ব্রেকফাস্ট বানানোর, হট ডগ সেদ্ধ করা, ডিম ভাজা আর পাঁউরুটি সেঁকা আমার পক্ষে অতি সহজ কাজ।
এখানে স্থায়ী বাসিন্দা আমরা চারজন, তার মধ্যে গ্রেগরি করসোকে দিয়ে কোনও কাজই করানো যায় না। তাকে ঘর ঝাঁট দেওয়ার ভার দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু ঝাঁটা হাতে নিয়েও গ্রেগরি একটা লম্বা গল্প শুরু করে, তারপর নিজের গল্পে নিজেই হেসে লুটোপুটি খায়। একসময় অ্যালেন তার হাত থেকে ঝাঁটাখানা নিয়ে নিজেই শুরু করত ঝাঁট দিতে। এইরকম প্রতিদিন।
গ্রেগরি করসো অতিশয় বিশুদ্ধ ধরনের কবি, এবং একেবারেই পাগলাটে ধরনের মানুষ। তার ইটালিয়ান অরিজিন চেহারায় স্পষ্ট, খুবই রূপবান, কিন্তু সকাল থেকেই নেশা শুরু করে, গাঁজা-ভাঙ ছাড়াও তার মদেও যথেষ্ট আসক্তি, দাড়ি কামায় না, স্নান করে না, দাঁতও মাজে না। নেশাগ্রস্ত অবস্থাতেই সে হঠাৎ কবিতা লিখতে শুরু করে, চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে অ্যালেনের কাছে এক-একটা শব্দের বানান জিগ্যেস করে। মনে আছে, একদিন সে জিগ্যেস করেছিল, অ্যালেন, পোয়েট্রির প্লুরাল কি পোয়েট্রিজ হয়? অ্যালেন বলেছিল, না, পোয়েমস লেখো। তারপরই অ্যালেন আবার বলেছিল, হ্যাঁ, কেন হবে না, গ্রেগরি করসো লিখলে পোয়েট্রিজ-ও বিশুদ্ধ!
গ্রেগরি এক একদিন স্নান করে, দাড়ি কামিয়ে, সিল্কের জামা পরে বেরিয়ে যেত। সবাই হাসতে-হাসতে বলত, ও বিয়ে করতে যাচ্ছে। বড়লোকের মেয়েদের ঠকানো ছিল গ্রেগরির একটা পেশা। তার সুন্দর চেহারা ও খ্যাতির জন্য আকৃষ্ট হত অনেক মেয়ে, গ্রেগরি তাদের বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিত, দু-একজনকে সত্যি বিয়ে করে তাদের পয়সায় জুয়া খেলতে যেত, কিন্তু কোথাও সাত দিনের বেশি টিকতে পারেনি। সে এক্কেবারে জন্ম বাউন্ডুলে।
অ্যালেন আমাকে সাবধান করে দিয়েছিল, গ্রেগরি টাকা ধার চাইলে খবরদার দেবে না। ও কখনও ফেরত দেয় না। গ্রেগরিকেও ধমকে দিয়েছিল, তুমি খবরদার সুনীলের কাছে টাকা চাইবে না, ওর টাকা নেই। গ্রেগরি বলত, না, না, তুমি থাকতে আমি এ গরিব ইন্ডিয়ানের টাকা মারব, তাও কি হয়!
বেশ কয়েকদিন আমি মেতেছিলাম এখানে। মার্গারিটকেও ভুলে গিয়েছিলাম প্রায়। আয়ওয়ায় থাকার সময় আমার মন টিকছিল না, তখন মনে হত আয়ওয়াটাই আমেরিকা, কিন্তু এখানে পরিবেশ একেবারে অন্যরকম। এক দল ছেলেমেয়ে সবসময় উৎসাহ টগবগ করছে, সাহিত্য-শিল্প ছাড়া আর কোনও কথা নেই, জীবন-যাপনের কোনও চিন্তা নেই, এই বোহেমিয়ানিজমের আকর্ষণ এমনই তীব্র যে কাটানো প্রায় অসম্ভব। অ্যালেনও আমাকে বলেছিল, এখানে থেকে যাও, কোনও অসুবিধে নেই, তোমার কিছু লেখা-টেখা আমি অনুবাদের ব্যবস্থা করে দেব, তাতেই তোমার হাতখরচ চলে যাবে!
একদিন রাত্তিরে অ্যালেন ও আমি লম্বা হলঘরটার এক প্রান্তে শুয়ে আছি। নানারকম গল্প করতে-করতে অ্যালেন একসময় আমার গালে দুটো হালকা চাপড় মেরে বলল, সুনীল, হবে নাকি?
সমকামী অ্যালেন আমাকে তার পার্টনার হতে বলেছে। কয়েক মুহূর্ত মাত্র দ্বিধা করে আমি ভাবলাম, মন্দ কী? দেখাই যাক না, একটা নতুন অভিজ্ঞতা হবে। ক্ষতি তো কিছু নেই। আমি বললাম, ঠিক আছে, হোক। তুমি একবার, তারপর আমি একবার।
অ্যালেন আঁতকে উঠে বলল, না, না, তা হবে না। আমি অ্যাকটিভ। আমি প্যাসিভ হতে পারি না।
আমি বললাম, ওসব অ্যাকটিভ-প্যাসিভ আমি বুঝি না। আমি অভিজ্ঞতাটা পুরোপুরি চাই। তুমি যা করবে, আমিও তাই করব।
অ্যালেন বলল, থাক, দরকার নেই। দরকার নেই।
পরদিন সকালবেলা অ্যালেন বলল, তুমি কোনও মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব করছ না কেন? এখানে কত মেয়ে আসে, একজনকে বেছে নাও!
তখনই মার্গারিটের কথা আবার মনে পড়ে গেল আমার। এখানে অনেক যুবতীর সঙ্গেই আলাপ হয়েছে, কিন্তু কারুর সঙ্গেই ঘনিষ্ঠতা হয়নি। যখন তখন কারুর সঙ্গে শুয়ে পড়া আপাতত চলতি ফ্যাশান, যেন সবরকম সামাজিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। কিন্তু মার্গারিট আমার মন প্রাণ জুড়ে আছে।
সেই দিনই একটা কাণ্ড হল। অ্যালেন, পিটার ও অন্যান্যরা দুপুরবেলা বেরিয়ে গিয়েছিল, বাড়িতে শুধু আমি আর গ্রেগরি। গ্রেগরি স্নান-টান করে, ভালো জামা পরে বেরুবার উদ্যোগ করল, আমাকে বলল, এক রাজকুমারীর কাছে যাচ্ছি, দু’দিন ফিরব না। গ্রেগরিকেও এক রাজকুমারের মতনই দেখাচ্ছে। আমার দিকে ঘন ঘন তাকাচ্ছে সে, সন্দেহ হল, একা পেয়ে টাকা ধার চাইবে। কিন্তু গ্রেগরি কিছুই বলল না। সাড়ম্বরে গেল সে, শুনতে পেলাম তার জুতোর শব্দ। একটু পরেই সে ফিরে এল দৌড়ে, হাঁপাত-হাঁপাতে বলল, তোমার কাছে খুচরো পঞ্চাশ ডলার হবে, শিগগির দাও, শিগগির, আমি ট্যাক্সি ধরে দাঁড় করিয়ে এসেছি, ট্যাক্সি ভাড়া দিতে হবে, পঞ্চাশটা ডলার, চটপট দাও।
এমনই অপূর্ব গ্রেগরির কায়দা যে আমি প্রত্যাখ্যান করার কোনও সুযোগই পেলাম না, মন্ত্রমুগ্ধের মতন তার হাতে তুলে দিলাম পঞ্চাশ ডলার। সে আবার হুড়মুড়িয়ে নেমে গেল।
গ্রেগরি চেয়েছিল খুচরো পঞ্চাশ ডলার, ঠিক যেন খুচরো পঞ্চাশ পয়সা চাইছে। আমার কাছে ছিলই মোট সত্তর ডলার। গ্রেগরি চলে যাওয়ার পর গুম হয়ে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। অ্যালেন সাবধান করে দিয়েছিল, তবু ঠকতে হল, দোষ আমারই। তারপর মনে হল, যাক ভালো হয়েছে। প্রায় নিঃস্ব অবস্থায় এদেশে পৌঁছেছি, সেইভাবেই ফিরে যাব। অ্যালেনের ঘর থেকে ফ্রান্সে একটা ফোন করলাম মার্গারিটকে। আমি প্যারিস যাব শুনে সে দারুণ খুশি, তার মা অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছেন। প্যারিসে আমার থাকার জায়গারও কোনও অসুবিধে হবে না। টাকা-পয়সার জন্য চিন্তা নেই।
সেই দুপুরেই বেরিয়ে আমার প্লেনের টিকিটটা কনফার্মও করে আনলাম পরের দিনের জন্য। বিকেলে অ্যালেনকে জানালাম অভিপ্রায়। অ্যালেন বলল, প্যারিস ঘুরে আবার চলে এসো এখানে।
সে রাত্রেও আড্ডা ও গান হল প্রায় ভোর পর্যন্ত। একেবারে শেষের দিকে ফিরে এল গ্রেগরি। সগর্বে চেঁচিয়ে বলল, আজ জুয়া খেলায় অনেক জিতেছি, এই নাও সুনীল, তোমার পঞ্চাশ ডলার। আরও দশ ডলার দিচ্ছি, উইথ মাই কমপ্লিমেন্টস।
সবাই একেবারে থ। গ্রেগরি করসোর জীবনে এটা নাকি রেকর্ড। সে এ পর্যন্ত কারুর ধার শোধ করেনি।
পরদিন সকাল সাতটায়, সবাই তখন ঘুমোচ্ছে, কারুকে না জাগিয়ে আমি সুটকেস নিয়ে নেমে গেলাম নীচে। এক বছর আগে নিউ ইয়র্ক এয়ারপোর্টে একা নেমেছিলাম, কেউ আমাকে নিতে আসেনি, এবারেও একাই ফিরে গেলাম সেখানে। আমার আমেরিকা প্রবাসের এখানেই ইতি।