৮ম অধ্যায়
অশ্বত্থামার শিবিরপ্রবেশ-ধৃষ্টদ্যুম্নবধ
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “সঞ্জয়! মহারথ অশ্বত্থামা শিবিরে প্রবেশ করিলে কৃতবর্ম্মা ও কৃপাচার্য্য কি কাৰ্য্য করিলেন? তাঁহারা কি ভয়ব্যাকুল বা সামান্য রক্ষকগণ কর্ত্তৃক অলক্ষিতভাবে নিবারিত হইয়া পলায়ন করিলেন অথবা শিবির ভেদ এবং সোমক পাণ্ডবগণকে সংহারপূর্ব্বক পাঞ্চালদিগের হস্তে নিহত হইয়া দুর্য্যোধনের ন্যায় ধরাশায়ী হইলেন?”
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! মহাত্মা দ্রোণপুত্র শিবিরপ্রবেশে সমুদ্যত হইলে মহারথ কৃতবর্ম্মা ও কৃপাচার্য্য দ্বারদেশে অবস্থান করিতে লাগিলেন। মহাবীর অশ্বত্থামা তাঁহাদিগকে তথায় অবস্থিত দেখিয়া আনন্দচিত্তে মৃদুস্বরে কহিলেন, ‘হে বীরদ্বয়! আপনারা যত্ন করিলে নিদ্রাগত হতাবশিষ্ট বিপক্ষপক্ষীয় যোধগণের কথা দূরে থাকুক, সমুদয় ক্ষত্রিয়কুল সংহার করিতে পারেন। আমি এক্ষণে শিবিরমধ্যে প্রবেশ করিয়া কৃতান্তের ন্যায় পরিভ্রমণ করিব। যেন এ স্থানে কোন ব্যক্তি আপনাদের নিকট পরিত্রাণ না পায়, ইহাই আমার একমাত্র প্রার্থনা।’ মহাবাহু দ্রোণকুমার এই বলিয়া গম্যদ্বার পরিহারপূর্ব্বক অন্য স্থান দিয়া নির্ভরচিত্তে পাণ্ডবগণের শিবিরে প্রবেশ করিয়া সর্বাগ্রে নিঃশব্দপদসঞ্চারে ধৃষ্টদ্যুম্নের শয়নাগার-সন্নিধানে সমুপস্থিত হইলেন। ঐ সময় সমরপরিশ্রান্ত পাঞ্চালগণ বিশ্বস্তচিত্তে গাঢ়নিদ্রায় অভিভূত হইয়াছিলেন। মহাবীর অশ্বত্থামা তদ্দর্শনে আহ্লাদিতচিত্তে দ্রুপদপুত্রের শয়নগৃহে প্রবেশপূর্ব্বক তাঁহাকে দিব্যাস্ত্ররণসমাবৃত, সুগন্ধিমাল্য পরিশোভিত, বিচিত্র ক্ষৌমমণ্ডিত শয়নীয়ে অকুতোভয়ে নিদ্রাগত দেখিয়া পদাঘাত দ্বারা প্রবোধিত করিলেন। সমরদুর্ম্মদ ধৃষ্টদ্যুম্ন অশ্বত্থামার পদপ্রহারে জাগরিত ও উত্থিত হইয়া তাহাকে দ্রোণপুত্র বলিয়া জানিতে পারিলেন। তখন মহাবল অশ্বত্থামা দ্রুপদতনয়কে শয্যা হইতে সমুত্থিত দেখিয়া দুই হস্তে তাঁহার কেশ ধারণপূর্ব্বক তাঁহাকে ধরাতলে নিষ্পেষিত করিতে লাগিলেন। মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণপুত্রের প্রভাবে এইরূপ দুরবস্থাগ্রস্ত হইয়া নিদ্রা ও ভয়প্রযুক্ত প্রতিবিধানের কোন উপায়ই করিতে পারিলেন না। অশ্বত্থামা চরণ দ্বারা তাঁহার বক্ষঃস্থল ও কণ্ঠদেশ আক্রমণ করিয়া তাঁহাকে পশুর ন্যায় নিধন করিতে সমুদ্যত হইলেন। তখন দ্রুপদকুমার নখর প্রহারে দ্রোণপুত্রের কলেবর ক্ষতবিক্ষত করিয়া অস্পষ্টস্বরে কহিলেন, ‘আচাৰ্য্যপুত্র! অস্ত্রপ্রহার দ্বারা অবিলম্বে আমাকে সংহার কর, তাহা হইলে আমি তোমার প্রসাদে পবিত্রলোকে গমন করিতে পারিব। মহাবীর অশ্বত্থামা দ্রুপদতনয়ের এই অব্যক্ত বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, ‘রে কুলাঙ্গার! আচাৰ্য্যহন্তাদিগের কোন লোকেই গমনে অধিকার নাই; অতএব তোর উপর শস্ত্র নিক্ষেপ করা নিতান্ত অকৰ্ত্তব্য। কোপান্বিত দ্রোণপুত্র এই বলিয়া, সিংহ যেমন মদমত্ত মাতঙ্গের মর্ম্মপীড়ন করে, তদ্রূপ সুদারুণ পদাঘাতে ধৃষ্টদ্যুম্নের মর্ম্মপীড়ন করিতে লাগিলেন। তখন তত্ৰত্য মহিলাগণ ও ধৃষ্টদ্যুম্নের রক্ষক সকল তাঁহার আর্ত্তনাদে জাগরিত হইয়া তাঁহাকে ভূতোপহত জ্ঞান করিয়া ভয়ে বাঙনিস্পত্তি [বাক্য উচ্চারণ] করিতেও সমর্থ হইল না। মহাবীর অশ্বত্থামা এইরূপে ধৃষ্টদ্যুম্নকে নিপাতিত করিয়া রথে আরোহণপূর্ব্বক সিংহনাদে দশদিক্ পরিপূর্ণ করিয়া অন্যান্য শত্ৰুসংহারার্থ গমন করিতে লাগিলেন।
উত্তমৌজা ও যুধামনু-প্রমুখ বীরগণ বধ
মহারথ দ্রোণপুত্র ধৃষ্টদ্যুম্নের গৃহ হইতে বহির্গত হইলে যাবতীয় মহিলা ও রক্ষকগণের ভীষণ ক্রন্দনকোলাহল সমুত্থিত হইল। ধৃষ্টদ্যুম্নের পত্নীগণ স্বামীকে নিহত দেখিয়া হাহাকার করিতে লাগিলেন। তাঁহাদের রোদনশব্দে অন্যান্য ক্ষত্রিয়গণ সহসা জাগরিত হইয়া বৰ্মধারণপূর্ব্বক কোলাহলের কারণ জিজ্ঞাসা করিলে রমণীগণ ভয়বিহ্বলচিত্তে কাতরস্বরে কহিতে লাগিলেন, ‘তোমরা সত্বর আগমন কর। ঐ দেখ, একজন পুরুষ ধৃষ্টদ্যুম্নকে সংহার করিয়া রথে আরোহণপূর্ব্বক অবস্থান করিতেছে। ঐ ব্যক্তি মনুষ্য কি নিশাচর, তাহা আমরা কিছুই নির্ণয় করিতে পারিলাম না। তখন শিবিরস্থ প্রধান প্রধান যোধগণ সহসা অশ্বত্থামাকে পরিবেষ্টন করিলেন। মহাবীর দ্রোণকুমার রুদ্রাস্ত্র দ্বারা সেই সমাগত বীরগণকে নিপাতিত করিয়া অনতিদুরে নিদ্রিত উত্তমৌজাকে অবলোকনপূর্ব্বক তাঁহার সমীপে সমুপস্থিত হইলেন এবং অচিরাৎ পাদ দ্বারা তাঁহার কণ্ঠ ও বক্ষঃস্থল আক্রমণ করিয়া তাঁহাকে শমনসদনে প্রেরণ করিলেন। মহাবীর যুধামন্যু উত্তমৌজাকে রাক্ষসহস্তে নিহত বিবেচনা করিয়া সত্বর গদা গ্রহণপূর্ব্বক মহাবেগে অশ্বত্থামার হৃদয়ে আঘাত করিলেন। তখন দ্রোণপুত্র বেগে ধাবমান হইয়া তাঁহাকে ভূতলে নিক্ষেপপূর্ব্বক পশুর ন্যায় সংহার করিয়া ফেলিলেন।
যুধামন্য নিহত হইলে মহাবীর অশ্বত্থামা ইতস্ততঃ শয়ান মহারথগণের প্রতি ধাবমান হইয়া খড়্গাঘাতে যজ্ঞস্থলে বিকম্পিত পশুগণের ন্যায় একে একে তাঁহাদের প্রাণ সংহার করিলেন এবং ক্ষণকাল-মধ্যে শিবির-মধ্যস্থ ন্যস্তশস্ত্র পরিশ্রান্ত যোধগণকে সমুদয় হস্তী ও অশ্বের সহিত নিপাতিত করিয়া রুধিরাক্তকলেবরে কালান্তক যমের ন্যায় দৃষ্ট হইতে লাগিলেন। সেই করাল করবালধারী মহাবীরের গাত্রে অসিবিচ্ছিন্ন ইতস্ততঃ সঞ্চরিত বীরগণের শোণিতধারা সংলগ্ন হওয়াতে তাহাকে অতি ভীষণ অপূর্ব্ব প্রাণী বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। সমরে অগ্রসর যোধগণ অশ্বত্থামার অলৌকিক রূপদর্শনে নিতান্ত ব্যথিত হইয়া পরস্পরের মুখাবলোকন করিতে আরম্ভ করিলেন এবং অনেকে তাঁহাকে রাক্ষস বিবেচনা করিয়া নেত্র নিমীলিত করিতে লাগিলেন।
দ্রৌপদীর প্রতিবিন্ধ্যাদি পঞ্চপুত্রবধ
এইরূপে মহাবীর অশ্বত্থামা সাক্ষাৎ কৃতান্তের ন্যায় শিবিরে পরিভ্রমণ করিতে করিতে দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্র ও অবশিষ্ট সোমকগণকে অবলোকন করিলেন। শরাসনধারী মহারথ দ্রৌপদীতনয়গণ সমর কোলাহলে জাগরিত হইয়া ধৃষ্টদ্যুম্নের বিধানবার্ত্তা শ্রবণপূর্ব্বক অশ্বত্থামাকে শরনিকরে সমাচ্ছন্ন করিতে লাগিলেন। প্রভদ্রকগণ ও মহাবীর শিখণ্ডী তাঁহাদিগের সমরশব্দে প্রবোধিত হইয়া শরজালে দ্রোণপুত্রকে নিপীড়িত করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন সমরপরাক্রান্ত মহারথ অশ্বত্থামা সেই শরজালবর্ষী বীরগণকে দর্শন করিয়া সিংহনাদ করিতে লাগিলেন এবং পিতৃবধবৃত্তান্ত স্মরণ করিয়া সরোষনয়নে সহস্রচন্দ্র পরিশোভিত চর্ম্ম ও সুবর্ণমণ্ডিত দিব্য খড়্গ গ্রহণপূর্ব্বক রথ হইতে অবতীর্ণ হইয়া দ্রৌপদীতনয়গণের প্রতি ধাবমান হইলেন। তিনি সর্বাগ্রে প্রতিবিন্ধ্যের কুক্ষিদেশ ছেদন করিলে ঐ মহাবীর নিহত হইয়া ধরাতলে শয়ন করিলেন। তখন প্রতাপশালী সুতসোম প্রাস দ্বারা অশ্বত্থামাকে বিদ্ধ করিয়া খড়্গ উত্তোলনপূর্ব্বক তাঁহার প্রতি ধাবমান হইলেন। মহাত্মা দ্রোণপুত্ৰ তদ্দর্শনে ক্রোধভরে সুতসোমের অসিসমবেত [১] বাহু ছেদন করিয়া তাঁহার পার্শ্বদেশে খড়্গাঘাত করিলেন। মহাবীর সুতসোম সেই আঘাতে ব্যথিত হইয়া ধরাতলে নিপতিত হইলেন। তখন নকুলপুত্র মহাবল, শতানীক বাহুবলে অশ্বত্থামার হৃদয়ে রথচক্র নিক্ষেপ করিলেন। মহাবীর দ্রোণকুমার নকুলনন্দনের প্রহারে নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া তাঁহাকে ভূতলে নিপাতনপূর্ব্বক তাঁহার মস্তকচ্ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তখন মহাবীর শ্রুতকর্ম্মা পরিঘ ধারণপূর্ব্বক মহাবেগে ধাবমান হইয়া অশ্বত্থামার মধ্যদেশে আঘাত করিলেন। আচাৰ্য্যপুত্র তদ্দর্শনে করাল করবাল দ্বারা তাঁহার আস্যদেশ ক্ষতবিক্ষত করিতে লাগিলেন। মহাবীর শ্রুতকর্ম্মা আচাৰ্য্যতনয়ের খড়্গাঘাতে বিকৃতমুখ ও নিহত হইয়া ধরাতলে নিপতিত হইলেন। তখন মহারথ শ্রুতকীৰ্ত্তি অশ্বত্থামার প্রতি অনবরত শরবর্ষণ করিতে লাগিলেন। মহাবীর দ্রোণপুত্ৰ চর্ম্ম দ্বারা শ্রুতকীৰ্ত্তির সেই শরবর্ষণ নিবারণ করিয়াতাঁতাহার কুণ্ডলসম্বলিত মস্তক ছেদন করিয়া ফেলিলেন।
শিখণ্ডীর প্রাণসংহার
অনন্তর ভীষ্মনিহন্তা শিখণ্ডী প্রভদ্রকগণের সহিত মিলিত হইয়া মহাবীর অশ্বত্থামাকে বিবিধ অস্ত্রে নিপীড়িত করিয়া তাহার ললাটে এক বাণ নিক্ষেপ করিলেন। মহাবল-পরাক্রান্ত দ্রোণকুমার তদ্দর্শনে কোপান্বিত হইয়া খড়্গ দ্বারা শিখণ্ডীকে দুই খণ্ড করিয়া ফেলিলেন। দ্রুপদতনয় নিহত হইলে অসিমার্গবিশারদ মহাবীর অশ্বত্থামা ক্রোধভরে ধাবমান হইয়া যাবতীয় প্রভদ্রক, বিরাটরাজার হতাবশিষ্ট সৈন্য-সমুদয়, দ্রুপদের পুত্রপৌত্র ও সুহৃদগণ এবং অন্যান্য বীরগণকেও ছেদন করিতে লাগিলেন। ঐ সময় পাণ্ডবপক্ষীয় যোধগণ দেখিলেন যে, রক্তবদনা, লোহিতনয়না, রক্তমাল্যানুলেপনা, রক্তবস্ত্রধারিণী, কৃষ্ণবর্ণা কালরাত্রি অসংখ্য অশ্ব, কুঞ্জর ও ন্যস্তশস্ত্র মুক্তকেশ মহারথদিগকেও ভীষণ পাশে বদ্ধ করিয়া প্রস্থানে সমুদ্যত হইয়াছেন। হে মহারাজ! কুরু-পাণ্ডবের ভীষণ সংগ্রাম সমুপস্থিত হইয়া অবধি পাণ্ডবপক্ষীয় যোধগণ প্রতি রাত্রিতেই স্বপ্নে দেখিতেন যে, ঐ করালবদনা কামিনী তাঁহাদিগকে লইয়া গমন করিতেছেন এবং মহারথ দ্রোণতনয় তাহাদের সংহারে প্রবৃত্ত হইয়াছেন।
এইরূপে মহাবীর দ্রোণকুমার সেই দৈবোপহত প্রাণীগণকে সিংহনাদে বিত্রাসিত ও নিপাতিত করিলেন। বীরগণ তৎকালে পূর্ব্বকালীন স্বপ্নদর্শন স্মরণ করিয়া উহা দৈবপীড়ন বলিয়া বুঝিতে পারিলেন। অনন্তর পাণ্ডবশিবিরস্থ সহস্র সহস্র ধনুর্দ্ধর বীর সেই শব্দে জাগরিত হইয়া উঠিলেন। তখন মহাবীর অশ্বত্থামা সাক্ষাৎ কৃতান্তের ন্যায় কাহারও চরণদ্বয় ছেদন, কাহারও জঘন বিদারণ এবং কাহারও বা পার্শ্বদেশ ভেদ করিতে লাগিলেন। ঐ সময় কেহ কেহ গজ ও কেহ কেহ অশ্ব দ্বারা উন্মথিত হইল এবং অনেকে নিতান্ত পেষিত হইয়া আর্ত্তস্বর পরিত্যাগ করিতে লাগিল। এইরূপে সেই সমস্ত নিপাতিত বীরগণে রণভূমি পরিপূর্ণ হইলে ‘ঐ বীর কে, কোন্ জাতি হইতে উৎপন্ন হইয়াছে, কাহার কণ্ঠস্বর শ্রুতিগোচর হইতেছে’, এইরূপ নানাপ্রকার ক্রন্দনধ্বনি সমুত্থিত হইল। ঐ সময় দ্রোণনন্দন অন্তকের ন্যায় পরাক্রম প্ৰকাশপূর্ব্বক শস্ত্রহীন ও কবচশূন্য পাণ্ডবসৈন্য ও সৃঞ্জয়গণকে যমালয়ে প্রেরণ করিতে লাগিলেন। তৎকালে অনেকে অশ্বত্থামার শস্ত্রপাতে নিতান্ত ভীত হইয়া দ্রুতবেগে পলায়ন করিয়া নিদ্রাবেশপ্রভাবে বিসংজ্ঞ ও নিপতিত হইল। অনেকে মোহমুক্ত ও ঊরুস্তম্ভে অভিভূত হইয়া পড়িল এবং অনেকে নিতান্ত ভীত ও একান্ত অবসন্ন হইতে লাগিল।
ভৌতিক বিভীষিকাজ্ঞানে সৈন্যগণের বিক্ষোভ
অনন্তর মহাবীর অশ্বত্থামা সেই ভীমনিস্বনসম্পন্ন রথে পুনরায় আরোহণপূর্ব্বক ধনুর্ধারণ করিয়া শরনিকরে অনেকানেক বীরকে যমালয়ে প্রেরণ করিলেন। কতকগুলি বীর উত্থিত এবং কতকগুলি তাঁহার অভিমুখে ধাবমান হইতেছিল, তিনি তাঁহাদিগকে দূর হইতে মৃত্যুমুখে নিপাতিত করিলেন। তৎপরে তিনি রথচক্র দ্বারা অনেককে প্রমথিত করিয়া অবশিষ্ট শত্রুগণের প্রতি শরনিকর বর্ষণপূর্ব্বক ধাবমান হইলেন এবং অব্যবহিত পরেই বিচিত্র চর্ম্ম ও আকাশের ন্যায় শ্যামল অসি গ্রহণ করিয়া রণস্থলে বিচরণ করিতে লাগিলেন। এইরূপে দ্রোণতনয় মত্তমাতঙ্গ যেমন অতি বিস্তীর্ণ হ্রদ আলোড়িত করে, তদ্রূপ সেই শত্রুশিবির বিক্ষোভিত করিতে আরম্ভ করিলেন।
ঐ সময় নিদ্রায় একান্ত কাতর অনেক যোদ্ধা সেই তুমুল সংগ্রামশব্দে নিতান্ত ভীত ও উত্থিত হইয়া ইতস্ততঃ ধাবমান হইল। তন্মধ্যে কেহ কেহ অতি কর্কশস্বরে চীৎকার ও কেহ কেহ অসম্বদ্ধ প্রলাপ করিতে লাগিল। তৎকালে অনেকে অস্ত্রশস্ত্র ও বসন প্রাপ্ত হইল না; অনেকের কেশ আলুলিত হইয়া গেল; কেহই কাহাকে জ্ঞাত হইতে সমর্থ হইল না। কেহ কেহ গাত্রোত্থান করিতে উদ্যত হইয়া নিপতিত হইল; কেহ কেহ ইতস্ততঃ ভ্রমণ করিতে আরম্ভ করিল। হস্তী ও অশ্বেরা বন্ধন ছেদন করিয়া বিষ্ঠা মূত্র পরিত্যাগ করিতে লাগিল এবং কতকগুলি দলবদ্ধ হইয়া ধাবমান হইল। কতকগুলি মনুষ্য নিতান্ত ভীত হইয়া ভূতলে বিলীন হওয়াতে হস্তী ও অশ্বগণ তাহাদিগকে চরণ দ্বারা নিস্পেষিত করিয়া ফেলিল।
এইরূপে সেই রণস্থল তুমুল হইয়া উঠিলে রাক্ষসগণ হৃষ্টমনে সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিল। সেই সিংহনাদ-শব্দে দিঙ্মণ্ডল ও নভোমণ্ডল পরিপূর্ণ হইয়া গেল। হস্তী ও অশ্বগণ সেই ভীষণ শব্দ-শ্রবণে বন্ধন ছেদনপূর্ব্বক শিবিরস্থ ব্যক্তিদিগকে বিমর্পিত করিয়া ইতস্ততঃ ধাবমান হইল। তখন উহাদিগের চরণসমুত্থিত ধূলিজালে সেই রজনীযোগে শিবিরমধ্যে অন্ধকার দ্বিগুণ পরিবর্ধিত হইয়া উঠিল। তখন সকলেই জ্ঞানশূন্য হইয়া কে পিতা, কে পুত্র, কে ভ্রাতা, কিছুই স্থির করিতে পারিল না। হস্তী হস্তিযূথকে ও অশ্ব অশ্বগণকে অতিক্রম করিয়া তাড়িত, সমাহত, ভূতলে পাতিত ও মর্দ্দিত করিতে লাগিল। ঐ সময়ে সুপ্তোতি, অন্ধকারাচ্ছন্ন, জ্ঞানশূন্য মনুষ্যগণ কালপ্রেরিত হইয়াই যেন আত্মপক্ষবিনাশে প্রবৃত্ত হইল। তখন দ্বারপালেরা দ্বারদেশ ও শিবিররক্ষকেরা শিবির পরিত্যাগপূর্ব্বক ভয়ে প্রাণপণে পলায়ন করিতে লাগিল। তৎকালে কেহই কাহাকে চিনিতে পারিল না। সকলেই বন্ধুবান্ধব পরিত্যাগপূর্ব্বক পলায়ন করিয়া গোত্র ও নামোচ্চারণ করিয়া হা তাত! হা পুত্র! বলিয়া চীকার করিতে আরম্ভ করিল। অনেকে হাহাকার শব্দ করিতে করিতে ভূতলে শয়ান হইল। মহাবীর অশ্বত্থামা তদ্দর্শনে পলায়মান ব্যক্তিদিগকে আক্রমণ করিতে লাগিলেন।
কৃতবর্ম্মা ও কৃপ কর্ত্তৃক পলায়মান সৈন্যসংহার
ঐ সময় অনেক ক্ষত্রিয় প্রাণরক্ষাৰ্থ ভয়ে শিবির হইতে পলায়নে উদ্যত হইল। ভোজরাজ কৃতবর্ম্মা ও মহাবীর কৃপাচার্য্য দ্বারদেশেই তাহাদিগকে নিহত করিতে লাগিলেন। অনেকে অস্ত্র শস্ত্র ও কবচ পরিত্যাগপূর্ব্বক আলুলায়িতকেশে কৃতাঞ্জলিপুটে দণ্ডায়মান হইলেন। কৃপ ও কৃতবর্ম্মা তথাপি তাঁহাদিগকে পরিত্যাগ করিলেন না। ঐ সময় তাঁহারা উভয়ে দ্রোণপুত্রের প্রিয়চিকীর্ষু হইয়া শিবিরের তিন স্থানে অগ্নি প্রদান করিলেন। অগ্নি প্রজ্বলিত হওয়াতে শিবির আলোকময় হইলে আচাৰ্য্যতনয় অশ্বত্থামা করে তরবারি ধারণপূর্ব্বক বিচরণ করিয়া যাহারা তাহার অভিমুখে আগমন ও যাহারা ভয়ে পলায়ন করিতেছিল, তাহাদিগকে বিনাশ করিতে লাগিলেন। তাহার খড়্গাঘাতে অনেকে দ্বিখণ্ড হইয়া ভূতলে নিপতিত হইল। দীর্ঘকলেবর হস্তী, অশ্ব ও মনুষ্যগণ চীৎকার করিয়া ভূতলে নিপতিত হইতে লাগিল। তাদের কলেবরে পৃথিবী এককালে সমাকীর্ণ হইয়া গেল। এইরূপে অসংখ্য মনুষ্য নিহত হইলে বহুসংখ্যক কবন্ধ সমুত্থিত হইয়া ইতস্ততঃ ধাবমান হইল। তখন মহাবীর অশ্বত্থামা কোন কোন বীরের আয়ুধ ও অঙ্গদযুক্ত বাহু, কাহারও মস্তক, কাহারও করিশুণ্ড সদৃশ উরু, কাহারও পাদ, কাহারও পৃষ্ঠ, কাহারও পার্শ্ব, কাহারও মধ্যদেশ ও কাহারও কর্ণ ছেদন করিয়া ফেলিলেন এবং কাহারও কাহারও স্কন্ধদেশে আঘাত করিয়া তাহার মস্তক শরীরমধ্যে প্রবেশিত করিয়া দিলেন। তৎকালে তাঁহার প্রভাবে অনেকেই সমরে পরাঙ্মুখ হইল।
মহাবীর অশ্বত্থামা এইরূপে অসংখ্য মনুষ্য সংহারপূর্ব্বক বিচরণ করিতে আরম্ভ করিলেন। ঐ সময়ে রজনী ঘোরতর অন্ধকারে আচ্ছন্ন ও অতি ভয়ানক হইয়া উঠিল। অনেকে দ্রোণতনয়ের হস্তে নিহত ও অনেকে দৃঢ়তর সমাহত হইয়া সেই মৃত হস্তী, অশ্ব ও রথসঙ্কুল, যক্ষরাক্ষস-সমাকীর্ণ সমরস্থলে নিপতিত হইল। অসংখ্য লোক পিতা, ভ্রাতা ও পুত্রের নিমিত্ত আক্ষেপ করিতে লাগিল! ঐ সময় কেহ কেহ কহিল, ‘ধৃতরাষ্ট্রনয়েরা ক্রোধাবিষ্ট হইয়া যে কাৰ্য্যসম্পাদনে সমর্থ হয় নাই, আজ দুরাত্মা রাক্ষসগণ সেই কাৰ্য্য সংসাধন করিল। পাণ্ডবগণ এখানে উপস্থিত না থাকাতেই আমাদিগের এইরূপ দুর্দ্দশা ঘটিয়াছে। বাসুদেব-পরিরক্ষিত ধনঞ্জয়কে কি অসুর, কি গন্ধর্ব্ব, কি যক্ষ, কি রাক্ষস, কেহই পরাজিত করিতে সমর্থ হয় না। ঐ মহাবীর ব্রাহ্মণপ্রিয়, সত্যবাদী, দান্ত ও পরম দয়ালু। শত্রুপক্ষ নিদ্রিত, প্রমত্ত, ন্যস্তশস্ত্র, বদ্ধাঞ্জলি, ধাবমান বা মুক্তকেশ হইলে তিনি কখনই তাঁহাদিগকে বিনাশ করেন না। হায়! আজ দুরাত্মা রাক্ষসগণ কি ঘোরতর নৃশংস কার্য্যের অনুষ্ঠান করিল!’ হে মহারাজ! অসংখ্য লোক এইরূপ বিলাপ ও পরিতাপ করিতে করিতে ভূতলশায়ী হইল।
অনন্তর মুহূর্ত্তকালমধ্যে মনুষ্য ও অন্যান্য জীবগণের তুমুল কোলাহল তিরোহিত হইয়া গেল। বসুন্ধরা শোণিতসিক্ত হওয়াতে সেই ঘোরতর রজোরাশি এককালে অদৃশ্য হইল। তখন মহাবীর অশ্বত্থামা, পশুপতি যেমন পশু বিনাশ করেন, তদ্রূপ কি শয়ান, কি ধাবমান, কি যুধ্যমান, সকলকেই সংহার করিতে লাগিলেন। ঐ সময় অনেকে হুতাশনে দগ্ধ ও অশ্বত্থামার আঘাতে নিপীড়িত হইয়া পরস্পরকে বিনাশ করিতে আরম্ভ করিল। মহাবীর দ্রোণতনয় এইরূপে অর্দ্ধরাত্ৰমধ্যে পাণ্ডবদিগের সমুদয় সৈন্য শমনসদনে প্রেরণ করিলেন। অসংখ্য হস্তী, অশ্ব ও মনুষ্যগণ নিহত হওয়াতে ঐ রাত্রিতে রাক্ষস ও পিশাচগণের আনন্দের আর পরিসীমা রহিল না। তাহারা পুত্ৰকলত্রসমভিব্যাহারে [৪] তথায় সমাগত হইয়া শোণিত পান, মাংস ভক্ষণ এবং মেদ, মজ্জা, অস্থি ও বসা আস্বাদনপূর্ব্বক ইহা অতি উপাদেয়, ইহা অতি পবিত্র, ইহা অতি সুস্বাদু, এই বলিয়া মহা আহ্লাদে নৃত্য করিতে আরম্ভ করিল। উহাদের মধ্যে কেহ কেহ বসাপানে পরিতৃপ্ত হইয়া ধাবমান হইল। ঐ সমুদয় মাংসজীবী দেখিতে অতি ভয়ানক। উহাদিগের বর্ণ পিঙ্গল, দন্ত পর্ব্বতাকার, কেশ জটিল, জঙ্ঘা সুদীর্ঘ, উদর বৃহৎ, অঙ্গুলি পশ্চাদ্ভাগে নিহিত, কণ্ঠস্বর অতি ভয়ানক, শরীর ঘণ্টাজালে জড়িত এবং কণ্ঠ নীলবর্ণ। উহারা নিতান্ত নিষ্ঠুর ও নির্ঘণ্য; উহাদের মধ্যে অনেকেরই পাঁচ চরণ। হে মহারাজ! এইরূপ নানাপ্রকার বদনযুক্ত অতি বিকটাকার অর্বুদ অর্বুদ। রাক্ষস তথায় সমুপস্থিত হইয়াছিল; ঐ সময় অসংখ্য ভূতও তাহাদের সহিত সম্মিলিত হইল।
অনন্তর প্রত্যুষসময়ে রুধিরাক্তকলেবর মহাবীর অশ্বত্থামা শিবির হইতে প্রতিগমন করিবার বাসনা করিলেন। ঐ সময় তাঁহার খড়্গমুষ্টি একেবারে করতলে সংশ্লিষ্ট হইয়াছিল। তিনি অতি দুর্গম পথে পদার্পণপূর্ব্বক প্রতিজ্ঞা প্রতিপালন করিয়া কল্পান্তকালীন অনলের ন্যায় শোভা ধারণ করিয়াছিলেন। তৎকালে তাঁহার পিতৃবিনাশজনিত দুঃখ অন্তর্হিত হইয়াছিল। অনন্তর তিনি রজনীযোগে লোকসকল নিদ্রিত হইলে শিবিরে প্রবেশপূর্ব্বক উহা যেরূপ নিঃশব্দ দেখিয়াছিলেন, এক্ষণে তত্রত্য যাবতীয় লোক বিনষ্ট হওয়াতে উহা তদ্রূপ নিঃশব্দ দেখিয়া তথা হইতে নির্গত হইলেন এবং অচিরাৎ কৃপাচার্য্য ও কৃতবর্ম্মার সহিত মিলিত হইয়া তাঁহাদিগের হর্ষোৎপাদনপূর্ব্বক আদ্যোপান্ত সমস্ত কীৰ্ত্তন করিলেন; তখন তাহারাও ‘আমরা অসংখ্য পাঞ্চাল ও সৃঞ্জয়কে উৎসন্ন করিয়াছি’ বলিয়া অশ্বত্থামার প্রতি উৎপাদন করিতে লাগিলেন। অনন্তর, তাঁহারা তিনজনই করতালি প্রদানপূর্ব্বক মহা হর্ষধ্বনি করিতে আরম্ভ করিলেন।
হে মহারাজ! এইরূপে সেই রজনী নিদ্রিত ও অনবহিত পাণ্ডবপক্ষীয় বীরগণের পক্ষে অতি ভয়ানক হইয়াছিল। কালের গতি অতিক্রম করা সুকঠিন। দেখুন, যাহারা আমাদিগের অসংখ্য বল নিহত করিয়াছিল, তাহারাই আবার. এক্ষণে নিহত হইল।”
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! অশ্বত্থামা প্রতিনিয়তই আমার পুত্রের জয়লাভের নিমিত্ত যত্নবান্ ছিলেন। তিনি কি কারণে পূৰ্বেই ঐরূপ পরাক্রম প্রকাশপূর্ব্বক পাণ্ডব-সৈন্যসংহারে প্রবৃত্ত হয়েন নাই? এক্ষণে নীচাশয় দুৰ্য্যোধন নিপাতিত হইলেই বা তিনি কি কারণে ঐ কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিলেন, তাহা কীৰ্ত্তন কর।”
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! পূৰ্ব্বে মহাবীর অশ্বত্থামা অসাধারণ ধীশক্তিসম্পন্ন বাসুদেব, সাত্যকি ও পাণ্ডবগণের ভয়ে ঐ কার্য্যের অনুষ্ঠান করিতে সমর্থ হয়েন নাই। এক্ষণে তাঁহারা, তথায় উপস্থিত না থাকাতে, বিশেষতঃ রাত্রিকালে সকলেই নিঃশঙ্কচিত্তে নিদ্রিত হওয়াতেই তিনি অভিলষিত কাৰ্য্যসংসাধনে সমর্থ হইলেন। বাসুদেব ও সাত্যকি সমবেত পাণ্ডবগণের সমক্ষে অন্যের কথা দূরে থাকুক, দেবরাজ ইন্দ্রও পাঞ্চাল ও সৃঞ্জয়গণকে বিনাশ করিতে পারেন না। এইরূপে মহাবীর অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য্য ও কৃতবর্ম্মা পাণ্ডবসৈন্যগণকে বিনাশপূর্ব্বক পরস্পরের মুখাবলোকন করিয়া ‘পরম সৌভাগ্য, পরম সৌভাগ্য’ বলিয়া আহ্লাদ প্রকাশ করিতে লাগিলেন। অনন্তর মহাবীর দ্রোণতনয় মহা আহ্লাদে কৃপাচার্য্য ও কৃতবর্ম্মাকে আলিঙ্গন করিয়া কহিলেন, ‘আমি দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্র এবং হতাবশিষ্ট পাঞ্চাল, সোমক ও মৎস্যগণকে নিহত করিয়াছি। এক্ষণে আমরা কৃতকার্য্য হইলাম। অতএব আর বিলম্ব করিবার প্রয়োজন নাই। অচিরাৎ কুরুরাজের সমীপে গমনপূর্ব্বক যদি তিনি জীবিত থাকেন, তাহা হইলে তাঁহাকে এই সকল বৃত্তান্ত নিবেদন করা কর্ত্তব্য।”