হস্তিনা নগরে এল দারুক সারথি।
করজোড়ে কহে কথা ধর্ম্মরাজ প্রতি।।
অবধান কর রাজা পাণ্ডুর নন্দন।
কৃষ্ণ পাঠাইল মোরে তোমার সদন।।
গোবিন্দের প্রিয়বন্ধু তোমা পঞ্চভাই।
তোমার ভাবনা বিনে অন্য মনে নাই।।
সে কারণে আমারে পাইলেন হেথা।
দ্বারকা লইয়া যাইব পার্থ মহারথা।
বহুদিন তাঁর সহ নাহি দরশন।
হেই হেতু লইতে কহেন নারায়ণ।।
তিলেক বিলম্ব রাজা না হয় বিচার।
শীঘ্রগতি অর্জ্জুন করুন অগ্রসর।।
কৃষ্ণের বচন শুনি পঞ্চ সহোদর।
দারুকেরে বসাইয়া করিয়া আদর।।
বসিয়া সুস্থির চিত্ত না হয় দারুক।
হৃদয় দহিছে শোকে বৈসে হেঁটমুখ।
দারুকের চিত্ত রাজা দেখি উচাটন।
বিস্ময় ভাবিয়া মানিছেন মনে মন।।
এইত দারুক হয় কৃষ্ণের সারথি,
যেই কৃষ্ণ অনাদি পুরুষ লক্ষ্মপতী।।
তাঁহার আশ্রিত জন কি দুঃখে দুঃখিত।
ইহার কারণ কিছু না বুঝি কিঞ্চিৎ।।
এত চিন্তি জিজ্ঞাসেন ধর্ম্মের নন্দন।
কিহেতু দারুক এত চিত্ত উচাটন।।
কৃষ্ণের আশ্রিত জন কিবা তব দুঃখ।
কি দুঃখে ত্রাসিত হৈলে কহত দারুক।।
সাত্যকি প্রদ্যুম্ন শাম্ব যাদব সকল।
কেমন আছেন অনুরুদ্ধ মহাবল।।
কেমন আছেন সবে কহ সত্যবাণী।
কহ দেখি কৃষ্ণের কুশলবার্ত্তা শুনি।
তব চিত্ত উচাটন দেখিয়া নয়নে।
প্রাণাধিক মিত্র মম ধৈর্য্য নাহি মানে।।
কৃষ্ণের কুশল কহ দারুক সারথি।
কেমন আছেন প্রিয়বর যদুপতি।।
শুনিয়া দারুক কহে যোড়করি হাত।
সে সকল অবগত হইবে পশ্চাত।
ত্বরিত অর্জ্জুনে রাজা করহ বিদায়।
বন্ধুজন দেখিতে চাহেন যদুরায়।।
শুনি অনুমতি দেন পাণ্ডুবংশপতি।
সুসজ্জ হইয়া পার্থ যান শীঘ্রগতি।।
ত্বরিত গমনে পার্থ দ্বারকানগরী।
বিস্ময় মানেন সেই দ্বারাবতী হেরি।।
পূর্ব্বরূপ শোভা কিছু না সেখানে আর।
শূন্যাকার পুরীখান দিনে অন্ধকার।।
পুরেতে পুরুষ নাহি কেবল রমণী।।
চিত্র-পুত্তলিকা প্রায় আছে অনুমানি।।
শুষ্ক ওষ্ঠ শুষ্ক মুখ শুষ্ক সর্ব্ব অঙ্গ।
না হয় আনন্দ বাদ্য নৃত গীত রঙ্গ।।
মনুষ্যের শব্দ নাহি দ্বারকানগরে।
কপোত পেচক শিবা চৌদিকে বিহরে।।
গৃধ্র কঙ্ক নানা পক্ষী উড়ে বসে পালে।
ঘোরতর শব্দ করি উঠে বসে চালে।।
এত সব দেখি পার্থ হইয়া চিন্তিত।
চক্ষেতে পড়য়ে জল চিত্ত বিকলিত।।
বসুদেব দৈবকী রোহিণী তিনজন।
প্রাণহীন জন যেন ভূমিতে শয়ন।।
প্রণমিয়া জিজ্ঞাসেন অর্জ্জুন-বারতা।
শুষ্কতনু সবার বদনে নাহি কথা।।
পুনঃ পুনঃ পার্থ বীর করেন জিজ্ঞাসা।
হরি বলি কান্দে সবে নাহি অন্য ভাষা।।
কৃষ্ণ বিনা প্রাণ নাহি বলে সর্ব্বজন।
চিন্তাম্বিত হইলেন কুন্তীর নন্দন।।
দারুক বলেন পার্থ কি কর ভাবনা।
প্রভুরে দেখিবা যদি চল সর্ব্বজনা।।
প্রভাসের তীরেতে আছেন তথাই।।
এতবলি সত্বরে চলিল দুইজন।
শূন্যময় হৈল পুরী দ্বারকা ভুবন।।
পথ বিহরণে সবে যায় ধীরে ধীরে।
আসিয়া মিলিল সবে প্রভাসের তীরে।।
তথায় দেখিয়া যদুকুলের সংহার।
ভূমে গড়াগড়ি যায় অঙ্গ সবাকার।।
হাহা রবে কান্দিলেন ইন্দ্রের নন্দন।
করেন বিলাপ বহু মহাশোক মন।।
রামের শরীর দেখি প্রভাসের তীরে।
বিলাপ করেন পার্থ লুন্ঠিত শরীরে।।
হায় যদুকুলপতি বীর হলধর।
মুষল লাঙ্গল কেন ভূমির উপর।।
সকল ত্যজিয়া প্রভু যোগে দিলা মন।
দুষ্ট দৈত্য বিনাশ করিবে কোন্ জন।।
ভারাবতরণ হেতু আসি ক্ষিতিতলে।
পৃথিবীর ভার হরি যোগ আচরিলে।।
বারেক উত্তর দেহ রেবতীরমণ।
কান্দিয়া আকুল তব বন্ধু পরিজন।।
তবে ধনঞ্জয় যায় বৃক্ষের তলায়।
প্রাণনাথ কৃষ্ণদেহ দেখিয়া তথায়।।
কৃষ্ণদেহ কোলে করি কান্দিছেন বীর।
পৃথিবী তিতিল তাঁর নয়নের নীর।
মহাভারতের কথা অমৃত অর্ণবে।
পাঁচালী প্রবন্ধে কহে কাশীরাম দেবে।।