অতল জলের পথিক
এবার, প্রফেসর, ক্যাপ্টেন নেমো বললেন, আমাদের সমুদ্র যাত্রা শুরু হবে; আবার একবার আস্ত পৃথিবী ঘুরে আসবে নটিলাস সমুদ্রের তলা দিয়ে। আমাকে গিয়ে যাত্রার ব্যবস্থা করতে হয়। এখন আমরা পারীর মধ্যরেখার ৩৭°১৫’ পশ্চিম দ্রাঘিমা আর ৩০° অক্ষরেখায় আছি। এখান থেকেই আজ নভেম্বরের আট তারিখে দ্বিপ্রহরে আমাদের সমুদ্রতল অভিযান শুরু হবে। আসলে আমরা এখন জাপানের উপকূল থেকে তিনশো মাইল দূরে রয়েছি। আপনি বরং এখানেই বসুন, আমি ইঞ্জিনঘর থেকে ঘুরে আসি।
ক্যাপ্টেন নেমো চলে গেলেন। আমি একা বসেবসে এই রহস্যময় মানুষটির কথা ভাবতে-ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়লুম। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে অতীতের স্মৃতি তার পক্ষে অত্যন্ত বেদনাময়; তাঁর আর্ত পাণ্ডর মুখচ্ছবিতে বিষণ্ণ অথচ উজ্জ্বল চোখ দুটি যেন অত্যন্ত সযত্নে কোনো দূর দিনকে লুকিয়ে রাখতে চাচ্ছে। মানুষটি স্বাধীনচেতা; যতক্ষণ কথা হলো ততক্ষণই কেবল স্বাধীনতার কথা উল্লেখ করেছেন বারেবারে। তবে কি তিনি কোনো পরাধীন দেশের মানুষ? কোন দেশের মানুষ তিনি আসলে? কেন তিনি পৃথিবীকে এমন ঘৃণা করেন? কেন এই মানবজাতি সম্বন্ধে তার অবজ্ঞা ও ঘৃণার শেষ নেই? কেন তার গলার স্বর মাঝে মাঝে অমন তীব্র ও ভীষণ হয়ে ওঠে?
কতক্ষণ ধরে যে এসব কথা ভাবছিলুম বলতে পারবো না। হঠাৎ অন্যমনস্ক ভাবে চোখ গিয়ে পড়লো টেবিলের উপরকার মস্ত ভূগোলকটার উপর। তারপর ভালো করে তাকিয়ে আঙুল রেখে দেখলুম আমরা কোনখানে রয়েছি–কোনথানে ওই দ্রাঘিমা আর অক্ষরেখা পরস্পরকে ছেদ করেছে।
ডাঙায় যেমন নদী থাকে, তেমনি থাকে সিন্ধুতলেও। তাপমাত্রা আর বর্ণলেপের তারতম্য থেকেই এই বিশেষ স্রোতগুলোকে শনাক্ত করতে হয়। এদের ভিতর সবচেয়ে বিখ্যাত হলো গালফ স্ট্রিম এই স্রোত ধরেই আমরা এখন ছুটে চলেছি। নিপ্পনীরা এই সিন্ধু-নদীকে বলে কুররা-শিভো অর্থাৎ কালো নদী। বঙ্গোপসাগর থেকে বেরিয়ে এই স্রোত মালাক্কা প্রণালী অতিক্রম করে এশিয়ার উপকূল ধরে এগোতে-এগোতে একেবারে উত্তর-প্রশান্ত মহাসাগরে এসে পড়ে। এই সামুদ্রিক স্রেতটির রঙ এত গাঢ়-নীল যে প্রায় কালো বলেই বোধ হয়। আর এই স্রোত যে শুধু কালো তা-ই নয়, বেশ উষ্ণও বটে। ভূগোলকটির উপর আঙুল রেখে এই কালো নদীর গতিপথ দেখছি এমন সময়ে ঘরে ঢুকলো নেড আর কোনসাইল।
সংগ্রহশালাটি দেখেই দুজনে বিস্ময়ে হতবাক। কিন্তু নেড ল্যাণ্ড ডাকাবুকো একবোখা লোক; তা-দেখে সহজে ভুলবে কেন? কী করে এই নটিলাস নামক জেলখানা থেকে পালানো যায়, সেই চিন্তাই তখন তার কাছে একমাত্র চিন্তা। কথাবার্তার মধ্যেও বারেবারে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সেই প্রসঙ্গই উত্থাপন করছে।
এমন সময় হঠাৎ সব অন্ধকার হয়ে গেলো। নেডল্যাণ্ড কী-একটা কথা বলতে চাচ্ছিলো, কিন্তু হঠাৎ এই গভীর অন্ধকার নেমে এলো বলে তার মুখের কথা মুখেই রয়ে গেলো। কী যে করবো কিছুই বুঝতে পারছিলুম না। এই অন্ধকার কি কোনো ভীষণ অমঙ্গলের সংকেত, না কি নটিলাস-এর যাত্রার সুচনা-তা আমাদের কাছে স্পষ্ট ছিলো না। শুধু একটা ঘড়ঘড়ে শব্দ ছাড়া আর কোনো সাড়াশব্দ নেই। নেড ল্যাণ্ড শুধু বললে, এবার সব শেষ!
আচমকা সেলুনের দু-পাশে দুটি আয়তাকার কাচের মধ্য দিয়ে উজ্জ্বল আলো দেখা দিলো। অমনি সিন্ধুতল ঝলমলে হয়ে উঠলো, ওই পুরু কাচ ছাড়া। আমাদের সঙ্গে সমুদ্রের আর কোনো ব্যবধান রইলো না।
এই কাচের ওপাশে যে-অপরূপ দৃশ্য ফুটে উঠলো, তা কোনোদিনই ভোলবার নয়। প্রকৃতির হাতে গড়া এক বিপুল জলাধারে আলো এসে পড়লো, আর উদঘাটিত করে দিলো এক বিস্ময়কর দৃশ্য, যেখানে প্রাণের স্রোত বয়ে চলেছে অবিশ্রাম, যেখানে সবুজ শ্যাওলার ফাকে ফাকে স্বচ্ছল ও স্বাধীন মাছেরা খেলা করে বেড়াচ্ছে—কত বিভিন্ন জাতের, বিভিন্ন রূপের, বিভিন্ন আকারের মাছ। আলোর রেখা যেন তাদের টান দিয়েছিলো। তাই আকৃষ্ট হয়ে ছুটে এসেছিলো অগুন্তি মাছের ঝাঁক। যেন কোনো তৃতীয় নয়ন চোখের সামনে থেকে কোনো-এক বিশ্রী পর্দা তুলে দিয়ে আশ্চর্যকে উন্মোচন করে দিল। আমি যখন মুগ্ধ বিস্ময়ে এই আশ্চর্য দৃশ্যে তন্ময় হয়ে আছি, নেড কিন্তু তখন এই মৎস্যকুলের মধ্যে কোনটা সুখাদ্য এবং কোনটা অখাদ্য তা-ই নিয়ে মহা-সমস্যায় পড়েছে।
প্রায় দু-ঘণ্টা ধরে এই আশ্চর্য মৎস্যবাহিনীকে দেখে গেলুম আমি। চেনাঅচেনা মাছের বাহিনী নটিলাস-এর আলোর রেখা ধরে ছুটে এলো তার পিছনপিছন : ম্যাকারেল, স্যালাম্যাণ্ডার, সারমুলেট, সিন্ধুসাপ—কত কি। তারপর হঠাৎ সেই পুরু কঁচের জানলা বন্ধ হয়ে গেলো, আর সেলুনের মধ্যে উজ্জ্বল আলো জ্বলে উঠলো। সে অপরূপ দৃশ্য হারিয়ে গেলো মুহূর্তে। কিন্তু অনেক পরেও আমার ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে হানা দিলো সেই সব উজ্জ্বল মসৃণ বিকট-সুন্দর মৎস্যবাহিনী-সমুদ্রের সেই স্পন্দমান বাসিন্দারা, নটিলাস-এর কাচের জানলা দুটি কোনো তৃতীয়-নয়নের মতো হয়ে আমার সামনে যাদের চাঞ্চল্য, স্পন্দন ও খেলা উন্মোচিত করে দিয়েছিলো।