৮৯তম অধ্যায়
ভীম-ভীষ্মযুদ্ধ-ধৃতরাষ্ট্রতনয় সুনাভবধ
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! প্রতাপশালী ভাস্করসদৃশ প্রভাসম্পন্ন, মহাবীর শান্তনুতনয় সমরে সমাগত হইলে পাণ্ডবগণ তাঁহাকে অবলোকন করিতে সমর্থ হইলেন না। ক্ষণকাল পরে পাণ্ডবসৈন্যগণ ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের নিয়োগানুসারে ভীষ্মের উপর শরনিকর নিক্ষেপ করিয়া সংগ্রামে ধাবমান হইল। তখন সমরশ্লাঘী শান্তনুনন্দন অসংখ্য সায়ক বর্ষণ করিয়া মহাধনুৰ্দ্ধর সোমক, সৃঞ্জয় ও পাঞ্চালগণকে পাতিত করিতে লাগিলেন। রণোৎসাহী পাঞ্চাল ও সোমকগণ ভীষ্মের শরে দৃঢ়তর সমাহত হইয়াও মৃত্যুভয় পরিত্যাগপূর্ব্বক তাঁহার অভিমুখে ধাবমান হইলেন। মহাবীর শান্তনুতনয় তাঁহাদের কাহার হস্ত ও কাহার মস্তকচ্ছেদন এবং রথিগণের রথ ভগ্ন করিতে আরম্ভ করিলেন। ভীষ্মের ভীষণ শরপ্রভাবে সমরক্ষেত্রে চতুর্দ্দিকে অশ্ব হইতে নিপতিত অশ্বারোহিগণের মস্তক ও আরোহিশূন্য, ভূতলে শয়ন, পর্ব্বতোপম গজসমুদয় দৃষ্ট হইতে লাগিল।
“হে মহারাজ। ঐ সময় পাণ্ডবপক্ষে রথিশ্রেষ্ঠ ভীমসেন ব্যতীত, আর কেহই সমরে বিক্রম প্ৰকাশ করিতে সমর্থ হইল না। ঐ মহাবীর ভীষ্মকে আক্রমণপূর্ব্বক তাড়ন করিতে লাগিলেন। এইরূপে ভীষ্ম ও ভীমসেনের সংগ্রাম সমুপস্থিত হইলে, উভয়পক্ষীয় সৈন্যগণমধ্যে ঘোরতর কোলাহল আরম্ভ হইল। পাণ্ডবগণ হৃষ্টচিত্তে সিংহনাদ করিতে লাগিলেন। মহারাজ দুৰ্য্যোধন সোন্দরগণসমভিব্যাহারে ভীষ্মকে রক্ষা করিতে নিযুক্ত হইলেন। মহাবীর ভীমসেন ভীষ্মের সারথিকে সংহার করিলে অশ্বগণ উচ্ছৃঙ্খল হইয়া ভীষ্মের রথ লইয়া ইতস্ততঃ ধাবমান হইতে লাগিল। মহাবীর ভীমসেন ঐ অবসরে সুতীক্ষ্নক্ষুরপ্রদ্বারা সুনাভের মস্তকচ্ছেদন করিলেন। হে রাজন! এইরূপে আপনার পুত্র সুনাভ নিহত হইলে মহাবীর আদিত্যকেতু, বহুশী, কুণ্ডধার, মহোদর, অপরাজিত, পণ্ডিত ও বিশালাক্ষ-আপনার এই সাতপুত্র সোদর বিনাশ সহ্য করিতে না পারিয়া বিচিত্র কবচ ও আয়ুধসমুদয় গ্রহণপূর্ব্বক ভীমসেনের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইলেন। পূর্ব্বে ইন্দ্র যেমন বৃত্ৰকে বাণবিদ্ধ করিয়াছিলেন, তদ্রূপ মহাবীর মহোদর বজ্রসদৃশ নয়বাণে ভীমসেনকে বিদ্ধ করিলেন। তখন আদিত্যকেতু সপ্ততি, বহ্বাশী পাঁচ, কুণ্ডধার নবতি, বিশালাক্ষ সাত, পণ্ডিত তিন ও মহারথ অপরাজিত অসংখ্য সায়কদ্বারা ভীমসেনকে তাড়িত করিলেন।
ধৃতরাষ্ট্রের অপরাজিতপ্রমুখ সপ্তপুত্রবধ
“মহাবীর বৃকোদর সমরে শক্রগণের প্রহার সহ্য করিতে না পারিয়া বামহস্তদ্বারা শরাসন নিপীড়ন করিয়া অনাতপর্ব্ব শরপ্ৰহারে অপরাজিতের মস্তকচ্ছেদন করিলেন; পরে ভল্লদ্বারা সর্ব্বসৈন্যসমক্ষে মহারথ কুণ্ডধারকে শমনসদনে প্রেরণপূর্ব্বক রণপণ্ডিত পণ্ডিতের প্রতি এক সুতীক্ষ্নশর নিক্ষেপ করিলেন। ভীমনিক্ষিপ্ত ভীষণ সায়ক কালপ্রেরিত ভুজঙ্গের ন্যায় পণ্ডিতকে বিনষ্ট করিয়া ধরণীতলে প্রবিষ্ট হইল। তখন মহাবীর বৃকোদর পূর্ব্বতনক্লেশ স্মরণপূর্ব্বক তিনশরে বিশালাক্ষের মস্তকচ্ছেদন করিয়া মহোদরের বক্ষঃস্থলে সুতীক্ষ্ন নারাচ নিক্ষেপ করিলেন। মহোদর ভীমের ভীতপ্রহারে নিহত হইয়া ভূতলে নিপতিত হইলে মহাবীর ভীমসেন তীক্ষ্নবাণে আদিত্যকেতুর ছত্র ও নিশিতভল্লপ্রহারে তাঁহার মস্তকচ্ছেদন করিয়া আনতপর্ব্ব শরদ্বারা বহ্বশীকে যমালয়ে প্রেরণ করিলেন। হে রাজন! সেই মহাবীর সমুদয় বিনষ্ট হইলে আপনার অন্যান্য তনয়গণ ভীমসেনের প্রতিজ্ঞ সত্য বোধ করিয়া ইতস্তত পলায়ন করিতে লাগিলেন। তখন মহারাজা দুৰ্য্যোধন ভ্রাতৃবিনাশে নিতান্ত কাতর হইয়া কৌরবসৈন্যগণকে কহিলেন, “হে সৈন্যগণ! এই দুরাত্মা ভীমকে তোমরা সত্বর সংহার কর।”
দীনতাপন্ন দুর্য্যোধনপ্রতি ভীষ্মের তিরস্কার
“হে মহারাজ! আপনার পুত্ৰগণ এইরূপে সৌন্দরগণকে বিনষ্ট দেখিয়া ভীমসেনের পূর্ব্বপ্রতিজ্ঞা স্মরণ করিতে লাগিলেন। হে রাজন! সত্যবাদী মহাপ্রাজ্ঞ বিদুর যাহা কহিয়াছিলেন, তাহা এক্ষণে সত্য হইল। আপনি লোভ, মোহ ও পুত্ৰপ্রীতিনিবন্ধন পূর্ব্বে বিদুরের হিতবাক্য বুঝিতে পারেন নাই। মহাবাহু বৃকোদর মহাশয়ের পুত্ৰগণকে বিনষ্ট করিতে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন। যাহা হউক, এক্ষণে যুদ্ধবৃত্তান্ত শ্রবণ করুন।
“মহারাজ দুৰ্য্যোধন ভ্রাতৃবধে কাতর হইয়া ভীষ্মের সমীপে গমনপূর্ব্বক বাষ্পগদগদম্বরে কহিতে লাগিলেন, “হে পিতামহ! ভীমসেন সংগ্রামে আমার ভ্রাতাদিগকে সংহার করিয়াছে। আমরা বহু যত্নসহকারে সংগ্রাম করিতেছি, তথাপি আমাদের সৈন্যগণ নিহত হইতেছে। আপনি উদাসীন হইয়া সতত আমাদিগের উপেক্ষা করিতেছেন। আমি সমরে প্রবৃত্ত হইয়া নিতান্ত কুকর্ম্ম করিয়াছি।”
“মহাত্মা ভীষ্ম দুৰ্য্যোধনের বাক্যশ্রবণে নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া কহিলেন, “হে দুৰ্য্যোধন! আমি, দ্রোণ, বিদুর ও যশস্বিনী গান্ধারী, আমরা পূর্ব্বে তোমাকে এই কথা কহিয়াছিলাম, তুমি তৎকালে আমাদের বাক্যে উপেক্ষা করিয়াছিলে। যাহা হউক, আমি পূর্ব্বে তোমাদের নিকট প্রতিজ্ঞা করিয়া এক্ষণে সমর পরিত্যাগ করিব না; দ্রোণাচাৰ্য্যও রণে ক্ষান্ত হইবেন না; কিন্তু আমি সত্য কহিতেছি যে, মহাবীর ভীমসেন সমরে ধার্ত্তরাষ্ট্রগণের মধ্যে যাহাকে যাহাকে দেখিবে, তাহাকে তাহাকে অবশ্যই সংহার করিবে। অতএব তুমি স্থির হইয়া দৃঢ়বুদ্ধি অবলম্বনপূর্ব্বক পাণ্ডবগণের সহিত যুদ্ধ কর। পাণ্ডবগণকে পরাজয় করা ইন্দ্রাদি দেবগণেরও দুঃসাধ্য।’ ”