৮৯তম অধ্যায়
কৌরবসৈন্যগণের পরাজয়
অর্জ্জুন কহিলেন, হে হৃষীকেশ! যে স্থানে দুৰ্ম্মর্ষণ অবস্থান করিতেছে, সেই স্থলে শীঘ্র রথ লইয়া গমন কর। আমি এই গজ সৈন্য ভেদ করিয়া অরিবাহিনী মধ্যে প্রবেশ করিব। তখন মহাবাহু কেশব অর্জ্জুনের আদেশানুসারে দুৰ্ম্মর্ষণের অভিমুখে অশ্বসঞ্চালন করিলেন। অনন্তর অর্জ্জুনের সহিত কৌরবগণের অতি ভীষণ সংগ্রাম সমুপস্থিত হইল। ঐ যুদ্ধে অসংখ্য রথী, নর ও মাতঙ্গ প্রাণ পরিত্যাগ করিল। মেঘ যেমন পর্ব্বতোপরি বারি বর্ষণ করে সেই রূপ মহাবীর পার্থ অরাতিগণের উপর শরবর্ষণ করিতে লাগিলেন। কৌরব পক্ষীয় রখিগণও সত্বরে কৃষ্ণ ও অর্জ্জুনের উপর শরজাল বিস্তার করিলেন। তখন মহাবাহু ধনঞ্জয় রোষপরবশ হইয়া শরদ্বারা রথিগণের মস্তক ছেদন করিতে লাগিলেন। দংশিতাধর উদ্ভান্তনয়ন কুলালঙ্কৃত উষ্ণিষসুশোভিত নরমস্তকে ধরাতল সমাকীর্ণ হইয়া গেল, ইতস্তত: বিক্ষিপ্ত যোদ্ধৃগণের মস্তক সমুদায় পুণ্ডরীক বনের ন্যায় শোভা ধারণ করিল। স্বর্ণ নির্মিত বৰ্ম্মসকল রুধিরাক্ত হইয়া সৌদামিনী-মণ্ডিত মেঘমালার ন্যায় দৃষ্ট হইতে লাগিল। পরিপক্ক তালফল সকল ধরাতলে নিপতিত হইলে যে রূপ শব্দ হয়, সৈন্যগণের মস্তক সমুদায়, রণক্ষেত্রে নিপতিত হওয়াতে সেই রূপ শব্দ সমুত্থিত হইল। কবন্ধগণ কেহ কেহ শরাসন অবলম্বন ও কেহ কেহ খড়্গ নিষ্কাশনপূর্ব্বক প্রহারোদ্যত হইয়া দণ্ডায়মান রহিল; বীর পুরুষেরা অর্জ্জুনকে পরাজয় করিতে একাগ্রচিত্ত হইয়া স্ব স্ব শিরঃপতন বৃত্তান্ত অবগত হইতে পারিলেন না। তুরঙ্গমগণের মস্তক, গজযূথের শুণ্ড এবং বীরগণের বাহু ও মস্তক সমুদায় রণস্থল সমাচ্ছাদিত হইল।
হে মহারাজ! ঐ সময় আপনার সৈন্যগণ সমুদায় জগৎ অর্জ্জুনময় অবলোকন করিয়া কেহ কেহ ‘এই পার্থ’ কেহ কেহ ‘পার্থ কোথায় গমন করিতেছে’ বলিয়া চীৎকার করিতে লাগিল। এই রূপে সেই যোদ্ধৃগণ কালপ্রভাবে সকলকেই অর্জ্জুন জ্ঞান করিয়া আপনারা পরস্পর পরস্পরকে আঘাত- করিতে আরম্ভ করিল। কেহ কেহ স্বয়ং স্বশরীরে অস্ত্রাঘাত করিতে লাগিল। রক্তাক্ত কলেবর, সংজ্ঞাহীন বীরগণ রণশয্যায় শয়ান ও দারুণ বেদনায় একান্ত কাতর হইয়া স্ব স্ব বান্ধবগণের নাম কীৰ্ত্তন করত আর্ত্তনাদ করিতে আরম্ভ করিল। ভিন্দিপাল, প্রাশ, শক্তি, ঋষ্টি, পরশু, নির্ব্যূহ, খড়্গ, শরাসন, তোমর, বাণ, বৰ্ম্ম, আভরণ, গদা ও অঙ্গদযুক্ত ভীষণ ভুজগাকার অর্গলপ্রতিম বাহুসকল বাণনিকৃত্ত হইয়া কখন সমুত্থিত কখন বা মহাবেগে বিলুণ্ঠিত হইতে লাগিল। ফলত তৎকালে যে যে ব্যক্তি পার্থের সহিত সময়ে প্রবৃত্ত হইয়াছিল, পার্থের শরনিকর তাহাদের সকলের শরীরে প্রবিষ্ট হইয়া তাহাদিগকে সংহার করিল। ঐ সময় মহাবীর অর্জ্জুন কখন যে, রথোপরি নৃত্য করিতেছেন, আর কখনই বা শরাসন গ্রহণ করিতেছেন, তাহার কিছুমাত্র বিশেষ লক্ষিত হইল না। তিনি হস্তলাঘব প্রদর্শনপূর্ব্বক অতি সত্বরে শরবিক্ষেপ করিয়া রণভূমিস্থ সমুদায় বীরগণকেই বিস্ময়াবিষ্ট করিলেন। অসংখ্য হস্তী, গজনিয়ন্তা, অশ্ব, অশ্বারোহী, রথী ও সারথি অর্জ্জুনের নিশিতশরে বিনষ্ট হইতে লাগিল। পাণ্ডুতনয় সেই রণস্থলে কি ভ্রমণকারী, কি যুধ্যমান, কি সম্মুখে সমুপস্থিত সকলকেই যমসদনে প্রেরণ করিলেন। মরীচিমালী গগনমণ্ডলে সমুদিত হইয়া যেমন গাঢ়ান্ধকার বিনষ্ট করেন, সেইরূপ মহাবীর অর্জ্জুন কঙ্কপত্রবিভূষিত শরনিকর দ্বারা সমস্ত গজসৈন্য সংহার করিতে লাগিলেন। পার্থশর-নির্ভিন্ন করি সমুদায় রণক্ষেত্রে নিপতিত হওয়াতে বোধ হইল, পৃথিবী প্রলয়কালে ভূধরে সমাকীর্ণ হইয়াছে।
হে মহারাজ! ঐ সময় রোষাবিষ্ট মহাবীর ধনঞ্জয় মধ্যাহহ্নকালীন সূর্যের ন্যায় শত্রুগণের দুর্নিরীক্ষ্য হইয়া উঠিলেন। কৌরব সৈন্যগণ তাঁহার শরে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া শঙ্কিতচিত্তে সমর পরিত্যাগ পূর্ব্বক পলায়ন করিতে লাগিল। বেগবান্ বায়ু যেমন মেঘমণ্ডল ছিন্ন ভিন্ন করিয়া ফেলে, সেই রূপ মহাবীর ধনঞ্জয় কৌরবসৈন্য বিমর্দ্দিত করিলেন। রথী ও অশ্বারোহিগণ অর্জ্জুনশরে নিপীড়িত হইয়া প্রতোদ, চাপকোটি, হুঙ্কার, কশাঘাত, পার্ষ্ণিঘাত ও উগ্র বাক্য দ্বারা অশ্বসঞ্চালন করত সত্বরে পলায়ন করিতে লাগিল; গজারোহিগণ পাদাঙ্গুষ্ঠ ও অঙ্কুশ প্রহার দ্বারা মাতঙ্গগণকে সঞ্চালিত করত দ্রুতবেগে ধাবমান হইল এবং অনেকে অর্জ্জুনের শরে বিমোহিত হইয়া তাঁহার অভিমুখে গমন করিতে আরম্ভ করিল। হে মহারাজ! এইরূপে আপনার পক্ষীয় বীরগণ হতোৎসাহ ও বিমনায়মান হইতে লাগিল।