বিদায় লইয়া মুনি দুর্য্যোধন স্থানে।
বহু শিষ্য সহ যায় আনন্দিত মনে।।
যাইতে যাইতে মুনি বিচারিল মনে।
কহিল ডাকিয়া কাছে যত শিষ্যগণে।।
চল সবে এই পথে প্রভাসের তীর।
কাম্যবনে যাব যথা রাজা যুধিষ্ঠির।।
বহু দিন পরে ধর্ম্মে করিব দর্শন।
পরম ধর্ম্মাত্মা তারা ভাই পঞ্চ জন।।
প্রভাসের স্নান আর ধর্ম্মের সম্ভাষ।
দুর্য্যোধন রাজার মনের অভিলাষ।।
অনায়াসে তিন কর্ম্ম হবে এককালে।
এতেক বলিয়া মুনি পূর্ব্বদিকে চলে।।
জনপদ ছাড়ি সবে প্রবেশিল বন।
হেনকালে অস্তাচলে যান বিকর্ত্তন।।
পূর্ব্বদিক সুপ্রসন্ন কৈল কলানিধি।
কুমুদিনী বিকশিতা দেখিয়া কৌমুদী।।
মাধব মাসেতে সিতপক্ষে চতুর্দ্দশী।
সেই দিনে যাত্রা করে দুর্ব্বাসা মহর্ষি।।
কৌতুকে পথেতে নানা কথার প্রবন্ধ।
বিচিত্র বনের শোভা দেখিয়া সানন্দ।।
অতিক্রান্ত হৈল ক্রমে যবে অর্দ্ধনিশি।
অত্যন্ত আনন্দযুক্ত গেল মহাঋষি।।
যথায় ধর্ম্মের পুত্র রাজা যুধিষ্ঠির।
উত্তরিল মহামুনি প্রভাসের তীর।।
যুধিষ্ঠির শুনি তবে মুনি আগমন।
আগুসরি কত দূর যান পঞ্চ জন।।
দুর্ব্বাসা দেখিয়া সবে আনন্দিত মন।
সেইমত চলিল যতেক দ্বিজগণ।।
চিন্তাযুক্ত যুধিষ্ঠির করেন বিচার।
এ রাত্রে কি হেতু মুনি করে আগুসার।।
বিশেষে দুর্ব্বাসা মুনি আর কেহ নয়।
অল্পদোষে মহারোষে করিবে প্রলয়।।
চিত্তেতে ভাবেন ধর্ম্ম, চিন্তা করি মিছা।
অবশ্য হইবে যাহা ঈশ্বরের ইচ্ছা।।
দেখিতে দেখিতে তথা আসে মুনিরাজ।
সংহতি সহস্র দশ শিষ্যের সমাজ।।
ভূমে লুটি প্রণমিয়া করেন সম্মান।
পাদ্য অর্ঘ্যেতে পূজেন দেবের সমান।।
মুনিরে প্রণাম করে ভাই পঞ্চ জনে।
সেইমত সম্ভাষেন যত শিষ্যগণে।।
আছিল রাজার সঙ্গে যতেক ব্রাহ্মণ।
মুনিরাজে সম্ভাষণ করে সর্ব্বজন।।
বয়োধিকে মান্য করি প্রণাম করিল।
জ্যেষ্ঠজন কনিষ্ঠেরে আশীর্ব্বাদ দিল।।
সমান সমান জনে ধরি দেয় কোল।
নমস্কার আশীর্ব্বাদ হৈল মহাগোল।।
তবে যুধিষ্ঠির রাজা যুড়ি দুই কর।
বিনয় করেন মুনিরাজ কবরাবর।।
ধর্ম্ম বলিলেন, মুনি করি নিবেদন।
শুনিবারে ইচ্ছা আগমনের কারণ।।
কোন দেশে হৈতে আজি হৈল আগমন।
কোন দেশ করিবেন মঙ্গল ভাজন।।
তীর্থ অনুসারে, কিম্বা মম ভাগ্যোদয়।
বিশেষ করিয়া সহ কৃপা যদি হয়।।
মুনি বলে, শুন যদি জিজ্ঞাসিলে তুমি।
সশিষ্যে হস্তিনাপুরে গিয়াছিনু আমি।।
অনেক করিল সেবা ভাই শত জনে।
তোমারে দেখিতে বড় ইচ্ছা হৈল মনে।।
এ হেতু হেথায় এবে কির আগমন।
যেমন কৌরব মোর, পাণ্ডব তেমন।।
আর এক কথা শুন ধর্ম্মের নন্দন।
পথশ্রমে ক্ষুধাতুর আছি সর্ব্বজন।।
রন্ধন করিতে কহ, যাত শীঘ্রগামী।
তাবৎ প্রভাসে গিয়া সন্ধ্যা করি আমি।।
শুনিয়া মুনির কথা ধর্ম্মের তনয়।
মনেতে চিন্তেন, আজি না জানি কি হয়।।
অন্তরে জন্মিল ভয় পাছে করে ক্রোধ।
অনুমতি দিলেন মুনির অনুরোধ।।
যুধিষ্ঠির বলিলেন মম ভাগ্যোদয়।
সে কারণে আগমন আমার আলয়।।
সন্ধ্যা হেতু গতি এবে কর মহাশয়।
করিব যে কিছু মম ভাগ্যোদয়ে হয়।।
তবে মুনি চলিলেন সহ শিষ্যগণে।
প্রভাসের কূলে গেল সন্ধ্যার কারণে।।
চিন্তাযুক্ত যুধিষ্ঠির আপন আশ্রমে।
দ্রৌপদীরে আসিয়া কহেন ক্রমে ক্রমে।।
ধর্ম্মের যতেক কথা দ্রৌপদী শুনিল।
উপায় না দেখি কিছু প্রমাদ গণিল।।
কৃষ্ণা বলে, যেই কথা কৈলে মহাশয়।
হেন বুঝি, বিধি কৈল অকালে প্রলয়।।
সশিষ্য অতিথি হৈল উগ্রতপা ঋষি।
আমার নহিল শক্তি আজিকার নিশি।।
রজনী প্রভাতে কালি সূর্য্যের প্রসাদে।
দশলক্ষ হইলে ভুঞ্জাব অপ্রমাদে।।
ধর্ম্ম বলিলেন, কৃষ্ণা উত্তম কহিলে।
মুনি ক্রোধানলে আজি সব দগ্ধ হৈলে।।
কি কর্ম্ম করিবে কালি প্রভাতে কে জানে।
দুর্ব্বাসার ক্রোধ সহে কাহার পরাণে।।
দ্রৌপদী কহিল, এ কি দৈবের সংযোগ।
আমার কর্ম্মের ফল, কে করিবে ভোগ।।
সুকর্ম্মের চিহ্ন যদি হৈত মহারাজ।
দিবসে আসিত তবে মুনির সমাজ।।
আমা সবা হতে কিছু নাহি প্রতিকার।
কেবল পারেন কৃষ্ণ করিতে উদ্ধার।।
তবেত দ্রৌপদী দেবী ভাবে মনে মন।
কৃষ্ণ বিনা এ সময়ে রাখে কোন্ জন।।
হে কৃষ্ণ করুণাসিন্ধু পাণ্ডব-সারথি।
তুমি যদি এইবার না কর রক্ষণ।।
তবেত পাণ্ডব বংশ হইল নিধন।
এমতে দ্রৌপদী দেবী অনুক্ষণ ভাবে।
যুধিষ্ঠিরে কহে দেবী, কহ কিবা হবে।।
অনর্থ হৈল বড় দুর্ব্বাসা আগমনে।
বুঝিলাম, রক্ষা নাহি শুনহ রাজনে।।
দ্রৌপদীর মুখে রাজা শুনিয়া বচন।
জ্ঞানাহত যুধিষ্ঠির হইল তখন।।
হেঁটমুখে বসি রাজা ভাবিতে লাগিল।
দুর্ব্বাসার ক্রোধে বুঝি সকলি মজিল।।
এ সময়ে কৃষ্ণ বিনা কে করে তারণ।
ভকতের নাথ কৃষ্ণ পতিত পাবন।।
কোথা কৃষ্ণ কৃষ্ণ বলি ডাকে উচ্চৈঃস্বরে।
পার কর জগন্নাথ বিপদসাগরে।।
পার কর শ্রীগোবিন্দ হৈয়া কৃপাময়।
রাখহ পাণ্ডবকুল মজিল নিশ্চয়।।
তোমা হেন আছে যার মহারত্ন নিধি।
এমন সংকট তারে মিলাইল বিধি।।
তোমারে পাণ্ডব বন্ধু বলি লোকে কয়।
সে কথা পালন কর, ওহে দয়াময়।।
কৃষ্ণা সহ পঞ্চ ভাই আকুল হইয়া।
ডাকিতেছে কোথা কৃষ্ণ উদ্ধার আসিয়া।।
হেথায় কৌতুকে কৃষ্ণ দ্বারকা নগরে।
শয়ন করিয়াছেন রুক্মিণীর ঘরে।।
আর্ত্ত হয়ে ভক্ত ডাকে বলি জগন্নাথ।
বাজিল অন্তরে যেন কণ্টকের ঘাত।।
রহিতে নাহিক শক্তি ভক্ত-দুঃখ জানি।
ব্যস্ত হয়ে উঠিলেন দেব চক্রপাণি।।
চিন্তান্বিত অন্তরে করেন ছটফট।
রুক্মিণী কহেন দেখি, করিয়া কপট।।
চিত্তের চাঞ্চল্য আজি দেখি কি কারণ।
হেন বুঝি, কোথা যাবে হইয়াছে মন।।
অরণ্যে দ্রৌপদী সখী আছয়ে যথায়।
অকস্মাৎ মনে বুঝি পড়িল তাহায়।।
শ্রীকৃষ্ণ কহেন, শুন প্রাণপ্রিয়তমা।
অদ্যকার এই অপরাধ কর ক্ষমা।।
ভক্তাধীন করি মোরে সৃজিল বিধাতা।
আমার কেবল ভ্ক্ত সুখদুঃখদাতা।।
মম ভক্তজন যথা তথা থাকে সুখে।
আমিহ তথায় থাকি পরম কৌতুকে।।
মম ভক্তজন দেখ যদি দুঃখ পায়।
সে দুঃখ আমার হেন জানিহ নিশ্চয়।।
সে কারণে ভক্ত দুঃখ খণ্ডাই সকল।
নহিলে কি হেতু নাম ভকতবৎসল।।
আমার একান্ত ভক্ত রাজা যুধিষ্ঠির।
বিপদসাগরে পড়ি হয়েছে অস্থির।।
দুঃখ পেয়ে ডাকে ধর্ম্ম কোথা জগন্নাথ।
বাজিল অন্তরে সেই কণ্টকের ঘাত।।
যতক্ষণ নাহি দেখি ধর্ম্মের নন্দন।
ততক্ষণ মম দুঃখ না হবে খণ্ডন।।
এই আমি চলিলাম যথা ধর্ম্মমণি।
এত শুনি কহেন রুক্মিণী ঠাকুরাণী।।
তোমার একান্ত ভক্তি আছয়ে পাণ্ডবে।
সর্ব্বকালে এইরূপ জানি অনুভবে।।
বিশেষে করিল বশ দ্রুপদের সুতা।
তোমার বাসনা সর্ব্বকাল থাক তথা।।
গমন রজনীকালে উচিত না হয়।
সে কারণে নিবেদন করি মহাশয়।।
যাইবে অবশ্য কালি তপন উদয়।
যে ইচ্ছা তোমার, কর তুমি ইচ্ছাময়।।
শ্রীকৃষ্ণ বলেন, সত্য কহিলে যে তুমি।
ক্ষণেক তথায় যদি নাহি যাই আমি।।
সবংশে মজিবে রাজা ধর্ম্মের নন্দন।
আমার গমন তবে কোন্ প্রয়োজন।।
এত বলি করিলেন গরুড়ে প্রয়োজন।
আসিল স্মরণমাত্রে বিনতা নন্দন।।
আসিল উড়িয়া বীর যথা জগন্নাথ।
সম্মূখে দাঁড়ায় বীর করি যোড়হাত।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুন পুণ্যবান।।