৮৬তম অধ্যায়
সঞ্জয় কৃর্ত্তক ধৃতরাষ্ট্রকে তিরস্কার
সঞ্জয় কহিল, “মহারাজ! যুদ্ধ সম্পর্কীয় সমস্ত ব্যাপারই আমার প্রত্যক্ষ হইয়াছে; আমি তৎসমুদায় বর্ণন করিতেছি, আপনি সুস্থির হইয়া শ্রবণ করুন। আপনার দুর্নীতি নিবন্ধনই এই বিষম ব্যসন উপস্থিত হইয়াছে। হে রাজন! বিগত-সলিল প্রদেশে সেতুবন্ধন যেমন কোন ফলোপধায়ক হয় না, আপনকার অনুতাপও এক্ষণে সেইরূপ নিতান্ত নিস্ফল হইতেছে, অতএব শোক পরিত্যাগ করুন। কৃতান্তের অদ্ভুত নিয়ম অতিক্রম করা নিতান্ত দুঃসাধ্য। হে ভরতশ্রেষ্ঠ! যদি পূর্ব্বে কুন্তিপুত্র যুধিষ্ঠির ও স্বীয় পুত্রগণকে দূত হইতে নিবৃত্ত করিতেন, যদি যুদ্ধকাল সমুপস্থিত হইলে ক্রুদ্ধ কুরু পাণ্ডবদিগকে সান্ত্বনা করিয়া যুদ্ধ হইতে নিবৃত্ত করিতেন, যদি পূর্ব্বে কৌরবগণকে অবাধ্য দুরাত্মা দুর্য্যোধনের সংহারে আদেশ করিতেন, অথবা যদি ঐ দুরাত্মাকে সৎপথে সংস্থাপন পূর্ব্বক পিতার উচিত কাৰ্য্য করিয়া ধর্ম্মানুসারে কর্ম্ম করিতেন, তাহাহইলে কখনই আপনাকে এই দারুণ ব্যসনে নিমগ্ন হইতে হইত না; এবং পাণ্ডব, পাঞ্চাল, বৃষ্ণি ও অন্যান্য ভূপালগণও আপনার বুদ্ধি ব্যভিচার জানিতে পারিতেন না। হে রাজন! আপনি ইহলোকে বিজ্ঞতম বলিয়া প্রথিত আছেন, তবে কি নিমিত্ত সনাতন ধর্ম্ম পরিত্যাগ পূর্ব্বক দুর্য্যোধন, কর্ণ ও শকুনির মতাবলম্বী হইলেন? অতএব স্পষ্ট বোধ হইতেছে, আপনি নিতান্ত বিষয়াসক্ত, এক্ষণে আপনার এই বিলাপ বাক্য বিষমিশ্রিত মধু বলিয়া আমার বোধ হইতেছে। মহাত্মা মধুসূদন পূর্ব্বে আপনাকে যুধিষ্ঠির, ভীষ্ম ও দ্রোণ অপেক্ষাও সমধিক সম্মান করিতেন কিন্তু যে অবধি আপনাকে অধাৰ্মিক বলিয়া জানিয়াছেন, সেই অবধি আর তাদৃশ সম্মান করেন না। হে মহারাজ! আপনার কুসন্তানগণ পাণ্ডবগণের প্রতি যার পর নাই কটুবাক্য প্রয়োগ করিলেও আপনি তৎকালে পুত্রগণের রাজ্য কামনায় সে সমুদায় অনায়াসে উপেক্ষা করিয়াছিলেন, এক্ষণে আপনাকে তাহার ফল ভোগ করিতে হইবে। আপনি তৎকালে পাণ্ডবগণকে বঞ্চনা করিয়া পৈতামহোপভুক্ত রাজ্য লাভ করিয়াছিলেন, এক্ষণে সেই পাণ্ডবগণ কর্ত্তৃক নিজ্জিত সমুদায় ভূমণ্ডল উপভোগ করুন। পূর্ব্বে মহারাজ পাণ্ডু কৌরবগণের বিপক্ষাপহৃত রাজ্য ও যশ প্রত্যুদ্ধৃত করিয়াছিলেন। তৎপরে তাঁহার পুত্রগণ তাহা অপেক্ষা সমধিক যশোলাভ করিয়া রাজ্য করেন; কিন্তু এক্ষণে আপনি রাজ্যলোভবশত তাঁহাদিগকে পৈতৃক রাজ্যচ্যুত করিয়া তাঁহাদের যশ বিলুপ্ত করিয়াছেন। যাহা হউক, এক্ষণে যুদ্ধকালে পুত্রদিগকে তিরস্কার ও তাহাদের দোষকীৰ্ত্তন করা আপনার কর্ত্তব্য নয়। কৌরবপক্ষীয় মহাবল পরাক্রান্ত ক্ষত্রিয়গণ জীবন নিরপেক্ষ হইয়া অগাধ পাণ্ডব সৈন্য সাগরে অবগাহন পূর্ব্বক সংগ্রাম করিতেছেন। হে মহারাজ! শ্রীকৃষ্ণ, অর্জ্জুন, সাত্যকি ও বৃকোদর যে সকল সৈন্যের রক্ষায় নিযুক্ত রহিয়াছেন, কৌরবগণ ভিন্ন অন্য কোন্ ব্যক্তি তাঁহাদিগের সহিত সংগ্রামে সাহসী হইতে পারে? অর্জ্জুন যাঁহাদিগের যোদ্ধা, জনার্দ্দন যাঁহাদিগের মন্ত্রী এবং সাত্যকি ও বৃকোদর যাঁহাদিগের রক্ষিতা; কৌরবগণ বা তাঁহাদের বশবর্তী বীরগণ ব্যতীত আর কোন্ ধনুর্ধারী ব্যক্তি সেই পাণ্ডবগণের পরাক্রম সহ্য করিতে সমর্থ হয়? ফলতঃ ক্ষত্ৰধর্ম্মাবলম্বী অনুরক্ত ব্যক্তিগণ যাহা করিতে পারে, কৌরব পক্ষীয় বীরগণ প্রাণপণে তাহাই করিতেছে, কোন অংশে ত্রুটি করিতেছে না। যাহা হউক, এক্ষণে পাণ্ডবদিগের সহিত কুরুদিগের যে রূপ ঘোরতর সংগ্রাম হইয়াছিল, তাহা বর্ণন করিতেছি শ্রবণ করুন।