৮৬তম অধ্যায়
ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি বিদুরের হিতোপদেশ
বিদুর কহিলেন, “হে রাজন! আপনি যে কথা কহিলেন, ইহাতে স্পষ্টই বোধ হইতেছে যে, আপনি সমুদয় লোকের মান্য, আদরণীয় ও প্রিয়। আপনি শাস্ত্র ও তর্কদ্বারা স্থিরবুদ্ধি হইয়াছেন। প্ৰজাগণ আপনার ধর্ম্ম প্রস্তরফলকস্থিত লেখার ন্যায়, সূৰ্য্যকিরণের ন্যায়, সাগরতরঙ্গের ন্যায় অবিনশ্বর বলিয়া স্থির করিয়াছে। আপনার গুণগ্রামে সমুদয় লোকই সন্তুষ্ট রহিয়াছে; অতএব আপনি বান্ধবগণসমভিব্যাহারে গুণরক্ষণে নিয়ত যত্নবান হউন; সরলতা অবলম্বন করুন; অজ্ঞানতাপ্রযুক্ত বহুসংখ্যক পুত্র, পৌত্র ও প্রিয় সুহৃদগণকে কালকবলে নিক্ষেপ করিবেন না।
“হে মহারাজ! আপনি কৃষ্ণকে যেসমুদয় দ্রব্য প্রদান করিতে বাসনা করিয়াছেন এবং যাহা প্ৰদান করিলে তাঁহার পক্ষে যথেষ্ট হইবে বলিয়া স্থির করিয়াছেন, মহাত্মা দেবকীনন্দন তৎসমুদয় ও তদ্ভিন্ন অন্যান্য দ্রব্যজাতের উপযুক্ত পাত্র, বলিতে কি, তিনি সমুদয় পৃথিবী-লাভের ভাজন। আমি সত্য করিয়া কহিতেছি যে, আপনি ধর্ম্মানুষ্ঠান বা কৃষ্ণের প্রীতিসাধনের উদ্দেশে তাঁহাকে ঐ সমুদয় দ্রব্য প্রদান করিতে বাসনা করেন নাই; কেবল কপটতাসহকারে তাঁহাকে বঞ্চিত করিবার অভিলাষ করিতেছেন। আমি আপনার বাহ্য কর্ম্মদ্বারা আন্তরিক অভিপ্ৰায় বুঝিতে পারি। পঞ্চপাণ্ডব আপনার নিকট পঞ্চগ্রাম যাচ্ঞা করিতেছেন; কিন্তু আপনি তাঁহাদিগকে উহা প্ৰদান করিতে অসম্মত; অতএব স্পষ্টই বোধ হইতেছে, আপনার সন্ধি করিতে বাসনা নাই।
“আপনি অর্থপ্রদানদ্বারা কৃষ্ণকে প্রলোভিত করিয়া পাণ্ডবগণ হইতে পৃথক করিতে বাসনা করিতেছেন; কিন্তু আমি নিশ্চয় কহিতেছি যে, কি অর্থ, কি উদ্যম, কি নিন্দা, কোন উপায়েই তাহাকে অর্জ্জুন হইতে পৃথক করিতে পরিবেন না। আমি কৃষ্ণের মাহাত্ম্য ও অর্জ্জুনের দৃঢ়ভক্তি জানি এবং বাসুদেব যে অর্জ্জুনকে প্ৰাণতুল্য জ্ঞান করেন ও তাঁহাকে কখনই পরিত্যাগ করিতে পরিবেন না, তাহাও বিলক্ষণ অবগত আছি। ভগবান জনাৰ্দন পূর্ণকুম্ভ [মঙ্গল-কলস], পাদ্য ও কুশলপ্রশ্ন ব্যতীত আপনাদের নিকট আর কিছুই অভিলাষ করবেন না। অতএব যেরূপ সৎকার করিলে মাননীয় মধুসূদন প্রীত হয়েন, তাহাই করা কর্ত্তব্য। মহাত্মা কেশব মঙ্গলকামনায় এখানে আগমন করিতেছেন; অতএব তাঁহার যাহা অভিপ্ৰায়, তাহা সম্পাদন করাই সর্ব্বতোভাবে বিধেয়। হে মহারাজ! দুৰ্য্যোধন, পাণ্ডবগণ ও আপনার শাস্তিবিধান করাই শ্ৰীকৃষ্ণের উদ্দেশ্য। অতএব তাঁহার বচনানুসারে কাৰ্য্য করা আপনার অবশ্য কর্ত্তব্য। হে রাজন! পাণ্ডবগণ আপনার পুত্রস্বরূপ, আপনি তাঁহাদের পিতাস্বরূপ; তাঁহারা বালক, আপনি বৃদ্ধ; তাঁহারা আপনাকে পিতৃতুল্য জ্ঞান করেন, আপনিও তাঁহাদিগকে সন্তানসদৃশ জ্ঞান করুন।”