গন্ধর্ব্ব বিদায় হয়ে গেল নিজস্থান।
দুর্য্যোধন আসি ধর্ম্মে করিল প্রণাম।।
বসিল মলিন মুখে হয়ে নম্রশির।
মধুর বচনে কহিছেন যুধিষ্ঠির।।
শুন ভাই, হেন কর্ম্ম না করিহ আর।
পৌরুষ নাহিক ইথে আমা সবাকার।।
বিশেষ বৈভব কালে ধর্ম্ম-আচরণ।
সমধিক হয় ইহা খ্যাতির কারণ।।
কহিলেন এই মত বহু নীতি বানী।
অগ্রসরি নারীগণে আনে যাজ্ঞসেনী।।
দ্রৌপদীরে প্রণমিল যত নারীগণ।
যতেক দুঃখের কথা কৈল নিবেদন।।
দুস্তর সাগর মাঝে ডুবিল তরণী।
নিজগুণে উদ্ধারিলা ধর্ম্ম নৃপমণি।।
বুঝিলাম, কুরুবংশ রক্ষার কারণে।
নিবসতি তোমা সবে কৈলে এই বনে।।
তবে কৃষ্ণা সবাকারে করিল সম্মান।
ক্ষুধার্ত্ত দেখিয়া দিল দিব্য অন্নাপান।।
একত্র হইল তবে যত সৈন্যগণ।
পরম কৌতুকে কবে করিল ভোজন।।
রাজা আদি করিয়া ভুঞ্জিল ক্রমে ক্রমে।
নারীবৃন্দ আকুল হইল সবে ঘুমে।।
ভয়ে কেহ নাহি শোয় রাজার কারণে।
দ্রৌপদী সহিত আছে কথোপকথনে।।
তবে মানী দুর্য্যোধন মলিন বদনে।
বিদায় লইয়া চলে ধর্ম্মের চরণে।।
মধুর সম্ভাষে রাজা করিয়া বিদায়।
অগ্রসরি কতদূর যান ধর্ম্মরায়।।
শীঘ্রগামী চলে সবে যত সেনাগণ।
বিরস বদনে যায় রাজা দুর্য্যোধন।।
নগরে যাইতে আর আছে কত পথ।
সেইখানে দুর্য্যোধন রহাইল রথ।।
মাতুল শকুনি আর কর্ণ দুঃশাসনে।
সম্বোধিয়া কহিতে লাগিল দুঃখমনে।।
স্বসৈন্য সহিত দেশে যাহ সর্ব্বজন।
নিশ্চয় কহিনু আমি ত্যজিব জীবন।।
পূর্ব্বে না বুঝিনু আমি আপনার বল।
বিধি তার সমুচিত দিয়াছেন ফল।।
পূর্ব্বে যদি এ সকল কহিতে হে সবে।
যুধিষ্ঠির সহ কেন বিরোধ হইবে।।
ভীমার্জ্জুন হতে মোরে স্নেহ তাঁর অতি।
স্বচ্ছন্দে পালিত মোরে ধর্ম্ম নরপতি।।
ভ্রাতৃভেদ করাইলে করিয়া আশ্বাস।
আমি মন্দমতি, তাহে করিনু বিশ্বাস।।
অনুক্ষণ কহ সবে, মারিব পাণ্ডব।
চক্ষু কর্ণে বিবাদ ঘুচিল আজি সব।।
পলাইলে সবে মোরে রাখি যুদ্ধভূমে।
বান্ধিয়া লইতেছিল গন্ধর্ব্ব-আশ্রমে।।
আর দেখ অপরূপ রহস্য বিধির।
আজন্ম হিংসিনু আমি রাজা যুধিষ্ঠির।।
উদ্ধার করিল সেই আমা হেন জনে।
মরণ অধিক লাজ মস্তক মুণ্ডনে।।
চিত্রসেন হস্তে মৃত্যু শ্রেষ্ঠ শতগুণ।
অযশ লভিনু উদ্ধারিল যে অর্জ্জুন।।
কোন্ লাজে লোকমাঝে দেখাব বদন।
নিশ্চয় না যাব দেশে, এই নিরূপণ।।
তবে কর্ণ মহাবীর দেখিয়া অশক্য।
কহিতে লাগিল কথা রাজহিত পক্ষ।।
শুন রাজা কি কারণে চিন্ত অকারণ।
জয় পরাজয় যত দৈবের ঘটন।।
ইন্দ্র দেবরাজ হন অমর ঈশ্বর।
সদাকাল দেখ তাঁর দানবের ডর।।
কতবার স্বর্গভ্রষ্ট করাইল তাঁরে।
পুনরায় পায় রাজ্য উপায় প্রকারে।।
পূর্ব্বাপর হেন নীতি বিধির আছয়।
কখন বা জয় যুদ্ধে, কভু পরাজয়।।
কহিলে যে যুধিষ্ঠির উদ্ধার কারণ।
আপনার স্বীয় ধর্ম্ম কৈল প্রবর্ত্তন।।
ধর্ম্মপুত্র যুধিষ্ঠির অধর্ম্মের ভয়ে।
সে কারণে পাঠাইল বীর ধনঞ্জয়ে।।
সৈন্য হেতু সেনাপতি জয় করে রণ।
পূর্ব্বাপর এইমত বিধির ঘটন।।
শুন ওহে মহারাজ আমার বচন।
আজি আমি কহি কথা, করিব যেমন।।
প্রতিজ্ঞা করিনু আমি সবাকার আগে।
মহাবীর ধনঞ্জয় থাক্ মোর ভাগে।।
তব হস্তে ভীমসেন না ধরিবে টান।
আর জনে সংহারিব পতঙ্গ সমান।।
পরাজয় হেতু রাজা কর অভিমান।
শাস্ত্রমত কহি শুন তাহার বিধান।।
বিদ্যার সমান বন্ধু নাহি ত্রিভুবনে।
অপত্য সমান স্নেহ নাহি অন্য জনে।।
শত্রু কেহ নহে রাজা ব্যাধির সমান।
সবারে অধিক দেখ দৈব বলবান।।
দৈব রণ বুঝি ক্ষমা করিলাম সবে।
মনুষ্য হইলে অপমান বলি তবে।।
এতেক বলিল যদি সূর্য্যের নন্দন।
তথাপিহ মৌনভাবে আছে দুর্য্যোধন।।
হেনকালে মিলি দৈত্য দানব সকল।
দুর্য্যোধন দুঃখে কহে হইয়া বিকল।।
আমাদের হিতে জন্ম হইল ইহার।
তেঁই সে ইহার দুঃখে দুঃখ সবাকার।।
আশ্বাস করিয়া সবে বলে শূন্যবাণী।
ঘরে যাহ ওহে রাজা কর্ণ কথা শুনি।।
যাহ কুরুশ্রেষ্ঠ রাজা আপন আলয়।
কর্ণের প্রতিজ্ঞা রাজা কভু মিথ্যা নয়।।
যুদ্ধে পরাজয় হেতু না করিহ মনে।
দেবতা মনুষ্যে যুদ্ধ ভঙ্গ সে কারণে।।
এত শুনি উঠিলেন কৌরবের পতি।
সসৈন্যেতে নিজরাজ্যে যায় শীঘ্রগতি।।
পাইয়া এ সব বার্ত্তা ভীষ্ম মহাবল।
ধৃতরাষ্ট্র অগ্রে গিয়া কহিল সকল।।
তোমার পুত্রের কথা করহ শ্রবণ।
যে হেতু বিলম্ব তার হৈল এতক্ষণ।।
যথায় কাম্যকবন প্রভাসের তীর।
পঞ্চ সহোদর যথা রাজা যুধিষ্ঠির।।
দুষ্টবুদ্ধি কর্ণ শকুনির দুষ্টপণে।
বৈভব দেখাতে গেল লয়ে সর্ব্বজনে।।
গন্ধর্ব্ব অধিপ সহ সংগ্রাম হইল।
সসৈন্যে শকুনি কর্ণ দূরে পলাইল।।
নারীবৃন্দ সহ পরে ধরি দুর্য্যোধনে।
গন্ধর্ব্ব লইতেছিল করিয়া বন্ধনে।।
দয়ার সাগর অতি, ধর্ম্মের তনয়।
উদ্ধারিল পাঠাইয়া বীর ধনঞ্জয়।।
এখনো এরূপ যার ধর্ম্ম আচরণ।
তাহার সর্ব্বত্র জয়, জানিহ রাজন।।
শুনিয়া অন্ধের হৈল ব্যাকুলিত মন।
বহু মতে নিন্দা করে নিজ পুত্রগণ।।
মহাভারতের কথা ধর্ম্ম উপাখ্যান।
ভবসিন্ধু তরিতে হয় পুণ্য সোপান।।