৮৫তম অধ্যায়
শ্রুতায়ু যুধিষ্ঠির যুদ্ধ-শ্রুতায়ুর পরাজয়
সঞ্জয় কহিলেন, “অনন্তর দিবাকর নভোমণ্ডলের মধ্যবর্ত্তী হইলে ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির শ্রুতায়ুকে লক্ষ্য করিয়া অশ্বসকল চালনাপূর্ব্বক তাঁহার নিকট উপস্থিত হইয়া সুতীক্ষ্ন নয় শর নিক্ষেপ করিলেন। শ্রুতায়ু ঐ সমস্ত শর নিবারণ করিয়া তাঁহার প্রতি সাতবাণ প্রয়োগ করিলে শরীসকল রাজা যুধিষ্ঠিরের বর্ম্ম ভেদ করিয়া শোণিত পান করিতে লাগিল; বোধ হইল যেন দেহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিয়া তাঁহার প্রাণ অনুসন্ধান করিতেছে। রাজা শ্রুতায়ুর শরে সাতিশয় বিদ্ধ হইয়া বরাহকর্ণ অস্ত্রে তাঁহার হৃদয়দেশ বিদ্ধ করিলেন এবং ভল্লাস্ত্ৰে তাঁহার কেতু ছিন্ন করিয়া ফেলিলেন। তদ্দর্শনে শ্রুতায়ু নিশিতসপ্তসায়কে তাঁহাকে বিদ্ধ করিলেন। যেমন যুগান্তকালীন হুতাশন লোকসকলকে ভস্মসাৎ করিবার নিমিত্ত প্রজ্বলিত হইয়া থাকে, তদ্রূপ ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির রোষানলে প্ৰদীপ্ত হইয়া উঠিলেন। দেবতা, গন্ধর্ব্ব ও রাক্ষসগণ তাঁহাকে ক্রোধাবিষ্ট নিরীক্ষণ করিয়া নিতান্ত ব্যথিত হইলেন এবং সমস্ত জগৎ আকুল হইয়া উঠিল। তখন সকলেই মনে করিলেন, অদ্য রাজা যুধিষ্ঠির ক্রোধাবিষ্ট হইয়া ত্ৰিলোক দগ্ধ করিবেন। তাহাতে সন্দেহ নাই। মহর্ষিগণ লোকদিগের শান্তিলাভার্থ স্বস্ত্যয়ন করিতে প্ৰবৃত্ত হইলেন। ধর্ম্মরাজ রোষকষায়িতলোচনে বারংবার সৃক্কণী লেহন করিতে লাগিলেন, তাঁহার মূর্ত্তি যুগান্তকালীন মার্ত্তণ্ডের ন্যায় নিতান্ত ভয়ঙ্কর হইয়া উঠিল। তদ্দর্শনে কৌরবসেনাসকল এককালে জীবিতাশা পরিত্যাগ করিল। অনন্তর রাজা যুধিষ্ঠির ধৈৰ্য্যসহকারে ক্ৰোধসংবরণপূর্ব্বক শ্রুতায়ুর মুষ্টিদেশে কামুক ছেদন ও সকল সৈন্যসমক্ষে নারাচদ্বারা বক্ষঃস্থল বিদীর্ণ করিয়া সত্বর তাঁহার অশ্ব ও সারথিকে বিনাশ করিলেন। শ্রুতায়ু রাজা যুধিষ্ঠিরের পুরুষকার অবলোকন করিয়া রথ পরিত্যাগপূর্ব্বক মহাবেগে পলায়ন করিতে লাগিলেন। দুৰ্য্যোধনের সৈন্যগণ শ্রুতায়ুকে পরাজিত দেখিয়া তৎক্ষণাৎ সত্বর পরাঙ্মুখ হইল। রাজা যুধিষ্ঠির ব্যাদিতবদন কৃতান্তের ন্যায় কৌরবসৈন্যগণকে বিনাশ করিতে লাগিলেন।
চেকিতান-কৃপাচাৰ্য্যযুদ্ধ
“অনন্তর বৃষ্ণিবংশীয় চেকিতান সর্ব্বসৈন্যসমক্ষে কৃপাচাৰ্য্যকে শরজালে সমাচ্ছন্ন করিলেন। কৃপাচাৰ্য্য সেই সমস্ত শরনিকর নিবারণ করিয়া সমরপ্রিয় চেকিতানকে সায়কসমূহে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন; পরে এক ভল্লাস্ত্রে তাহার কার্ম্মুক ছেদন ও অন্য ভল্লাস্ত্রে তাঁহার সারথিকে ভূতলে নিপতিত করিয়া অশ্বসকল ও দুইটি পার্ষ্ণি-সারথিকে [সারথির পার্শ্বরক্ষককে] বিনাশ করিলে চেকিতান সত্বর রথ হইতে অবতীর্ণ হইয়া বীরঘাতিনী গদা গ্রহণপূর্ব্বক তাঁহার অশ্বগণকে বিনাশ ও সারথিকে ভূতলে নিপাতিত করিলেন। অনন্তর কৃপাচাৰ্য্য ভূতলে অবস্থান করিয়া যোড়শ শর নিক্ষেপ করিলে উহা চেকিতানের দেহ ভেদ করিয়া ধরণীতলে প্রবেশ করিল। যেমন পুরন্দর বৃত্ৰাসুরকে বিনাশ করিতে অভিলাষী হইয়াছিলেন, তদ্রূপ চেকিতান ক্রুদ্ধ হইয়া তাঁহাকে সংহার করিবার নিমিত্ত পুনর্ব্বার গদা নিক্ষেপ করিলে কৃপাচাৰ্য্য সেই পাষাণগর্ভ [প্রস্তরতুল্য সারবান-কঠিন] বিপুল মহাগদা বহুসহস্রশরে নিবারণ করিলেন। অনন্তর চেকিতান লঘুহস্ত প্রদর্শনপূর্ব্বক কোষ হইতে অসি নিষ্কাশিত করিয়া কৃপের প্রতি ধাবমান হইলেন। কৃপাচাৰ্য্যও কামুক পরিত্যাগপূর্ব্বক সুসংস্কৃত [সুশাণিত] অসি গ্রহণ করিয়া চেকিতানের প্রতি মহাবেগে গমন করিতে লাগিলেন। পরে উভয়ে সুতীক্ষ্ন অসিদ্ধারা পরস্পর আঘাত করিলেন। তাঁহারা ব্যায়ামে পরিশ্রান্ত, নিস্ত্রিংশবেগে অভিহিত ও মূর্চ্ছায় অভিভূত হইয়া ভূতধাত্ৰী [প্রাণীদিগের আশ্রয়স্থল] ধরিত্রীতে নিপতিত হইলেন। এই অবসরে চেকিতানের প্রিয়সুহৃৎ, করকর্ষ মহাবেগে ধাবমান আরোহণ করাইলেন। এদিকে শকুনিও কৃপাচাৰ্য্যকে সত্বর রথে আরোপিত করিলেন।
“অনন্তর মহাবলপরাক্রান্ত ধৃষ্টকেতু ক্রোধাবিষ্ট হইয়া নবতিসায়কে সোমদত্তের পুত্ৰ ভূরিশ্রবার বক্ষঃস্থল বিদ্ধ করিলেন। যেমন মার্ত্তণ্ডমণ্ডল মধ্যাহ্নকালে রশ্মিজলে সুশোভিত হয়, তদ্রূপ সৌমদত্তি শরনিকরে অলঙ্কৃত হইয়া সায়কসমূহে ধৃষ্টকেতুর রথ, সারথি ও অশ্বকে বিনষ্ট করিয়া তাঁহাকেও সমাচ্ছন্ন করিলেন। ধৃষ্টকেতু রথ পরিত্যাগপূর্ব্বক শতানীকের রথে আরূঢ় হইলেন। সুবৰ্ণকবচে অলঙ্কৃত রখী চিত্ৰসেন, বিকর্ণ ও দুর্ম্মর্ষণ অভিমন্যুর অভিমুখে গমন করিলে যেমন বাত, পিত্ত ও কফের সহিত শরীরের যুদ্ধ হইয়া থাকে, তদ্রূপ তাঁহাদিগের সহিত অভিমন্যুর ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ হইল। অভিমন্যু, তাঁহাদিগকে রথচ্যুত করিলেন, কেবল ভীমের বাক্য স্মরণ করিয়া তাঁহাদিগের প্রাণনাশ করিলেন না।
ত্ৰিগৰ্তরাজ সুশর্ম্মার সহিত অর্জ্জুনের যুদ্ধ
“ইত্যবসরে দেবগণেরও নিতান্ত দুৰ্দ্ধৰ্ষ ভীষ্ম দুৰ্য্যোধনপ্রভৃতি বীরগণকে রক্ষা করিবার নিমিত্ত একমাত্র বালক অভিমন্যুকে লক্ষ করিয়া গমন করিতেছেন দেখিয়া অর্জ্জুন বাসুদেবকে কহিলেন, “হে বাসুদেব! যে স্থানে ঐ বহুসংখ্যক রথ রহিয়াছে, সেই দিকে শীঘ্র অশ্ব চালনা কর। ঐ দেখ, যুদ্ধদুর্ম্মদ বীরগণ আমাদের সেনাসকল বিনাশ করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছে।” তখন বাসুদেব, শ্বেতাশ্বযুক্ত রথ ঘর্ঘরশব্দে প্রেরণ করিলেন। মহাবীর অর্জ্জুন ক্রোধাবিষ্ট হইয়া কৌরবদিগের প্রতি গমন করিতেছেন দেখিয়া কৌরব সৈন্যগণ অতিশয় কোলাহল করিতে লাগিল। মহাবীর অর্জ্জুন ভীষ্মরক্ষক [ভীষ্মের পৃষ্ঠপোষক] ক্ষিতিপালগণসন্নিধানে সমুপস্থিত হইয়া সুশর্ম্মাকে কহিলেন, “হে সুশর্ম্মন! তুমি আমার পূর্ব্ববৈরী এবং যুদ্ধে শ্রেষ্ঠ পদবী লাভ করিয়াছ দেখিতেছি; কিন্তু আজি তোমাকে দুর্নীতির অতি দারুণ ফল প্রাপ্ত হইতে হইবে; আমি এক্ষণেই তোমাকে মৃত পিতামহদিগকে দর্শন করাইব।”
সুশর্ম্মা অর্জ্জুনের এইরূপ অতি কঠোর বাক্য শ্রবণগোচর করিয়া ভালমন্দ কিছুই বলিলেন না। পরে যেমন ঘনমণ্ডলী দিবাকরকে পরিবৃত করে, তদ্রূপ সুশর্ম্মা দুৰ্য্যোধনপ্রভৃতি বহুসংখ্যক ভূপালগণে পরিবৃত হইয়া অর্জ্জুনকে বেষ্টনপূর্ব্বক চারিদিক হইতে শরজালে সমাচ্ছন্ন করিলেন। এইরূপে কৌরব ও পাণ্ডবগণের শোণিতময় ঘোরতর যুদ্ধ হইতে লাগিল।