জিজ্ঞাসেন ধনঞ্জয় অদ্ভুত-কথন।
বিশ্বামিত্র বশিষ্ঠে কলহ কি কারণ।।
গন্ধর্ব্ব কহিল শুন কথা পুরাতন।
কান্যকুব্জ দেশে গাধি নামেতে রাজন।।
তাঁর পুত্র বিশ্বামিত্র সর্ব্ব-গুণ-যুত।
বেদবিদ্যা বুদ্ধিবলে ভুবনে অদ্ভুত।।
এক দিন সসৈন্যেতে গাধির নন্দন।
মহাবনে প্রবেশিল মৃগয়া কারণ।।
মারিল অনেক মৃগ বনের ভিতর।
মৃগরায় শ্রান্ত বড় হৈল নৃপবর।।
ক্ষুধায় পীড়িত বড় হৈল পরিশ্রম।
ভ্রমিতে ভ্রমিতে গেল বশিষ্ঠ-আশ্রম।।
মনোহর স্থল দেখি হৈল হৃষ্টমন।
উত্তরিল যথায় বশিষ্ঠ তপোধন।।
রাজারে দেখিয়া পাদ্য-অর্ঘ্য দিয়া মুনি।
অতিথি বিধানে পূজা করিলেন তিনি।।
রাজার যতেক সৈন্য পরিশ্রান্ত দেখি।
নন্দিনী ধেনুর প্রতি বলিল যে ডাকি।।
দেখহ, রাজার সৈন্য অতিথি আমার।
যেই যাহা চাহে তোষ করহ তাহার।।
বশিষ্ঠের আজ্ঞা পেয়ে সুরভি- নন্দিনী।
সংসারে যাঁহার কর্ম্ম অদ্ভুত কাহিনী।।
হুঙ্কারে বিবিধ দ্রব্য করিল সৃজন।
চর্ব্ব- চুর্ষ্য -লেহ্য-পেয় নানা রত্নধন।।
বস্ত্র অলঙ্কার মাল্য কুসুম চন্দন।
বিচিত্র পালঙ্ক শয্যা বসিতে আসন।।
যেই যাহা মাগে, তাহা পায় ততক্ষণে।
পাইল পরমানন্দ সর্ব্ব-সৈন্যগণে।।
গবীর দেখিয়া কর্ম্ম বিস্ময় রাজন।
বশিষ্ঠ-মুনিরে বলে গাধির নন্দন।।
এই গবী মুনিরাজ দান কর মোরে।
এক কোটি গবী দিব স্বর্ণ মণ্ডি খুরে।।
নতুবা সকল রাজ্য লহ তপোধন।
হস্তী অশ্ব পদাতিক যত সৈন্যগণ।।
বশিষ্ঠ বলেন, নাহি দিতে পারি দান।
দেবতা অতিথি হেতু আছে মম স্থান।।
রাজা বলে, মুনি তুমি জাতিতে ব্রাহ্মণ।
ব্রাহ্মণের হেন দ্রব্যে নাহি প্রয়োজন।।
হেন দ্রব্য মুনিবর রাজাকে যে সাজে।
কি করিবা তুমি ইহা, থাক বন মাঝে।।
গবী নাহি দিবে, যদি আপন ইচ্ছায়।
নিশ্বয় লইব গবী, জানাই তোমায়।।
মাগিলে না দিবে গবী, লৈয়া যাব বলে।
ক্ষত্র-কর্ম্ম আমার, লইব বলে ছলে।।
বশিষ্ঠ বলেন, তুমি অধিকারী দেশে।
বলিষ্ঠ ক্ষত্রিয়-সৈন্য সহায় বিশেষে।।
যাহা ইচ্ছা কর শীঘ্র না কর বিচার।
সহজে তবস্বী দ্বিজ, কি শক্তি আমার।।
শুনি বিশ্বামিত্র বলে, শুন সৈন্যগণ।
কামধেনু লয়ে চল করিয়া বন্ধন।।
শুনি যত সৈন্যগণ গলে দিল দড়ি।
চালাইল কামধেনু, পাছে মারে বাড়ি।।
প্রহারে পড়িল গবী তবু নাহি যায়।
ক্ষুব্ধমুখে সজলাক্ষে মুনিপানে চায়।।
মুনি বলে, নন্দিনী কি চাহ মম ভিতে।
তোমার যতেক কষ্ট দেখেছি চক্ষেতে।।
তপস্বী ব্রাহ্মণ আমি কি করিতে পারি।
বলে তোমা লয়ে যায় রাজ্য-অধিকারী।।
তবে রাজ-সৈন্যগণ বৎসকে ধরিয়া।
আগে লৈয়া যায় তারে গলে দড়ি দিয়া।।
বৎসকে ধরিয়া লয়, কান্দয়ে নন্দিনী।
ডাক দিয়া বলে দেখ হের মহামুনি।।
উপরোধ না মানিল যদি দুষ্ট লোকে।
কি করিব মুনি, আজ্ঞা করহ আমাকে।।
মুনি বলে, আমি তোমা ত্যাগ নাহি করি।
বলে লৈয়া যায় রাজা কি করিতে পারি।।
নিজ শক্তিবলে যদি পার রহিবারে।
তবে সে রহিতে পার, কি কব তোমারে।।
মুনিরাজ মুখে যদি এতেক শুনিল।
অতি ক্রোধে ভয়ঙ্কর তনু বাড়াইল।।
ঊর্দ্ধপুচ্ছ করি গবী হাম্বারবে ডাকে।
নানাজাতি সৈন্য বাহিরায় লাখে লাখে।।
পহ্লব নামেতে জাতি, নানা অস্ত্র হাতে।
পুচ্ছ হৈতে বাহির হইল আচম্বিতে।।
মূত্রেতে পাইল জ্ন্ম বহু বাধ্যগণ।
দুই পার্শ্বে জন্ম নিল কিরাত যবন।।
জন্মিল অনেক সৈন্য মুখের ফেণাতে।
নানাজাতি ম্লেচ্ছ হৈল চারি পদ হৈতে।।
নানা অস্ত্র লইয়া ধাইল সর্ব্বজন।
দুই সৈন্যে দেখাদেখি, হৈল মহারণ।।
বিশ্বামিত্র-সৈন্যগণ যতেক আছিল।
একজন প্রতি তার পঞ্চজন হৈল।।
সহিতে না পারি রণ বিশ্বামিত্র-সেনা।
রাজ-বিদ্যামান ভঙ্গ দিল সর্ব্বজনা।।
পড়িল অনেক সৈন্য, রক্তে বহে নদী।
মুনি-সৈন্য রাজ-সৈন্য পাছে যায় খেদি।।
পলায় সকল সৈন্য পাছে নাহি চায়।
সর্ব্বসৈন্য বিশ্বামিত্র পাছে খেদি যায়।।
বনেরে বাহির করি গাধির কুমারে।
বাহুড়িয়া সৈন্যগণ প্রণমে মুনিরে।।
তবে বিশ্বামিত্র বড় মনে অভিমান।
মুনির নিকটে এত পাই অপমান।।
অদ্ভুত দেখিয়া কর্ম্ম মনে মনে গণে।
সর্ব্বশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ জানিনু এতক্ষণে।।
ধিক্ ক্ষত্রজাতি, মম ধিক্ রাজপদে।
একই তপস্বী দ্বিজে না পারি বিবাদে।।
এ জন্ম রাখিয়া আর কোন্ প্রয়োজন।
তপস্যা করিয়া আমি হইব ব্রাহ্মণ।।
ব্রাহ্মণ হইব কিম্বা যায় যাক্ প্রাণ।
এত চিন্তি বিশ্বামিত্র করে সম্বিধান।।
দেশে পাঠাইয়া দিল সর্ব্ব-সৈন্যগণে।
তপস্যা করিতে গেল গহন কাননে।।
বিশ্বামিত্র-তপ-কথা অদ্ভুত কথন।
যাঁর তপে তাপিত হইল ত্রিভুবন।।
গ্রীষ্মকালে চতুর্দ্দিকে জ্বালি হুতাশন।
ঊর্দ্ধপদে তার মধ্যে থাকেন রাজন।।
নাকে মুখে রক্ত বহে, ঘোর দরশন।
অস্থি-চর্ম্ম-সার মাত্র আহার পবন।।
বরিষা-কালেতে যথা সদাই বরিষে।
যোগাসন করি রাজা তথাই নিবসে।।
অহর্নিশি জলধারা বরিষে উপর।
স্থাবর সদৃশ হৈয়া থাকে নৃপবর।।
শীতকালে হীনবস্ত্র হৈয়া নিরাশ্রয়।
হেমন্ত-পর্ব্বতে যথা সদা বরিষয়।।
এইরূপে তপ করে সহস্র বৎসর।
তপে তুষ্ট হৈয়া ব্রহ্মা দিতে এল বর।।
ব্রহ্মা বলে, বর মাগ গাধির নন্দন।
বিশ্বামিত্র বলে, কর আমারে ব্রাহ্মণ।।
বিরিঞ্চি বলেন, তব ক্ষুন্দ্রকুলে জন্ম।
কেমনে হইবে দ্বিজ, দুষ্কর এ কর্ম্ম।।
অন্য বর চাহ তুমি, যেই লয় মন।
বিশ্বামিত্র বলে, অন্যে নাহি প্রয়োজন।।
ব্রহ্মা বলে, পরজন্মে হইবে ব্রাহ্মণ।
এক্ষণে যে চাহ, তাহা মাগহ রাজন।।
বিশ্বামিত্র বলে, আমি অন্য নাহি চাই।
কিবা প্রাণ যায় কিবা ব্রাহ্মণত্ব পাই।।
এত শুনি বিধাতা গাধির নন্দন।
পুনঃ তপ আরম্ভিল গাধির নন্দন।।
ঊর্দ্ধ দুই পদ কুর ঊর্দ্ধমুখ হৈয়া।
এক পদে অঙ্গুলিতে রহে দাণ্ডাইয়া।।
শুষ্ক কাষ্ঠ মত সে হইল নরবর।
কেবল আছয়ে প্রাণ মজ্জার ভিতর।।
তাঁর তপে মহাতাপ হৈল তিন লোক।
ইন্দ্রাদি দেবতা ভয় হইল সবাকে।।
সহিতে নারিয়া ব্রহ্মা আসি আরবার।
বলিলেন, মাগ বর গাধির কুমার।।
বিশ্বামিত্র বলে, আমি মাগিয়াছি পূর্ব্বে।
ব্রাহ্মণ করহ যদি মোরে বর দিবে।।
এড়াইতে নারিয়া সৃষ্টির অধিকারী।
বিশ্বামিত্র-গলে দেন আপন উত্তরী।।
বর দিয়া বিধাতা করিলেন গমন।
বিশ্বামিত্র-মুনি হৈল মহা-তপোধন।।
কেহ নহে তপস্যায় তাঁহার সমান।
সদা মনে জাগে বশিষ্ঠের অপমান।।
সুরাসুর নাগ নর বশিষ্ঠকে পূজে।
সুধা পান করিল সহিত দেবরাজে।।
বশিষ্ঠের অপমান সদা জাগে মনে।
বশিষ্ঠের ছিদ্র খুঁজি ভ্রমে অনুক্ষণে।।
ইক্ষবাকু, বংশেতে রাজা সর্ব্ব-গুণধাম।
সংসারেতে বিখ্যাত কল্মাষপাদ নাম।।
মহামুনি বশিষ্ঠ তাঁহার পুরোহিত।
যজ্ঞহেতু তাঁহারে করিল নিমন্ত্রিত।।
বশিষ্ঠ বলেন, কিছু আছে প্রয়োজন।
রাজা বলে, যজ্ঞ আমি করিব এক্ষণ।।
মুনি না আইল, রাজা হৈল ক্রোধ মন।
বিশ্বামিত্রে যজ্ঞ হেতু কৈল নিমন্ত্রণ।।
বিশ্বামিত্র লৈয়া সঙ্গে আইসে রাজন।
পথেতে ভেটিল শক্তি বশিষ্ঠ-নন্দন।।
রাজা বলে পথ ছাড়ি দেহ মুনিবর।
শক্তি বলে, মোরে পথ দেহ নরেশ্বর।।
রাজা বলে, রাজপথ জানে সর্ব্বজন।
পথ ছাড় যাব আমি যজ্ঞের কারণ।।
শক্তি বলে, দ্বিজ-পথ বেদের বিহিত।
পথ ছাড়ি দেহ মোরে যাইব ত্বরিত।।
এইমতে বোলাবুলি হৈল দুই জন।
কেহ না ছাড়িল পথ, কুপিল রাজন।।
হাতেতে প্রবোধ-বাড়ি আছিল রাজার।
ক্রোদে মুনি-অঙ্গে রাজা করিল প্রহার।।
প্রহারে জর্জ্জর শক্তি, রক্ত পড়ে ধারে।
ক্রোধ-চক্ষে চাহিয়া বলিল নৃপবরে।।
উত্তম বংশেতে জন্মি করিস্ অনীতি।
ব্রাহ্মণের হিংসা তুই করিস্ দুর্ম্মতি।।
এই পাপে মম শাপে হও নিশাচর।
মনুষ্যের মাংসে তোর পূরুক উদর।।
শাপ শুনি ভীত হৈল সৌদাস-নন্দন।
কৃতাঞ্জলি করি বলে বিনয় বচন।।
হেনকালে বিশ্বামিত্র পেয়ে অবসর।
রাজ-অঙ্গে নিয়োজিল এক নিশাচর।।
রাক্ষস-শরীর হৈল, রাজা হতজ্ঞান।
দেখি বিশ্বামিত্র-মুনি হৈল অন্তর্ধান।।
সম্মুখে পাইয়া শক্তি ধরিল রাজন।
ব্যাগ্য যেন পশু ধরি করয়ে ভক্ষণ।।
মোরে শাপ দিলা দুষ্ট, ভুঞ্জ তার ফল।
বধিয়া ঘাড়ের রক্ত খাইল সকল।।
শক্তি কে খাইয়া মূর্ত্তি হৈল ভয়ঙ্কর।
উন্মত্ত হইয়া ভ্রমে বনের ভিতর।।
দেখি বিশ্বামিত্র-মুনি ভাবিল অন্তর।
রাক্ষস লইয়া সঙ্গে গেল মুনিবর।।
যথা আছে বশিষ্ঠের শতেক কুমার।
কাল পেয়ে বিশ্বামিত্র দেয় ফল তার।।
একে একে দেখাইয়া সর্ব্বজনে দিল।
রাক্ষস সবারে ধরি ভক্ষণ করিল।।
বশিষ্ঠ আসিয়া গৃহে দেখে শূন্যময়।
শতপুত্র না দেখিয়া হইল বিস্ময়।।
ধ্যানেতে জানিল যত বিশ্বামিত্র কৈল।
শক্তি সহ শত পুত্র রাক্ষসে ভক্ষিল।।
শতপুত্র-শোকে তাঁর দহয়ে শরীর।
অতি ধৈর্য্যবন্ত তবু হইল অস্থির।।
আপনার মরণ বাঞ্ছিয়া মুনিবর।
শোকানলে প্রবেশিল সমুদ্র-ভিতর।।
সমুদ্র দেখিয়া তাঁরে রাখি গেল কূলে।
মরণ না হইল যদি সমুদ্রের জলে।।
অত্যুচ্চ পর্ব্বতে গিয়া উঠিল সে মুনি।
তথা হৈতে শোকাকুল পড়িল ধরণী।।
বিংশতি সহস্র ক্রোশ উচ্চ হৈতে পড়ি।
তুলারাশি পরে মুনি যায় গড়াগড়ি।।
তাহাতে নহিল মৃত্য, চিন্তে মুনিরাজ।
প্রবেশ করিল গিয়া অনলের মাঝ।।
যোজন প্রসর অগ্নি পরশে আকাশে।
শীতল হইলা অগ্নি মুনির পরশে।।
তবে মুনি প্রবেশিল অরণ্য ভিতর।
নানা পশু ব্যাঘ্র হস্তী ভল্লুক শূকর।।
বশিষ্ঠে দেখিয়া সবে পলাইয়া যায়।
হেনমতে কৈল মুনি অনেক উপায়।।
মরণ নহিল, মুনি ভ্রমিল সংসার।
কত দিনে আসে মুনি গৃহ আপনার।।
একশত পুত্র নাই দেখি মুনিবর।
পুত্র শোকে অবশ হইল কলেবর।।
চতুর্দ্দিকে অনুক্ষণ বেদ-অধ্যয়ন।
নানা শাস্ত্র পঠন করিত পুত্রগণ।।
এ সব চিন্তিয়া মুনি অধিক তাপিত।
গৃহমধ্যে প্রবেশিতে নাহি লয় চিত।।
পুনরপি বশিষ্ঠ চলিল দেশান্তর।
মরিতে উপায় মুনি করে নিরন্তর।।
দেখিল একটি নদী অত্যন্ত গভীর।
ভয়ঙ্কর লক্ষ লক্ষ আছয়ে কুম্ভীর।।
তাহে পড়িবার তরে ইচ্ছা কৈল মুনি।
হেনকালে পাছু হৈতে শুনে বেদধ্বনি।।
বিস্ময় হইলা মুনি উলটিয়া চায়।
শক্তি-ভার্য্যা অদৃশ্যন্তী দেখিল তথায়।।
যোড়হাত করি বলে শক্তির বনিতা।
তোমার সংহতি প্রভু আইলাম হেথা।।
মুনি বলে, সঙ্গে আর আছে কোন্ জন।
শত শত বেদধ্বনি করে উচ্চারণ।।
শক্তির কন্ঠের প্রায় শুনিলাম স্বর।
এত শুনি বলে দেবী বিনয়ে উত্তর।।
শক্তির নন্দন আছে আমার উদরে।
দ্বাদশ বৎসর বেদ অধ্যয়ন করে।।
এত শুনি বশিষ্ঠ হইল হৃষ্টমন।
বংশ আছে শুনি নিবর্ত্তিল তপোধন।।
বধূ সঙ্গে লইয়া চলিল পুনঃ ঘর।
হেনকালে ভেটিল রাক্ষস নরবর।।
নির্জ্জন গহনবনে থাকে নিরন্তর।
বহু নর পশু খেয়ে পূরয়ে উদর।।
নৃপতি কল্মাষপাদ দেখি বশিষ্ঠেরে।
মুখ মেলি ধাইল মুনিরে গিলিবারে।।
বিপরীত মূর্ত্তি দেখি হাতে কাষ্ঠদণ্ড।
তৃতীয় প্রহরে যেন তপন প্রচণ্ড।।
নিকটে আইল মূর্ত্তি অতি ভয়ঙ্কর।
দেখি অদৃশ্যন্তী দেবী কাঁপে থর থর।।
শ্বশুরে ডাকিয়া বলে শুন মহাশয়।
মৃত্যু উপস্থিত, হের রাক্ষস দুর্জ্জয়।।
রাক্ষসের হাতে দেখি নিকট মরণ।
তোমা বিনা রাখে ইথে নাহি কোন জন।।
বশিষ্ঠ বলিল, বধূ, না করিহ ভয়।
নৃপতি কল্মাষপাদ রাক্ষস এ নয়।।
এতেক বলিতে দুষ্ট আইল নিকটে।
মুনি গিলিবারে যায় দশন বিকটে।।
মুনির হুঙ্কারেতে রহিল কতদূরে।
কমণ্ডলু-জল মুনি ফেলিল উপরে।।
রাজ-অঙ্গ হৈতে হৈল রাক্ষস বাহির।
রাহু হৈতে যেন হৈল বাহির মিহির।।
পূর্ব্বজ্ঞান হৈল, রাজা পাইল চেতন।
কৃতাঞ্জলি-পুটে করে বশিষ্ঠে স্তবন।।
অধম পাপিষ্ঠ আমি, পাপে নাহি অন্ত।
দয়া কর মুনিরাজ তুমি দয়াবন্ত।।
মুনি বলে, চলে শীঘ্র অযোধ্যা-নগরে।
কদাচিত অমান্য না করহ দ্বিজেরে।।
রাজা বলে, আজি হৈতে তোমার কিঙ্কর।
তব আজ্ঞাবর্ত্তী আমি হব নিরন্তর।।
সূর্য্যবংশে জন্ম মোর সৌদাস-নন্দন।
হেন কর মোরে, নাহি নিন্দে কোন জন।।
এত বলি নৃপবর আজ্ঞা যে পাইয়া।
অযোধ্যা-নগরে পুনঃ রাজা হৈল গিয়া।।
বধূ সহ বশিষ্ঠ আইল নিজ ঘর।
কতদিনে জন্ম হৈল মুনি পরাশর।।
পৌত্রে দেখি বশিষ্ঠের শোক নিবারিল।
অতি যত্নে মুনিরাজ বালকে পুষিল।।
শিশুকাল হৈতে পরাশর মহামুনি।
পিতা বলে বশিষ্ঠের জানে সে আপনি।।
একদিন পরাশর মায়ের গোচরে।
পিতৃ সম্বোধন করি ডাকে বশিষ্ঠেরে।।
শুনি অদৃশ্যন্তী শোক করিল প্রচুর।
রোদন করিয়া পুত্র বলেন মধুর।।
পিতৃহীন পুত্র তুমি বড় অভাগিয়া।
পিতামহে পিতা বলি ডাক কি লাগিয়া।।
যেই কালে ছিলা তুমি আমার উদরে।
তোমার জনকে বনে খায় নিশাচরে।।
মায়ের মুখেতে শুনি এতেক বচন।
বিশেষ মায়ের দেখি শোকেতে ক্রন্দন।।
ক্রোধেতে শরীর কম্পে, লোহিত লোচন।
কি করিব হৃদয়ে চিন্তিল তপোধন।।
এত বড় নিদারুণ নির্দ্দয় বিধাতা।
রাক্ষসের হাতে মোর বিনাশিল পিতা।।
আজি তার সর্ব্বসৃষ্টি করিব নিধন।
না রাখিব ত্রিলোকে তাহার একজন।।
এত যদি মনে কৈল শক্তির কুমার।
বশিষ্ঠ জানিল এ সকল সমাচার।।
মধুর বচনে তারে করেন প্রবোধ।
অকারণে শিশু তুমি কারে কর ক্রোধ।।
ব্রাহ্মণের ধর্ম্ম এই না হয় উচিত।
ক্ষমা শান্তি ব্রাহ্মণের বেদের বিহিত।।
কর্ম্ম-অনুরূপে শক্তি হইল নিধন।
তার প্রতি অনুশোচ কর অকারণ।।
কার এত শক্তি তারে মারিবারে পারে।
কর্ম্ম-অনুরূপ ফল ভুঞ্জয়ে সংসারে।।
ক্রোধ শান্তি কর বাপু তত্ত্বে দেহ মন।
অকারণ সৃষ্টি কেন করিবা নিধন।।
মহাভারতের কথা অমৃত-লহরী।
শুনিলে অধর্ম্ম ক্ষয়, পরলোকে তরি।।