যুধিষ্ঠির বলিলেন, যাহ শীঘ্রগতি।
গন্ধর্ব্ব না যায় যেন আপন বসতি।।
ছাড়াইয়া আন গিয়া প্রধান কৌরবে।
প্রণয়পূর্ব্বক হৈলে দ্বন্দ্ব না করিবে।।
এত যদি কহিলেন ধর্ম্ম নরপতি।
গর্জ্জিয়া উঠিল ভীম অর্জ্জুন সুমতি।।
ধন্য মহাশয় তুমি ধর্ম্ম অবতার।
এখনো ঈদৃশ চিত্তে মহত্ত্ব তোমার।।
আমা সবাকারে দুষ্ট যতেক করিল।
কাল পেয়ে সেই ফল এখন ফলিল।।
অহর্নিশি জাগে সেই মনের অনিষ্ট।
গন্ধর্ব্ব করিল তাহা, ঘুচিল অরিষ্ট।।
অধর্ম্মে বাড়ায় রাজা অধর্ম্মীর সুখ।
তাহা দেখি নিত্য পায় পরম কৌতুক।।
ক্রমে ক্রমে সকল সংসার করে জয়।
যথাকালে মূল সহ বিনাশিত হয়।।
যত গর্ব্ব করিল কৌরব দুরাশয়।।
নিঃশত্রু হইল রাজ্য, চল নিজালয়।
এতেক বলেন যদি ভাই দুই জন।
মনেতে চিন্তেন তবে ধর্ম্মের নন্দন।।
বিনা ক্রোধে কার্য্যসিদ্ধি না হয় নিশ্চয়।
তবে ধর্ম্ম কহিলেন ডাকি ধনঞ্জয়।।
কহিলে যতেক পার্থ অন্যথা না করি।
সে মম পরম শত্রু, আমি তার বৈরী।।
আত্মপক্ষে ঘরে দ্বন্দ্ব করিব যখন।
তারা শত সহোদর মোরা পঞ্চ জন।।
সেই দ্বন্দ্ব হয় যদি পরপক্ষগত।
তখন আমরা ভাই পঞ্চোত্তর শত।।
সে কারণে কহি ভাই করিতে উদ্ধার।
পূর্ব্বাপর আছে ভাই নীতি বিধাতার।।
আর এক কথা শুন বিচারিয়া মনে।
যদি না আনিবে তুমি রাজা দুর্য্যোধনে।।
দুষ্টবুদ্ধি অতিশয় রাজা চিত্রসেনে।
পশ্চাৎ হইবে তার অহঙ্কার মনে।।
লইবেক দুর্য্যোধনে সহ নারীবৃন্দ।
অমর মণ্ডলী তথা আছেন সুরেন্দ্র।।
সবাকার আগে কহিবেক সমাচার।
জিনিনু কৌরবসেনা রণে অনিবার।।
যুধিষ্ঠির পঞ্চ জন তথায় আছিল।
যত মোর পরাক্রম বসিয়া দেখিল।।
তাহার কুলের বধূ সহ দুর্য্যোধনে।
বান্ধিয়া আনিনু দেখিলেক সর্ব্বজনে।।
বারণ করিতে শক্তি নহিল কাহার।
কহিবে ইন্দ্রের আগে এই সমাচার।।
শুনিয়া হাসিবে যত অমর সমাজ।
অবজ্ঞা করিবে তোমা ইন্দ্র দেবরাজ।।
তুমি যে অবজ্ঞা কর ভাবিয়া বিপক্ষ।
দেবতা জানিবে, তুমি বলেতে অশক্য।।
আনিতে বলিনু আমি ইহা মনে করি।
নহে দুর্য্যোধন মম কোন উপকারী।।
শুনিয়া উঠিল কোপে বীর ধনঞ্জয়।
এমত কহিবে দুষ্টবুদ্ধি পাপাশয়।।
এই দেখ মহাশয় তোমার প্রসাদে।
না জীবে গন্ধর্ব্ব আজি, পড়িল প্রমাদে।।
এত বলি মহাক্রোধে উঠিয়া অর্জ্জুন।
গাণ্ডীব নিলেন হাতে বান্ধি যুগ্ম তূণ।।
যুধিষ্ঠিরে প্রণমিয়া করি কৃতাঞ্জলি।
রথে গিয়া চড়িলেন শ্রীগোবিন্দ বলি।।
পবন গমন জিনি চলে স্বর্গপথ।
ক্ষণে উত্তরিল যথা চিত্রসেন রথ।।
পাছে যান ধনঞ্জয় ফিরিয়া নেহালি।
শীঘ্রগতি রথ চালাইল মহাবলী।।
তবে পার্থ মনে মনে করেন বিচার।
পলায় গন্ধর্ব্ব ভয়ে অই কুলাঙ্গার।।
অতিবেগে ধায় রথ, যাবে স্বর্গমাঝে।
বিদিত হইবে তবে দেবতা সমাজে।।
ইহা জানি শরজালে রোধিলেন পথ।
ফাঁফর গন্ধর্ব্বপতি নাহি চলে রথ।।
চতুর্দ্দিকে ফিরি দেখে, যেতে নাহি শক্য।
পিঞ্জরের মধ্যে যেন রহে পোষা পক্ষ।।
সেইক্ষণে উপনীত বীর ধনঞ্জয়।
দেখিয়া গন্ধর্ব্বপতি কহে সবিনয়।।
কহ পার্থ কোন কাজে আসিলে হেথায়।
দুর্য্যোধন উপকারে আসিতেছ প্রায়।।
এই সে আশ্চর্য্য বড় লাগে মোর মনে।
আজন্ম হিংসিল দুষ্ট তোমা পঞ্চ জনে।।
কহিতে না পরি পূর্ব্বে দিল যত ক্লেশ।
সম্প্রতি দেখি যে বনে তপস্বীর বেশ।।
তাহার উচিত ফল পায় দৈববশে।
পথ ছাড় শীঘ্রগতি, যাই নিজ বাসে।।
পার্থ বলিলেন, জ্ঞান নাহিক তোমায়।
কহিলে যতেক কথা পাগলের প্রায়।।
আপনা আপনি লোক যত দ্বন্দ্ব করে।
আত্মপক্ষ কভু নহে প্রতিপক্ষ পরে।।
ইহাতে এতেক ছিদ্র কহিস অজ্ঞান।
আমা সবে ভিন্ন ভাব করেছিস্ জ্ঞান।।
যুধিষ্ঠির তুল্য মম ভাই দুর্য্যোধন।
তাহারে লইয়া যাস্ করিয়া বন্ধন।।
এই কুলবধূগণে তুমি লয়ে যাবে।
লোকেতে হইবে কুৎসা, কলঙ্ক রটিবে।।
কুলের কুৎসায় সুখী কুলাঙ্গার জন।
কি মতে সহিবে তাহা আমার এ মন।।
এই হেতু শীঘ্রগতি আইনু হেথায়।
ছাড় দুর্য্যোধনে, নহে যাবে যমালয়।।
করহ সকলে মুক্ত, নহে ফল দিব।
মুহূর্ত্তে শমন-গৃহে তোমারে পাঠাব।।
চিত্রসেন বলে, তোর জানিলাম মতি।
বুঝিয়া করিল বিধি এতেক দুর্গতি।।
মরিতে বাসনা তব হইল নিশ্চয়।
দুই ভাই এক সঙ্গে যাবি যমালয়।।
এত বলি দিল শীঘ্র ধনুকে টঙ্কার।
দশ দিক শরজালে হৈল অন্ধকার।।
দেখি পার্থ হইলেন জ্বলন্ত অনল।
নিমিষের মধ্যে কাটিলেন সে সকল।।
দোঁহার বিচিত্র শিক্ষা দোঁহে লঘু হস্ত।
বৃষ্টিবৎ শত শত পড়ে কত অস্ত্র।।
কাটিল দোঁহার অস্ত্র দোঁহাকার শরে।
জ্বলন্ত উলকা প্রায় উঠয়ে অম্বরে।।
হইল দোঁহার অঙ্গ শরেতে জর্জ্জর।
ভ্রুভঙ্গ তিলেক নাহি, দোঁহে ধনুর্দ্ধর।।
গন্ধর্ব্ব আপন মায়া করিল প্রকাশ।
সন্ধান পূরিয়া অস্ত্র এড়িলেন পাশ।।
দিব্য অস্ত্র এড়ি পার্থ করে নিবারণ।
দশ অস্ত্র অঙ্গে তার করেন ঘাতন।।
দেবতা গন্ধর্ব্ব যক্ষ রাক্ষসিক দীক্ষা।
নরেতে নাহক তুল্য অর্জ্জুনের শিক্ষা।।
যে বাণে গন্ধর্ব্ব বান্ধে রাজা দুর্য্যোধনে।
সেই বাণ ধনঞ্জয় যুড়ে ধনুর্গুণে।।
বান্ধি গন্ধর্ব্বের গলা ভুজের সহিত।
নিজ রথে চড়াইয়া চলেন ত্বরিত।।
দুর্য্যোধন নারী সহ গন্ধর্ব্বের পতি।
মুহূর্ত্তেকে উপনীত ধর্ম্মের বসতি।।
সমর্পিয়া সকলেরে করে নিবেদন।
যেমতে গন্ধর্ব্বপতি করিলেক রণ।।
যুধিষ্ঠির খুলিলেন দোঁহার বন্ধন।
পার্থে অনুযোগ করিলেন অগণন।।
এই চিত্রসেন হয় গন্ধর্ব্বের পতি।
ইহাকে উচিত নহে এতেক দুর্গতি।।
চিত্রসেনে কহিলেন, তুমি মতিমন্ত।
চালন করহ কেন ক্ষত্রিয় দুরন্ত।।
বালক অর্জ্জুন করিলেক অপরাধ।
চাহিয়া আমার মুখ করহ প্রসাদ।।
না কহিবে ইন্দ্রকে এ সব অপমান।
যাহ শীঘ্র নিজালয়ে, করহ প্রয়াণ।।
শুনিয়া গন্ধর্ব্বপতি আনন্দিত মনে।
আশীর্ব্বাদ করি তবে চলে সেইক্ষণে।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।