৮৫তম অধ্যায়
জয়ত্রথবধপর্ব্বাধ্যায়
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! পাণ্ডবগণ অভিমন্যুশোকে নিতান্ত কাতর হইয়া পরদিন কি করিলেন? আমাদের পক্ষীয় কোন্ কোন্ বীর পাণ্ডবগণের সহিত যুদ্ধ করিয়াছিলেন? কৌরবগণ অরাতি নিপাতন সব্যসাচীর অসাধারণ কার্য্যসকল অবগত থাকিয়াও কিরূপে তাদৃশ অন্যায় কার্য্যের অনুষ্ঠান পূর্ব্বক নির্ভয়ে অবস্থান করিলেন? পুত্রশোকসন্তপ্ত কালান্তক যমোপম কপিধ্বজ ধনঞ্জয় ক্রোধভরে শরাসন বিধূনন করিয়া সংগ্রাম স্থলে আগমন করিলে অস্মাৎপক্ষীয় বীরগণ কি প্রকার তাঁহাকে নিরীক্ষণ করিলেন এবং নিরীক্ষণ করিয়াই বা কি করিলেন? আর সংগ্রাম স্থলে দুৰ্যোনেরই বা কি অবস্থা ঘটিয়াছে? হে সঞ্জয়! এই সমুদায় বৃত্তান্ত আমার নিকট কীৰ্ত্তন কর।
আজি আর আনন্দ ধ্বনি আমার শ্রবণগোচর হইতেছে না। জয়দ্রথের ভবনে যে সকল মনোহর শ্রুতিমধুর ধ্বনি হইত, আজি তাহা তিরোহিত হইয়াছে। আজি আমার পুত্রগণের শিবির হইতে সূত মাগধগণের স্তুতিপাঠ এবং নর্ত্তকগণের শব্দ আমার শ্রবণবিবরে প্রবেশ করিতেছে না। কৌরবগণের যে বীরনাদে আমার কর্ণকুহর নিরন্তর নিনাদিত হইত, আজি তাহারা দীনভাবাপন্ন হওয়াতে সেই শব্দ শ্রুতিগোচর হইতেছে না। আমি পূর্ব্বে সত্যধৃতি সোমদত্তের নিবেশনে আসীন হইলেই মধুর শব্দ শ্রবণ করিতাম; কিন্তু আজি তাহা শ্রবণ করিতেছি না। হে সঞ্জয়! এই সমুদায়ই আমার পরিবেদনের কারণ। হায়! আমি কি পুণ্যহীন! আজি পুত্রগণের নিবেশন নিরুৎসাহ ও আর্ত্তস্বরে নিনাদিত নিরীক্ষণ করিতেছি। বিবিংশতি, দুর্মুখ, চিত্রসেন, বিকর্ণ ও অন্যান্য পুত্রগণের তাদৃশ বীরনাদ আর শ্রুতিগোচর হয় না। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যগণ শিষ্য হইয়া যাঁহার উপাসনা করেন, যে মহাধনুর্দ্ধর আমার পুত্রগণের প্রধান অবলম্বন, যিনি বিতণ্ডা, আলাপ, সংলাপ ও বিবিধ মনোহর গীত বাদ্য দ্বারা দিবারাত্র কাল যাপন করিতেন এবং কৌরব, পাণ্ডব ও সাত্বতগণ সতত যাঁহার উপাসনা করিত, আজি সেই অশ্বত্থামার গৃহে পূর্ব্বের ন্যায় শব্দ হইতেছে না। যে সকল গায়ক ও নৰ্ত্তক মহাধনুর্দ্ধর অশ্বত্থামাকে নিরন্তর উপাসনা করিত, আজি তাহাদের শব্দ শ্রুতিগোচর হয় না। বিন্দ ও অনুবিন্দের শিবিরে সায়ং সময়ে যে মহাধ্বনি হইত এবং কৈকয়গণের শিবিরে আনন্দিত স্বভাব সৈন্যগণ নৃত্যকালে যে মহান্ তাল ও গীতধ্বনি করিত, আজি তাহা তিরোহিত হইয়াছে। যে সকল যাজক যজ্ঞ করিতে করিতে শ্রুতনিধি ভূরিশ্রবার উপাসনা করিতেন, আজি তাহাদিগের শব্দ শ্রুতিপথে প্রবিষ্ট হইতেছে না। পূর্ব্বে দ্রোণাচার্য্যের গৃহে অবিরত মৌর্ব্বীধ্বনি, বেদ ধ্বনি এবং তোমর, অসি ও রথ ধ্বনি হইত, আজি তাহা শ্রবণ করিতেছি না। নানা দেশীয় গীত ও বাদিত্রধ্বনিও আজি অন্তর্হিত হইয়াছে।
হে সঞ্জয়! মহাত্মা জনার্দ্দন যে সময়ে সকল লোকের প্রতি অনুকম্পা প্রদর্শনার্থ সন্ধি স্থাপনের অভিলাষে বিরাট নগর হইতে আগমন করিলেন। আমি তখন মূর্খ দুৰ্য্যোধনকে কহিয়াছিলাম যে, দুৰ্য্যোধন! এই সময় কৃষ্ণের সাহায্যে পাণ্ডবগণের সহিত সন্ধিস্থাপন কর। আমার মতে সন্ধি সংস্থাপন সময়োচিতই হইতেছে; অতএব আমার বাক্য লঙ্ঘন করিও না। মহাত্মা বাসুদেব তোমার হিতার্থেই সন্ধি প্রার্থনা করিতেছেন; যদি তুমি তাঁহাকে প্রত্যাখ্যান কর, তাহা হইলে সংগ্রামে কদাচ তোমার জয়লাভ হইবে না। হে সঞ্জয়! আমি এইরূপে বারংবার দুৰ্য্যোধনকে সন্ধিস্থাপনে অনুরোধ করিলাম, কিন্তু ঐ কুলাঙ্গার কালপরিপাক বশত আমার বাক্যে অনাস্থা প্রদর্শনপূর্ব্বক কর্ণ ও দুঃশাসনের মতের অনুবর্তী হইয়া কেশবকে প্রত্যাখ্যান করিল। আর দেখ দ্যূতক্রীড়ায় আমার বা মহাত্মা বিদুর, জয়দ্ৰথ, ভীম, শল্য, ভূরিশ্রবা, পূরুমিত্র, জয়, অশ্বত্থামা, কৃপ ও দ্রোণের আমাদের কাহারও সম্মতি ছিল না। আমার পুত্র যদি তৎকালে আমাদের মতের অনুবৰ্তন করিত, তাহা হইলে চিরজীবী হইয়া জ্ঞাতি ও মিত্রের সহিত নিরাপদে পরম সুখে কালযাপন করিত।
আমি তাহাকে আরও কহিয়াছিলাম যে, পাণ্ডবগণ স্নিগ্ধ স্বভাব, মধুরভাষী, প্রিয়ংবদ, কুলীন, মান্য ও প্রাজ্ঞ, তাহারা অবশ্যই সুখ লাভ করিবে। ধর্মের প্রতি যাঁহার দৃষ্টি থাকে, তিনি ইহলোকে সকল সময়ে সর্ব্বত্র সুখ সম্ভোগ এবং পরকালে কল্যাণ ও সমতা লাভ করেন। সামর্থ্যসম্পন্ন পাণ্ডবগণ পৃথিবীর অর্থভাগ ভোগ করিবার উপযুক্ত। এই কুরুকুলোপভুক্ত সমুদ্রবেষ্টিত ভূমণ্ডলে তোমাদের ন্যায় তাহাদেরও অধিকার আছে। আর তাহারা রাজ্যলাভানন্তর ধর্ম্ম পরিত্যাগ পূর্ব্বক কদাচ তোমাদিগকে অভিভব করিবে না; ধর্মের অনুগত হইয়াই অবস্থান করিবে। আমার জ্ঞাতিগণ, শল্য, সোম দত্ত, মহাত্মা ভীষ্ম, দ্রোণ, বিকর্ণ, বাহ্লীক, কৃপ ও অন্যান্য মহাত্মা ভরতবংশীয়গণ তোমার নিমিত্ত পাণ্ডবগণকে যে সকল হিতকর কথা কহিবেন, তাহারা অবশ্যই তাহা শ্রবণ ও তদনুসারে আচরণ করিবে। কেহই পাণ্ডবগণকে তোমার বিপক্ষতাচরণে অনুরোধ করিবে না। যদিও করে তাহাও কোন কার্য্যকারক হইবে না; কারণ কৃষ্ণ কদাচ ধর্ম্ম পরিত্যাগ করেন না। পাণ্ডবগণ তাঁহার অনুগত, আর আমি ধর্ম্মাত্মা পাণ্ডবগণকে ধর্ম্মানুগত বাক্য কহিলে তাহারা তাহার অন্যথা করিতে পারিবে না।”
হে সঞ্জয়! আমি বিলাপ সহকারে অনেকবার দুৰ্য্যোধনকে এইরূপ কহিয়াছিলাম, কিন্তু সে মূঢ় কাল প্রেরিত হইয়া তাহা শ্রবণ করিল না! অতএব স্পষ্টই বোধ হইতেছে, আমাদের আর নিস্তার নাই। দেখ, যে সংগ্রামে মহাবীর বৃকোদর, অর্জ্জুন, বৃষ্ণিবীর সাত্যকি, পাঞ্চালাধিপতি উত্তমৌজা, দুৰ্জ্জয় যুধামন্যু, দুর্দ্ধর্ষ ধৃষ্টদ্যুম্ন, অপরাজিত শিখণ্ডী, সোমকতনয় ক্ষত্ৰধর্ম্মা, কেকয়দেশীয় ভূপতিগণ, চৈদ্য, চেকিতান, কাশ্যের পুত্র বিভূ, বিরাট, মহারথ দ্রুপদ এবং পুরুষ প্রধান নকুল ও সহদেব যোদ্ধা এবং মহামতি মধুসূদন মন্ত্রী, কোন্ জীবিতার্থী ব্যক্তি সে সমরে সম্মুখীন হইতে সাহস করিতে পারে? ফলত দুৰ্য্যোধন, কর্ণ, শকুনি ও দুঃশাসন ভিন্ন আমাদের পক্ষীয় আর কোন বীরই সংগ্রামে অরাতিগণ নিক্ষিপ্ত নিশিত শরনিকর সহ্য করিতে সমর্থ নহে। হে সঞ্জয়! ভগবান মধুসূদন যাহাদের অশ্বরশ্মি ধারণ করেন, বৰ্মধারী অর্জ্জুন যাহাদের যোদ্ধা, কখনই তাহাদিগের পরাজয়ের সম্ভাবনা নাই। আমি তোমার মুখে ভীষ্মের ও দ্রোণের নিধন বার্তা শ্রবণ করিয়া বোধ করিতেছি যে, এক্ষণে আমার পুত্রগণ দীর্ঘদর্শী মহাত্মা বিদুরের পূর্বোক্ত বাক্য সফল হইতেছে দেখিয়া এবং নির্বোধ দুৰ্য্যোধন আমার সেই বিলাপ স্মরণ করিয়া যৎপরোনাস্তি অনুতাপ করিতেছে। শৈনেয় ও অর্জ্জুনের শরে সৈন্যগণকে অভিভূত ও রথ সকল বীরশূন্য সন্দর্শন করিয়া নিশ্চয়ই আমার পুত্রের বিষাদার্ণবে নিমগ্ন হইতেছে। হিমাত্যয়ে সমীরণসহায় হুতাশন যেমন শুষ্ক তৃণ সকল দগ্ধ করে, তদ্রূপ ধনঞ্জয় আমার সৈন্যগণকে সংহার করিতেছে।
হে সঞ্জয়! অর্জ্জুনতনয় অভিমন্যু রণে নিহত হইলে তোমাদিগের অন্তঃকরণ কি রূপ হইয়াছিল? মহাবীর গাণ্ডীবধম্বার অপকার করিয়া তাহার ক্রোধবেগ সহ্য করে আমাদের পক্ষে এমন কেহই নাই। হায়! লোভপরতন্ত্র, দুর্বুদ্ধি, ক্রোধ বিকৃতাত্মা, রাজ্যলোলুপ দুর্য্যোধনের দুর্নীতি নিবন্ধনই আমার সমুদায় পুত্রেরা এই বিপদে নিপতিত হইয়াছে। যাহা হউক, এক্ষণে অভিমন্যু বধানন্তর দুৰ্য্যোধন, দুঃশাসন, সৌবল ও কর্ণ ইহারা এই বিষম বিপত্তি সময়ে কি রূপ কর্ত্তব্য অবধারণ করিল এবং দুৰ্ব্বদ্ধি দুৰ্য্যোধন তৎকালে সুনীতি বা দুর্নীতির অনুবর্তী হইল; তৎসমুদায় আদ্যোপান্ত বৰ্ণন করিয়া আমার উৎকণ্ঠা দূর কর।