৮৫তম অধ্যায়
করতোয়-প্রমুখ তীর্থমাহাত্ম
“পুলস্ত্য কহিলেন, “হে রাজন! সন্ধ্যাসময়ে সংবেদ্যা-তীর্থে স্নান করিলে বিদ্যালাভ হয়। পূর্ব্বে রামের প্রভাবে লৌহিত্যনামে এক তীর্থ হইয়াছিল, তাহাতে গমন করিলে বহু-সুবর্ণপ্রাপ্ত হয়। প্রজাপতি এই বিধি নির্দ্দিষ্ট করিয়াছেন যে, ত্রিরাত্ৰ উপবাস করিয়া করতোয়া-তীর্থে গমন করিলে অশ্বমেধযজ্ঞের ফললাভ হয়। হে রাজেন্দ্র। পণ্ডিতেরা কহিয়াছেন, যে স্থানে গঙ্গা ও সাগরের সমাগম হইয়াছে, তথায় অবগাহন করিলে অশ্বমেধযজ্ঞের দশগুণ ফলপ্ৰাপ্ত হয়। যে ব্যক্তি ত্রিরাত্ৰ উপবাসী থাকিয়া গঙ্গার পশ্চিমপারে গমন করিয়া স্নান করে, সে সর্ব্বপ্রকার পাপ হইতে বিমুক্ত হয়।
‘অনন্তর সর্ব্বপাপপ্ৰণাশিনী বৈতরণী-তীর্থে গমন করিবে। তৎপরে বিরাজ-তীর্থে গমন করিলে নিম্পাপ ও চন্দ্রের ন্যায় বিরাজমান হয় এবং সহস্রগোদানের ফলপ্রাপ্ত হইয়া স্বীয় কুল পবিত্র ও উদ্ধার করে। শোণ ও জ্যোতীরথ্যার সঙ্গমস্থানে সংযত ও পবিত্র হইয়া দেবলোক এবং পিতৃলোকদিগকে তৰ্পণ করিলে অগ্নিষ্টোমের ফললাভ হয়। শোণ এবং নর্ম্মদা-প্রভাব বংশগুল্মে স্নান করিলে অশ্বমেধের ফললাভ হয়। হে নিরাধিপ! ত্রিরাত্ৰ উপবাসী থাকিয়া কোশলাস্থ ঋষভ-তীর্থে গমন করিলে অশ্বমেধের ফললাভ, সহস্রগোদানের ফলপ্ৰাপ্তি ও স্বীয় কুল উদ্ধার হয়। অনন্তর তত্ৰত্য কাল-তীর্থে স্নান করিলে একাদশ বৃষভদানের ফললাভ হয়। ত্রিরাত্ৰ উপবাসী থাকিয়া পুষ্পবতীতে স্নান করিলে সহস্ৰ গোদানের ফলপ্রাপ্ত এবং স্বীয় কুল পবিত্র হয়।
অনন্তর বদরিকা-তীর্থে স্নান করিলে দীর্ঘায়ু-প্রাপ্ত হয় ও স্বৰ্গলোকে গমন করে। চম্প-তীর্থে গমনপূর্ব্বক ভাগীরথীতে তৰ্পণ ও দণ্ডাখ্যা-তীর্থে গমন করিলে সহস্ৰ গোদানের ফললাভ হয়। তদনন্তর পরমপবিত্ৰ লপেটিকায় গমন করিলে বাজপেয়-ফললাভ ও দেবগণকর্ত্তৃক পূজিত হয়। তৎপরে পরশুরাম-নিষেবিত মহেন্দ্ৰ-তীর্থে গমন করিয়া রাম-তীর্থে স্নান করিলে অশ্বমেধের ফললাভ হয়; সেই স্থানে মতঙ্গকেদারনামে এক প্রসিদ্ধ তীর্থ আছে, তথায় স্নান করিলে সহস্ৰ গোদানের ফললাভ হয়। অনন্তর শ্ৰীপর্ব্বতে উত্তীর্ণ হইবে; যে স্থানে ভগবান ভবানীপতি পার্ব্বতীর সহিত প্রীতমনে বাস করিতেন এবং যে স্থানে ব্ৰহ্মাদি দেবগণেরও আবাসস্থান, তত্রস্থ নদীতে অবগাহন করিয়া মহাদেবের উপাসনা করিলে অশ্বমেধের ফললাভ হয়। সেই স্থানে দেবহ্রদ নামে এক পরমপবিত্র তীর্থ আছে, শুচি ও সংযতচিত্ত হইয়া তথায় স্নান করিলে পরমাসিদ্ধি ও অশ্বমেধের ফল প্রাপ্ত হয়। দেবপূজিত ঋষভ-পর্ব্বতে গমন করিলে বাজপেয়-ফল ও স্বৰ্গলাভ হয়।
তদনন্তর অন্সরাগণপরিবৃত কাবেরীতে গমন করিবে। হে রাজন! তথায় স্নান করিলে সহস্রগোদানের ফললাভ হয়। তৎপরে সাগরের উপকূল-সন্নিহিত কন্যা-তীর্থে অবগাহন করিলে সমুদয় পাপ হইতে মুক্ত হয়। অনন্তর ত্ৰিলোকবিশ্রুত সমুদ্রমধ্যস্থিত অতিপবিত্ৰ গোকৰ্ণ তীরে গমন করিবে; যে স্থানে দেবগণ, তপোধন, ঋষিগণ, ভূত, যক্ষ, পিশাচ, কিন্নর, মহোরগ, সিদ্ধ, চারণ, গন্ধর্ব্ব, মানুষ, পান্নগ, সরিৎ, সাগর এবং পর্ব্বত-সকল উমাপতির উপাসনা করেন। তথায় ত্রিরাত্ৰ উপবাস ও মহাদেবের আরাধনা করিলে নর গাণপত্য-প্ৰাপ্ত ও অশ্বমেধের ফললাভ করে এবং দ্বাদশারাত্র বাস করিলে পুতাত্মা হয়।
‘হে নিরাধিপ! ত্ৰৈলোক্য-পূজিত গায়ত্রীস্থানে গমন ও ত্রিরাত্ৰ উপবাস করিলে সহস্ৰ গোদানের ফললাভ হয়। যদি বর্ণসঙ্কর ব্যক্তি দ্বিজাতিগণের প্রত্যক্ষ নিদর্শনস্বরূপ গায়ত্রী পাঠ করে, তাহা হইলে সে গাথা ও গীতিকা-সম্পন্ন হয়, কিন্তু অব্রাহ্মণে গায়ত্রী পাঠ করিলে তাহার গাথা ও গীতিকা প্ৰণষ্ট হইয়া যায়। বিপ্ৰর্ষি সংবর্তের বাপীতে স্নান করিলে রূপবান ও ভাগ্যশালী হয়। বেথাতীর্থে গমন করিয়া ত্রিরাত্ৰ উপবাস করিলে ময়ূর ও হংসসংযুক্ত বিমানলাভ হয়। সর্ব্বদা সিদ্ধগণ-পরিষেবিত গোদাবরীতে গমন করিলে অনুত্তম বাসুকি-লোক-প্রাপ্ত হওয়া যায়। বেশ্বাসঙ্গমে স্নান করিলে বাজিমেধ-ফললাভ হয়। বরদাসঙ্গমে স্নান করিলে সহস্রগোদানের ফল হয়। ব্ৰহ্মস্থানে গমন করিয়া ত্রিরাত্ৰ উপবাস করিলে সহস্রগোদানের ফললাভ হয় এবং স্বৰ্গলোকে গমন করে। ব্ৰহ্মচারী ও সমাহিত হইয়া কুশপ্লবন-তীর্থে ত্রিরাত্র বাস ও স্নান করিলে অশ্বমেধের ফলপ্ৰাপ্ত হয়।
অনন্তর দেবহ্রদ-নামক অরণ্যে ও বেশ্বাজলসম্ভব জাতিস্মরনামক হ্রদে স্নান করিলে নর জাতিস্মর হয়; যে স্থানে দেবরাজ ইন্দ্ৰ একশত অশ্বমেধ-যজ্ঞ করিয়া স্বৰ্গধাম-প্ৰাপ্ত হইয়াছেন, তথায় কেবল গমন করিবামাত্ৰই অগ্নিষ্টোমের ফললাভ হয়। সর্ব্বহ্রদে স্নান করিলে সহস্ৰগোদানের ফললাভ হয়। পরমপবিত্ৰ পয়োষী ব্যাপীতে পিতৃলোক ও দেবলোকের অর্চনা করিলে সহস্রগোদানের ফললাভ হয়। হে রাজন! পবিত্র দণ্ডকারণ্যে গমন করিয়া স্নান করিবামাত্ৰ সহস্রগোদানের ফললাভ হয়। শরভঙ্গাশ্রম ও মহাত্মা শুকাশ্ৰমে গমন করিলে দুৰ্গতি হইতে মুক্ত এবং কুল পবিত্ৰ করিতে সমর্থ হয়। তৎপরে মহর্ষি জামদগ্ন্যনিষেবিত শূর্পারকে গমন করিবে, তথায় স্নান করিলে বহু সুবৰ্ণ লাভ হয়। সংযত ও নিয়তাশন হইয়া সপ্ত গোদাবরে স্নান করিলে মহৎ পুণ্যপ্ৰাপ্তি ও দেবলোকলাভ হয়। নিয়তব্রত ও নিয়তাশন হইয়া দেবপথে গমন করিলে দেবসত্রের ফললাভ হয়।
‘হে রাজন! পূর্ব্বে ব্ৰহ্মচারী মহর্ষি সারস্বত তুঙ্গকারণ্যে গমন করিয়া তত্ৰত্য ঋষিগণকে বেদাধ্যাপন করেন। কালক্রমে সেই সকল বেদ বিনষ্ট হইলে পর, অঙ্গিরার পুত্র ভগবান বৃহস্পতি ঋষিগণের উত্তরীয়বসনে সুখাসীন হইলেন। অনন্তর সকলে সমবেত হইয়া যথান্যায়ে ওঁকার উচ্চারণ করিবামাত্র যিনি যাহা অভ্যাস করিয়াছিলেন, তৎসমুদয় তাহাদিগের স্মৃতিপথে সমারূঢ় হইল। অনন্তর দেবগণ, বরুণ, অগ্নি, প্রজাপতি, হরি, নারায়ণ এবং মহাদেব ইঁহারা সকলে তেজঃপুঞ্জ মহর্ষি ভৃগুকে তুঙ্গ কারণ্যনিবাসী ঋষিগণের যাজন-কাৰ্য্যে নিয়োজিত করিলে সেই মহাতপঃ বিধির্দ্দিষ্ট কর্ম্মদ্বারা পুনর্ব্বার বহ্নিস্থাপন করিলেন। পরে দেবগণ ও ঋষিগণ যথাক্রমে আজ্যভাগদ্বারা সেই অগ্নির যথাবিধি তৰ্পণ করিয়া স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান করিলেন। হে রাজসত্তম! কি স্ত্রী, কি পুরুষ, সেই তুঙ্গকারণ্যে প্রবেশ করিবামাত্র নিষ্পাপ হয়, সন্দেহ নাই। তথায় একমাস বাস করিলে দুর্লভ ব্ৰহ্মলোকপ্রাপ্ত হয় এবং স্বীয় কুল উদ্ধার করিতে পারে।
“মেধাবিক-তীর্থে পিতৃলোক ও দেবলোকের তর্পণ করিলে অগ্নিষ্টোমের ফললাভ, স্মৃতি এবং মেধাপ্রাপ্ত হয়। অনন্তর লোকবিশ্রুত কালঞ্জর-পর্ব্বতে গমন করিয়া তত্ৰত্য দেবহ্রদে স্নান করিলে সহস্রগোদানের ফল ও স্বৰ্গলাভ হয়। হে রাজন! গিরিবর চিত্ৰকূটে সর্ব্বপাপপ্ৰণাশিনী মন্দাকিনী প্রবাহিত আছেন; সেই পুণ্যসলিলা স্রোতস্বতীতে অবগাহনপূর্ব্বক পিতৃলোক ও দেবলোকের অৰ্চনা করিলে অশ্বমেধের ফললাভ ও অনুত্তম গতি প্রাপ্ত হয়। তদনন্তর ভর্ত্তৃস্থানে গমন করিবে; যে স্থানে মহাসেন গুহ নিত্য সন্নিহিত রহিয়াছেন; তথায় গমনমাত্র সিদ্ধ হয়। পরে কোটি-তীর্থে স্নান করিলে সহস্ৰগোদানের ফললাভ হয়। তদনন্তর জ্যেষ্ঠস্থান প্ৰদক্ষিণপূর্ব্বক মহাদেবের নিকট অভিগমন করিলে চন্দ্রের ন্যায় বিরাজমান হয়। মহারাজ! তত্ৰত্য কূপমধ্যে বিখ্যাত চতুঃসমুদ্র বিদ্যমান আছে; তথায় স্নান ও নিয়তাত্মা হইয়া পিতৃলোক এবং দেবলোকের অৰ্চনা করিলে পবিত্র এবং চরমে পরামগতি-লাভ হয়। তৎপরে শৃঙ্গবেরপুরে গমন করিবে; যে স্থানে পূর্ব্বে রামচন্দ্ৰ বনবাস-মানসে উত্তীর্ণ হইয়াছিলেন; সেই তীর্থে স্নান করিলে পাপবিনিন্মুক্ত হয়। ব্ৰহ্মচারী ও সমাহিত হইয়া গঙ্গাস্নান করিলে নিম্পাপ হয় এবং বাজপেয়ফললাভ করে। পরে দেবস্থান মুঞ্জবাটে গমন করিবে; তথায় মহাদেবকে প্ৰদক্ষিণ করিলে গাণপত্যলাভ হয় এবং সেই তীর্থে জাহ্নবীতে স্নান করিলে পাপবিনির্ন্মুক্ত হয়।
অনন্তর ঋষিপূজিত প্ৰয়াগে গমন করিবে; যে স্থানে ব্ৰহ্মাদি দেবগণ, দিক, দিকপাল-সকল, লোকপালগণ, সাধ্যগণ, পিতৃগণ, সনৎকুমার-প্রমুখ মহর্ষিগণ, অঙ্গিরাপ্রমুখ ব্ৰহ্মর্ষিগণ, নাগ সুবৰ্ণ, সিদ্ধ, চক্ৰধর, সরিৎসাগর, গন্ধর্ব্ব, অন্সরঃ, ভগবান হরি এবং প্রজাপতি অবস্থিতি করিতেছেন। তথায় তিনটি অগ্নিকুণ্ড আছে; তন্মধ্য দিয়া সরিদ্বারা গঙ্গা বেগে প্রবাহিত হইয়াছেন এবং তৎপ্রদেশে তপনতনয়া যমুনা গঙ্গার সহিত সঙ্গত আছেন। সেই ভুভাগ পৃথিবীর জঘন্যস্বরূপ, তাহাকেই ঋষিগণ প্রয়াগ বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন। প্রয়াগ, প্রতিষ্ঠান, কম্বল ও অশ্বতর এই সমস্ত প্রধান তীৰ্থ বলিয়া পরিগণিত এবং ভোগবতী। প্রজাপতির বেদী বলিয়া বিখ্যাত। তথায় দেবযজ্ঞ মূর্ত্তিমান হইয়া ঋষিগণের সহিত ব্ৰহ্মার উপাসনা করিতেছেন; দেবতা এবং চক্রবর্ত্তী রাজগণ তথায় যোগানুষ্ঠান করিয়া থাকেন, এই নিমিত্ত প্ৰয়াগ ত্ৰিলোকমধ্যে পুণ্যতমরূপে বিখ্যাত ও সর্ব্বতীর্থ অপেক্ষা শ্ৰেষ্ঠ বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে। সেই তীর্থে গমন, তাহার নামসঙ্কীর্ত্তন অথবা গাত্রে মৃত্তিকালেপন করিবামাত্ৰ পাপমোচন হয়। যে ব্যক্তি গঙ্গাযমুনাসঙ্গমে স্নান করে, সে নিখিল পুণ্যফলভাগী এবং রাজসূয় ও অশ্বমেধ প্রভৃতি যজ্ঞের ফলভোগী হয়, সন্দেহ নাই। সেই স্থানে দেবগণের সংস্কৃত যজনভূমি আছে, তথায় অত্যঙ্গমাত্র দান করিলেও মহা ফলজনক হয়। হে রাজন! আপনি বেদবচন ও লোকবাদ্যবশতঃ প্রয়াগমরণে পরাঙ্মুখ হইবেন না; কারণ, প্ৰয়াগে দশ সহস্র ও ষষ্টি কোটি তীর্থের সান্নিধ্য আছে। গঙ্গাযমুনাসঙ্গমে স্নান করিবামাত্র চতুর্ব্বিধ বিদ্যা ও সত্যবাক্যের ফললাভ হয়, তাহাতে সন্দেহ নাই। প্রয়াগে ভোগবতী নামে বাসুকি-তীৰ্থ আছে, যে ব্যক্তি তথায় স্নান করে, সে অশ্বমেধের ফলপ্রাপ্ত হয়। তত্রত্য গঙ্গায় হংসপ্ৰপতন ও দশাশ্বমেধিকতীৰ্থ আছে। প্ৰয়াগের যে স্থানে গঙ্গাস্নান করিবে, সেই স্থানেই কুরুক্ষেত্রসদৃশ ফললাভ হইবে। বিশেষতঃ কনখল এবং প্রয়াগের সমধিক মাহাত্ম্য কীর্ত্তিত আছে; তথায় শত শত অকাৰ্য্য করিয়াও গঙ্গাস্নান করিলে, অগ্নি যেমন ইন্ধন দাহ করে, তদ্রূপ পবিত্ৰ গঙ্গাসলিলস্নাত ব্যক্তির সমুদয় পাপরাশি ভস্মীভূত করে। সত্যযুগে সকল স্থান, ত্রেতায় পুষ্কর, দ্বীপরে কুরুক্ষেত্র পুণ্যজনক ও তীর্থ বলিয়া বিখ্যাত ছিল; কিন্তু কলিযুগে কেবল একমাত্র গঙ্গাই পুণ্যবিধাত্রী হইয়াছেন। পুষ্করে তপস্যা, মহালয়ে দান, মালয়ে অগ্নিসোমারোহণ এবং ভৃগুতুঙ্গে অনশন করিলে পাপক্ষয় হয়; কিন্তু পুষ্কর, কুরুক্ষেত্র, গঙ্গা এবং মগধ এই সকল তীর্থে কেবল স্নান করিলেই পূর্ব্ব সপ্তপুরুষ ও অবরজ [অধস্তন] সপ্তপুরুষ উদ্ধার হয়। গঙ্গার নাম-কীর্ত্তনে পাপ বিনষ্ট হয়, দর্শনে শুভলাভ হয়, অবগাহন ও জল-পানে সপ্তমকুল পৰ্য্যন্ত পবিত্র হয়; যত কাল পৰ্য্যন্ত মনুষ্যের অস্থি গঙ্গাজল স্পর্শ করিয়া থাকে, তাবৎকাল সেই ব্যক্তির স্বৰ্গভোগ হয়। পবিত্র তীর্থ ও পুণ্যাশ্রম সকল সেবা করিয়া পুণ্যোপার্জ্জনপূর্ব্বক সুরলোকে উত্তীর্ণ হয়, ইহা সত্য; কিন্তু পিতামহ কহিয়াছেন, গঙ্গার সদৃশ তীর্থ নাই, কেশবের পর দেব নাই এবং ব্রাহ্মণের অপেক্ষা কেহই শ্রেষ্ঠ নাই। মহারাজ! যে স্থানে ‘গঙ্গা’ আছেন, সেই যথার্থ দেশ; গঙ্গাতীর-সন্নিহিত স্থান তপোবনস্বরূপ এবং তাহাকে সিদ্ধক্ষেত্ৰ বলিয়া বিবেচনা করিবেন। ব্রাহ্মণ, সাধু, আত্মজ, সুহৃদ, শিষ্য ও অনুগত ব্যক্তিকে এইরূপ সত্য উপদেশ প্ৰদান করিবে যে, ইহাই ধন্য, পবিত্ৰ, অনুত্তম স্বৰ্গস্বরূপ, পুণ্যজনক, রম্য, পাবন, পরমধর্ম্ম, ইহাই মহর্ষিদিগের পরম গুহ্য এবং সর্ব্বপাপ-প্ৰমোচন; ইহা দ্বিজমধ্যস্থ হইয়া অধ্যয়ন করিলে স্বৰ্গলাভ হয়।
‘হে মহারাজ! শ্ৰীমৎ, স্বগজনক, পুণ্যপ্ৰদ, সপত্নশমন, মেধাজনন এবং পরমোৎকৃষ্ট তীর্থ বংশানুকীর্ত্তন শ্রবণ করিলে অপুত্রের পুত্র হয়, অধনের ধন হয়, রাজার পৃথিবীলাভ হয়, বৈশ্যের অর্থগম হয়, শূদ্রের অভিলষিত অৰ্থসিদ্ধি হয়, এবং ব্ৰাহ্মণ বিদ্যায় পারদর্শিনী হয়েন। যে ব্যক্তি শুচি হইয়া প্রতিদিন তীর্থ-পুণ্য শ্রবণ করে, সে জাতিস্মর হইয়া অমরপুরে বিরাজমান হয়। হে রাজনী! আমি যে সমস্ত অধিগম্য ও অগম্য তীর্থের কীর্ত্তন করিলাম, আপনি সকল-তীর্থ দিদৃক্ষায় [দর্শনেচ্ছায়] মনদ্বারা সেই সকল স্থানে গমন করিবেন। এই সকল তীর্থে বসু, আদিত্য, মরুৎ, অশ্বিনীকুমার এবং দেবকল্প ঋষিগণ সুকৃতাৰ্থী হইয়া স্নান করিয়াছিলেন; অতএব আপনিও সংযত হইয়া পুণ্যদ্বারা পুণ্যবৰ্দ্ধন করিয়া বিধিপূর্ব্বক সেই সমস্ত তীৰ্থপৰ্যটন করুন।
‘মহারাজ! ভাবিতাত্মা, আস্তিক, বেদজ্ঞ ও শাস্ত্ৰদশী সাধু পুরুষেরা তীর্থে গমন করেন; কিন্তু ব্ৰতবিহীন, অকৃতাত্মা, অশুচি, তস্কর ও কুটিলমতি মানবেরা কখনই তীর্থস্নান করে না। তুমি সচ্চরিত্ৰতা ও ধার্ম্মিকতাদ্বারা পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহ, ব্ৰহ্মাদি। দেবগণ ও ঋষিগণকে পরিতুষ্ট করিয়াছ, তুমি বসুলোকপ্রাপ্ত হইবে এবং মহতী শাশ্বতী কীর্ত্তি সংস্থাপন করিতে পরিবে।”
যুধিষ্ঠিরের প্রতি নারদের তীৰ্থসেবা উপদেশ
নারদ কহিলেন, “হে কুরুশার্দূল! ভগবান পুলস্ত্য এই কথা বলিয়া প্ৰীতিপ্ৰসন্নচিত্তে সেই স্থানেই অন্তহিত হইলেন। অনন্তর শাস্ত্রতত্ত্বার্থবিশেষজ্ঞ ভীষ্ম মহর্ষি পুলস্ত্যের বচনানুসারে পৃথিবী- পর্যটন করিতে লাগিলেন। মহাপুণ্যা সর্ব্বপাপপ্রমোচনী তীর্থযাত্ৰা এইরূপে প্ৰয়াগে প্রতিষ্ঠিত আছে। যে ব্যক্তি উল্লিখিত বিধিপূর্ব্বক পৃথিবীসঞ্চরণ করিতে সমর্থ হইবে, সে পরলোকে শত শত অশ্বমেধের ফলভোগ করবে। পূর্ব্বে কুরুপ্রবর ভীষ্ম যে প্রকার ধর্ম্মোপার্জ্জন করিয়াছিলেন, তুমি তাহার অষ্টগুণ ধর্ম্মপ্রাপ্ত হইবে। তুমি ঋষিগণের নেতা, এই নিমিত্ত তোমার অষ্টগুণ ফললাভ হইবে। হে কুরুনন্দন! তোমা ব্যতীত রক্ষোগণবিকীর্ণ [রাক্ষসগণ-সমাকীর্ণ] এই সমস্ত তীর্থে কেহই গমন করিতে পারে না। যে ব্যক্তি প্ৰভাতে গাত্ৰোত্থানপূর্ব্বক এই দেবর্ষি-চরিত পাঠ করিবে, সে সকল পাপ হইতে বিমুক্ত হইবে। মহারাজ! বাল্মীকি, কাশ্যপ, আত্ৰেয়, কুণ্ডজঠর, বিশ্বামিত্র, গৌতম, অসিত, দেবল, মার্কণ্ডেয়, গালব, ভরদ্বাজ, বশিষ্ঠ, উদ্যালক, সপুত্ৰ শৌনক, ব্যাস, দুর্ব্বাসা এবং মহাতপাঃ জাবালি প্রভৃতি তপোধন ঋষিবরেরা তোমার প্রতীক্ষায় কালক্ষেপ করিতেছেন, তুমি তাহাদিগের সমভিব্যাহারে তীৰ্থপৰ্য্যটনে কৃতসঙ্কল্প হও। মহর্ষি লোমশ তোমার নিকট আগমন করিলে তুমি তাহার সহিত গমন করিবে তাহার সহিত এই সকল তীর্থভ্ৰমণ করিলে তুমি রাজা মহাভিষের ন্যায় মহতী কীর্ত্তি-প্ৰাপ্ত হইবে। হে রাজশার্দ্দূল! সুবিখ্যাত রাজা রামচন্দ্র ও ভগীরথের ন্যায় তুমি স্বীয় ধর্ম্মে পরামশোভিত, সকল রাজগণ অপেক্ষা সমধিক দীপ্তিশালী এবং মনু, ইক্ষাকু, পুরু ও রাজা বৈণ্যের ন্যায় সর্ব্বত্র সুবিখ্যাত হইয়াছ। পূর্ব্বে যেমন বৃত্ৰহা নিখিল আরতিকুল নির্মূল করিয়া নিষ্কটকে তৈলোক্যপালন করিয়াছিলেন, তদ্রূপ তুমিও সপত্নসকল নিঃশেষিত করিয়া সুখে প্রজােপালন করিবে, সন্দেহ নাই। হে রাজীবলোচন! তুমি মহাবীৰ্য্য কর্ত্তবীৰ্য্য অর্জ্জুনের ন্যায় স্বধর্ম্মবিজিত বসুমতী শাসনপূর্ব্বক মহতী খ্যাতি ও প্রতিপত্তি—লাভ কর।”
দেবর্ষি নারদ রাজাকে এইরূপে আশ্বাসপ্রদানপূর্ব্বক বিদায়গ্ৰহণ করিয়া সেই স্থানেই অন্তর্হিত হইলেন। অনন্তর ধর্ম্মাত্মা যুধিষ্ঠির নিরন্তর কেবল তদ্বিষয় চিন্তা করিয়া তীর্থযাত্ৰাশ্ৰিত পুণ্যপুঞ্জ ঋষিগণের নিকট নিবেদন করিলেন।