মুনি বলিলেন, শুন পঞ্চ সহোদর।
দ্রুপদ নৃপতি করে কন্যা-স্বয়ন্বর।।
পৃথিবীতে বসে যত রাজ-রাজেশ্বর।
স্বয়ম্বরে এল সবে পাঞ্চাল নগর।।
অদ্ভুত রচিল লক্ষ্য পাঞ্চালের পতি।
সে লক্ষ্য কাটিতে নাহি কাহার শকতি।।
অর্জ্জুন কাটিবে লক্ষ্য সভার মাঝার।
পাঞ্চালের কন্যা প্রাপ্তি হইবে তাহার।।
শীঘ্রগতি যাহ তথা না কর বিলম্ব।
চারিদিন হৈল স্বয়ম্বরের আরম্ভ।।
এত বলি বেদব্যাস গেলেন স্বস্থান।
কুন্তীসহ পঞ্চ ভাই করেন প্রস্থান।।
অন্তর্হিত হইলেন ব্যাস তপোধন।
উত্তরমুখেতে যান পাণ্ডু-পুত্রগণ।।
দিবানিশি চলিলেন নাহিক বিশ্রাম।
নানাদেশ নদ-নদী লঙ্ঘিলেন গ্রাম।।
আগে যান ধনঞ্জয় ঘোর রজনীতে।
অন্ধকার হেতু ধরি দেউটি করেতে।।
কত দিনে উত্তরেন জাহ্নবীর তীরে।
স্ত্রীসহ গন্ধর্ব্ব এক তথায় বিহরে।।
পাণ্ডবের শব্দ শুনি বলে ডাক দিয়া।
বড় অহঙ্কার দেখি মনুষ্য হইয়া।।
প্রয়াগ গঙ্গার মধ্যে আমার আশ্রয়।
রাত্রিকালে আসি জীয়ে, কে হেন আছয়।।
যক্ষ রক্ষ রাক্ষস পিশাচ ভূতগণ।
নিশাকালে অধিকারী এই সব জন।।
বিশেষে অঙ্গারপূর্ণ নাম মোর খ্যাত।
নিশ্চয় আমার হাতে হইবে নিপতি।।
পার্থ বলিলেন, শাস্ত্র না জান দুর্ম্মতি।
জাহ্নবীর জলে স্থানে কিবা দিবা রাতি।।
অকাল হইল তাহে, কিবা আসে যায়।
তোর কাছে যে দুর্ব্বল, সে তোরে ডরায়।।
গঙ্গার মহিমা না জানহ মূঢ়মতি।
স্বর্গেতে অলকানন্দা, ভূমে ভাগীরথী।।
পিতৃলোকে বৈতরণী, অধো ভাগীরথী।
অকাল-সুকাল নাহি, সদা লোক গতি।।
হেন গঙ্গাস্নান রুদ্ধ করহ অজ্ঞান।
ইহার উচিত ফল পাবে মম স্থান।।
অর্জ্জুনের বাক্যে কোপে গন্ধর্ব্ব-ঈশ্বর।
ধনু টঙ্কারিয়া এড়ে সর্পময় শর।।
হাতেতে উলকা ছিল, ইন্দ্রের নন্দন।
তাহে করিলেন তার অস্ত্র নিবারণ।।
ডাকিয়া বলেন পার্থ, শুন রে গন্ধর্ব্ব।
এই অস্ত্র বলেতে করিতেছিল গর্ব্ব।।
তোর বাণ লইব তোমার আজি প্রাণ।
পূর্ব্বে দ্রোণাচার্য্য অস্ত্র দিলেন আমারে।
এড়িলাম অস্ত্র, এই রাখ আপনারে।।
এত বলি এড়িলেন অস্ত্র ধনঞ্জয়।
গন্ধর্ব্বের রথ পুড়ি হৈল ভস্মময়।।
পলায় গন্ধর্ব্বপতি রণে ভঙ্গ দিয়া।
পাছে পাছে অর্জ্জুন ধরেন চুলে গিয়া।।
স্বামীর দেখিয়া হেন সঙ্কট সময়।
নারীগণ গেলা যথা ধর্ম্মের তনয়।।
গন্ধর্ব্বের ভার্য্যা কুম্ভনসী নাম ধরে।
যুধিষ্ঠির পায়ে ধরি বিনয় সে করে।।
সাধুজন-শ্রেষ্ঠ তুমি ধর্ম্ম-অবতার।
তোমার আশ্রয়ে দুঃখ খণ্ডে সবাকার।।
পরম সঙ্কট হৈতে মোরে কর ত্রাণ।
সহস্র সতীনে মোর স্বামী দেহ দান।।
কামিনীর ক্রন্দন শুনিয়া পাণ্ডুপতি।
অর্জ্জুনে করেন আজ্ঞা, ছাড় শীঘ্রগতি।।
ধর্ম্মের পাইয়া আজ্ঞা ছাড়েন অর্জ্জুন।
গন্ধর্ব্ব বলয়ে তবে বিনয় বচন।।
মোরে প্রাণদান যদি দিলা মহাশয়।
করিব তোমার প্রীতি, উচিত যে হয়।।
অদ্ভুত চাক্ষুসী বিদ্যা আছে মোর স্থানে।
এ বিদ্যা জানিলে লোক জানে সর্ব্বজনে।।
মনু পূর্ব্বে এই বিদ্যা দিলেন চন্দ্রেরে।
বিশ্বাবসু চন্দ্র-স্থানে, সে দিল আমারে।।
মনুষ্য-অধিক আমি সেই বিদ্যা হৈতে।
সেই বিদ্যা দিব আমি তোমার প্রীতিতে।।
ভাই প্রতি শত অশ্ব দিব আনি আর।
সেই অশ্ব শ্রান্ত নহে ভ্রমিলে সংসার।।
পূর্ব্বে ইন্দ্র বৃত্রাসুরে বজ্র প্রহারিল।
অসুরের মুণ্ডে বজ্র শতখান হৈল।।
স্থানে স্থানে সেই বজ্র কৈল নিয়োজন।
সবা হৈতে শ্রেষ্ঠ বজ্র ব্রাহ্মণ-বচন।।
শূদ্রগণ কর্ম্ম করে, বজ্র তার সেহি।
বৈশ্যগণ দান করে, বজ্র তারে কহি।।
ক্ষত্রিয় থুইল বিদ্যা রথের বাজিতে।
সে কারণে দিব অশ্ব তোমার সে হিতে।।
অর্জ্জুন বলেন, তুমি হারিলা সমরে।
তব স্থানে লব অস্ত্র , না শোভে আমারে।।
গন্ধর্ব্ব বলিল, যাতে সর্ব্বলোকে জানে।
হেন বিদ্যা জানি, তুমি ত্যজ কি কারণে।।
অর্জ্জুন বলেন, আমি জানিনু সকল।
ভয় পেয়ে এতেক বিনয় কেন বল।।
গন্ধর্ব্ব বলেন, আমি জানি যে তোমারে।
তপতী হইতে জন্ম বিখ্যাত সংসারে।।
তোমার পুরুষকার জানি ভালমতে।
গুরু দ্রোণ জানি, তিনি খ্যাত ত্রিজগতে।।
তবু রুষিলাম রাত্রে, আমার বিষয়।
বিশেষ স্ত্রীসহ মোর ক্রীড়ার সময়।।
স্ত্রীসহিত ক্রীড়াতে অবজ্ঞা যেবা করে।
বলবান নাহি বুঝি রুদ্ধ করি তারে।।
অনাহূত অনাগ্নেয় যেই দ্বিজগণ।
তাহারে করি যে বদ্ধ নিশার কারণ।।
আর যত জাতি আমি পাই নিশাকালে।
অবশ্য সংহার তার শোর শরানলে।।
পুরোহিত কিম্বা দ্বিজ সঙ্গেতে করিয়া।
গৃহ হৈতে বাহিরায় দেবতা স্মরিয়া।।
সর্ব্বত্র মঙ্গল তার যথাকারে যায়।
তাহাতে নাহিক শক্তি হিংসতে আমায়।।
জিতেন্দ্রিয় ধার্ম্মিক তোমরা পঞ্চজন।
আমারে জিনিতে শক্ত হৈলা সে কারণ।।
মোর বাক্য তাপত্য শুনহ এইক্ষণে।
সকল নিষ্ফল পুরোহিতের কারণে।।
আপন মঙ্গল বাঞ্ছা করে যেই জন।
কভু না লঙ্ঘিবে পুরোহিতের বচন।।
সহজেতে পুরোহিত সদা হিতকারী।
পুরোহিত ভজি ইন্দ্র স্বর্গ অধিকারী।।
অর্জ্জুন বলেন, শুন বলি যে তোমারে।
তাপত্য বলিয়া কেন বলিলা আমারে।।
জননী আমার কুন্তী আছেন সংহতি।
তাপত্য বলিলা কেন, কেবা সে তপতী।।
গন্ধর্ব্ব বলিল, শুন ইহার কারণ।
তব পূর্ব্ববংশ-কথা শুন দিয়া মন।।
এইত সূর্য্যের কন্যা হইল তপতী।
ত্রৈলোক্যতে তাঁর সমা নাহি রূপবতী।।
যৌবন সময়ে তাঁরে দেখি দিনকর।
চিন্তিলেন নাহি দেখি কন্যা- যোগ্য বর।।
তোমার উপর বংশে রাজা সম্বরণ।
নিরবধি করিলেন সূর্য্যের সেবন।।
উপবাস নিয়ম করেন চিরকাল।
তাহাতে হলেন তুষ্ট দেব লোকপাল।।
সূর্য্যের সেবায় সম্বরণ মহারাজা।
রূপে অনুপম হৈল বলে মহাতেজা।।
তাঁর রূপগুণে তুষ্ট হৈল বলে মহাতেজা।।
তাঁর রূপগুণে তুষ্ট হৈল দিনকর।
মনে চিন্তা কৈল তপতীর যোগ্যবর।।
তবে কতদিনে সম্বরণ নৃপবর।
মৃগয়া করিতে গেল অরণ্য ভিতর।।
একা অশ্বে চড়িয়া ভ্রময়ে বনে বনে।
বহু শ্রমে অশ্ব মরে জলের বিহনে।।
অশ্বহীন পদব্রজে ভ্রমে নরবর।
দিক্ জানিবারে উঠে পর্ব্বত উপর।।
পর্ব্বত উপরে দেখে কন্যা নিরুপমা।
বিদ্যুতের পুঞ্জ, কিবা কাঞ্চন প্রতিমা।।
কন্যার রূপের তেজে দীপ্ত করে গিরি।
দেখিয়া নৃপতি চিন্তে আপনা পাসরি।।
সফল আমার জন্ম, বলে নৃপবর।
হেন রূপ দেখিলাম চক্ষুর গোচর।।
পূর্ব্বেতে নৃপতি যত দেখিল স্ত্রীগণে।
সবাকারে নিন্দা রাজা করে নিজ মনে।।
ত্রিভুবন রূপ কিবা বিধাতা মথিল।
সবাকার শ্রেষ্ঠ করি ইহারে নির্ম্মিল।।
স্থির করি কায় রাজা করে নিরীক্ষণ।
চিত্তের পুত্তলি প্রায় হইল রাজন।।
কতক্ষণে নৃপতি মধুর মৃদুভাষে।
মদনে পীড়িত হৈয়া গেল কন্যাপাশে।।
রাজা বলে, কহ শুনি মন্মথমোহিনী।
নির্জ্জন কাননে কেন আছ একাকিনী।।
রাতুল চরণ কিবা যুগ-পদ্ম-রম্ভা চারু।
তাহাতে স্থাপন তব যুগ্ম রম্ভা ঊরু।।
নিতম্ব কুঞ্জর কুম্ভ, কটিদেশ সরু।
নয়ন খঞ্জন যুগ কামচাপ-ভুরু।।
অতুল-যুগল কুচ কন্দর্প কলস।
ভুজঙ্গ-যুগল ভুজ, জঘন সরস।।
অনিন্দিত-অঙ্গ কন্যা! দেখিয়া তোমার।
পরশিতে বাঞ্ছা করে রত্ন-অলঙ্কার।।
কেবা তুমি দেবকন্যা অথবা অপ্সরী।
নাগিনী মানুষী কিবা, হবে বা কিন্নরী।।
কত দেখিয়াছি চক্ষে শুনিয়াছি কাণে।
হে হেন অপূর্ব্বরূপ লোকে নাহি জানে।।
কে তুমি, কাহার কন্যা, কহ শশিমুখি।
কি হেতু পর্ব্বত মধ্যে আছহ একাকী।।
চাতকের প্রায় মম কর্ণ করে আশা।
তৃপ্ত কর কর্ণ মম কহি এক ভাষা।।
বিবিধ বিনয় করি ভূপতি কহিল।
কিছু না বলিয়া কন্যা অন্তর্দ্ধান হৈল।।
মেঘের উপরে যেন বিদ্যুৎ লুকায়।
উন্মত্ত হইয়া রাজা চারিদিকে চায়।।
কন্যা না দেখিয়া রাজা হৈল অচেতন।
ভূমে গড়াগড়ি যায় রাজা সম্বরণ।।
অন্তরীক্ষে থাকি তাহা তপতী দেখিল।
ডাক দিয়া তপতী সে রাজারে বলিল।।
কি কারণে অচেতন হৈলা নৃপবর।
উঠহ নৃপতি তুমি যাহ নিজ ঘর।।
কন্যার এতেক বাক্য শুনিয়া রাজন।
মৃত-কলেবরে যেন পাইল চেতন।।
চেতন পাইয়া রাজা ঊর্দ্ধমুখে চায়।
অন্তরীক্ষে দেখে কন্যা বিদ্যুতের প্রায়।।
রাজা বলে, কামশরে হানিল শরীর।
ইচ্ছা করি ধৈর্য্য ধরি চিত্ত নহে স্থির।।
তোমার বদন দেখি অন্য নাহি মনে।
গরলে ব্যাপিল যেন ভুজঙ্গ দংশনে।।
তোমা বিনা অন্যে দেখি রাখিব জীবন।
কদাচিৎ নহে হেন অবশ্য মরণ।।
পাইলাম প্রাণ শুনি তোমার বচন।
অনুগ্রহ কৈলা মোরে যেন লয় মন।।
মোর প্রতি দয়া যদি হইল তোমার।
আলিঙ্গন দিয়া প্রাণ রাখহ আমার।।
কন্যা বলে, নরপতি এ নহে বিচার।
প্রার্থনা পিতার স্থানে করহ আমার।।
পরিচয় আমার শুনহ নরপতি।
সূর্য্যকন্যা আমি, নাম ধরি যে তপতী।।
তপঃক্লেশ ব্রত কর, সূর্য্য-আরাধন।
সূর্য্য দিলে আমারে সে পাইবা রাজন।।
এত বলি তপতী হইল অন্তর্ধান।
পুনঃ পড়ে নরপতি হইয়া অজ্ঞান।।
হেথা রাজমন্ত্রী সব সৈন্যগণ লৈয়া।
ভ্রমিল সকল বন রাজা না দেখিয়া।।
পর্ব্বত উপরে তবে দেখে নরবর।
পড়িয়াছে অজ্ঞান মোহিত কলেবর।।
শীতল সলিল অঙ্গে সিঞ্চে মন্ত্রিগণ।
ধরি বসাইল তবে করিয়া যতন।।
চৈতন্য পাইয়া রাজা চারিদিকে চায়।
মন্ত্রিগণ দেখি কিছু না বলিল রায়।।
কন্যার ভাবনা বিনা অন্য নাহি মনে।
বিদায় করিল রাজা সব সৈন্যগণে।।
রাজা বৃদ্ধমন্ত্রী এক রাখিল সংহতি।
সূর্য্যের উদ্দেশে তপ করে নরপতি।।
ঊর্দ্ধপদে অধোমুখে সদা উপবাসে।
একচিত্তে তপ করে সূর্য্যের উদ্দেশে।।
তবে চিত্তে অনুমানি রাজা সম্বরণ।
পুরোহিত বশিষ্ঠেরে করিল স্মরণ।।
আইল বশিষ্ঠ মুনি রাজার স্মরণে।
রাজার দেখিয়া ক্লেশ চিন্তে মুনি মনে।।
তপতী কারণে তপ তপন-সেবন।
জানি মুনিরাজ চিত্তে ভাবিল তখন।।
অন্তরীক্ষে উঠি গেল আকাশ-মণ্ডল।
দ্বিতীয় ভাস্কর তেজ যাঁর তপোবল।।
কৃতাঞ্জলি করি সূর্য্যে করিল প্রণাম।
সবিনয়ে জানাইল আপনার নাম।।
ভাস্কর বলেন, মুনি কহ সমাচার।
কোন্ প্রয়োজনে এলে আলয়ে আমার।।
কোন্ কার্য্যে অভিলাষ বলহ আমারে।
দুষ্কর হইলে তবু তুষিব তোমারে।।
প্রণমিয়া বশিষ্ঠ কহেন পুনর্ব্বার।
মম এই নিবেদন তোমার গোচর।।
ভারত-বশের রাজা নাম সম্বরণ।
রূপে গুণে অনুপম বিখ্যাত ভুবন।।
তোমার ভজনে রাজা বড় অনুরত।
তাহার বরণ হেতু তোমার অনুগত।।
তপতী নামেতে সেই সাবিত্রী তনুজা।
অযোগ্য না হয় রাজা উর্ব্বীতে প্রধান।
এই হেতু, যেই আজ্ঞা করহ বিধান।।
ভাস্কর বলেন, তুমি মুনিতে প্রধান।
নাহি কেহ ক্ষত্রেতে সম্বরণ সমান।।
তপতী সমান কন্যা নাহিক তুলনা।
তিন স্থানে শ্রেষ্ঠ যে তোমরা তিনজনা।।
তোমার বচন আমি না করিব আন।
তপতী কন্যারে দিব সম্বরণে দান।।
এত বলি কন্যা লৈয়া কৈল সমর্পণ।
কন্যা লৈয়া মুনিরাজ করিল গমন।।
তপতী দেখিয়া তপ ত্যজি নৃপবর।
বশিষ্ঠকে স্তব করে করি যোড় কর।।
তবে ঋষি দোঁহারে বিবাহ করাইল।
রাজারে রাখিয়া মুনি নিজাশ্রমে গেল।।
বশিষ্ঠের লৈয়া আজ্ঞা সেই মহাবনে।
তপতী লইয়া ক্রীড়া করে সম্বরণে।।
যেই বৃদ্ধমন্ত্রী ছিল রাজার সংহতি।
তাঁরে রাজ্যভার দিয়া পাঠায় নৃপতি।।
বিহার করয়ে রাজা পর্ব্বত উপরে।
তপতী সহিত ক্রীড়া দ্বাদশ বৎসরে।।
হেথায় রাজার রাজ্যে অনাবৃষ্টি হৈল।
দ্বাদশ বৎসর ইন্দ্র বৃষ্টি না করিল।।
বৃক্ষ আদি যত শস্য গেল ভস্ম হৈয়া।
গাভী-অশ্ব-পক্ষী যত মরিল পুড়িয়া।।
দুর্ভিক্ষ হইল রাজ্যে, হয় ডাকা চুরি।
একেরে না মানে অন্যে সত্য পরিহরি।।
কুটুম্ব বান্ধবগণে কেহ নাহি সয়।
সকল মনুষ্যগণ হৈল শবপ্রায়।।
হীনশক্তি স্থানে স্থানে রহিল পড়িয়া।
স্থানে স্থানে অস্থিপুঞ্জ পর্ব্বত জুড়িয়া।।
হাহাকার রব বিনা অন্য নাহি শুনি।
দেশান্তরে গেল লোক পরমাদ গণি।।
রাজ্যের এতেক কষ্ট রাজা নাহি জানে।
আইলেন বশিষ্ঠ সে দেশে কতদিনে।।
রাজ্যভঙ্গ দেখিয়া চিন্তিত মুনিবর।
রাজারে আনিতে যান পর্ব্বত উপর।।
বার্ত্তা পেয়ে অনুতাপ করিল রাজন।
তপতী সহিত দেশে করিল গমন।।
দেশে আসি যজ্ঞ দান করে নৃপবর।
তবে বৃষ্টি করিলেন দেব পুরন্দর।।
পুনঃ শস্য জন্মিল, সানন্দ প্রজাগণ।
পূর্ব্বমত রাজ্য পুনঃ কৈল সম্বরণ।।
তপতী সহিত ক্রীড়া করে চিরকাল।
তপতীর গর্ভে হৈল কুরু মহীপাল।।
কুরুর যতেক কর্ম্ম না যায় লিখন।
কুরুবংশ নাম খ্যাত হৈল সে কারণ।।
পুরোহিত বশিষ্ঠের সাহায্য কারণ।
পাইলেন ধর্ম্ম অর্থ কাম সম্বরণ।।
তপতীর গর্ভজাত কুরু নরবর।
তোমরা যাহার বংশে পঞ্চ সহোদর।।
তাপত্য বলিয়া তাই বলি যে তোমারে।
পূর্ব্ববংশ-কথা এই খ্যাত চরাচরে।।
শুনিয়া হরিষ হৈল পার্থ ধনুর্দ্ধর।
পুনঃ জিজ্ঞাসিল কহ গন্ধর্ব্ব-ঈশ্বর।।
সম্বরণ নৃপে রক্ষা করিলেন যিনি।
কে তিনি, বশিষ্ঠ, কহ তাঁর কথা শুনি।।
গন্ধর্ব্ব বলিল, সে বিখ্যাত তপোধন।
বশিষ্ঠের গুণ কর্ম্ম না যায় কহন।।
কাম ক্রোধ জিনে হেন নাহি ত্রিভুবনে।
হেন কাম ক্রোধ সেবে মুনির চরণে।।
বিশ্বামিত্র বহু তাঁর ক্রোধ না করিল।
ইক্ষবাকু-বংশের রাজা যাঁর বুদ্ধিবলে।
নিষ্কন্টক বৈভব ভুঞ্জিল ভুমণ্ডলে।।
মহাভারতের কথা অমৃতের ধার।
কাশী কহে, শুনি ভববারি হই পার।।