ত্র্যশীতিতম অধ্যায়
যযাতি হইতে যদু প্রভৃতির জন্ম
বৈশম্পায়ন কহিলেন, দেবযানী শর্ম্মিষ্ঠার পুৎত্রৎপত্তি সংবাদ শ্রবণ করিবামাত্র সাতিশয় ক্ষুব্ধ হইয়া নানা প্রকার বিতর্ক করিতে লাগিলেন। অনন্তর শর্ম্মিষ্ঠার সন্নিহিতা হইয়া কহিলেন, “হে সুভ্র,! তুমি কামান্ধ হইয়া এ কি পাপানুষ্ঠান করিলে?” শর্ম্মিষ্ঠা কহিলেন, “হে চারুহাসিনি! একদা কোন ধর্ম্মপরায়ণ ও বেদবেদাঙ্গ পারগ ঋষি আমার কুটীরে আগমন করিয়াছিলেন। আমি ঋতুরক্ষার্থে প্রার্থনা করাতে তিনি আমার মনোবাঞ্ছা পরিপূর্ণ করেন। আমি অন্যায়তঃ কাম-প্রবৃত্তি চরিতার্থ করি নাই। আমি সত্য কহিতেছি, আমার এই সন্তানটি সেই ঋষির ঔরসে জন্মগ্রহণ করিয়াছে।” তখন দেবযানী কহিলেন, “শর্ম্মিষ্ঠে! যদি ধর্ম্ম প্রতিপালনার্থ এই কর্ম্ম করিয়া থাক, তাহা উত্তমই হইয়াছে; কিন্তু যদি সেই ঋষির গোত্র, নাম ও আভিজাত্য জানিতে পারিয়া থাক, তবে বল, শুনিতে আমার নিতান্ত ঔৎসুক্য হইতেছে।” শর্ম্মিষ্ঠা কহিলেন, “সেই ঋষি সূর্যোর ন্যায় তেজস্বী ও তপঃপ্রভাবসম্পন্ন; তাঁহাকে দেখিয়া সে-সকল কথা জিজ্ঞাসা করিতে আমার সাহস হয় নাই।” দেবযানী কহিলেন, “যাহা হউক, যদি তুমি শ্রেষ্ঠজাতির ঔরসে সন্তানলাভ করিয়া থাক, তাহাতে আমার ক্ষোভ বা পরিতাপ নাই।” তাঁহারা পরস্পর এইরূপ হাস্য-পরিহাসপূর্ব্বক কিয়ৎক্ষণ কথোপকথন করিলেন। পরিশেষে দেবযানী এই বৃত্তান্তের প্রতি বিশ্বাস করিয়া স্বীয় আবাসে প্রবিষ্ট হইলেন।
অনন্তর যযাতি দেবযানীর গর্ভে যদু ও তুর্ব্বসু নামে দুই পুৎত্র এবং শর্ম্মিষ্ঠার গর্ভে দ্রুহ্য অনু ও পুরু নামক তিন পুৎত্র উৎপাদন করিলেন। কিয়ৎকাল অতীত হইলে একদা দেবযানী প্রিয়তম সমভিব্যাহারে এক নির্জ্জন বনে গমন করিয়া দেবরূপী তিনটি বালক দেখিতে পাইলেন, তাহারা অসঙ্কুচিতচিত্তে ক্রীড়া করিতেছিল। দেবযানী তাহাদিগের অসামান্য রূপলাবণ্য সন্দর্শনে বিস্মিত হইয়া কহিলেন, “মহারাজ! এই সর্ব্বাঙ্গসুন্দর বালকগুলি কোন্ ভাগ্যবানের পুৎত্র বলা যায় না। ইহারা দেবকুমারতুল্য সুকুমার। ইহাদিগের আকার-প্রকারে আপনারই ঔরসজাত বলিয়া বোধ হইতেছে।” দেবযানী রাজাকে এইরূপ কহিয়া বালকদিগকে সম্বোধন করিয়া জিজ্ঞাসিলেন, “বৎস! তোমরা কোন বংশে উৎপন্ন হইয়াছ কাহার পুৎত্র এবং তোমাদিগের পিতার নাম কি, শুনিতে আমার নিতান্ত বাসনা হইতেছে।” দেবযানী কর্ত্তৃক এইরূপ জিজ্ঞাসিত হইলে বালকেরা তর্জ্জনীসঙ্কেত দ্বারা মহারাজ যযাতিকে পিতা নির্দ্দেশ করিয়া কহিল, “আমাদিগের মাতার নাম শর্ম্মিষ্ঠা।” এই বলিয়া তাহারা হর্ষোৎফুল্ললোচনে নিজ পিতা যযাতির সন্নিহিত হইল; কিন্তু দেবযানীর সমীপে বলিয়া তিনি তাহাদিগকে সমাদর করিতে পারিলেন না। বালকেরা পিতার অনাদরে অভিমান করিয়া রোদন করিতে করিতে জননী-সন্নিধানে গমন করিল। রাজা বালকদিগের কথায় ঈষৎ লজ্জিত হইলেন। দেবযানী রাজার প্রতি বালকদিগের সদ্ভাবসন্দর্শনে সে বিষয়ের মর্ম্মোদ্ঘাটনপূর্ব্বক অনতিবিলম্বে শর্ম্মিষ্ঠার নিকট উপস্থিত হইয়া রোষভরে কহিলেন, “দেখ শর্ম্মিষ্ঠে! তুমি আমার অধীন হইয়া আমারই অপ্রিয়া কার্য্য করিয়াছ, ইহাতে কি তোমার মনে শঙ্কার উদয় হয় নাই?” শর্ম্মিষ্ঠা কহিলেন, “আমি যে ঋষির কথা উল্লেখ করিয়াছিলাম, তাহা মিথ্যা নহে। আমি ন্যায়তঃ ও ধর্ম্মতঃ বলিয়াছি; তোমার নিকট আমার ভয়ের বিষয় কি? আরও, তুমি মহারাজকে পতিত্বে বরণ করিয়াছ, তাহাতে আমারও বরণ করা হইয়াছে, কারণ, সখীর পতি ধর্ম্মতঃ নিজ পতি হইতে পারেন। তুমি ব্রাহ্মণকন্যা, তুমি আমার পূজ্যা ও মান্যা। আর আমি এই রাজর্ষিকে তোমা হইতেও সম্মান ও পূজা করিয়া থাকি, তাহা কি তুমি জান না?” দেবযানী শর্ম্মিষ্ঠার মুখে এই সমস্ত বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, “মহারাজ! তুমি আমার সাতিশয় অপ্রিয় কার্য্য করিয়াছ, অতএব অদ্যাবধি তোমার আলয়ে আর অবস্থান করিব না, এক্ষণে চলিলাম।” এই বলিয়া পিতৃগৃহে প্রস্থান করিতে উদ্যতা হইয়ে রাজা দেবযানীকে বাষ্পাকুলোচনে সহসা শুক্রসন্নিধানে গমন করিতে উদ্যত দেখিয়া ব্যথিত মনে তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হইলেন এবং নানাবিধ প্রবোধবাক্যে তাঁহাকে সান্ত্বনা করিতে লাগিলেন। রোষরক্তলোচনা দেবযানী কিছুতেই ক্ষান্ত হইলেন না। তিনি রাজাকে ভালমন্দ কিছুই না বলিয়া রোদন করিতে করিতে পিতৃসন্নিধানে উপস্থিত হইলেন এবং অভিবাদনপূর্ব্বক তাঁহার সম্মুখে দন্ডায়মান রহিলেন। রাজাও দেবযানীর অনুসরণক্রমে তথায় উপস্থিত হইয়া বিধানানুসারে শুক্রাচার্য্যের পূজাদি করিয়া অতি বিনীতভাবে একান্তে সমাসীন হইলেন। তদন্তর দেবযানী শুক্রকে কহিলেন, “তাত! অধর্ম্ম ধর্ম্মকে পরাজয় করিয়াছে; নিকৃষ্টেরা মহতের সহিত নীচব্যবহারে প্রবৃত্ত হইয়াছে। দেখুন, বৃষপর্ব্বতনয়া শর্ম্মিষ্ঠা আমাকে অতিক্রম করিয়া উঠিয়াছে। রাজা যযাতি তাহার গর্ভে তিনটি পুৎত্র উৎপাদন করিয়াছেন। আমি দুর্ভাগা, আমার দুইটি বৈ পুৎত্র নহে। হে ভৃগুকুলতিলক। এই রাজা পরম ধার্ম্মিক বলিয়া বিখ্যাত আছেন; কিন্তু এক্ষণে এইরূপ গর্হিতাচরণে প্রবৃত্ত হইয়াছেন। হে তাত! আমি সত্য বলিতেছি, সম্প্রতি ইনি শাস্ত্রমর্য্যাদা অতিক্রম করিতে আরম্ভ করিয়াছেন।”
যযাতির প্রতি শুক্রের শাপ
শুক্র এই সমস্ত বৃত্তান্ত অদ্যোপান্ত শ্রবণ করিয়া ক্রোধভরে রাজা যযাতিকে অভিসম্পাত করিলেন, “মহারাজ! তুমি ধার্ম্মিক হইয়া প্রিয়বোধে অধর্ম্মাচরণ করিয়াছ, অতএব দুর্জ্জয় জরা অচিরাৎ তোমাকে শুক্রকে কহিলেন, “ভগবান্! শর্ম্মিষ্ঠা ঋতুরক্ষার্থে প্রার্থনা করিয়াছিল, আমি ধর্ম্মসংস্থাপনের নিমিত্ত সেই কর্ম্ম অনুষ্ঠান করিয়াছিলাম, নিকৃষ্ট প্রবৃত্তি চরিতার্থ করিবার জন্য করি নাই। ধর্ম্মশাস্ত্রে কথিত আছে, যে পুরুষ ঋতুরক্ষার্থিনী স্ত্রীলোক কর্ত্তৃক প্রার্থিত হইয়া তদীয় ঋতুরক্ষা না করে, সে ভ্রূণহত্যাপাতকে লিপ্ত হইয়া নিরয়গামী হয়। এই সমস্ত পর্য্যালোচনা করিয়া ধর্ম্মলোপের আশঙ্কায় আমি শর্ম্মিষ্ঠার বাসনা সফল করিয়াছিলাম, শুক্র কহিলেন, “মহারাজ! আমি তোমাকে যে কর্ম্ম করিতে প্রতিষেধ করিয়াছিলাম, তাহা তুমি কেন করিলে? তুমি জান, মিথ্যাবাদী ব্যক্তির ধর্ম্মাচরণকেও একপ্রকার চৌর্য্য বলিলে বলা যাইতে পারে।”
যযাতি শুক্র কর্ত্তৃক এইরূপে অভিশপ্ত হইয়া তৎক্ষণাৎ জরাক্রান্ত হইলেন। পরে তিনি শুক্রকে কহিলেন, “ভগবান্! আমি অদ্যাপি যৌবনসুখ অনুভব করিয়া পরিতৃপ্ত হই নাই, অতএব প্রসন্ন হইয়া যাহাতে জরা হইতে মুক্ত হইতে পারি, এরূপ কোন উপায় অবধারণ করিয়া দিন।” শুক্র কহিলেন, “মহারাজ! আমার শাপ অন্যথা হইবার নহে। তবে এইমাত্র হইতে পারে, তুমি ইচ্ছা করিলে অন্যের শরীরে স্বকীয় জরা সঞ্চারিত করিতে পারিবে।” তখন রাজা কহিলেন, “হে ব্রহ্মন্! এক্ষণে এই অনুমতি করুন যে আমার পঞ্চপুৎত্রের মধ্যে যে পুৎত্র মদীয় জরা গ্রহণ করিয়া আমাকে যৌবন প্রদান করিবে, সে রাজ্যাধিকার, পুণ্যাধিকার ও কীর্ত্তি লাভ করিবে।” শুক্র কহিলেন, “হে নহুষতনয়! তুমি আমাকে স্মরণ করিয়া অন্যের শরীরে জরা সঞ্চারিত করিতে পারিবে এবং তাহাতে তুমি পাপভাগী হইবে না। আর তোমার যে পুৎত্র জরা গ্রহণ করিয়া তোমাকে যৌবন প্রদান করিবে, সে ত্বদীয় সাম্রাজ্য অধিকারপূর্ব্বক আয়ুষ্মান্, কীর্ত্তিমান্ ও পুৎত্রপৌৎত্রাদিমান্ হইবে।”