এইমত রহে সৈন্য যুড়ি বনস্থল।
গতায়াতে লণ্ডভণ্ড উদ্যান সকল।।
হেনকালে দেখ তথা দৈবের ঘটনে।
গন্ধর্ব্ব উদ্যান এক ছিল সেই বনে।।
চিত্রসেন নাম তাঁর গন্ধর্ব্ব-প্রধান।
যাঁর নামে সুরাসুর হয় কম্পমান।।
তাঁহার কিঙ্কর ছিল বনের রক্ষক।
দেখিল, উদ্যান ভাঙ্গে রাজার কটক।।
বহু সৈন্য দেখি একা না করি বিরোধ।
দুর্য্যোধন অগ্রে গিয়া কহিছে সক্রোধ।।
শুন রাজা মোর বাক্য কর অবগতি।
প্রভু মোর চিত্রসেন, গন্ধর্ব্বের পতি।।
কুসুম উদ্যান তাঁর এই বনে ছিল।
প্রবেশি তোমার সৈন্য সকলি ভাঙ্গিল।।
বনের রক্ষক আমি, কিঙ্কর তাঁহার।
না করিলে ভাল কর্ম্ম, কি কহিব আর।।
এই কথা, মোর মুখে পাইলে সম্বাদ।
আসিয়া ইঙ্গিতে রাজা করিবে প্রমাদ।।
এত শুনি মহাক্রোধে কহে বীর কর্ণ।
বিকচ কমল প্রায় চক্ষু রক্তবর্ণ।।
ওরে দুষ্ট এত কর কার অহঙ্কার।
কি ছার গন্ধর্ব্ব তোর, কিবা গর্ব্ব তার।।
যে কথা কহিলি তুই আসি মম কাছে।
এতক্ষণ জীয়ে রহে, হেন কেবা আছে।।
সহজে অত্যল্প বুদ্ধি দ্বিতীয়ে নফর।
যাহ শীঘ্র আন গিয়া আপন ঈশ্বর।।
বলাবল বুঝি লব সংগ্রামের কালে।
কর্ণের বিক্রম সেই জানে ভালে ভালে।।
এত বলি ঢেকা মারি বাহির করিল।
মহাদুঃখ মনে রক্ষী কান্দিয়া চলিল।।
বসি আছে চিত্রসেন আপন আবাসে।
হেনকালে অনুচর কহে মৃদুভাষে।।
রক্ষা হেতু তুমি মোরে রাখিলে উদ্যানে।
দুর্য্যোধন রাজা আসে প্রভাসের স্নানে।।
তার সৈন্য উদ্যান করিল লণ্ডভণ্ড।
রাজারে কহিনু গিয়া তার এই কাণ্ড।।
কতেক কুৎসিত ভাষা কহিল তোমারে।
দুর্য্যোধন-সেনাপতি কর্ণ নাম ধরে।।
মনুষ্য হইয়া করে এত অহঙ্কার।
দোষমত দণ্ড যদি না দিবা তাহার।।
এইমত দুষ্টাচার করিবেক সবে।
লঘু গুরু মনুষ্য দেবেতে কিবা তবে।।
এত শুনি মহাক্রোধে উঠিল গন্ধর্ব্ব।
কি ছার মনুষ্য, আজি নাশিব যে গর্ব্ব।।
মরণকালেতে পিপীলিকা পাখা উঠে।
যাইতে করিল বাঞ্ছা শমন নিকটে।।
ক্রোধভরে রথারোহে চলে শীঘ্রগতি।
ধনুক টঙ্কার শুনি কম্পমান ক্ষিতি।।
দিব্য সুশাণিত শরে পূরি যুগ্ম তূণ।
ক্রোধভরে আসিতেছে জ্বলন্ত আগুন।।
কত দূরে দেখে সবে রথের পতাকা।
শূন্যপথে আসে যেন জ্বলন্ত উলকা।।
কুরুসৈন্য নিকটে আইল সেইক্ষণে।
কহিতে লাগিল অতি গভীর গর্জ্জনে।।
আরে দুষ্ট ত্যজ আজি জীবনের সাধ।
মনুষ্য হইয়া কর গন্ধর্ব্বে বিবাদ।।
এতেক বলিয়া দিল ধনুকে টঙ্কার।
মুহূর্ত্তেকে শরজালে কৈল অন্ধকার।।
শুনিয়া গন্ধর্ব্ব গর্ব্ব কর্ণে হৈল ক্রোধ।
টঙ্কারিয়া ধনুর্গুণ ধায় মহাযোধ।।
সূর্য্য-অস্ত্র এড়িলেন সূর্য্যের নন্দন।
হাসি চিত্রসেন অস্ত্র কৈল নিবারণ।।
তবে ত গন্ধর্ব্ব এড়ে তীক্ষ্ণ পাঁচ বাণ।
অর্দ্ধপথে কর্ণবাণে হৈল দশখান।।
গন্ধর্ব্ব দেখিল, অস্ত্র কাটিলেক কর্ণ।
ক্রোধে কম্পমান তনু, চক্ষু রক্তবর্ণ।।
সিংহমুখ দিব্য অস্ত্র যুড়িল ধনুকে।
অস্ত্রে অগ্নি বাহিরায় ঝলকে ঝলকে।।
মহাবীর কর্ণ তবে অপূর্ব্ব সন্ধানে।
কাটিল গন্ধর্ব্ব অস্ত্র, অর্দ্ধচন্দ্র বাণে।।
সর্পবাণ যুড়িল যে গন্ধর্ব্ব তখন।
যুড়িল গরুড়বাণ সূর্য্যের নন্দন।।
তবে কর্ণ দিব্য ভল্ল মন্ত্রে অভিষেকি।
সগর্ব্বে কহিল কর্ণ চিত্রসেনে ডাকি।।
আরে দুষ্ট অহঙ্কারে না দেখ নয়নে।
গর্ব্ব চূর্ণ হবে আজি পড়ি মোর বাণে।।
আকর্ণ পূরিয়া কর্ণ কৈল নিক্ষেপণ।
উঠিয়া আকাশ পথে করিল গর্জ্জন।।
অস্ত্র দেখি ব্যস্ত হয়ে গন্ধর্ব্ব-ঈশ্বর।
শীঘ্রহস্তে এড়ে বীর চোক চোক শর।।
দুই অস্ত্রে মহাযুদ্ধ হইল অম্বরে।
কাটিল দোঁহার অস্ত্র দোঁহাকার শরে।।
অস্ত্র ব্যর্থ দেখি কর্ণ সক্রোধ অন্তর।
চিত্রসেনে প্রহারিল শতেক তোমার।।
বাণাঘাতে ব্যগ্র হয়ে গন্ধর্ব্বের পতি।
ডাকিয়া বলিল তবে কর্ণ বীর প্রতি।।
ধন্য তোর বীরপণা, ধন্য তোর শিক্ষা।
এখন বুঝহ তুমি আমার পরীক্ষা।।
এতেক বলিয়া প্রহারিল দশ বাণ।
ব্যথায় ব্যথিত কর্ণ হইল অজ্ঞান।।
কতক্ষণে চেতন পাইলা মহাবল।
বেড়িল গন্ধর্ব্বে আসি কৌরব সকল।।
শতপূর করিয়া বেড়িল সর্ব্ব সেনা।
ধনুক টঙ্কার যেন সঘন ঝন্ঝনা।।
দশদিক যুড়িয়া করিল অন্ধকার।
গন্ধর্ব্ব সবার অস্ত্র করিল সংহার।।
প্রাণপণে সবে যুদ্ধ করিল বিস্তর।
সবে নিবারণ করে গন্ধর্ব্ব-ঈশ্বর।।
পরশুরামের শিষ্য কর্ণ মহাবীর।
অচল পর্ব্বত প্রায় যুদ্ধে রহে স্থির।।
রাখিয়া আপন সেনা আপন বিক্রমে।
প্রহরেক পর্য্যন্ত যুঝিল মহাশ্রমে।।
তবে ত গন্ধর্ব্ব মনে করিল বিচার।
জানিল কৌরব সেনা রণে অনিবার।।
মায়া বিনা এ সকল নারিব জিনিতে।
মায়ার পুত্তলী এই বিচারিল চিতে।।
রথ লুকাইল তবে না দেখি যে আর।
অর্ন্তদ্ধান করি কৈল বাণে অন্ধকার।।
অন্তরীক্ষে পড়ে বাণ, দেখে সর্ব্বজনে।
অচ্ছিদ্রে বরিষে যেন ধারার শ্রাবণে।।
কোথায় গন্ধর্ব্ব আছে, কেহ নাহি দেখে।
বৃষ্টিবৎ অস্ত্র সব পড়ে লাখে লাখে।।
মুখে মাত্র মার মার শুনি সবাকর।
সৈন্যেতে অক্ষত জন না রহিল আর।।
পড়িল অনেক সৈন্য, রক্তে বহে নদী।
হয় হাতী রথ রথী কে করে অবধি।।
কতক্ষণ রণ সহি ছিল কর্ণ বীর।
তাহার সহিত কিছু সৈন্য ছিল স্থির।।
শূন্য তূণ, ছিন্ন গুণ, অঙ্গে শ্রমজল।
বিষণ্ণ বদন সবে হইল বিকল।।
সহিতে না পারি ভঙ্গ দিল কর্ণবীর।
পলায় কৌরবসেনা ভয়েতে অস্থির।।
অম্বর নাহিক কার, নাহি বান্ধে কেশ।
পলায় সকল সৈন্য, পাগলের বেশ।।
বেগে ধায়, পশ্চাৎ না চায়, কোন জন।
স্ত্রীগণ রক্ষকমাত্র রাজা দুর্য্যোধন।।
কতক্ষণ সহে যুদ্ধ, প্রাণ ব্যগ্রতায়।
হেনকালে চিত্রসেন আইল তথায়।।
দুর্য্যোধনে ডাকি বলে পরিহাস বাণী।
গগনে গরজে যেন ঘোর কাদম্বিনী।।
আরে মন্দমতি দুষ্ট রাজা দুর্য্যোধন।
মনুষ্য হইয়া কর গন্ধর্ব্ব চালন।।
কোথা তোর সে বন্ধু সহায় সমুদিত।
একেলা রহিলি নারীগণের সহিত।।
এই অহঙ্কারে তুমি না দেখ নয়নে।
আজিকার রণে যাবি শমন সদনে।।
মহাভারতের কথা পুণ্য গীতিগান।
ভবসিন্ধু তরিতে নাহি ইহার সমান।।