অজ্ঞাতে ব্রাহ্মণ-গৃহে পাণ্ডুপুত্রগণ।
নগরে ভ্রমেন নিত্য ভিক্ষার কারণ।।
ভিক্ষা করি আসি সবে দিবা অবসানে।
যে কিছু পায়েন দেন জননীর স্থানে।।
জননী করেন পাক দেন সবাকারে।
অর্দ্ধেক বাটিয়া দেন বীর বৃকোদরে।।
মাহাসহ অর্দ্ধ খান চারি সহোদর।
তথাপিও তৃপ্ত নহে বীর বৃকোদর।
হেনমতে বিপ্রগৃহে বঞ্চে অতিক্লেশে।
ভিক্ষা করে অনুদিন ব্রাহ্মণের বেশে।।
একদিন গৃহেতে রহিল বৃকোদর।
ভিক্ষাতে গেলেন আর চারি সহোদর।।
আচম্বিতে বিপ্রগৃহে মহাশব্দ শুনি।
বিলাপ করিয়া কান্দে ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণী।।
করুণ হৃদয়া কুন্তী সহিতে নারিয়া।
কহেন নিকটে বৃকোদরেরে ডাকিয়া।।
এতদিন বিপ্রগৃহে আছি যে অজ্ঞাতে।
পরম সাহায্য বিপ্র করিল বিপত্তে।।
এখন বিপদগ্রস্থ হইল ব্রাহ্মণ।
অবশ্য বিপদে তারে করহ রক্ষণ।।
উপকারী জনে যে সাহায্য নাহি করে।
পরলোক পাপ হয় অযশ সংসারে।।
ভীম বলিলেন, মাতা জিজ্ঞাস ব্রাহ্মণে।
শক্তি-অনুসারে রক্ষা করিব তৎক্ষণে।।
ভীমের আশ্বাস পেয়ে যান কুন্তীদেবী।
বৎসের বন্ধনে যেন ধায় ত সুরভি।।
ব্রাহ্মণের ঘরে কুন্তী করেন গমন।
দেখেন ব্যাকুল হৈয়া কাঁদিছে ব্রাহ্মণ।।
ব্রাহ্মণ কাতর হৈয়া বলে ব্রাহ্মণীরে।
এই হেতু পূর্ব্বে কত বলিনু তোমারে।।
রাক্ষসের উপদ্রব যেই দেশে হয়।
সে দেশে বসতি কভু উপযুক্ত নয়।।
পিতা-মাতা-স্নেহে তুমি লঙ্ঘিলা বচন।
তাহার উচিত দুঃখ পাইলা এখন।।
কি করিব উপায় না দেখি যে ইহার।
কোন্ বুদ্ধি করিব না দেখি প্রতিকার।।
তুমি ধর্ম্মপত্নী হও আমার গৃহিণী।
সর্ব্ব ধর্ম্ম-বিশারদা সুখ-প্রদায়িণী।।
বিশেষ বালক পুত্র আছে যে তোমার।
তোমা বিনা মুহূর্ত্তেক না জীবে কুমার।।
অরণ্যের প্রায় দুঃখ হবে তোমা বিনে।
জীয়ন্তে হইবে মরা তোমার মরণে।।
আপনা রাখিয়া তোমা দিব রাক্ষসেরে।
অপযশ হবে আমা সংসার ভিতরে।।
অপূর্ব্ব সুন্দরী এই কন্যা সুবদনী।
কন্যারে রাক্ষসে দিলে কুযশ কাহিনী।।
কন্যা-জন্ম হৈলে পিতৃলোকে করে আশ।
দান কৈলে চিরকাল হয় স্বর্গবাস।।
ইহা লৈয়া দিব আমি রাক্ষস-ভক্ষণে।
ধিক্ ধিক্ তবে মোর কি কাজ জীবনে।।
আপনি যাইব আমি রাক্ষসের স্থানে।
এত বলি কান্দে দ্বিজ সজল নয়নে।।
ব্রাহ্মণী বলেন, প্রভু কেন দুঃখ ভাব।
তোমরা থাকহ সুখে, আমি তথা যাব।।
তুমি যদি যাও তথা, একে হবে আর।
একেবারে মরিবে সকল পরিবার।।
আমি সহমৃতা হব তোমার মরণে।
অনাথ হইবে কন্যা পুত্র দুই জনে।।
তবে কদাচিৎ যদি রাখিব জীবন।
কি শক্তি আমার শিশু করিতে পালন।।
তোমা বিনা অনাথ হইব তিন জনে।
অনাথের বহু কষ্ট হবে দিনে দিনে।।
দরিদ্র দেখিয়া তবে অকুলীন জন।
এই কন্যা বরিবেক দিয়া কিছু ধন।।
অল্পকালে এই পুত্র হইবে ভিক্ষুক।
কুলধর্ম্ম আর বেদে হইবে বিমুখ।।
বলিষ্ঠ দুর্ম্মুখ লোক কামে মুগ্ধ হৈয়া।
মোরে আকর্ষিবে চিত্তে অনাথা দেখিয়া।।
বিবিধ দুর্গতি হবে তোমার বিহনে।
অনুচিত তোমার যাইতে সে কারণে।।
অপত্য নিমিত্ত তুমি করিলা সংসার।
কন্যা পুত্র দুইগুটি হৈয়াছে তোমার।।
কন্যা দান কর আর পড়াহ বালকে।
পুনর্ব্বার বিবাহ করিয়া থাক সুখে।।
আমা বিনা গৃহস্থলী হবে আরবার।
তোমার বিহনে সর্ব্ব হবে ছারখার।।
ভার্য্যার পরম ধর্ম্ম স্বামীর সেবন।
স্বামী বিনা অকারণ নারীর জীবন।।
সঙ্কটে তারয়ে স্বামী দিয়া আপনাকে।
ভুঞ্জয়ে অক্ষয় স্বর্গ, যশ ইহলোকে।।
তপ জপ যজ্ঞ ব্রত নানাবিধ দান।
স্বামীর প্রসাদে হয় সর্ব্বত্র সম্মান।।
সর্ব্বধর্ম্ম আছে ইথে শাস্ত্রের বিহিত।
রাক্ষসের ঠাঁই আমি যাইব নিশ্চিত।।
ব্রাহ্মণী এতেক যদি বলিল উত্তর।
গলে ধরি উচ্চৈঃস্বরে কান্দে দ্বিজবর।।
স্বামীর ক্রন্দন দেখি কান্দয়ে ব্রাহ্মণী।
মা বাপের দশা দেখি কন্যা বলে বাণী।।
অনাথের প্রায় দোঁহে কান্দ কি কারণ।
ক্রন্দন সম্বর, শুন মোর নিবেদন।।
রাক্ষসের ঠাঁই যদি জননী যাইবে।
জননী-বিচ্ছেদে এই বালক মরিবে।।
পিণ্ডস্থান যাবে আর হবে কুলক্ষয়।
সে কারণে মাতার যাইতে বিধি নয়।।
জন্ম হৈলে কন্যারে অবশ্য ত্যাগ করে।
বিধির সৃজন ইহা খণ্ডিতে কে পারে।।
দৈবেতে আমারে পিতা অন্যে দিবে দান।
এক্ষণে রাক্ষসে দিয়া দোঁহে পাও ত্রাণ।।
আমা হেন কত হবে তোমরা থাকিলে।
সে কারণে মোরে দিয়া বঞ্চ কুতূহলে।।
হইলে আমার পুত্র তারিবে পশ্চাতে।
সম্প্রতি তারিয়া আমি যাইব নিশ্চিতে।।
এতেক শুনিয়া কান্দে ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণী।
তিনজনে গলাগলি কান্দে উচ্চধ্বনি।।
এমন শুনিয়া পুত্র তিনের ক্রন্দন।
মুখে হস্ত দিয়া করে সবারে বারণ।।
হাতে এক তৃণ লৈয়া বলে সেই শিশু।
রাক্ষসের ভয় তোরা না করিস্ কিছু।।
রাক্ষসে মারিব এই তৃণের প্রহারে।
কোথা আছে দেখাইয়া দেহ, দেখি তারে।।
বালকেরবচন শুনিয়া তিনজন।
হাসিতে লাগিল তারা ত্যজিয়া ক্রন্দন।।
ক্রন্দন নিবৃত্ত দেখি ভোজের নন্দিনী।
বলেন ব্রাহ্মণ প্রতি সকরুণ বাণী।।
মৃতের উপরে যেন সুধা বরিষণে।
জিজ্ঞাসেন কুন্তীদেবী মধুর বচনে।।
কি কারণে ক্রন্দন করহ তিনজন।
জানিলে, হইলে সাধ্য করিব মোচন।।
দ্বিজ বলে, যেই হেতু করি যে ক্রন্দন।
মনুষ্যের শক্তি নাহি করিতে মোচন।।
এই ত নগরে আছে বক নিশাচর।
অত্যন্ত দুরন্ত সেই রাজ্যের ঈশ্বর।।
যক্ষ রক্ষ প্রেত ভূত পরচক্র-ভয়।
তার ভুজবলে ইথে নাহিক সংশয়।।
নগরের মধ্যে এই আছে যত নর।
রাক্ষসের নির্ণয় করিল এই কর।।
পায়স পিষ্টক অন্ন শকটে পূরিয়া।
এক নর আর দুই মহিষ ধরিয়া।।
এই কার্য্য বিনা অন্য নাহিক তাহার।
বহুকালে মম প্রতি হয়েছে করার।।
এইরূপে বলি নাহি দেয় যেইজন।
সকুটুম্ব সহ তারে করয়ে ভক্ষণ।।
আজি তার পালা পড়িয়াছে মম ঘরে।
কি করিব কি হইবে বুদ্ধি নাহি সরে।।
এই ভার্য্যা কন্যা পুত্র আছি চারিজনা।
কারে দিব বলিদান, করি এ ভাবনা।।
মনুষ্য কিনিয়া দিব নাহি হেন ধন।
সুহৃদ কুটুম্ব দিতে নাহি লয় মন।।
কারো মায়া তেয়াগিতে নারে কোন জনে।
সবে মিলি যাব কর্ম্মে যা থাকে লিখনে।।
ব্রাহ্মণের এতেক কাতর বাক্য শুনি।
সদয় হৃদয়ে বলে ভোজের নন্দিনী।।
ভয় ত্যজ দ্বিজবর না কর ক্রন্দন।
সকুটুম্বে যাবে কেন রাক্ষস-সদন।।
পঞ্চ পুত্র আছে মম শুন হে ব্রাহ্মণ।
এক পুত্র দিব আমি তোমার কারণ।।
ব্রাহ্মণ বলিল, ভাল করিলা বিচার।
অতিথি ব্রাহ্মণ আছ আশ্রমে আমার।।
আপনার প্রাণ হেতু করিব এ কর্ম্ম।
লোকে অসম্ভব হবে মজিবেক ধর্ম্ম।।
আত্মা দিয়া দ্বিজ রাখে, বেদে শাস্ত্রে কয়।
দ্বিজ দিয়া আত্মরক্ষা উচিত না হয়।।
অজ্ঞানে ব্রাহ্মণ বধে নাহি প্রতিকার।
জ্ঞানেতে করিব হেন কর্ম্ম দুরাচার।।
কুন্তী বলিলেন, যে কহিলা দ্বিজমণি।
মম অগোচর নহে, সব আমি জানি।।
লোকের বেদনা মম না সহে পরাণে।
বিশেষ ব্রাহ্মণ-দুঃখ সহিব কেমনে।।
দ্বিজ বলে হেন বাক্য না বলিহ মোরে।
এ পাপ ভুঞ্জিব আমি যুগ যুগান্তরে।।
নিঃশব্দে বলেন কুন্তী, শুন দ্বিজবর।
আমার তনয়গণ মহা-বলধর।।
রাক্ষসে খাইবে হেন না করিহ মনে।
রাক্ষস সংহার কৈল মম বিদ্যমানে।।
বেদবিদ্যা বুদ্ধিবলে মম পুত্রগণ।
পৃথিবীতে নাহিক জিনিতে কোন জন।।
শতপুত্র থাকিলে কি পুত্রে অনাদর।
ভয় ত্যজি অন্য বলি করহ সত্বর।।
কুন্তীর অদ্ভুত বাক্য শুনিয়া তখন।
মৃতদেহে দ্বিজ যেন পাইল জীবন।।
দ্বিজ সঙ্গে করি কুন্তী করিয়া গমন।
ভীমেরে জানাইলেন সব বিবরণ।।
মায়ের বচনে ভীম করেন স্বীকার।
হরিষে ব্রাহ্মণ গেল গৃহে আপনার।।
কতক্ষণে আইলেন ভাই চারিজন।
যুধিষ্ঠির শুনিলেন সব বিবরণ।।
একান্তে ধর্ম্মের সুত ডাকিয়া মায়েরে।
জিজ্ঞাসা করেন, ভীম গেল কোথাকারে।।
তোমার সম্মতি কিবা আপন ইচ্ছায়।
কাহার বুদ্ধিতে হেন করিলা উপায়।।
কুন্তী বলে, আমার বচনে বৃকোদর।
বিপ্রের কারণে আর রাখিতে নগর।।
ধর্ম্ম কীর্ত্তি আছে ইথে নাহি অপযশ।
বিশেষ ব্রাহ্মণ-রক্ষা পরম পৌরুষ।।
এত শুনি যুধিষ্ঠির কহেন বিরস।
কি বুদ্ধিতে মাতা হেন করিলা সাহস।।
এমন দুষ্কর নাহি শুনি ইহলোকে।
মাতা হৈয়া পুত্রে দেয় রাক্ষসের মুখে।।
পুত্রের ভিতরে পুত্র কব কি বিশেষে।
সবে প্রাণ রাখিয়াছি তাহার আশ্বাসে।।
ভিক্ষা মাগি প্রাণ রাখি, যথা তথা বাস।
পুনঃ রাজ্য পাব বলি যার বলে আশ।।
যার ভুজবলে নিদ্রা না যায় কৌরবে।
যার তেজে জতুগৃহে রক্ষা পাই সবে।।
স্কন্ধে করি নিল সবা হিড়িম্বক-বনে।
হিড়িম্বে মারিয়া কৈল সবার রক্ষণে।।
হেন পুত্র দিলা তুমি রাক্ষস-ভক্ষণে।
আমরা বাঁচিব আর কিসের কারণে।।
গর্ভধারী হয়ে ইহা কেহ নাহি করে।
বেদেতে নাহিক, নাহি সংসার ভিতরে।।
রাজার দুহিতা তুমি রাজার মহিষী।
দুঃখ পেয়ে হতবুদ্ধি, হৈলা বনবাসী।।
কুন্তী বলেষ যুধিষ্ঠির না ভাবিহ তাপ।
মম অগোচর নহে ভীমের প্রতাপ।।
অযুত হস্তীর বল ধরে কলেবরে।
ভীমে পরাজয় করে নাহিক সংসারে।।
জন্মকালে পরাক্রম শুনহ তাহার।
প্রসবিয়া নিতে শক্তি নহিল আমার।।
কিছুমাত্র তুলি পুনঃ ফেলাইনু তলে।
গিরিশৃঙ্গ চূর্ণ হৈল ভীমের আস্ফালে।।
বারণাবতেতে তুমি দেখিলা নয়নে।
চারি হস্তী তুল্য যে তোমরা চারিজনে।।
আমা সহ সবারে লইল স্কন্ধে করি।
হিড়িম্বা লইল বলে হিড়িম্বে সংহারি।।
ভীম-পরাক্রম পুত্র আমি জানি ভালে।
রাক্ষস-সংহার হবে ভীম-ভুজ-বলে।।
উপস্থিত ভয়ে ত্রাণ করে যেই জন।
তাহা সম পুণ্য বাপু না করি গণন।।
বিশেষ গো-বিপ্র হেতু দিবে নিজ প্রাণ।
আপনাকে দিয়া দ্বিজে করিবেক ত্রাণ।।
রাজ্য রক্ষা দ্বিজ রক্ষা আর যে পৌরুষ।
হেন কর্ম্মে কেন তুমি হইলা বিরস।।
মায়ের এতেক নীতি শুনিয়া বচন।
ধন্য ধন্য বলিলেন ধর্ম্মের নন্দন।।
পরদুঃখে দুঃখী তুমি দয়ালু হৃদয়।
তোমা বিনা হেন বুদ্ধি অন্যের কি হয়।।
পর-পুত্র প্রাণ হেতু নিজ পুত্র দিলা।
ব্রাহ্মণের এ সঙ্কটে রক্ষণ করিলা।।
তোমার পুণ্যেতে দ্বিজ তরিবে বিপদে।
রাক্ষস মারিবে ভীম তোমার প্রসাদে।।
আর এক কথা মাতা কহ দ্বিজবরে।
এ সব প্রচার যেন না হয় নগরে।।
তবে কুন্তী কহিলেন তথ্য সে ব্রাহ্মণে।
বলি ভোজ্য করি দ্বিজ দিল ততক্ষণে।।
নিশাকালে বৃকোদর শকটে চড়িয়া।
যথা বসে বনে বক উত্তরিল গিয়া।।
রে রে বক নিশাচর আইস সত্বর।
এত বলি অন্ন খান বীর বৃকোদর।।
নাম ধরি ডাকাতে ক্রোধেতে থর থর।
বক বীর আসে যেন পর্ব্বত-শিখর।।
মহাকায় মহাবেশ মহা-ভয়ঙ্করে।
চলিতে বিদরে ক্ষিতি চরণেতে ভরে।।
অন্ন খান বৃকোদর, দেখি বিদ্যমান।
ক্রোধে দুই চক্ষু যেন অরুণ-সমান।।
ডাক দিয়া বলে বক অরে দুষ্টমতি।
মনুষ্য হইয়া কেন করিস্ অনীতি।।
সকুটুম্ব ব্রাহ্মণে খাইব তোর দোষে।
এত বলি নিশাচর ধায় অতি রোষে।।
রাক্ষসের বাক্য ভীম না শুনিয়া কাণে।
পৃষ্ঠ দিয়া তারে অন্ন পূরেন বদনে।।
দেখি ক্রোধে নিশাচর করয়ে গর্জ্জন।
ঊর্দ্ধ বাহু করি ধায়অতি ক্রোধ মন।।
দুই হাতে বজ্রমুষ্টি পৃষ্ঠেতে প্রহারে।
তথাপি ভ্রূক্ষেপ নাহি বীর বৃকোদরে।।
পৃষ্ঠে যে রাক্ষস মারে, সহেন হেলায়।
পায়সান্ন খায় বীর সহি নিঃশঙ্কায়।।
দেখিয়া অধিক ক্রোধ হইল নিশাচরে।
বৃক্ষ উপাড়িয়া হানে ভীমের উপরে।।
তথাপিহ অন্না খান হাসি বৃকোদর।
বামহাতে কাড়িয়া নিলেন তরুবর।।
পুনঃ মহাবৃক্ষ উপাড়িল নিশাচর।
গর্জ্জিয়া মারিল বৃক্ষ ভীমের উপর।।
ভোজনান্তে বৃকোদর করি আচমন।
বৃক্ষ উপাড়িলেন যে ঘোর দরশন।।
বৃক্ষে বৃক্ষে যুদ্ধ হৈল না যায় কথনে।
উৎসন্ন হইল বৃক্ষ না রহিল বনে।।
শিলাবৃষ্টি করে দোঁহে দোঁহার উপর।
বাহু-বাহু যুদ্ধ হৈল দেখি ভয়ঙ্কর।।
মুণ্ডে, মুণ্ডে, বুকে বুকে, ভুজে ভুজে তাড়ি।
জড়াজড়ি করি দোঁহে যায় গড়াগড়ি।।
যুদ্ধেতে হইল শ্রান্ত বক নিশাচর।
রাক্ষসে ধরিল বীর কুন্তীর কোঙর।।
বাম হস্তে দুই জানু, ডান হস্তে শির।
বুকে জানু দিয়া টানিলেন ভীমবীর।।
মধ্যে মধ্যে ভাঙ্গিয়া করেন দুইখান।
মহাশব্দ করি বক ত্যজিল পরাণ।।
আর যত আছিল বকের অনুচর।
ভয়ে পলাইয়া সবে গেল বনান্তর।।
নগর নিকটে ভীম বকে ফেলাইয়া।
মাতৃ-ভ্রাতৃ-স্থানে সব কহিলেন গিয়া।।
হরষিতা কুন্তীদেবী ডাকি যুধিষ্ঠিরে।
আলিঙ্গিয়া প্রশংসা করেন বৃকোদরে।।
রজনী প্রভাত হৈল, উদয় অরুণ।
বাহির হইল যত নগরের জন।।
দেখিয়া সকল লোক হৈল চমৎকার।
পড়িয়াছে বক যেন পর্ব্বত-আকার।।
কেহ বলে, এ কর্ম্ম করিল কোন্ জন।
কেহ বলে, নিষ্কণ্টক হৈল সর্ব্বজন।।
পরম দুরন্ত বক সদা হিংসা করে।
আপনার পাপে দুষ্ট এত দিনে মরে।।
তবে সবে বিচারিয়া নগরের জন।
তদন্ত করহ বকে কে কৈল নিধন।।
কালিকার ভোজ্য যার আছিল পঞ্চক।
সেই বলিবারে পারে বকের অন্তক।।
ব্রাহ্মণের ঘরে বলি জানিল নির্ণীত।
সবে মিলি ব্রাহ্মণেরে ডাকিল ত্বরিত।।
জিজ্ঞাসিল ব্রাহ্মণেরে সব বিবরণ।
ব্রাহ্মণ বলিল, শুনি ইহার কারণ।।
কালিকার দিনে পালা ছিল মম ঘরে।
আমাকে শোকার্ত্ত দেখি এক দ্বিজবরে।।
সদয় হইয়া দিল আমারে অভয়।
বলি লৈয়া বক-স্থানে গেল মহাশয়।।
সেই দ্বিজবর বকে করিল সংহার।
এইত রাজ্যের দ্বিজ করিল নিস্তার।।
এত শুনি মহাহৃষ্ট হৈল সর্ব্বজন।
ব্রাহ্মণের মহাপূজা করিল তখন।।
আনন্দে ব্রাহ্মণ এল আপনার ঘরে।
দেবতুল্য দ্বিজবর পূজে পাণ্ডবেরে।।