০৮২. তীৰ্থফলবিবরণ

৮২তম অধ্যায়

তীৰ্থফলবিবরণ

“পুলস্ত্য কহিলেন, “হে ধর্ম্মজ্ঞ! আমি তোমার প্রশ্রয়, দাম ও সত্যসন্দর্শনে পরম পরিতুষ্ট হইয়াছি। তুমি পিতৃভক্তিপরায়ণ হইয়া ঈদৃশ ধর্ম্ম অবলম্বন করিয়াছ বলিয়াই আমার দর্শন পাইলে। হে পুত্র! আমি তোমার প্রতি প্ৰসন্ন হইয়াছি; আমার দর্শন কখন ব্যর্থ হইবার নহে; অতএব বল, তোমার কি করিতে হইবে? তুমি যাহা চাহিবে, আমি অবশ্যই তাহা প্ৰদান করিব।”

“ভীষ্ম কহিলেন, “হে মহাভাগ! আপনি সর্ব্বলোকপূজিত, আপনাকে দর্শন করিয়াই আমি কৃতকৃত্য হইয়াছি। এক্ষণে মহাশয় যদি আমার প্রতি বিশেষ অনুগ্রহ করিতে অভিলাষ করেন, তাহা হইলে কৃপা করিয়া আমার একটি সন্দেহভঞ্জন করুন। তীর্থসমুদয়ে আমার এক ধর্ম্মসংশয় আছে, আমি আপনার নিকট তাহার সবিশেষ বৃত্তান্ত শ্রবণ করিতে বাসনা করি, আপনি অনুগ্রহ করিয়া বর্ণন করুন। হে বিপ্ৰর্ষে! যে ব্যক্তি তীর্থ-দর্শনাভিলাষী হইয়া এই সমুদয় পৃথ্বীমণ্ডল প্ৰদক্ষিণ করে, তাহার কি ফললাভ হয়?”

“পুলস্ত্য কহিলেন, “হে পুত্র! আমি মহর্ষিগণের পরম অবলম্বন তীৰ্থ-গমনের ফল তোমার নিকট কহিতেছি, একমনাঃ হইয়া শ্রবণ কর। যাহার হস্তদ্বয়, পদদ্বয়, মন, বিদ্যা, তপ ও কীর্ত্তি সুসংযত আছে, সেই ব্যক্তি তীর্থফল ভোগ করে। যে ব্যক্তি প্রতিগ্রহপরাঙ্মুখ ও সতত সন্তুষ্ট, যাহার শরীরে অহঙ্কারের লেশমাত্ৰ নাই, সেই ব্যক্তিই তীর্থফল ভোগ করে। যে ব্যক্তি অহঙ্কারাদি-রহিত, উদ্যোগশূন্য, নিরারম্ভ, অল্পাহার, জিতেন্দ্রিয় ও 

র্ব্বপাপবিমুক্ত, সেই ব্যক্তিই তীৰ্থফল ভোগ করে; মহর্ষিসকল দেবগণোদ্দেশে যজ্ঞের অনুষ্ঠান ও তাহার যথার্থ ফল কহিয়া গিয়াছেন। কিন্তু যজ্ঞসমুদয় বহুপকরণসাধ্য; কেবল পার্থিবগণ বা সমৃদ্ধ ব্যক্তিরাই উহার অনুষ্ঠানে সমর্থ হয়; সহায়সম্পত্তিহীন দরিদ্রেরা কখনই উহা সম্পন্ন করিতে পারে না। এক্ষণে দরিদ্রগণও যাহা অনায়াসে সুসম্পন্ন করিতে পারে এবং যাহার অনুষ্ঠান করিয়া যজ্ঞানুষ্ঠানের তুল্য ফললাভ করিতে সমর্থ হয়, ঋষিগণের পরম গুহ্য সেই পবিত্র তীর্থভিগমনের বিষয় সবিশেষ কহিতেছি, শ্রবণ করা। লোকে ত্রিরাত্ৰ উপবাস, তীর্থভিগমন এবং কাঞ্চন ও গোসমুদয় প্রদান না করিয়াই দরিদ্র হয়। অতএব তীর্থভিগমন করা সর্ব্বতোভাবে কর্ত্তব্য। লোকে তীর্থভিগমন করিয়া যে ফললাভ করে, বিপুল দক্ষিণ অগ্নিষ্টোমাদি যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়াও তদ্রূপ ফললাভ করিতে সমর্থ হয় না।

পুষ্করথীর্থের পরম পাবিত্র্যকীর্ত্তন

“হে মহাভাগ! বিধাতৃবিহিত পুষ্করতীৰ্থ সর্ব্বলোকবিশ্রুত। এই ভূমণ্ডলে সমুদয়ে দশ সহস্ৰ কোটি তীর্থ আছে; পুষ্করতীর্থে এই সমুদয় তীর্থেরই সতত সান্নিধ্য আছে। আদিত্য, বসু, রুদ্র, সাধ্য, মরুৎ, অপ্সরা ও গন্ধর্ব্বগণ নিত্য এই তীর্থের সন্নিহিত থাকেন। দেব, দৈত্য ও ব্রহ্মর্ষিগণ ঐ স্থানে তপস্যা করিয়া দিব্যযোগসম্পন্ন ও বিপুলপুণ্যশালী হইয়াছেন। মনস্বী ব্যক্তি মনে মনে পুষ্করগমনের অভিলাষ করিলেও সর্ব্বপাপবিমুক্ত ও সুরলোকে পূজিত হয়েন। সর্ব্বলোকপিতামহ ভগবান কমলযোনি পরমপ্রীতমনে সতত তথায় বাস করেন। পূর্ব্বকালে দেবগণ ও ঋষিগণ ঐ পুষ্করতীর্থে মহৎ পুণ্য উপার্জ্জন ও পরমসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন, যে ব্যক্তি পিতৃগণ ও দেবগণের অর্চনে রত থাকিয়া এই তীর্থে অভিষেক করে, তাহার অশ্বমেধানুষ্ঠানের দশগুণ ফললাভ হয়। যে ব্যক্তি পুষ্করারণ্যে বাস করিয়া একমাত্র ব্ৰাহ্মণভোজন করায়, সে ইহকাল ও পরকালে পরমানন্দ অনুভব করে। যে ব্যক্তি এই স্থানে থাকিয়া অসূয়াশূন্যচিত্তে শ্রদ্ধাসহকারে শাক, মূল বা ফল ব্রাহ্মণগণকে প্রদান করিয়া ঐ সমুদয়দ্বারা স্বয়ং জীবনধারণ করে, তাহার অশ্বমেধের ফললাভ হয়। কি ব্ৰাহ্মণ, কি ক্ষত্ৰিয়, কি বৈশ্য, কি শূদ্র যে কেহ পুষ্করতীর্থে স্নান করে, তাহাকে পুনর্ব্বার জন্মগ্রহণ করিতে হয় না। বিশেষতঃ যে ব্যক্তি কার্ত্তিকী পূর্ণিমাতে পুষ্করতীর্থে গমন করে, তাহার অক্ষয় ব্ৰহ্মলোকপ্ৰাপ্তি হয়। যে ব্যক্তি কৃতাঞ্জলিপুটে সায়ং ও প্ৰাতঃকালে পুষ্করতীর্থের স্মরণ করে, তাহার সকল-তীৰ্থস্নানের ফললাভ হয়। স্ত্রী কিংবা পুরুষের জন্মাবধি যে-সকল পাপ জন্মিয়া থাকে, একবার পুষ্করে স্নান করিবামাত্র তৎসমুদয়ই বিনষ্ট হইয়া যায়। যেমন ভগবান, মধুসূদন সর্ব্বদেবের আদি, তদ্রূপ পুষ্করতীৰ্থ যাবতীয় তীর্থের আদি। সংযত হইয়া পবিত্ৰচিত্তে দ্বাদশ বৎসর পুষ্করতীর্থে বাস করিলে সমুদয় যজ্ঞানুষ্ঠানের ফললাভ ও চরমে ব্ৰহ্মলোকে বাস হয়। যে ব্যক্তি সম্পূর্ণ শত বৎসর অগ্নিহোত্ৰ উপাসনা করে, আর যে ব্যক্তি এক কার্ত্তিকী-পূর্ণিমায় পুষ্করে বাস করে, এই উভয়েরই তুল্য ফললাভ হয়। হিমালয়ের তিন শৃঙ্গ হইতে যে তিন প্রস্রবণ প্রবাহিত হইতেছে, সেই পুষ্করতীৰ্থ উহা উৎপত্তিরহিত, এই নিমিত্ত তাহার জন্ম-করণ কেহই জানে না। হে মহাত্মন! পুষ্করতীর্থে গমন, তপস্যা, দান ও বাস করা নিতান্ত দুষ্কর।

‘পুষ্করতীর্থে সংযত ও পরিমিতাহারী হইয়া দ্বাদশারাত্র বাসপূর্ব্বক পরিশেষে ঐ তীর্থ প্ৰদক্ষিণ করিয়া দেব, ঋষি ও পিতৃগণসেবিত জম্বুমার্গে গমন করিলে, অশ্বমেধের ফললাভ ও সর্ব্ব কাম প্রাপ্ত হয়। ঐ স্থানে পঞ্চরাত্র বাস করিলে মানবগণ পূতাত্মা হয়; তাহার কোন দুৰ্গতি হয় না এবং সে চরমে পরমসিদ্ধিলাভ করে। জম্বুমাৰ্গ হইতে তণ্ডূলিকাশ্রমে গমন করিলে দুৰ্গতিনাশ ও চরমে ব্ৰহ্মলোকপ্ৰাপ্তি হয়। অগস্ত্যসরোবরে উপস্থিত হইযা ত্রিরাত্র উপবাস করিয়া পিতৃদেবার্চ্চনে রত থাকিলে অগ্নিষ্টোমের ফললাভ হয় এবং শাক বা ফলদ্বারা জীবিকানির্ব্বাহ করিলে কৌমার-পদপ্রাপ্তি হয়।

বিবিধ তীর্থবৰ্ণন

‘অনন্তর লোকপূজিত কণ্বাশ্রমে গমন করিবে। কণ্বাশ্রম পরমপবিত্ৰ আদ্য ধর্ম্মরণ্য। ঐ স্থানে প্রবেশমাত্র সর্ব্বপাপ বিনষ্ট হয়। তথায় নিয়তাশন হইয়া পিতৃগণ ও দেবগণের অৰ্চনা করিলে সবকামসমৃদ্ধ যজ্ঞের ফললাভ হয়। কণ্বাশ্রম প্ৰদক্ষিণ করিয়া যযাতিপতনে গমন করিলে অশ্বমেধযজ্ঞের ফললাভ হয়। সে স্থান হইতে মহাকালে গমন করিবে। তথায় সংযত ও নিয়তাহারী হইলে কোটি তীর্থ-স্নান ও অশ্বমেধানুষ্ঠানের ফললাভ হয়। তথা হইতে রুদ্রবটনামে সর্ব্বভূতভাবন ভগবান ভবানীপতির ত্ৰিলোকবিশ্রুত তীর্থে গমন করিলে গোসহস্রদানের ফল ও মহাদেবের প্রসাদে গাণপত্যলাভ হয়। ত্ৰৈলোক্যবিশ্রুত নর্ম্মদানদীতে গমন করিয়া দেব ও পিতৃগণের তর্পণ করিলে অগ্নিষ্টোমের ফললাভ হয়। জিতেন্দ্ৰিয় ও ব্ৰহ্মচারী হইয়া দক্ষিণসিন্ধুতে গমন করিলে অগ্নিষ্টোমের ফললাভ ও বিমানে আরোহণ করিতে পারে। চর্ম্মণ্বতীনদীতে গমন করিয়া রান্তিদেবকৃত নিয়মানুসারে সংযত ও নিয়তাশন হইলে অগ্নিষ্টোমের ফললাভ হয়।

‘পরে হিমবৎসূত অৰ্ব্বুদ-তীর্থে গমন করিবে; পূর্ব্বে যে স্থানে পৃথিবীর ছিদ্র ছিল ও যে স্থানে মহর্ষি বশিষ্ঠের ত্ৰিলোকবিশ্রুত আশ্রম, তথায় একরাত্রি বাস করিলে গোসহস্রদানের ফললাভ হয়। জিতেন্দ্ৰিয় ও ব্রহ্মচারী হইয়া পিঙ্গ-তীর্থে স্নান করিলে শতকপিলাদানের ফললাভ হয়। তৎপরে সর্বোত্তম প্ৰভাস-তীর্থে গমন করবে। ঐ তীর্থে দেবগণের মুখস্বরূপ অনিলসারথি ভগবান হুতাশন সতত সন্নিহিত আছেন। তথায় প্রয়তমানসে পবিত্ৰচিত্তে স্নান করিলে অগ্নিষ্টোম ও অতিরাত্রের ফললাভ হয়। অনন্তর সরস্বতীসাগরসঙ্গমে গমন করিবে, তথায় গমন করিলে মানবগণ গােসহস্রদানের ফলভাগী, অগ্নির ন্যায় দীপ্তিশালী ও চরমে স্বৰ্গলোকগামী হয়। প্ৰয়তমানসে সলিলরাজের তীর্থে ত্রিরাত্র বাস করিয়া স্নান এবং দেবতা ও পিতৃগণের তর্পণ করিলে চন্দ্রের ন্যায় প্রভাশালী হয় এবং অশ্বমেধের ফললাভ করে। পরে বরদানতীর্থে গমন করিবে, যে স্থানে মহর্ষি দুর্ব্বাসা বিষ্ণুকে বর প্রদান করিয়াছিলেন। বরদানে স্নান করিলে গোসহস্রদানের ফললাভ হয়। তৎপরে সংযত ও নিয়মিতাহারী হইয়া দ্বারাবতীতে গমন করিবে। তত্রস্থ পিণ্ডারকে স্নান করিলে প্রচুর সুবৰ্ণলাভ হয়। ঐ তীর্থে অদ্যাপি পদ্মলক্ষণলক্ষিত মুদ্রাসমুদয় ও ত্রিশূলাঙ্কিত পদ্মসকল দৃষ্ট হইয়া থাকে। তথায় ভগবান ভবানীপতির সান্নিধ্য আছে। সাগর ও সিন্ধুর সঙ্গমে গমনপূর্ব্বক প্রয়তমানসে সলিলরাজের তীর্থে স্নান এবং দেব, ঋষি ও পিতৃগণের তর্পণ করিলে স্বতেজঃপ্রদীপ্ত বারুণলোকপ্ৰাপ্তি হয়। শঙ্কুকৰ্ণেশ্বর দেবকে অৰ্চনা করিলে অশ্বমেধানুষ্ঠানের দশগুণ ফললাভ হয়।

‘শঙ্কুকৰ্ণেশ্বরকে প্ৰদক্ষিণ করিয়া ত্ৰিলোকবিশ্রুত সর্ব্বপাপপ্রণাশন, দমীনামে বিখ্যাত তীর্থে গমন করিবে। তথায় ব্ৰহ্মাদি দেবগণ মহেশ্বরের উপাসনা করেন। ঐ তীর্থে স্নান করিয়া দেবগণপরিবৃত রুদ্রকে অৰ্চনা করিলে জন্মাবধি-কৃত-সমুদয় পাপ বিনষ্ট হইয়া যায় এবং অশ্বমেধ-যজ্ঞের ফললাভ হয়। প্ৰভবিষ্ণু বিষ্ণু দৈত্যদানবগণকে সংহার করিয়া তথায় অবগাহনপূর্ব্বক স্বীয় শৌচসম্পাদন করিয়াছিলেন। তদনন্তর সর্ব্বলোকপূজিত বসুধারায় গমন করিবে। তথায় গমন করিলে অশ্বমেধের ফললাভ হয় এবং তথায় প্রয়তান্তঃকরণে সুসমাহিত-চিত্তে স্নান এবং দেবপিতৃগণের তর্পণ করিলে বিষ্ণুলোকে পূজিত হয়। ঐ তীর্থে বসুগণের পবিত্র সরোবর আছে। তথায় স্নান ও জলপান করিলে তাঁহাদিগের প্রিয়তর হয়। সিন্ধুত্তমনামে সুবিখ্যাত সর্ব্বপাপপ্রণাশন তীর্থে স্নান করিলে বহু সুবৰ্ণলাভ হয়। শুদ্ধান্তঃকরণে ভদ্রতুঙ্গে গমন করিলে ব্ৰহ্মলোকপ্ৰাপ্তি ও পরমগতিলাভ হয়। সিদ্ধগণনিষেষিত শক্রের কুমারিকা-তীর্থে স্নান করিলে শীঘ্র স্বৰ্গলোকপ্ৰাপ্তি হয়। তথায় সিদ্ধগণসেবিত রেণুকা-তীৰ্থ আছে; তথায় স্নান করিলে চন্দ্ৰমার ন্যায় নির্ম্মল-কান্তি ব্ৰাহ্মণ হয়। সংযত ও মিতাহারী হইয়া পঞ্চনদে গমন করিলে ক্রমানুকীর্ত্তিত দেবযজ্ঞ প্রভৃতি পঞ্চযজ্ঞের ফললাভ হয়।

“পরে ভীমাস্থানে গমন করিয়া তত্রস্থ যোনিতীর্থে স্নান করিলে মানব দেবীপুত্র হয়, তাহার শরীর লাবণ্য তপ্তকাঞ্চনের ন্যায় হইয়া উঠে এবং সে শতসহস্রগোদানের ফললাভ করে। ত্রিলোবিশ্রুত শ্রীকুণ্ডে গমন করিয়া পিতামহকে নমস্কার করিলে গোসহস্রদানের ফললাভ হয়। তৎপরে বিমল-তীর্থে গমন করিবে; তথায় অদ্যাপি সুবর্ণ ও রজতময় মৎস্যসকল দৃষ্ট হইয়া থাকে। তথায় স্নান করিলে লোক সর্ব্বপাপবিমুক্ত পরমগতিপ্রাপ্ত হইয়া বাসবলোকে গমন করে। বিতস্তায় গমনপূর্ব্বক দেব ও পিতৃগণের তর্পণ করিলে বাজপেয়-ফললাভ হয়। কাশ্মীরস্থ বিতস্তা-নদী নাগরাজ তক্ষকের ভবন! ঐ বিতস্তাসঙ্গম-তীর্থে স্নান করিলে বাজপেয়ের ফললাভ, সর্ব্বপাপপ্রমোচন ও চরমে পরামগতিপ্ৰাপ্ত হয় ।

‘অনন্তর ত্ৰিলোকবিশ্রুত বড়বায় গমন করিবে। তথায় পশ্চিম সন্ধ্যাসময়ে বিধিপূর্ব্বক স্নান করিয়া ভগবান হুতাশনকে যথাশক্তি চরু নিবেদন করিবে। ঐ স্থানে পিতৃগণোদ্দেশে দান করিলে উহা অক্ষয় হয়। পিতৃগণ, ঋষি, দেব, গন্ধর্ব্ব, অপ্সর, গুহ্যক, কিন্নর, যক্ষ, সিদ্ধ, বিদ্যাধর, নর, রাক্ষস, দৈত্য ও রুদ্রগণ এবং স্বয়ং ব্ৰহ্মা ঐ স্থানে সহস্ৰ-বৎসর-ব্যাপী পরম দীক্ষাগ্রহণপূর্ব্বক বিষ্ণুকে প্রসন্ন করিয়া চারু প্ৰদান ও সপ্ত সপ্ত ঋকের দ্বারা স্তব করিয়াছিলেন। ভগবান কেশব তাঁহাদের প্রতি পরিতুষ্ট হইয়া তাঁহাদিগের অষ্টগুণ ঐশ্বৰ্য্য ও অন্যান্য অভিলাষসকল সফল করিয়া জলদজালমধ্যস্থ বিদ্যুতের ন্যায় সেই স্থানেই অন্তর্হিত হইলেন। হে মহাভাগ! এই নিমিত্ত ঐ স্থানের নাম সপ্তচরু বলিয়া লোকমধ্যে বিখ্যাত হইয়াছে। ঐ স্থানে ভগবান হব্যবাহনকে চারুপ্রদান করিলে শতসহস্রগোদান, শত রাজসূয় ও সহস্ৰ অশ্বমেধানুষ্ঠান অপেক্ষা অধিকতর ফললাভ হয়। তথা হইতে রুদ্রপদে গমন করিয়া মহাদেবের অৰ্চনা করিলে অশ্বমেধের ফললাভ হয়। ব্ৰহ্মচারী হইয়া সুসমাহিতচিত্তে মণিমানে গমনপূর্ব্বক একরাত্রি বাস করিলে অগ্নিষ্টোমের ফললাভ হয়।

“পরে লোকবিশ্রুত দেবিকায় গমন করিবে; যে স্থানে মানবজাতি যথাবিধি কর্ম্ম করিলে ব্রাহ্মণ হয় এবং যাহা ভূতভাবন ভবানীপতির ত্ৰিলোকবিশ্রুত আশ্রম। তাহার দৈর্ঘ্য পঞ্চযোজন ও বিস্তৃতি অৰ্দ্ধযোজন। সেই দেবর্ষিগণসেবিত পরমপবিত্ৰ দেবিকায় অবগাহন করিয়া মহেশ্বরকে অৰ্চনা ও যথাশক্তি চারু নিবেদন করিলে সর্ব্বকামসমৃদ্ধ যজ্ঞের ফললাভ হয়। তথায় দেবগণনিষেষিত রুদ্রদেবের কামাখ্যতীর্থ আছে। মনুষ্য সেই তীর্থে স্নান করিলে ত্বরায় সিদ্ধিলাভ করে। তথায় যজন, যােজন এবং ব্ৰহ্মবালুক ও পুষ্পম্ভের উপস্পৰ্শন [সমীপে গিয়া স্পর্শ] করিলে পরলোকে শোকরহিত হয়। তদনন্তর যথাক্রমে দীর্ঘসূত্রে গমন করিবে। যে স্থানে ব্ৰহ্মাদি দেবগণ, সিদ্ধগণ ও ব্রহ্মর্ষিগণ দীক্ষিত ও নিয়ত ব্ৰত হইয়া দীর্ঘসত্রের অনুষ্ঠান করেন, সেই দীর্ঘসত্রে গমনমাত্র রাজসূয় ও অশ্বমেধের ফললাভ হয়।

‘অনন্তর সংযত ও মিতাহারী হইয়া বিনশনে গমন করিবে; যে স্থানে সরস্বতী নদী অন্তর্হিত হইয়া মেরুপৃষ্ঠে, চমসোদ্ভেদে শিবোদ্ভেদে ও নাগোদ্ভেদে গমন করিতেছেন। চমসোদ্ভেদে স্নান করিলে অগ্নিষ্টোমের ফল, শিবোদ্ভেদে স্নান করিলে গোসহস্রদানের ফল এবং নাগোদ্ভেদে স্নান করিলে নাগলোকপ্ৰাপ্তি হয়। পরে শশযানে গমন করিবে; যে স্থানে পুষ্করসকল প্রতিবৎসর শশারদীপ-প্ৰতিচ্ছন্ন [গৃঢ় শশরূপী—প্রচ্ছন্নরূপধারী] হইয়া কৌশিকী অতিক্রমণপূর্ব্বক সরস্বতীতে পতিত হয়। সেই তীর্থে স্নান করিলে লোক শশাঙ্কসদৃশ দীপ্তিশালী ও গোসহস্রদানের ফলপ্রাপ্ত হয়। সংযতচিত্তে কুমারকোটিতে গমনপূর্ব্বক অভিষেক এবং দেব ও পিতৃগণের অর্চনা করিলে লোক অযুতসংখ্যক গোদানের ফলপ্ৰাপ্ত হয় ও নিজকুল উদ্ধার করে।

“পরে সমাহিতচিত্তে রুদ্রকোটিতে গমন করিবে; পূর্ব্বে যেখানে কোটিসংখ্যক মুনি মহাদেবের দর্শনাকাঙক্ষায় সাতিশয় হৃষ্টচিত্তে “আমি পূর্ব্বে মহাদেবকে দেখিব, আমি পূর্ব্বে মহাদেবকে দেখিব৷” বলিয়া সত্বরে প্রস্থান করিলেন। তখন সর্ব্বভুতেশ্বর যোগিবর মহর্ষিগণের ক্ৰোধনিরাকরণার্থ যোগবলে তাহাদের অগ্ৰে কোটিরুদ্রের সৃষ্টি করিলেন। তপোধনগণ সকলেই “আমি অগ্ৰে মহাদেবকে দেখিয়াছি”, এই মনে করিয়া পরম পরিতুষ্ট হইলেন। তখন ভগবান মহাদেব মহর্ষিগণের ভক্তি-সন্দর্শনে সাতিশয় সন্তুষ্ট হইয়া “অদ্যাবধি তোমাদের ধর্ম্মবৃদ্ধি হইবে।” বলিয়া তাহাদিগের বর প্রদান করিলেন। হে নরনাথ! সেই রুদ্রকোটিতে স্নান করিলে অশ্বমেধের ফলপ্ৰাপ্তি ও কুলোদ্ধার হয়।

‘অনন্তর লোকবিশ্রুত সরস্বতীসঙ্গমে গমন করিবে; যে স্থানে ব্ৰহ্মাদি দেবগণ ও তপোধনসমুদয় চৈত্রমাসীয় শুক্লা চতুর্দ্দশীতে আগমনপূর্ব্বক কেশবের উপাসনা করেন। ঐ তীর্থে স্নান করিলে বহু সুবৰ্ণলাভ, সর্ব্বপাপমোচন ও চরমে পরমপবিত্র ব্ৰহ্মলোকপ্ৰাপ্তি হয়। হে রাজন! যেস্থানে ঋষিগণের সত্ৰসমুদয় সমাপ্ত হইয়াছিল, সেই সত্ৰাবসানে গমন করিলে গোসহস্রদানের ফল হয়।’ ”