নিশাচরী দূরে থাকি, বীর বৃকোদরে দেখি,
শরীর নেহালে ঘনে ঘন।
কিবা সুমেরুর চূড়া, যেন শাল-দ্রুম কোঁড়া,
শশিমুখ পঙ্কজ-নয়ন।।
সিংহের বিক্রম ধর, ভুজযুগ করিকর,
কম্বুকন্ঠ খগবর-নাসা।
অঙ্গ নিরখিয়া ক্ষণে, মাতিল অনঙ্গ-বাণে,
মনে চিন্তে হিড়িম্বের স্বসা।।
এমন সুন্দর রূপে, নাহি দেখি ইহলোকে,
যক্ষ রক্ষ মনুষ্য ভিতরে।
মম ভাগ্য হেতু বিধি, মিলাইল হেন নিধি,
স্বামী আমি করিব ইহারে।।
ভাই মোর দুরাচারী, এ হেন পুরুষে মারি,
মাংস খাইবেক মনসুখে।
ইহারে রাখিয়া আমি, বরিয়া করিব স্বামী,
চিরকাল বঞ্চিব কৌতুকে।।
এতেক কামনা করি, কামরূপা নিশাচরী,
দিব্যরূপা হইল কামিনী।
পূর্ণচন্দ্র মুখখানি, নয়ন কুরঙ্গ জিনি,
স্তন-যুগ বরা নিতম্বিনী।।
কামের কার্ম্মূক ভূরু, তিলফূল নাসা চারু,
শ্রুতিযুগ নিন্দিত গৃধিনী।
করিকর-যুগ ঊরু, সুন্দর কদলী-তরু,
মত্ত-বর-মাতঙ্গ-চলনী।।
চম্পক-কুসুম আভা, অঙ্গের বরণ-শোভা,
কটাক্ষে মোহিত মুনি-মন।
আসিয়া ভীমের পাশে, সলজ্জিত মৃদু-ভাষে,
কহে যেন কোকিল ভাষণ।।
কহ তুমি কোন্ জন, কোথা হৈতে আগমন,
কি হেতু আইলা এই বন।
দেবতার মূর্ত্তি প্রায়, ভূমিতলে নিদ্রা যায়,
কেবা হয় এই চারি জন।।
নিদ্রা যায় নিরুপমা, সুবদনী ঘনশ্যামা,
এ রামা তোমার কেবা হয়।
এ ঘোর দুর্গম বনে, নিদ্রা যায় অচেতনে,
নাহি জান রাক্ষস-আলয়।।
তিলেক নাহিক ডর, যেন আপনার ঘর,
অতিশয় দেখি দুঃসাহস।
এই বন-অধিকারী, পাপ-আত্মা দুরাচারী,
ভয়ঙ্কর হিড়িম্ব রাক্ষস।।
হ্য় সে আমার ভ্রাতা, মোরে পাঠাইল হেথা,
তোমা সবা ধরিয়া লইতে।
মনুষ্যাদি-জন বৈরী, মাংসলোভী পাপকারী,
ইচ্ছা করে তোমারে খাইতে।।
দেখিয়া তোমার অঙ্গ, দহিছে অনঙ্গে অঙ্গ,
স্বামী করি বরিনু তোমারে।
মিথ্যা নাহি কহি আমি বুঝি কার্য্য কর স্বামী,
সাবধান হও রাক্ষসেরে।।
আজ্ঞা কর এইক্ষণে, লৈয়া যাই অন্য স্থানে,
পর্ব্বত-কন্দর অন্য বনে।
হিড়িম্বার মুখে শুনি, মেঘের নিনাদ-বাণী,
বৃকোদর কহে ততক্ষণে।।
দেখি তোরে সুলক্ষণী, কহিস্ অনীতি-বাণী,
এই কথা না সম্ভবে লোকে।
কেন হেন দুরাচারী, ভ্রাতৃ মাতৃ পরিহরি,
স্ত্রী লইয়া যাইব কৌতুকে।।
সবারে রাক্ষস মুখে, দিয়া আমি যাব সুখে,
তোমারে লইয়া অন্য স্থান।
কহিতে এমন কাজ, মুখে তোর নাহি লাজ,
কামশরে হইলি অজ্ঞান।।
এত শুনি নিশাচরী, কহে যোড়কর করি,
মৃদু মৃদু মধুর বচনে।
আজ্ঞা কর মহাশয়, যে তোমার প্রিয় হয়,
প্রাণপণে করিব এক্ষণে।।
বড় দুষ্ট মম ভ্রাতা, এখনি আসিবে হেথা,
সাবধান হইতে জানাই।
জাগাইয়া সর্ব্বজনে, মোর পৃষ্ঠ-আরোহণে,
চলহ অন্যত্র লৈয়া যাই।।
ভীম বলে ভ্রাতৃ মায়, সুখে শুয়ে নিদ্রা যায়,
কেন নিদ্রা করিব ভঞ্জন।
তোর ভাই কোন্ ছার, কেবা ভয় করে তার,
আমি তারে না করি গণন।।
কীটজ্ঞান করি রক্ষ, দেবতা গন্ধর্ব্ব যক্ষ,
নাহি সহে মোর পরাক্রম।
হের দেখ সুলোচনি, আমার যুগল-পাণি,
দেখিয়া করয়ে ভয় যম।।
যাহ বা থাকহ হেথা, মনে লয় যেই কথা,
কর চিত্তে যেই অভিলাষ।
নতুবা তথায় গিয়া, ভায়ে দেহ পাঠাইয়া,
কি করিবে আসি মোর পাশ।।
ভীম হিড়িম্বাতে কথা, বিলম্ব দেখিয়া হেথা,
হিড়িম্ব হইল ক্রোধমন।
অতি ভয়ঙ্কর মূর্ত্তি, যুগান্তের সমবর্ত্তী,
আসে ঘোর করিয়া গর্জ্জন।।
দেখি মহাপ্রিয়ঙ্করী, স্তব্ধ হৈয়া নিশাচরী,
সকরুণে কহে বৃকোদরে।
হের দেখ মোর ভ্রাত, যেন ঘোর মহাবাত,
আইসে দুরন্ত-ক্রোধ ভরে।।
নির্দ্দয় নিষ্ঠুরতর, খাইল অনেক নর,
দেখিয়াছি আমি বিদ্যমান।
বিলম্ব না কর তুমি, বিশেষ রাক্ষস-ভূমি,
মায়ারী অধিক বলবান।।
বিলম্ব না কর প্রভু, আজ্ঞা মোরে দেহ তবু,
পৃষ্ঠে করি লই সবাকারে।
উড়িব পবনভরে, যথা বল তথাকারে,
লৈয়া যাব নিমেষ ভিতরে।।
হিড়িম্বে দেখিয়া উগ্র, হিড়িম্বারে দেখি ব্যগ্র,
হাসি বলে মরুত-নন্দন।
স্থির হও সুবদানি, কি ভয় কর লো ধনি,
বসি দেখ কৌতুক এখন।।
আসুক তোমার ভাই, মুহূর্ত্তেকে মোর ঠাঁই,
প্রাণ দিবে পতঙ্গ সমান।
এইমাত্র হবে তোকে, মজিব ভ্রাতার শোকে,
ইহা বই নাহি দেখি আন।।
ভারত-সঙ্গীত-রস, শ্রবণেতে পুণ্য যশ,
সদা শুভ পরম পবিত্র।
কলির কলুষ-নাশ, বিরচিল কাশীদাস,
আদিপর্ব্বে পাণ্ডব-চরিত্র।।