০৭. আসিফের অচেনা জগৎ
টুটুলরা রাতেও আসিফের নাগাল পেলো না। খেয়ে উঠে আসিফকে নিয়ে শোবার ঘরে এসে টুটুল বললো, এবার তোমাকে পেয়েছি বড়দা। তোমার অ্যাকশনের কথা শোনার জন্য কখন থেকে …। কথা শেষ করে নি এমন সময় বাবা এসে ঢুকলেন ঘরে। মোলায়েম গলায় বললেন, টুটুল, তুমি আর বিদ্যুৎ শুয়ে পড়ো। আমি আর তোমার কাকা আসিফের সঙ্গে একটু কথা বলবো।
টুটুল বলতে চেয়েছিলো, আমার সামনে বললে কি হয়? কিন্তু আসিফ কী মনে করে এই ভেবে চুপ করে রইলো। ওরা বেরিয়ে যেতেই বিদ্যুৎকে বললো, এটা কিন্তু অন্যায় বিদ্যুৎ। হলোই-বা তাঁর বড় ছেলে। এভাবে আগলে রাখা মোটেই উচিত হচ্ছে না। ওর ওপর আমাদেরও নিশ্চয়ই দাবি আছে।
বিদ্যুৎ মৃদু হেসে বললো, আমার মনে হয় আসিফদার জন্য ওঁরা কিছুটা টেনশনে আছেন টুটুলদা। কাল নিশ্চয়ই আমরা তাঁকে পাবো।
দেখো, কালও বাবা একটা অজুহাত বের করবেন। বাবার ওপর রাগ হলো টুটুলের। পরে মনে হলো, এমন তো হতে পারে, বিদ্যুৎ আছে বলে বাবা ওর সঙ্গে আগের মতো সহজ হতে পারছেন না? বাবা টুটুলের সঙ্গে যেসব বিষয় নিয়ে কথা বলেন, অন্য কেউ সামনে থাকলে কি আর তা পারা যায়! রাগ পড়ে এলো টুটুলের। আস্তে-আস্তে ঘুম ওর চোখের পাতা ভারী করে দিলো। রাতে কখন যে আসিফ এসে শুয়েছে টুটুল, বিদ্যুৎ কেউ টের পায় নি। বাবাকে সব কথা বলে আসিফও বহুদিন পর নিশ্চিন্তে ঘুমালো। শুধু ঘুমাতে পারবেন না বাবা আর হেডমাস্টার। আসিফ এমন কিছু কথা বলেছে, যা তাদের ঘুম নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট ছিলো। বাবা ঠিক করলেন, পরশু বুধবার তিনি ঢাকায় রওনা হবেন। আসিফের দুটো জরুরি চিঠি পৌঁছাতে হবে চিটাগাং আর ঢাকায়। ছেলেটা একা বিপদে পড়ে নি ওদের গোটা দলই বিপদে পড়েছে। একবার বাবার মনে হলো আসিফের দল নিয়ে তিনি বেশি ভাবছেন। পরেই আবার ভাবলেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে একা আর কত লড়বেন তিনি!
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আসিফ দেখলো পায়ে তেমন কোনো ব্যথা নেই। নাশতা খাওয়ার সময় টুটুলকে বললো, আজ মনে হচ্ছে তোমাদের সঙ্গে কাজ করতে পারবো। বেড়া বাঁধার কাজ আজও তো চলবে?
টুটুল কি যেন বলতে যাবে অমনি ধমক দিলেন দিদা–এমন বেআক্কেলে কথা শুনি নি তো কখনো! এতবড় একটা জখম হলো কাল, আজ উনি যাবেন বেড়া বাঁধতে। ওসব এখানে চলবে না। সারা দিন শুয়ে থাকবে। ঘুরতে ইচ্ছে হলো পুকুর পর্যন্ত যেতে পারো, তার ওপাশে নয়।
দিদার কথা শুনে টুটুল হেসে ফেললো। ওকেও ধমকে দিলেন তিনি হাসির কোনো কথা বলি নি তো বাছা! এতে এত হাসার কি হলো!
আসিফ দেখলো, হাসি চাপতে না পেরে টুটুল আর বিদ্যুৎ ততক্ষণে বাইরে চলে গেছে। ঘরে এসে আসিফ দেখলো, এক কোণে টুটুলের বই সব গাদা হয়ে পড়ে আছে। বইগুলো সাজাতে গিয়ে ওর ভেতর ইলিয়া এরেনবুর্গের প্যারির পতন বইটা দেখতে পেলো। কার কাছে যেন বইটার নাম শুনেছিলো। লেনিনের প্রিয় লেখকদের একজন এরেনবুর্গ। সারা দিন শুয়ে-শুয়ে বই পড়ে আর মিতুল কুমার সঙ্গে গল্প করে কাটিয়ে দিলো আসিফ। এর মধ্যে দিদা কয়েক বার এসে দেখে গেছেন। আর প্রত্যেক বারই এইতো লক্ষ্মী ছেলে বলে মার কাছে গিয়ে আসিফের প্রশংসা করেছেন। আসিফ শুয়ে-শুয়ে সব শুনেছে।
সেদিন রাতে টুটুলদের আর এড়ানো গেলো না। খেয়ে উঠে টুটুল বাবাকে বললো, বাবা আগেই বলছি, বাগড়া দিতে পারবে না। আমরা বড়দার সঙ্গে পুকুরঘাটে বসে গল্প করবো। কী সুন্দর জ্যোৎস্না, দেখেছো?
বাবা হাসলেন শুধু। কাল রাতেই তাঁর সঙ্গে আসিফের কথা হয়েছে। টুটুলদের কতটুকু বলা যায় আসিফ সেটা জানে।
দিদা একবার বললেন, আবার পুকুর ধারে যাওয়া কেন, বারান্দায় বসে গল্প করলেই তো হয়! ওদিকে সাপখোপ তো থাকতে পারে।
করমালি বললো, এডে হাফ কণ্ডায় হাইবো দাদি আম্মা!
কি যে বলো বাছা, তুমি নিজেই জানো। বলে দিদা ভেতরে চলে গেলেন।
যেতে-যেতে বিদ্যুৎ বললো, করমালি কি বলেছে কিছু বুঝেছো টুটুলদা?
টুটুল একটু ভেবে বললো, কি যেন কণ্ডর সাপের কথা বলছিলো। কণ্ডর বলে কোনো সাপ আছে নাকি?
আসিফ আর বিদ্যুৎ দুজন একসঙ্গে হেসে উঠলো। বিদ্যুৎ বললো, করমালি বলেছে, এখানে সাপ কোথায়!
লজ্জা পেয়ে টুটুল বললো, তুমি দেখে নিও, ছমাসের ভেতর করমালির সঙ্গে আমি ওদের ভাষায় কথা বলবো।
পুকুর পাড়ে কয়েকটা কংক্রিটের স্ল্যাব বসিয়ে ঘাটের মতো করা হয়েছে। সেখানে বসতেই মনটা ভরে গেলো আসিফের। মৃদু বাতাস বইছিলো। চাঁদের আলো পুকুরের ঝিরঝিরে ঢেউয়ের মাথায় হীরের কুচির মতো জ্বলজ্বল করছিলো। আসিফ বললো, কী শুনতে চাও বলো।
টুটুল বললো, তোমার সব কথা। কী করতে, কী করছে সব।
কী করছি কাল বলি নি?
না বড়দা, অতটুকু বলাতে হবে না।
কেন, সর্বহারা পার্টির নাম শোন নি?
নাম শুনেছি। কী করে, কী চায়–কিছুই জানি না।
বিদ্যুৎ নিশ্চয়ই জানো?
মাথা নেড়ে সায় জানালো বিদ্যুৎ। বললো, বাবার কাছ থেকে নিয়ে ওদের কিছু কাগজ পড়েছি।
আমাদের এখন খুব খারাপ সময় যাচ্ছে। আস্তে-আস্তে বললো আসিফ, পার্টিতে বেশ কিছু গুপ্তচর আছে। পার্টির বহু গোপন খবর ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। পরশু রাতে আমাদের মিশন সাকসেসফুল হয় নি খবর ফাঁস হওয়ার জন্য।
পরশু তোমরা কীভাবে ট্র্যাপে পড়লে বলো।
থানা অপারেশন সম্পর্কে একজন বন্ধুকে যতটুকু বলা উচিত ঠিক ততটুকুই বললো আসিফ। তারপর বললো, কীভাবে ও পার্টিতে এলো।
টুটুল বললো, তোমার বাবা-মার কথা বলো, ভাই-বোনদের কথা বলো।
আমার বাবা নেই। আস্তে-আস্তে বললো আসিফ, একাত্তরের যুদ্ধে মারা গেছেন। আর্মির ডাক্তার ছিলেন। যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালাবার সময় পাঞ্জাবিদের গুলীতে মারা যান। আমরা দুই ভাই। বড় ভাই জাহাজে চাকরি করেন। অবস্থা ভালোই বলতে হবে। বাড়িতে মা আছেন। ভাবী আছেন। আমার রাজনীতিকরা ভাইয়া একেবারেই পছন্দ করেন না। পড়তাম ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে। একদিন ভাইয়ার সঙ্গে খুব ঝগড়া হলো রাজনীতি নিয়ে। মাও বললেন এসব ছাড়তে। ভাইয়া রেগে বললেন, এসব চাষা-মজুরের রাজনীতি করলে তাঁর বাড়িতে থাকা চলবে না। তিনি যখন ছাত্র ছিলেন তখন এন. এস. এফ. করতেন। ব্যস, এক কাপড়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হয়ে গেলাম। গত দুবছর ধরে হিলট্রাক্টে আছি।
হিন্ট্রাক্টে তোমাদের ঘাঁটিটা কোথায় বড়দা? তুমি কোথায় থাকতে?
মৃদু হেসে আসিফ বললো, এটা বলার নিয়ম নেই টুটুল।
ও আচ্ছা। থতমত খেয়ে বললো টুটুল।
বিদ্যুৎ বললো, তুমি যে বললে পার্টির অবস্থা ভালো নয়, তোমার নিজেরও কী বিপদ হতে পারে আসিফদা?
আসিফ ম্লান হাসলো–তুমি নিশ্চয়ই শুনেছো, পার্টির ভেতর লুকিয়ে থাকা এক গুপ্তচরই সিরাজ সিকদারকে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দিয়েছিলো। পরে আরো অনেক গুপ্তচরের খোঁজ আমরা পেয়েছি। অনেককে শাস্তি দেয়া হয়েছে। এখনো বেশ কিছু রয়ে গেছে। প্রতি মুহূর্তেই আমরা বড় রকমের হামলার আশঙ্কা করছি।
গুপ্তচরদের তোমরা কী শাস্তি দাও? জানতে চাইলো টুটুল।
চরম শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। শক্ত গলায় জবাব দিলো আসিফ।
শান্তিবাহিনীর সঙ্গে তোমাদের গণ্ডগোল হয় না?
প্রথম দিকে হতো। পরে দুই দলের নেতারা বসে ঠিক করেছেন কেউ কাউকে ঘাঁটাবেন না।
ওরা যে স্বাধীনতা চায়, এটা কি ঠিক মনে করো বড়দা?
এ নিয়ে ওদের সঙ্গে অনেক আলাপ হয়েছে। ব্যাপারটা তোমাদের বুঝিয়ে বলা একটু শক্ত। তবে এটুকু বলতে পারি, আমরা চাই ওর ওদের নিজস্ব জাতিগত পরিচয় নিয়ে এদেশে থাকবে। ওদের ভাষা, ওদের সংস্কৃতি সব কিছু স্বাধীনভাবে এবং মর্যাদার সঙ্গে বিকশিত হবার সুযোগ দিতে হবে। অতীতে ওদের ওপর যত অন্যায়-অবিচার করা হয়েছে তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। তোমরা নিশ্চয়ই শুনেছো, এক কাপ্তাই বাঁধের জন্য কত শত পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে। ওদের সব পাওনাগণ্ডা ওদের বুঝিয়ে দিতে হবে।
টুটুল এরপর আসিফকে উড়ো চিঠির কথা বললো। আসিফও হেডমাস্টারের অনুমান সঠিক বললো। নিশ্চয়ই কোনো পাজি লোক তোমাদের ভয় দেখাবার জন্য এটা করেছে। শান্তিবাহিনী এ ধরনের কাজ করতে যাবে কেন? আমাদের নাম ভাঙিয়েও তো অনেক ডাকাত ব্যাংক লুট করছে।
টুটুল এবার আসল প্রশ্ন করলো, তোমরা কখন ক্ষমতায় যাবে বড়দা?
আসিফ এক মুহূর্ত ভাবলো। তারপর যতটা সহজভাবে বলা যায় ওদের ক্ষমতায় যাবার ধাপগুলো বুঝিয়ে বললো। শেষে বললো, দিনক্ষণ দিয়ে বলা যাবে না ঠিক কখন ক্ষমতায় যাবো। শুধু এটুকু জেনে রাখো, মজুর-কৃষকরা যত দিন দেশকে চালাবার ক্ষমতা না পাচ্ছে তত দিন এ দেশের কোনো ভালো হতে পারে না। অবস্থা তো দেখতেই পাচ্ছে দিন-দিন খারাপ হচ্ছে। বিপ্লবের আগে রাশিয়া, চীন, ভিয়েতনাম, সব দেশেই এমন অবস্থা ছিলো। সে সব দেশে মজুর আর কৃষকরা দল বেঁধে পার্টি করে, লড়াই করে ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে। ওরা হচ্ছে সমাজের মূল শক্তি। ওরা ক্ষমতায় গেলেই দেশ সত্যিকার অর্থে এগুবে, কোনো মানুষ না খেয়ে থাকবে না, কোনো অন্যায় অবিচার শোষণ থাকবে না।
অনেক রাত পর্যন্ত ওরা পুকুরপাড়ে বসে গল্প করলো। পেতলের থালার মতো চাঁদটা যখন পাহাড়ের ওধারে নেমে গেলো তখন ওরা উঠলো। বাড়ির সবাই ততক্ষণে ঘুমিয়ে গেছে। ওদের জন্য বারান্দায় হারিকেন জ্বলছিলো।
রাতে ঘুমোবার আগে টুটুল বললো, বাড়ির জন্য তোমার কষ্ট হয় না বড়দা?
না, কষ্ট কীসের! কাজে ব্যস্ত থাকলে ওসব মনেই পড়ে না। একটু থেমে আসিফ বললো, এখন তো এটা আমার বাড়ি হলো। বাবা, মা, ভাই, বোন সবই পেলাম।
আমাদের ছেড়ে যাবে না তো বড়দা?
যেতেই হবে টুটুল। বাবা ঢাকা থেকে ফিরলেই যেতে হবে আমাকে। বলেছি না, পার্টির এখন ভীষণ বিপদ। এই বিপদে বন্ধুদের ছেড়ে নিরাপদ জায়গায় লুকিয়ে থাকবো, তা কি কখনো হয়!
টুটুল আর কোনো কথা বললো না। আসিফ চলে যাবে শুনে ওর কষ্ট হলো। একই সঙ্গে ওর জন্য শ্রদ্ধাও অনুভব করলো।
.
০৮. ঢাকায় বাবার ব্যস্ততা
বুধবার সকালে বাবা ঢাকা রওনা হলেন। আগের দিন বিকেলে মাসের বাজার করে দিয়ে গেছেন। বলেছেন, রোববারে ফিরবেন। সঙ্গে ট্রাকে করে জানু ফুপিদের বাড়িতে রাখা জিনিসপত্রের ভেতরে দরকারিগুলো নিয়ে আসবেন। কি-কি আনতে হবে মা ফর্দ করে দিয়েছেন। মিতুল বলেছে, ওর সাইকেলটা আনার জন্য আর ঝুমা বলেছে ওর দোলনাটা আনতে। স্ট্যাণ্ডসুদ্ধ বেশ বড় দোলনা বলে ওটা গতবার সঙ্গে আনা যায় নি। বাবা টুটুলকে জিজ্ঞেস করেছিলেন ওর কি লাগবে। টুটুল বলেছে, কিছু লাগবে না বাবা, শুধু তুমি সময়মতো ফিরে এসো।
বিদ্যুত্রা বাবার সঙ্গে চলে গেছে। টুটুলরা সবাই বলেছিলো আরো কদিন থাকতে। দিদা তো বিদ্যুতের মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই ফেললেন—তোমরা চলে গেলে আমার দিন কাটবে কি করে শানু! কখন উড়ো চিঠি আসে, কোন মেনিমুখো শয়তান কোথায় ওঁৎ পেতে আছে, এই দুধের বাচ্চাদের নিয়ে একা কীভাবে থাকবো! আমার বৌমা তো আরশোলা দেখলে ভয় পায়। আর আছে করমালি। ও যে কি বলে কিছুই তো বোঝ যায় না। কি হবে আমাদের।
বাবার দেরি হয়ে যাচ্ছিলো। মৃদু ধমকের গলায় বললেন, আহ্, মা যে কি আবোল-তাবোল বলো! আসিফ আর টুটুল বুঝি দুধের বাচ্চা হলো! করমালি একা বৌ নিয়ে এতকাল থাকে নি এখানে?
হেডমাস্টার বললেন, গরমের ছুটি পুরোটা আপনার সঙ্গে কাটাবো মা। দুদিন পরই স্কুল খুলছে। না গেলেই নয়। ছুটির দিন এসে খবর নিয়ে যাবো। আর আপনি না হয় হাটের দিনগুলোতে আপনার ছেলের সঙ্গে আমাদের বাড়িতে বেড়িয়ে যাবেন।
বিদ্যুৎ বললো, টুটুলদা, হাটের দিন কাকার সঙ্গে তুমিও চলে এসো।
টুটুল বললো, আর তুমি আসবে প্রত্যেক রোববারে।
দিদা তবু ফেঁত-ফোঁত করে কাঁদতে লাগলেন–কি যে মায়া ধরিয়ে গেলে শানু! হাবু, তাড়াতাড়ি ফিরিস। জানুকে বলিস কান্নাকাটি যেন না করে। কান্নাকাটি একদম সইতে পারি না আমি। ও যেন জামাই আর বাচ্চাদের নিয়ে এসে বেড়িয়ে যায়। বেয়ান যদি আসতে চায় বলিস আসতে পারে। আমার রাগ পড়ে গেছে। …
দিদা আরো অনেক কথা বলতেন। বাবা গাড়ি ছেড়ে দিলেন। টুটুলকে বললেন, কোনো সুসবিধে হলে খাগড়াছড়ি থেকে জানুদের বাসায় ট্রাঙ্কল কোরো।
মা বললেন, টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার আছে। মনে করে দুপুরে খেয়ে নিও।
মিতুল চেঁচিয়ে বললো, আমার সাইকেল বাবা।
ঝুমাও রিনরিনে গলায় চ্যাঁচালো–আমার দোলনা বাবা।
বাবা মৃদু হেসে গাড়ির মোড় ঘোরালেন।
গোলাবাড়িতে বিদ্যুৎদের নামিয়ে দেরি না করে চট্টগ্রাম রওনা হলেন। চট্টগ্রামে কিছুক্ষণ থেমে আসিফের লোকের সঙ্গে কথা বলে আবার একটানা গাড়ি চালিয়ে সন্ধ্যের আগে জানু ফুপিদের বাসায় এসে পৌঁছলেন। জানু ফুপি বাবাকে দেখেই ভ্যাক করে কেঁদে ফেললেন–দাদা, এ কী চেহারা হয়েছে তোমার! এত কালো হয়ে গেছে । শুকিয়ে গেছে। অসুখবিসুখ করে নি তো? মা ভালো আছে তো? আর সবাই–?
ফুপা বাড়িতে ছিলেন। বললেন, দাদাকে আগে বিশ্রাম নিতে দাও। খাওয়ার ব্যবস্থা করো। কান্নার কী আছে! দাদা থাকবেন তো কদিন।
রোববার ভোরে রওনা দেবো। জানু, আমরা সবই ভালো আছি। কান্না থামা তুই। মা পইপই করে বারণ করছেন, তুই যেন কান্নাকাটি না করিস। আমাকে এক গ্লাস লেবুর শরবত দে। একটু লবণও দিস।
ফুপা বললেন, তারপর বলেন দাদা, ওখানকার অবস্থা কী? আছেন কীভাবে?
জানু ফুপি শরবত আনতে যাচ্ছিলেন। বললেন, এখন কিছু বোলো না দাদা, আমি এসে শুনবো।
ফুপা অসহায় ভঙ্গিতে ঠোঁট বাঁকালেন। আর বাবা সেদিনকার খবরের কাগজে মন দিলেন।
দুটো আপেল আর লেবুর শরবত এনে বাবার সামনে রাখলেন জানু ফুপি–এবার বলো দাদা, যাবার দিন ভোরে গাড়ি ছাড়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত সব বলো।
বাবা হেসে বললেন, তুই যেভাবে শুনতে চাইছিস, এখন থেকে বলা শুরু করলে রোববার পর্যন্ত বলে শেষ করতে পারবো বলে তো মনে হয় না।
তোমার সব কিছুতে কেবল ঠাট্টা! না দাদা, প্লীজ, বলল না।
বাবা ঘড়ি দেখলেন, বিশ মিনিটের বেশি বলতে পারবো না। বলে বাবা তাঁদের কমলছড়ি পৌঁছানো, হেডমাস্টার পরিবারের সঙ্গে বন্ধুত্ব, গাছ কেটে দেড় শ মিস্ত্রি দিয়ে পনের দিনে বাড়ি বানানো, বনমোরগ শিকার করা সবই বললেন, শুধু উড়ো চিঠির কথা বাদ দিয়ে। আসিফের কথা বললেন এইভাবে, একটা ছেলেকে আমি দত্তক নিয়েছি।
তাই বুঝি! জানু ফুপি উৎসাহিত হয়ে বললেন, কত বড় বাচ্চা? হাঁটতে পারে, কথা বলতে পারে!
হাঁটতে পারে। কথা বলতে পারে। বাচ্চা বলা উচিত হবে না, যদিও মা তাই বলেন। ওর বয়স বাইশ-তেইশ বছর হবে। তোর বড় খোকা বেঁচে থাকলে যত বড় হতো।
বড় খোকার প্রসঙ্গ উঠতেই জানু ফুপি ফুঁপিয়ে উঠলেন, ওর কথা আর বোলো না। তোমার ছেলের কথা বলল। বাপ-মা নেই বুঝি! ভালো বংশের ছেলে তো?
বাবা-মা নেই। ভালো ছেলে। ইউনিভার্সিটিতে পড়ে।
মা কি বলেন?
মা তোর বড় খোকার আদল ওর ভেতর খুঁজে পেয়ে আহ্লাদে আটখানা হয়ে আছেন। দাঁড়া, ছবি দেখাবো তোদের। টুটুল তুলেছে সবার ছবি। আমাদের নতুন বাড়ির ছবিও। প্রিন্ট করে আনলে দেখিস।
শরবত খেয়ে একটা আপেল খেলেন বাবা। দেশের অবস্থা নিয়ে ফুপার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললেন। তারপর বাথরুমে গিয়ে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে বললেন, আমি একটু ঘুরে আসি। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে ফিরবো।
জানু ফুপি বললেন, বাইরে কোথাও খেয়ে না দাদা। আমি তোমার জন্য রান্না করছি।
ফুপা বললেন, জীপটাকে আপাতত বিশ্রাম দিন দাদা। আপনি আমার গাড়িটা নিয়ে যান। কাল বরং জীপটা সার্ভিসিঙের জন্য দেবো।
বাবা আপত্তি করলেন না। গাড়ি নিয়ে সোজা ওয়ারী গেলেন। আসিফের ঠিকানা দেয়া বাড়ি খুঁজে বের করলেন। এক ইকবাল আহমেদের নামে চিঠি দিয়েছে আসিফ, তাঁর নাম জিজ্ঞেস করে বাবা জানতে চাইলেন বাড়ি আছেন কি না। যে দ্রলোক দরজা খুলেছিলেন তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন, আপনি কে? কোত্থেকে এসেছেন?
আসিফ আমাকে একটা চিঠি দিয়ে পাঠিয়েছে। আসছি হিলট্র্যাক্ট থেকে। জরুরি কিছু কথা আছে ইকবাল সাহেবের সঙ্গে।
চিঠিটা দিন। আপনি এক-দেড় ঘণ্টা পরে আসুন। উনি এখানে থাকেন না। দেখি খবর পাঠানো যায় কি না।
বাবা চিঠিটা দিয়ে মনে-মনে হাসলেন। তিনি জানেন চিঠিতে আসিফ শুধু লিখেছে পত্রবাহক আমাদের একজন শুভানুধ্যায়ী। এখানকার সব খবর তাঁর কাছে পাবেন। করণীয় জানাবেন। নামের জায়গায় ওর পার্টির গোপন নাম লিখেছে। সাংকেতিক হরফে লেখা চিঠি। ইকবাল আহমেদ ছাড়া কেউ পাঠোদ্ধার করতে পারবে না।
এক ঘণ্টার জন্য কোথায় যেতে পারেন ভাবলেন বাবা। স্টুডিওতে টুটুলের ছবি প্রিন্ট করতে দিয়ে তাঁর বন্ধু কামালের কাছে যাবেন ঠিক করলেন।
স্টুডিওতে আরেক ঝামেলা। রোববারের আগে রঙিন ফিল্ম প্রিন্ট করতে পারবে না। বললো, তাড়া থাকলে আমাদের মোহাম্মদপুরের ল্যাবে যান। ওরা একদিনেও দিতে পারে।
তাই করলেন বাবা। ল্যাবের ওরা বললো, শনিবার বিকেলে যেতে। এরপর কাজী কামালের বাসা। ইনিও একজন ইঞ্জিনিয়ার। টুটুলের বাবার সহপাঠী ছিলেন। চাকরি করেন না। নিজের কনসাল্টিং ফার্ম আছে। ভদ্রলোক বাড়িতেই ছিলেন। টুটুলের বাবাকে দেখে হইচই করে উঠলেন–এই যে গ্রেট হিরো। তোর রেজিগনেশন নিয়ে যে হুলস্থুল কাণ্ড পড়ে গেছে। ইনস্টিটিউটের মীটিঙে আমি তুলেছিলাম। মিনিস্টার পর্যন্ত গড়িয়েছে। তাদের চীফ বদলি হয়ে গেছে। তোর অফিস তোকে রেজিগনেশন উইথড্র করার জন্য বলবে।
বাবা মৃদু হেসে বললেন, চীফ বদলি হলেই তো সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। সিস্টেমটাই যে নষ্ট হয়ে গেছে। চাকরি আর আমার পোষাবে না। তোদের স্পটির বাচ্চা দিতে চেয়েছিলি, নিতে এলাম। আছে তো, না বিলিয়ে দিয়েছিস?
দুটো নিতে পারিস। কিন্তু চাকরি করবি না বলছিস কেন? তোরই তো জিত হলো।
বাবা মাথা নাড়লেন। তাঁর বন্ধু বিরক্ত হয়ে বললেন, তোর উচিত গ্রামের স্কুলের হেডমাস্টার হয়ে নীতিশাস্ত্র পড়ানো। বল কি খাবি, ঠাণ্ডা না গরম?
বন্ধুর সঙ্গে ঘন্টাখানেক গল্প করে বাবা আবার ওয়ারীর সেই বাসায় এলেন। আগের সেই ভদ্রলোক দরজা খুললেন–আসুন বলে বাবাকে ভেতরের ঘরে নিয়ে বসালেন। তারপর নিজে বসলেন–বলুন, খবর কি?
বাবা একটু অবাক হয়ে বললেন, আমি তো ইকবাল সাহেব ছাড়া আর কারো সঙ্গে কথা বলবো না।
ভদ্রলোকের বয়স চল্লিশের কাছে। মাথায় বড়সড় একটা টাক। মৃদু হেসে বললেন, আমিই ইকবাল আহমেদ।
বাবা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন। কোনো ফাঁদে পড়লেন না তো? এমন তো হতে পারে ইকবাল আহমেদ গ্রেফতার হয়ে গেছেন? পুলিশের লোক অপেক্ষা করছে তাঁর কাছে কারা আসে জানবার জন্য? বাড়ির ভেতর দ্বিতীয় কোনো মানুষের সাড়াশব্দ নেই। পুরনো আমলের বাড়ি। ভদ্রলোক ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন। অত্যন্ত সতর্ক হয়ে বাবা বললেন, আপনি ইকবাল আহমেদ, প্রমাণ কি?
ভদ্রলোক এবার হেসে ফেললেন–আপনি আমাকে সন্দেহ করছেন। আপনার সতর্কতার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আপনি তো জানেন, আসিফ কোড ওয়ার্ডে চিঠি লিখেছে, যে কোড প্রাপক ছাড়া কেউ ভাঙতে পারবে না। চিঠি কি আপনাকে পড়ে শোনাবো? লাইনে চিঠি। আসল চিঠি তো আপনি।
বাবার মনে হলো এটা যথেষ্ট প্রমাণ নয়। ইকবাল যদি গ্রেফতার হয়ে থাকেন তাহলে হয়তো জোর করে ওঁকে দিয়ে চিঠি পড়িয়ে নিয়েছে। এক-দেড় ঘণ্টা সময় নিলো কেন তবে? বললেন, আর কোনো প্রমাণ আছে আপনি যে ইকবাল?
ভদ্রলোক এবার হতাশ হয়ে কাঁধ ঝাঁকালেন–আর কি প্রমাণ দেবো? একটু ভেবে বললেন, আসিফের চেহারার বর্ণনা দিলে চলবে? ওর বয়স বাইশ, রং ফর্সা, চিবুকের বাঁ পাশে একটা তিল আছে। খাড়া নাক, শার্প চেহারা, হাইট পাঁচ সাত। ওজন এক শ চল্লিশ পাউণ্ড। চোখের রং বাদামী। চুলের রং পুরো কালো নয়, একটু লালচে, সামান্য কোঁকড়া–চলবে এতে?
এবার বিশ্বাস হচ্ছে দ্রলোককে। বাবা তবু বললেন, তাহলে প্রথমে বললেন না কেন? সময় নেয়ার দরকার কি ছিলো?
দরকার ছিলো আপনাকে যাচাই করা। আসিফের চিঠি যাচাই করা। আপনি শত্রুপক্ষ কি না বুঝবো কি করে?
হেসে ফেললেন বাবা। যাকে শত্রুপক্ষ ভেবেছেন, উল্টো তিনি তাঁকে শত্রুপক্ষ ভাবছেন। আসিফ শুনলে হেসে খুন হবে। তারপর হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন। এরা যে কতখানি বিপদে পড়েছে, চট্টগ্রামে কিছুটা শুনেছেন। তে সতর্কতার পরও ধরা পড়ছে, এটাই আশ্চর্যের ব্যাপার। বাবা বললেন, চট্টগ্রামে পাঁচলাইশের তালুকদারের সঙ্গে দেখা করে এসেছি। তিনি বললেন, চট্টগ্রাম শহরের সবগুলো শেল্টার বাতিল করে দিতে হয়েছে। বান্দরবনের দুটো পার্টি ডেন বাতিল করতে হয়েছে। করিম ভাইরা পুরো দল নিয়ে রামুর দিকে সরে গেছেন। গত এক মাসে এগারো জন ধরা পড়েছে। মারা গেছে পাঁচজন। আসিফের সঙ্গে ছিলো অনুপম আর তারেক। ওরাও ট্র্যাপে পড়ে মারা গেছে। অল্পের জন্য বেঁচেছে আসিফ। আমার কাছে আছে। ওর পায়েও গুলী লেগেছিলো। তালুকদার বলেছেন, আসিফকে ঢাকা পাঠিয়ে দিতে। অবশ্য এ ব্যাপারে তিনি আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে বলেছেন।
বাবার কথা শুনে খুব বিচলিত হলেন ইকবাল আহমেদ–আসিফের জন্য ঢাকাও নিরাপদ নয়। ঢাকা থেকে আমাদের বরিশালে শিফট করতে হচ্ছে। বরিশালের চেইন আপনাকে দিচ্ছি। একমাস পরে আসিফ যেন সেখানে যোগাযোগ করে। আপাতত আপনার ওখানে না হয় অন্য কোনো শেল্টারে থাকুক। ঢাকা থেকে গত মাসে আমাদের পাঁচজন ধরা পড়েছে। এই বলে তিনি বরিশালের ঠিকানায় কীভাবে যোগাযোগ করতে হবে বাবাকে বললেন।
পঁচিশ মিনিট পর বাবা উঠলেন। ইকবাল আহমেদ দাঁড়িয়ে আন্তরিকভাবে হাত মেলালেন বাবার সঙ্গে। বললেন, আসিফকে চিন্তা করতে বারণ করবেন। সব ঠিক হয়ে যাবে। এটা একটা টেম্পোরারি সেটব্যাক।
বাড়ি ফিরে দেখেন, জানু ফুপি টেবিলে খাবার সাজিয়ে তার জন্য বসে আছেন। বাবা বললেন, জানু, তোর ভাবীর ফর্দমতো জিনিসপত্র সব তিন দিনের মধ্যে গুছিয়ে ফেল। রোববার ভোরেই ট্রাক রওনা হয়ে যাবে। এদিকে বিক্রিটিক্রি কিছু হলো?
ফুপা বললেন, যা যা বলেছিলেন সব বিক্রি করে ফেলেছি। ভারী ফার্নিচারের মধ্যে দুটো স্টীল আলমারি, দুটো ওয়ার্ডরোব, খাট, ড্রেসিং টেবিল আর দুই সেট সোফা আছে। আপনার ক্যাসেট ডেকটার দাম বারো হাজারের বেশি উঠলো না। কিনেছেন তো তিরিশে। সব মিলিয়ে হয়েছে আটত্রিশ হাজার ছয় শ।
মন্দ কি! খেতে-খেতে বাবা বললেন, আমি তিরিশ-পঁয়তিরিশের বেশি আশা করি নি। বেশিটা জানু নিয়ে নিস। ঈদে তোর জন্য শাড়ি কিনিস।
তুমি ক্ষেপেছো দাদা! এখন তোমার টাকার কত দরকার! যখন তোমার খামার চালু হবে, তখন না হয় দিও যা ইচ্ছে। এখন ওসব বললে কেঁদেকেটে অনখ করবো বলে দিলাম।
আঁতকে উঠে বাবা বললেন, প্লীজ জানু, আর নয়। আমার কথা উইথড্র করলাম। ফুপা শব্দ করে হাসলেন। জানু ফুপি লজ্জায় লাল হয়ে বললেন, কী যে করো দাদা!
ঢাকার বাকি তিন দিন অফিসের ঝামেলা মেটাতেই কাটলো। আসার পরদিন অফিসে গিয়েছিলেন প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের ব্যাপারটা তাড়াতাড়ি করার জন্য। নতুন চীফ ডেকে দারুণ খাতির করলেন। রেজিগনেশন লেটার উইথড্র করে চাকরিতে জয়েন করতে বললেন। এও বললেন, প্রমোশনের জন্য তিনি নিজে সুপারিশ করবেন।
বাবা তার মত জানিয়ে দিলেন। বিস্তর ঝুলোঝুলি চললো তিন দিন ধরে। শেষে ঠিক হলো বাবা পদত্যাগ পত্র তুলে নিয়ে চাকরি থেকে অবসর নেবেন। তাহলে অফিসের মানটা বজায় থাকে। কোন কাগজেও নাকি সড়ক বিভাগের দুর্নীতির প্রতিবাদে চাকরি থেকে তার পদত্যাগের খবর ছেপেছে। বুঝলেন, এটা কামাল ছাড়া আর কারো কাজ নয়।
অবসর নেয়াতে বাবার একটা লাভ হলো। তিনি পেনশন পাবেন। চীফ জানালেন, কাগজপত্র সব যত শিগগির পারেন রেডি করে ফেলবেন। বাবার ব্যাংকই যাতে টাকা তুলতে পারে, সে ব্যবস্থা তিনি করে দেবেন। আসার সময় আন্তরিকভাবে বাবার সাফল্য। কামনা করলেন তিনি।
শনিবার সন্ধ্যেবেলা কামাল সাহেবের বাসায় কুকুরের বাচ্চা আনতে যাওয়ার সময় বাবার খেয়াল হলো বন্দুকের ব্যাপারটা এ কদিন বেমালুম ভুলে ছিলেন। রাইফেল নয়, বন্দুক আরেকটা যে খুবই দরকার। বন্ধু কামালকে বললেন, জোগাড় করে দিতে। কামাল বললেন, কাল রোববার, সব বন্ধ। সোমবার দিনটা থেকে যা। লাইসেন্স, বন্দুক সব জোগাড় হয়ে যাবে।
একটু ইতস্তত করে বাবা আরো দুদিন থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। সন্ধের পর থেকে জানু ফুপি-ফোত-ফোঁত করে কাঁদছিলেন, বাবা চলে যাবেন বলে। বার-বার ফুপাকে বলছিলেন, আবার যে কবে আসবে দাদা তার কোনো ঠিক আছে?
বাবা বাড়ি ফিরে জানু ফুপিকে বললেন, যাওয়া দুদিন পিছিয়ে দিলাম জানু।
কান্নার মাঝখানে খবরটা শুনে জানু ফুপির মুখটা হাসিতে ভরে গেলো সত্যি বলছো দাদা?
হ্যাঁ, সত্যি! বাবাও হাসলেন–তবে কাল সকালে ট্রাক পাঠিয়ে দেবো চিঠি দিয়ে। নে ফ্যাঁচ-ফাঁচ না করে টুটুলের তোলা ছবি দেখ।
ছবি দেখে জানু ফুপি বললেন, এত সুন্দর বাড়ি বানিয়েছো দাদা! এ যে বিদেশি ক্যালেণ্ডারের ছবির মতো লাগছে! ফুপাকেও দেখালেন–দেখ, দেখ, মা কি রকম হাসছে! আমাদের একেবারে ভুলে গেছে। এই ছাগুলে দাড়িওলাটা কে দাদা?
ওর আমাদের কেয়ারটেকার করমালি, ভারি কাজের লোক!
ছবি দেখে তো মনে হচ্ছে ভালোই আছো দাদা।
বাবা মৃদু হাসলেন–রঙিন ছবিতে সবকিছু একটু বেশি সুন্দর মনে হয়।
বাবা ভাবলেন, টুটুল সব আনন্দের ছবি তুলেছে। কমলছড়ির ভয়ের কোনো ছবি নেই এতে। সে ছবি তোলাও সম্ভব নয়। পরদিন ভোরে দুটো ট্রাকে তোলা হলো স্টীলের দুটো আলমারি, দুটো ওয়ার্ডরোব, ড্রেসিং টেবিল আর সোফার আলগা কুশনগুলো। বাবা ভেবে দেখলেন, তাঁর কাঠের বাড়ির জন্য এই সোফাগুলো বেশি জমকালো আর ভারী হবে। বাথরুমের জন্য কিছু ফিটিংস কিনেছিলেন। সেগুলো গুছিয়ে তুললেন। গোলাপের টবের ভেতর থেকে বাছাই করে কয়েকটা নিলেন। আর নিলেন বিভিন্ন রঙের শখানেক বোগেনভিলিয়ার চারা। কাঁটাওয়ালা বোগেনভিলিয়ার লতা কাঁটাতারের বেড়ার ওপর তুলে দিলে বেড়াও মজবুত হবে আর বছরখানেকের ভেতর ফুলের মধ্যে কাঠের খুঁটির বেড়া ঢাকা পড়ে যাবে। কয়েকটা মুসায়েণ্ডা আর পাতাবাহারের গাছ নিলেন। কুকুরের বাচ্চা দুটো, এখন আর ঠিক বাচ্চা বলা যায় না, তিন মাস বয়স হয়েছে সামনে বসে যাবে। বাবা বার-বার বলে দিলেন, ওদের যেন সময়মতো দুধ-রুটি খাওয়ানো হয়।