০৭.
প্রথম কয়েকদিন রিটিন ক্লিওনের কথাগুলো নিজের ভেতর নানাভাবে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করল। ক্লিওনের কথা যদি সত্যি হয় তাহলে এই পৃথিবীর সবকিছু পূর্ব নির্ধারিত। কোনো না কোনোভাবে নির্ধারণ করা হয়ে আছে যে রিটিনকে ভবিষ্যতে কোনো একটা বিশেষ কাজ করতে হবে, সেই কাজটি যেন সে করতে পারে সেজন্যে প্রকৃতির তাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে! ভাবনাটিই অতি বিচিত্র, প্রকৃতি কেমন করে জানবে যে তাকে ভবিষ্যতে একটা কাজ করতে হবে? ভবিষ্যৎটি এখনো আসেনি কাজেই সেই বিশেষ কাজটি তাকে দিয়েই করাতে হবে সেটি কে বলেছে?
অনেক ভেবে ভেবে সে যখন এই বিচিত্র ধাঁধাটি সমাধান করতে পারল না তখন সে ব্যাপারটি ভুলে যাবার চেষ্টা করল। ধরে নিল কন্ট্রোল সেন্টারের মিশনে তার জীবন্ত ফিরে আসার ব্যাপারটি হচ্ছে একটি কাকতালীয় ঘটনা। এটি ছিল অস্বাভাবিক কম সম্ভাবনার একটি ঘটনা কিন্তু তারপরও সেটি ঘটে গেছে। ব্যাপারটি এভাবে মেনে নেয়ার পর রিটিনের পুরো ঘটনাটি ভুলে যাবার কথা ছিল কিন্তু কোনো একটি বিচিত্র কারণে রিটিন ঘটনাটি ভুলতে পারল না। সেই ভয়ংকর রাতটিতে যেকোনো মুহূর্তে সে গুলি খেয়ে মারা যেতে পারত কিন্তু তার মাথায় একটিবারও মৃত্যুভয় আসেনি। একবারও মনে হয়নি সে গুলি খেয়ে মারা যাবে, এই অতি বিচিত্র আত্মবিশ্বাসটি কেমন করে তার ভেতরে জন্ম নিয়েছিল? সত্যিই কি প্রকৃতির সাথে সাথে সেও বিশ্বাস করতে শুরু করেছে একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ শেষ না করা পর্যন্ত তার মৃত্যু নেই? সে এখন মারা যেতে পারে না? কী আশ্চর্য!
কন্ট্রোল সেন্টারে মিশনটি শেষ করার কারণে খুব বড় একটা লাভ হয়েছে বলে মনে হলো। ক্যাটাগরি সি মানুষের দলটি বিশাল একটি তথ্যভান্ডার সংগ্রহ করতে পেরেছে, যেটি অন্য কোনোভাবে সংগ্রহ করা সম্ভব ছিল না। উপরের দিকের নেতৃস্থানীয় মানুষেরা খুবই উত্তেজিত। ঠিক কী ধরনের তথ্য পেয়েছে সেটি রিটিন কিংবা রিটিনের মতো মানুষেরা কিছুই জানে না। সম্ভবত জানার দরকারও নেই–যদি কখনো জানার দরকার হয় নিশ্চয়ই জানিয়ে দেবে। রিটিন তারপরও একদিন সেটা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করল।
ডাইনিং টেবিলে আরেক দিন ক্লিওন খাবারের ট্রে নিয়ে রিটিনদের টেবিলে এসে বসল। আগেরবারের মতো ক্লিওন এবারেও খাবারের মান নিয়ে নানা ধরনের কথা বলল এবং একসময় তারা কে
কী করছে সেটা জানতে চাইল। রিটিন নিজের কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করল, “কন্ট্রোল সেন্টারের মিশন শেষ করে আমরা অনেক তথ্য পেয়েছি। সেগুলো কী ধরনের তথ্য আমাদের বলবে?”
ক্লিওন বলল, “এই তথ্যগুলো আসলে গোপন, তোমাদের জানার কথা নয়। কিন্তু তুমি যেহেতু জিজ্ঞেস করেছ বলি–”
রিটিন প্রস্তুত হয়ে বলল, “না না। গোপন হলে আমাদের বলতে হবে না। আমি বুঝতে পারিনি।”
ক্লিওন শুকনো এক টুকরো রুটি স্যুপে ভিজিয়ে নরম করে চিবুতে চিবুতে বলল, “তোমার কারণে আমরা এই তথ্যগুলো পেয়েছি, তাই তোমার নিশ্চয়ই জানার অধিকার আছে।”
টেবিলে দাঁড়ানো অন্যেরা দ্রতা করে উঠে দাঁড়িয়ে অন্য টেবিলে চলে যেতে চাইল যেন ক্লিওন নিরিবিলি রিটিনের সাথে কথা বলতে পারে, ক্লিওন হাত তুলে তাদের থামাল। বলল, “তোমরাও শুনতে পারবে। কোনো গুরুতর অন্যায় হয়ে যাবে না। তা ছাড়া কেউ যদি বুদ্ধিমান হয় তাহলে নিজেরাই চিন্তা করে এগুলো বের করে ফেলতে পারবে।”
রিটিনের পাশে বসে থাকা মেয়েটি হেসে বলল, “আমাদের মাঝে সেরকম বুদ্ধিমান কেউ আছে বলে মনে হয় না।”
ক্লিওন হাসল, বলল, “আছে, নিশ্চয়ই আছে। যাই হোক কন্ট্রোল সেন্টারের ওয়েভ গাইড দিয়ে নিরাপত্তা নিয়ে তথ্য আদান প্রদান করে। কাজেই বেশির ভাগ তথ্য নিরাপত্তা নিয়ে। কোথায় কোথায় নিয়ন্ত্রণ ভবন আছে সেগুলো আমরা মোটামুটি জানতাম এখন পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েছি।”
রিটিনের পাশে বসে থাকা মেয়েটি জিজ্ঞেস করল, “আমরা শুনেছি মূল যে নিয়ন্ত্রণ ভবন সেটি থার্মো নিউক্লিয়ার বোমা দিয়েও ধ্বংস করা যায় না? শুধুমাত্র পৃথিবী ধ্বংস হলেই সেটা ধ্বংস হবে?”
ক্লিওন মাথা নাড়ল। বলল, “তোমরা ঠিকই শুনেছ। মূল ভবনটি আসলেই এরকম। মনে হয় পৃথিবীটা ধ্বংস হলেও এই ভবনটি ধ্বংস হবে না।”
রিটিন বলল, “এর ভেতরে যারা থাকে তারা বের হয় কেমন করে?”
ক্লিওন বলল, “বের হয় না। ওটার ভেতরেই তাদের জীবন।”
“তাহলে নিশ্চয়ই রোবট?”
“না। রোবট না। মানুষ। যারা মানুষের মাঝে বিভাজন করেছে তারা নিশ্চয়ই মানুষ।”
আলোচনার এই পর্যায়ে মানুষে মানুষে বিভাজন, পৃথিবীর সমাজব্যবস্থা, পৃথিবীর ইতিহাস এরকম একটা আলোচনা শুরু হয়ে গেল। রিটিন একধরনের বিস্ময় নিয়ে অবিষ্কার করল ক্লিওনের ভেতরে কোনো কিছু নিয়ে কোনো ক্ষোভ নেই। সে সবকিছুকে মেনে নিতে পারে এবং সবকিছু মেনে নিয়েও তার বিরুদ্ধে একটা যুদ্ধ করে যেতে পারে। রিটিন অবাক হয়ে ভাবল সে যখন ক্লিওনের বয়সে পৌঁছাবে তখন সেও কি ক্লিওনের মতো বুকের ভেতর থেকে সব ক্ষোভ, সব প্রতিহিংসা দূর করে দিতে পারবে?
খাবার শেষ করে ক্লিওন উঠে যাবার আগে রিটিন জিজ্ঞেস করল, “কন্ট্রোল সেন্টার ধ্বংস হবার পর আমরা কি আর কোনো তথ্য পেয়েছি?”
ক্লিওন মাথা নাড়ল, বলল, “পেয়েছি। আমরা গবেষণার অনেক তথ্য পেয়েছি। কিন্তু সেগুলো বেশির ভাগ আমরা ব্যবহার করতে পারব না।”
“সময় পরিভ্রমণ নিয়ে কোনো তথ্য?”
“হ্যাঁ পেয়েছি। কেন?”
রিটিন একটু লজ্জা পেয়ে গেল, লাজুক মুখে বলল, “সময় পরিভ্রমণ নিয়ে আমার খুব কৌতূহল। আমার এই বিষয় নিয়ে কাজ করার খুব শখ।”
ক্লিওন শব্দ করে হাসল। হেসে বলল, “একজন মানুষের শখ কখনো অপূর্ণ রাখতে হয় না। বিশেষ করে তোমার শখ অবশ্যই আমাদের পূরণ করতে হবে। তুমি হচ্ছ বিশেষ মানুষ, প্রকৃতি তোমাকে নিজের হাতে রক্ষা করে”
হঠাৎ করে ক্লিওন মাথা ঘুরিয়ে রিটিনের দিকে তাকাল। তার চোখে-মুখে হঠাৎ করে এক সাথে বিচিত্র একধরনের উত্তেজনা এবং অবিশ্বাস উঁকি দিয়ে যায়। রিটিন বুঝতে পারল ক্লিওন তার ভেতরকার এই অনুভূতিটি জোর করে চেপে রাখার চেষ্টা করেছে। সে কয়েক সেকেন্ড বিস্ফারিত দৃষ্টিতে রিটিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর অনেকটা জোর করে রিটিন থেকে নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিল এবং একধরনের হতবিহ্বলভাবে খাবারের খালি ট্রে হাতে নিয়ে বের হয়ে গেল।
রিটিনের পাশে বসে থাকা মেয়েটি অবাক হয়ে রিটিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “কী হলো? হঠাৎ করে ক্লিওন এত বিচলিত হলো কেন?”
রিটিন মাথা নাড়ল, বলল, “জানি না।”
.
ক্লিওন হঠাৎ করে কেন এমনভাবে বিচলিত হয়েছিল সেটি অবশ্যি রিটিন সেদিন বিকেলবেলাতেই জানতে পারল। একজন এসে তাকে আবাসস্থালের শেষ মাথায় দুর্ভেদ্য অংশটুকুতে ডেকে নিয়ে গেল। নিরাপত্তার তিনটি স্তর পার হওয়ার পর একটা মাঝারি কনফারেন্স রুমে হাজির হয়ে রিটিন আবিষ্কার করে একটা গোল গ্রানাইটের টেবিলকে ঘিরে বেশ কয়েকজন বসে আছে, একটা চেয়ার আলাদাভাবে তার জন্যে খালি করে রাখা আছে। যারা বসে আছে তাদের মাঝে রিটিন শুধু ক্লিওনকে চিনতে পারল, অন্যেরা সবাই ক্লিওনের বয়েসী কিংবা তার থেকেও বৃদ্ধ কিন্তু তাদের কাউকে সে আগে দেখেছে বলে মনে করতে পারল না। কিন্তু দেখেই বোঝা যাচ্ছে ক্যাটাগরি সি মানুষদের সংগ্রামে এরা সবাই বড় বড় দায়িত্বে থাকে।
ক্লিওন রিটিনকে বলল, “রিটিন, তুমি বসো। তোমার সাথে জরুরি কথা আছে।”
সবাই স্থির দৃষ্টিতে রিটিনের দিকে তাকিয়ে আছে, রিটিন একধরনের অস্বস্তি অনুভব করে। সে জোর করে অস্বস্তিটুকু কাটিয়ে তার জন্য আলাদা করে রাখা চেয়ারটাতে বসল।
ক্লিওন তার সামনে রাখা একটা ফ্লাক্স থেকে খানিকটা পানীয় একটা গ্লাসে ঢেলে গ্লাসটা তার দিকে ঠেলে দিয়ে বলল, “নাও খাও। এটা তোমার স্নায়ুকে শীতল করবে। আমরা এখন তোমাকে যেটা বলব সেটা শোনার জন্যে তোমার স্নায়ুকে শীতল রাখতে হবে।”
রিটিন পানীয়ের গ্লাসটি হাতে নিয়ে ইতস্তত করে বলল, “আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। কী হয়েছে?”
“বলছি। তার আগে পানীয়টাতে চুমুক দাও। সত্যি সত্যি তোমার স্নায়ু শীতল রাখা দরকার। আমরা সবাই আমাদের পানীয় খাচ্ছি।”
রিটিন তার পানীয়তে চুমুক দিল এবং সত্যি সত্যি তার শরীরে আরামদায়ক এক ধরনের শীতলতা ছড়িয়ে পড়ল। রিটিন দ্বিতীয়বার পানীয়টিতে চুমুক দিয়ে ক্লিওনের দিকে উৎসুক চোখে তাকাল।
ক্লিওন বলল, “আমি তোমাকে এখন একটি ছবি দেখাব। সত্যি ছবি। ছবিটি দেখে তোমার বলতে হবে ছবিটি কার।”
রিটিনের কাছে ক্লিওনের কথাগুলো একধরনের হেঁয়ালির মতো মনে হলেও সে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে থাকে। ক্লিওন তার সামনে অদৃশ্য মনিটরটি স্পর্শ করতেই দেয়ালে একটা ছবি ফুটে উঠল, সাদা কালো একটি ছবি। ছবিতে রিটিন হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে, তার কোলে একটি চার-পাঁচ বছরের শিশু, পাশে একটি হাসিখুশি তরুণী।
ক্লিওন জিজ্ঞেস করল, “চিনতে পারছ?”
রিটিন অনিশ্চিতের মতো বলল, “হ্যাঁ, চিনতে পেরেছি। এটি আমার ছবি। কিন্তু এই ছবিটি আমি কখন তুলেছি মনে করতে পারছি না। এই মেয়েটি কে আমি জানি না–শিশুটি কে সেটাও জানি না।”
ক্লিওন বলল, “তুমি এই মেয়েটিকে চিনবে না, শিশুটিকেও চিনবে না কারণ তোমার সাথে এখনো তাদের দেখা হয়নি। ছবিটি কখন তোলা হয়েছে তুমি সেটিও জানো না কারণ ছবিটিও এখনো তোলা হয়নি। তবে ছবিটি তোলা হবে।”
রিটিন ইতস্তত করে বলল, “ভবিষ্যতে কখনো আমি এই ছবিটি তুলব? তোমরা ভবিষ্যতের একটা ছবি এখন পেয়ে গেছ?”
ক্লিওন মাথা নাড়ল, বলল, “তোমার প্রশ্নের উত্তর একই সাথে হ্যাঁ এবং না। হ্যাঁ–তুমি তোমার জীবনের ভবিষ্যতে এই ছবিটি তুলবে এবং না–ভবিষ্যতে কখনো এই ছবিটি তোলা হবে না। এই ছবিটা তোলার জন্যে তুমি আজ থেকে পাঁচশত বছর অতীতে যাবে। সেভাবে দেখলে বলা যায় ছবিটা তোলা হয়ে গেছে! পাঁচশ বছর আগে এই ছবিটি তোলা হয়ে গেছে! আমরা পুরাতন আর্কাইভে এই ছবিটি পেয়েছি! এই ছবিটি বহুদিন আগে আমাদের কাছে পাঠানো হয়েছে। কে পাঠিয়েছে কেন পাঠিয়েছে আমরা জানতাম না। এখন আমরা অনুমান করছি”
রিটিন কাঁপা গলায় বলল, “আমি পাঠিয়েছি তোমাদের কাছে?”
“হ্যাঁ। তুমি পাঠিয়েছ আমাদের কাছে। যেন আমরা এটা পাই এবং বুঝতে পারি সময় পরিভ্রমণের সর্বশেষ যে তাত্ত্বিক গবেষণাটি এসেছে সেটি সত্যি। সেটি ব্যবহার করে সত্যি সত্যি সময় পরিভ্রমণ করে অতীতে যাওয়া সম্ভব।”
রিটিনের মাথাটি হঠাৎ কেমন জানি ঝিমঝিম করতে থাকে। সে পরিষ্কার করে কিছু চিন্তা করতে পারে না। হাতের গ্লাসে যেটুকু পানীয় ছিল সে এক টেকে পুরোটুকু শেষ করে দিয়ে বলল, “তার মানে সময় পরিভ্রমণ করে আমি অতীতে যাব?”
“হ্যাঁ রিটিন, সময় পরিভ্রমণ করে তুমি অতীতে যাবে।”
“কেন যাব সেটা কি আমরা জানি?”
ক্লিওনের পাশে বসে থাকা ধবধবে সাদা চুলের বৃদ্ধমানুষটি এবারে রিটিনের প্রশ্নের উত্তর দিল। বলল, “না, আমরা এখনো পুরোপুরি জানি না। শুধু অনুমান করতে পারি।”
“কী অনুমান করেছ?”
“তুমি যাবে নিয়ন্ত্রণ ভবন ধ্বংস করতে।”
রিটিন চোখ বড় বড় করে তাকাল, বলল, “যে নিয়ন্ত্রণ ভবন থার্মো নিউক্লিয়ার বোমা দিয়ে ধ্বংস করা যায় না, পৃথিবী ধ্বংস হলেও যেটা ধ্বংস হবে না, আমি সেটা ধ্বংস করব?”
“হ্যাঁ।”
“কীভাবে?”
“কারণ তুমি কিছু বিস্ফোরক নিয়ে এই ভবনটির ভেতর হাজির হবে। বাইরে থেকে ভবনের ভেতর ঢোকা যাবে না–কিন্তু যেখানে ভবনটি তৈরি হবে তুমি সেখানে হাজির থাকবে।”
“আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।” রিটিন অসহায়ের মতো মাথা নাড়ল, বলল, “আমি কিছু বুঝতে পারছি না।”
রিটিনের কাছাকাছি বসে থাকা মধ্যবয়সী একজন মহিলা কোমল গলায় বলল, “তোমার এখন কিছু বুঝতে হবে না রিটিন। যখন বোঝার সময় হবে তখন বুঝলেই হবে। আমরাও এখনো সবকিছু বুঝে উঠতে পারিনি।”
রিটিন হঠাৎ সোজা হয়ে বসে বলল, “কিন্তু, কিন্তু–”
“কিন্তু কী?”
“সময়ে যদি সত্যি পরিভ্রমণ করা সম্ভব হয় তাহলে আমি যদি অতীতে গিয়ে আমার বাবাকে কিংবা মাকে খুন করে ফেলি তাহলে আমার জন্ম হবে কেমন করে?”
ক্লিওন বলল, “সময় পরিভ্রমণ নিয়ে শেষ যে তত্ত্বটি আমরা পেয়েছি সেখানে এর ব্যাখ্যা দেয়া আছে। আমরা পুরোটা এখনো বুঝতে পারিনি। জটিল জটিল সমীকরণ দিয়ে যেটা ব্যাখ্যা করা হয়েছে সেটা হচ্ছে, সময় পরিভ্রমণ করে তুমি নিকট অতীতে যেতে পারবে না যেখানে তুমি নিজের ভবিষ্যৎকে পরিবর্তন করতে পারো। চেষ্টা করলে ভয়ংকর কিছু ঘটবে। তোমাকে যেতে হবে দূর অতীতে যেন কোনো পরিবর্তন করলেও তার প্রভাব তোমার ভবিষ্যতে চলে আসে। অর্থাৎ তুমি যদি যথেষ্ট অতীতে গিয়ে তোমার কোনো পূর্বপুরুষকে হত্যা করো তারপরও তোমার জন্ম হবে অন্য কোনো পূর্বপুরুষ দিয়ে–”
রিটিন ভয় পাওয়া গলায় বলল, “তাহলে সবকিছু পূর্ব নির্ধারিত?”
রিটিনের বিপরীতে বসে থাকা একজন বৃদ্ধ বলল, “এই প্রশ্নটির কোনো অর্থ নেই। যদি পূর্ব নির্ধারিত হয়েও থাকে আমরা সেটা জানি শুধুমাত্র সেটা ঘটার পর। কাজেই পূর্ব নির্ধারিত হওয়া না হওয়ায় জগৎ সংসারের কোনো ক্ষতি বৃদ্ধি হয় না!”
রিটিন একধরনের শূন্য দৃষ্টিতে মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর শুকনো গলায় বলে, “এখন তোমরা কী করবে?”
ক্লিওন বলল, “আমরা তোমাকে অতীতে পাঠাব রিটিন। অতীতে একটি মেয়ে তোমার জন্যে অপেক্ষা করে আছে।”
মধ্যবয়স্ক মহিলাটি নিচু গলায় বলল, “শুধু সে জানে না যে সে তোমার জন্যে অপেক্ষা করে আছে।”
রিটিন দেয়ালে বড় ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকে। হাসিখুশি একটি মেয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই চোখে কোনো প্রশ্ন নেই, কোনো ক্ষোভ নেই, অভিযোগ নেই, সেই চোখে শুধু বিস্ময়কর এক সারল্য।
রিটিন হঠাৎ করে এই অপরিচিত মেয়েটির জন্যে তার বুকের ভেতর গভীর এক ধরনের মমতা অনুভব করে।
.
০৮.
প্রফেসর রাইখ চমকে উঠে দেখলেন তার সামনে একটা ছোট বাইভার্বাল থেমেছে। সে স্পেস টাইমের যে সমীকরণটির সমাধান তার মস্তিষ্কের ভেতর প্রায় শেষ করে এনেছিল সেটি এলোমেলো হয়ে গেল। প্রফেসর রাইখ খুব বিরক্ত হয়ে বাইভার্বালটির দিকে তাকাল এবং দেখল তার দরজা খুলে ভেতর থেকে কম বয়সী একজন তরুণ নেমে এসেছে। তরুণটি যে রিটিন, প্রফেসর রাইখের সেটি জানার কোনো উপায় ছিল না।
রিটিন প্রফেসর রাইখের দিকে কয়েক পা এগিয়ে হাসি হাসি মুখে বলল, “শুভসন্ধ্যা প্রফেসর রাইখ। আমি তোমাকে নিতে এসেছি।”
রিটিনের কথা শুনে প্রফেসর রাইখের বিরক্তি চরম পর্যায়ে পৌঁছাল। সে জ কুঁচকে বলল, “আমি নিজে নিজে আমার বাসায় যেতে পারব। কাউকে আমাকে নিয়ে যেতে হবে না।”
রিটিন তার মুখের হাসিটি আরেকটু বিস্তৃত করে বলল, “তুমি আমার কথাটি ঠিক বুঝতে পারোনি। আমি তোমাকে জোর করে ধরে নিয়ে যেতে এসেছি।”
প্রফেসর রাইখ অত্যন্ত বুদ্ধিমান মানুষ, সে সাথে সাথে বিপদটুকু আঁচ করতে পারল। মুখে একটা শান্তভাব ফুটিয়ে বলল, “তুমি নিশ্চয়ই এরকম একটি কাজ করবে না। কেন আমাকে ধরে নিতে এসেছ আমি জানি না, কিন্তু আমি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তায় আছি–আমাকে ধরে নিয়ে তুমি হজম করতে পারবে না।”
রিটিন বলল, “তোমাকে কে বলেছে আমি তোমাকে হজম করতে চাই। আমি তোমাকে খানিকটা ব্যবহার করতে চাই।”
“জোর করে কাউকে ব্যবহার করা যায় না।”
“কে বলেছে তোমাকে আমি জোর করে ব্যবহার করব? আমাদের কাছে তোমার জন্যে এমন চমকপ্রদ একটি সমস্যা আছে যে, দেখবে সেটা সমাধান করার জন্যে তুমি রীতিমতো পাগল হয়ে যাবে!”
রিটিন এবার দুই পা এগিয়ে গিয়ে খপ করে প্রফেসর রাইখকে ধরে ফেলল, তারপর বলল, “এখানে সময় নষ্ট করা খুব বুদ্ধিহীন মানুষের কাজ হবে। তোমাকে রক্ষা করার জন্যে মনে হয় নিরাপত্তা বাহিনী ড্রোন আর বাইভার্বালের বহর রওনা দিয়ে দিয়েছে।” কথা শেষ করে রিটিন হ্যাঁচকা টান দিয়ে প্রফেসর রাইখকে বাইভার্বালের উপরে তুলে ফেলল। ড্রোনের দরজাটি সাথে সাথে বন্ধ হয়ে উপরে উঠে গেল।
প্রফেসর রাইখ বলল, “তুমি নিতান্তই নির্বোধ। তুমি বুঝতে পারছ না আগামী পনেরো মিনিটের ভেতর তুমি মারা পড়বে।”
রিটিন বাইভার্বালের কন্ট্রোল প্যানেলে হাত রেখে স্বাভাবিক গলায় বলল, “আমি তোমার কথা অবিশ্বাস করছি না। আমি সম্ভবত যথেষ্ট নির্বোধ। কিন্তু তুমি একটা জায়গায় ভুল করছ। আমি মারা পড়ব না। আমাকে পৃথিবীর কেউ হত্যা করতে পারবে না। সময় পরিভ্রমণ করে আমি আনুমানিক পাঁচশ বৎসর অতীতে যাব, আমি যে গিয়েছিলাম তার প্রমাণ আছে। কেউ আমাকে মেরে ফেললে আমি কেমন করে যাব? তাই এখন কেউ আমাকে মারতে পারবে না। প্রকৃতি আমাকে রক্ষা করছে।”
প্রফেসর রাইখ বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠল। তাকে জোর করে ধরে নিয়ে আসার আগে সে স্পেস টাইমের ঠিক এই সমস্যার একটি সমাধান বের করার চেষ্টা করছিল–তবে সেটি জীবন্ত একটি মানুষকে নিয়ে নয়, এক জোড়া ইলেকট্রন পজিট্রন নিয়ে। প্রফেসর রাইখ অবিশ্বাসের গলায় বলল, “কী বলছ তুমি?”
“আমি সত্যি কথা বলছি। তুমি কিছুক্ষণের ভেতর নিজেই দেখতে পাবে।”
“তোমরা কারা?”
“আমরা ক্যাটাগরি সি মানুষ! তুমি যেহেতু বড় প্রফেসর জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা করো তাই ধরে নিচ্ছি তুমি ক্যাটাগরি এ মানুষ।”
“অবশ্যই আমি ক্যাটাগরি এ।”
রিটিন হাসল, বলল, “পদার্থবিজ্ঞানে তোমার যথেষ্ট জ্ঞান থাকলেও মানবসমাজ বা পৃথিবীর ইতিহাস নিয়ে তুমি বিশেষ কিছু জানো না। মানুষের ভেতর এই ক্যাটাগরি এ এবং সি বিভাজনের পুরো ব্যাপারটা আসলে ভুয়া। তোমার আর আমার মাঝে আসলে কোনো পার্থক্য নেই।”
প্রফেসর রাইখ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “আছে। আমাদের মস্তিষ্কের গঠন এবং তোমাদের মস্তিষ্কের গঠনে মৌলিক পার্থক্য আছে। নিউরনের সংখ্যায় পার্থক্য আছে। তাদের সিনান্স সংখ্যায় পার্থক্য আছে। কাজেই চিন্তা করার ক্ষমতার পার্থক্য আছে!”
“তোমাদেরকে সেটা বোঝানো হয়েছে। সেটা সত্যি নয়, আমাদের সুযোগ না দেয়ার কারণে আমরা আস্তে আস্তে পিছিয়ে পড়েছি তার বেশি কিছু নয়।”
“ক্যাটাগরি এ মানুষের মস্তিষ্কের গঠন নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা হয়েছে।”
“আমি তোমার সাথে তর্ক করব না। খুব সহজ একটা প্রশ্ন করি। আমি ক্যাটাগরি সি মানুষ। আমার পক্ষে কি রিকি ভাষা শেখা সম্ভব?”
প্রফেসর রাইখ একটু অবাক হয়ে রিটিনের দিকে তাকাল, “তুমি রিকিভ ভাষা জানো?”
“হ্যাঁ জানি। আমাকে কেউ শেখায়নি–আমি স্কুল কলেজ যেতে পারিনি কিন্তু আমি নিজে নিজে শিখেছি। বিশ্বাস না করলে রিকিভ ভাষার সিংগুলারিটিগুলো জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো-–কমপ্লেক্স তলে সেটি কীভাবে অসিলেট করে জিজ্ঞেস করতে পারো।”
প্রফেসর রাইখ বলল, “আমি তোমাকে বিশ্বাস করছি। সিংগুলারিটিগুলো কীভাবে অসিলেট করে বিষয়টা কেউ যদি জানে তাহলে সে আসলেই রিকিভ ভাষা জানে।”
“রিকভ ভাষা জানার কারণে আমি যেকোনো রোবটের মেটাকোড বের করে ফেলতে পারি। আমার সামনে কোনো রোবট নিরাপদ নয়।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ সত্যি। আমি একজন মাত্র উদাহরণ। খারাপ উদাহরণ। আমার থেকে অনেক ভালো উদাহরণ আছে। আরো কয়েক বছর পরে হলে তোমাকে জোর করে ধরে নিতে হতো না। আমাদের নিজেদেরই একজন ক্যাটাগরি সি প্রফেসর রাইখ পেয়ে যেতাম।”
“আমাকে কী করতে হবে?”
“আমরা একটা সমীকরণ পেয়েছি। কীভাবে পেয়েছি জিজ্ঞেস কোরো না। সমীকরণটির সমাধান করে দেবে।”
“সমীকরণ সমাধান করে দেব?”
“হ্যাঁ। সমাধান করার পর আমি নিজে এসে তোমাকে তোমার বাসায় পৌঁছে দেব।”
রিটিন কথা শেষ করার আগেই একটি গুলি বাইভার্বাল ভেদ করে চলে গেল। প্রফেসর রাইখ আতঙ্কে চিৎকার করে মাথা নিচু করে বসে গেল, রিটিন শব্দ করে হেসে বলল, “তোমার কোনো ভয় নেই। তোমার ট্র্যাকিওশান তোমাকে রক্ষা করবে। নিরাপত্তাকর্মীরা কখনোই তোমাকে গুলি করবে না। আমাকে রক্ষা করবে প্রকৃতি।” কথা শেষ করে রিটিন বাইভার্বালটিকে একটি ভয়ংকর ঘূর্ণন দিয়ে নিচে নামাতে থাকে।
প্রফেসর রাইখ চিৎকার করে বলল, “এখন কী হবে?”
”কিছু হবে না। তুমি ভয় পেয়ো না। আমরা জানি এটা ঘটবে। আমাদের মানুষেরা নিরাপত্তাকর্মীদের সরিয়ে নেবে, আমরা আমাদের এলাকায় পৌঁছে যাব।”
“তুমি কেমন করে জানো?”
“এটা সেভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছে। তোমার ধারণা হতে পারে ক্যাটাগরি সি মানুষ বুদ্ধিহীন নির্বোধ–কিন্তু আসলে আমরা যথেষ্ট বুদ্ধিমান। সত্যি কথা বলতে কি আমাদের বাস্তব বুদ্ধি তোমাদের থেকে অনেক বেশি!”
আরো কয়েক পশলা গুলি বাইভার্বাল ভেদ করে গেল, তারপর হঠাৎ সবকিছু শান্ত হয়ে গেল। রিটিন খুশি খুশি গলায় বলল, “এখন আমরা নিশ্চিন্তে আমাদের আস্তানায় যেতে পরি। তার আগে তোমাকে একটা কাজ করতে হবে।”
“কী করতে হবে?”
“তোমাকে এই ক্যাপসুলের মাঝে ঢুকতে হবে–”
“ক্যাপসুল? কিসের ক্যাপসুল?”
“তোমার শরীরে একটা ট্র্যাকিওশান আছে, সেটা থেকে তোমাকে ট্র্যাক করা সম্ভব।”
প্রফেসর রাইখ অবাক হয়ে বলল, “তোমার শরীরে নেই?”
“না। আমরা প্রথমেই একটা জঞ্জালের মতো এটাকে ফেলে দিই।”
“কী আশ্চর্য!”
“আশ্চর্যের কিছু নয়। প্রফেসর রাইখ, তুমি ক্যাপসুলের মাঝে ঢোকো।”
প্রফেসর রাইখ ক্যাপসুলটি দেখে চিৎকার করে বলল, “না। আমি ঢুকব না। এই ছোট ক্যাপসুলের মাঝে আমি ঢুকব না–”
রিটিন মুখ হাসি হাসি করে বলল, “তুমি না ঢুকলে আমি তোমাকে জোর করে ঢোকাব, তুমি বলো, তুমি কি সেটা চাও।”
প্রফেসর রাইখ চোখ দিয়ে আগুন ছড়িয়ে ক্যাপসুলের ভেতর ঢুকল। ক্যাপসুলটা বন্ধ করতেই প্রফেসর রাইখের দুই চোখ বন্ধ হয়ে গেল।
.
কয়েক ঘণ্টা পর প্রফেসর রাইখকে সময় পরিভ্রমণসংক্রান্ত সমীকরণটি দেয়া হলো। সমীকরণটি দেখে প্রফেসর রাইখ কিছুক্ষণ ভ্রূ কুঞ্চিত করে রাখল, তারপর মাথা ঝুঁকিয়ে সমীকরণটি ভালো করে দেখল, তারপর হঠাৎ করে তার চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল। সে ভিডি টিউবে কিছু সংখ্যা লিখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর মাথার চুলে হাত ঢুকিয়ে চোখ বন্ধ করে গভীরভাবে চিন্তা করতে থাকে।
গভীর রাতে রিটিন ঘুমাতে যাওয়ার আগে প্রফেসর রাইখের ঘরে উঁকি দিল। তার টেবিলের পাশে খাবারের ট্রে, প্রফেসর রাইখ সেগুলো স্পর্শ করেনি। শুধুমাত্র পানীয়ের বোতলটি খালি, সেখান থেকে পানীয়টুকু খেয়েছে। প্রফেসর রাইখ গভীর মনোযোগ দিয়ে ভিডি স্ক্রিনের স্বচ্ছ মনিটরটির দিকে তাকিয়ে আছে, এক হাতে মাথার চুল খামচে ধরেছে। মুখ কঠিন, দেখে মনে হয় সে বুঝি অত্যন্ত নিষ্ঠুর একটি কাজ করতে যাচ্ছে–এই মানুষটির চিন্তা করার পদ্ধতিটি অত্যন্ত চমকপ্রদ। রিটিন একবার ভাবল প্রফেসর রাইখকে কিছু একটা খেয়ে নিতে বলবে, শেষ পর্যন্ত কিছু বলল না। এই মানুষটির চিন্তার প্রক্রিয়ায় সে কোনো রকম বিচ্যুতি ঘটাতে চায় না।
ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে রিটিন আবার প্রফেসর রাইখের ঘরে উঁকি দিল। প্রফেসর রাইখ ঠিক একইভাবে তার মাথার একটা চুলের গোছা খামচি দিয়ে ধরে ঠিক আগের মতো নিঃশব্দে বসে আছে। সারা রাত মানুষটি তার চোখের পাতা এক মুহূর্তের জন্যেও বন্ধ করেছে বলে মনে হলো না। রিটিনের মনে হলো এখন তার সাথে একটু কথা বলা দরকার, এই খ্যাপা প্রফেসরকে একটু বিশ্রাম নিতে পাঠানো দরকার।
রিটিন ঘরের ভেতর ঢুকে নরম গলায় ডাকল, “প্রফেসর রাইখ।”
প্রফেসর রাইখ পেছনে ফিরে রিটিনের দিকে তাকাল। তার দুই চোখ টকটকে লাল, মাথার চুল এলোমেলো, চোখের নিচে কালি, শুধু চোখ দুটো শ্বাপদের চোখের মতো জ্বলজ্বল করছে। রিটিন বলল, “প্রফেসর রাইখ। তোমার মনে হয় একটু বিশ্রাম নেয়া দরকার।”
প্রফেসর রাইখ রিটিনের কথা শুনল বলে মনে হলো না। রিটিনের দিকে অনিশ্চিতের মতো তাকিয়ে রইল। রিটিন আবার বলল, “প্রফেসর রাইখ, তোমার মনে হয় এখন একটু বিশ্রাম নেয়া দরকার।”
প্রফেসর রাইখ বিড়বিড় করে বলল, “হয়ে গেছে।”
“কী হয়ে গেছে?”
“সমাধান হয়ে গেছে।”
রিটিন হাসিমুখে একটুখানি এগিয়ে গিয়ে বলল, “সমাধান হয়ে গেছে? চমৎকার! তোমাকে অভিনন্দন প্রফেসর রাইখ।”
“তার মানে জানো?”
“কী? তার মানে কী?”
“এই সমাধান থেকে আমি বলতে পারি যে সময় পরিভ্রমণ সম্ভব।”
রিটিন বলল, “আমি তোমাকে আগেই বলেছি সময় পরিভ্রমণ সম্ভব! আমি আমার ছবি দেখেছি–”
প্রফেসর রাইখ মাথা নেড়ে বলল, “আমি তোমার গাঁজাখুরি গল্প বিশ্বাস করিনি! কিন্তু এখন দেখছি সময় পরিভ্রমণ সম্ভব। একজন মানুষকে অতীতে পাঠানোর জন্যে একটা ক্যাপসুল তৈরি করা সম্ভব। এর জন্যে ওয়ার্ম হোলের প্রয়োজন নেই। স্পেস টাইম ফেব্রিকে খুব সূক্ষ্ম একটা ফুটো করে সেখান দিয়ে একটা ক্যাপসুলকে ঠেলে দেয়া সম্ভব! যে পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন সেই পরিমাণ শক্তি বর্তমান প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি করা সম্ভব। নিউক্লিয়ার প্লাজমা-”
রিটিন হাত তুলে প্রফেসর রাইখকে থামাল। বলল, “খুঁটিনাটি নিয়ে পরে আলোচনা করা যাবে। আমার মনে হয় তোমার এখন একটু বিশ্রাম নেয়া দরকার।”
প্রফেসর রাইখ মাথা নাড়ল, বলল, “না। আমি বিশ্রাম নিতে পারব না। আমার মস্তিষ্ক উত্তেজিত হয়ে আছে। আমি ঘুমাতে পারব না। খেতে পারব না।”
রিটিন বলল, “ক্লিওন আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে তোমাকে দেখাশোনা করার জন্যে। সে যখন দেখবে আমি তোমাকে কোনো কিছু খাওয়াতে পারিনি, বিশ্রাম নেয়াতে পারিনি তখন সে আমার উপর খুব রাগ করবে।”
প্রফেসর রাইখ রিটিনের কথা শুনল বলে মনে হয় না। তার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল, “একটা বিন্দুতে শক্তি কেন্দ্রীভূত করতে হবে। গামা লেজার দিয়েও করা যায়। ধরা যাক, দুই ডজন। গামা লেজার এক বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত করা হলো, স্পেস টাইম ফেব্রিককে তখন ফুটো করা সম্ভব—”
প্রফেসর রাইখ আপন মনে বিড়বিড় করে কথা বলে যেতে লাগল। রিটিন তখন আবার চেষ্টা করল, বলল, “আমি তোমাকে কথা দিয়েছিলাম সমীকরণটি সমাধান করা হলে আমি তোমাকে তোমার বাসায় পৌঁছে দেব। এখন তোমার সমাধান হয়ে গেছে। আমি ক্লিওনের কাছে অনুমতি নিয়ে তোমাকে তোমার বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি।”
প্রফেসর রাইখ এই প্রথমবার রিটিনের কথা শুনতে পেল। রিটিনের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “না, না আমি এখন বাসায় যেতে চাই না।”
“বাসায় যেতে চাও না?”
“না। আমি যদি বাসায় না যাই তাহলে আমার স্ত্রী মনে হয় খুশিই হবে।”
“তুমি এখানে থাকতে চাও?”
“হ্যাঁ। টাইম ক্যাপসুল তৈরি করার সময় আমি থাকতে চাই। আমি সমীকরণটির সমাধান করেছি কিন্তু খুঁটিনাটি হিসেব করিনি। তুমি যদি টাইম ক্যাপসুল তৈরি করতে চাও তাহলে শক্তিক্ষয়ের একটা হিসেব করতে হবে। তোমরা সেই হিসেব করতে পারবে না। আমাকে করতে হবে। তা ছাড়া–”
“তা ছাড়া কী?”
প্রফেসর রাইখ একটু বিব্রত হয়ে বলল, “না কিছু না।”
“তুমি বলে ফেল কী বলতে চাইছিলে।”
প্রফেসর রাইখ কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বলল, “আমার মনে হয় ক্যাটাগরি এ মানুষেরা ক্যাটাগরি সি মানুষদের উপর খুব বড় অবিচার করছে। ক্যাটাগরি এ মানুষ হিসেবে সেজন্যে আমি লজ্জিত। এবং নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। আমি তোমাদের সাথে কাজ করে আমাদের অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই!”
রিটিন কী বলবে বুঝতে পারল না, খানিকক্ষণ অবাক হয়ে প্রফেসর রাইখের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “এই গোপন আবাসস্থলটিতে আমি খুব ছোট একজন মানুষ। তোমাকে নিয়ে এসেছিলাম বলে আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তোমাকে দেখে শুনে রাখার জন্যে। খাবার, পানীয়, ঘুমের ব্যবস্থা করার জন্যে! তুমি এখন যে কথাগুলো বলছ সেগুলো আমার মতো ছোট মানুষের কাছে বলার কথা নয়। এগুলো অনেক বড় কথা, অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা। এই কথাগুলো তোমার আমাদের সুপ্রিম কাউন্সিলের কাছে বলা দরকার। তুমি একটু অপেক্ষা করো, আমি তাদের ডেকে নিয়ে আসি।”
প্রফেসর রাইখ মাথা নেড়ে বলল, “না, না, না, তুমি সুপ্রিম কাউন্সিলের সদস্যদের ডেকে এনো না! আমার যা বলার তোমাকেই বলব। দরকার হলে তুমি অন্যদের বলো। তোমার সাথে আমার এক ধরনের আত্মিক যোগাযোগ হয়েছে–অন্যদের সাথে হয়নি।”
রিটিন বলল, “তোমার মতো একজন মানুষের সাথে আমার আত্মিক যোগাযোগ হয়েছে, এটি আমার জন্যে অনেক বড় ব্যাপার।”
প্রফেসর রাইখ রিটিনের কথাটি শুনতে পেল বলে মনে হলো না, অন্যমনস্কভাবে বলল, “শক্তির ব্যাপারটা এখনই নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু সময়ের ব্যাপারটা কী হবে বুঝতে পারছি না। একটু উনিশ বিশ হলেই সময়ের বিশাল গোলমাল হয়ে যাবে। হয়তো একেবারে ডাইনোসরের এলাকায় গিয়ে হাজির হবে।”
প্রফেসর রাইখ হাহা করে হেসে উঠল। রিটিন লক্ষ করল মানুষটি যখন হাসে তখন তাকে হঠাত করে খুব সহজ সরল সাধারণ একজন মানুষ বলে মনে হয়!