সূক্তের শ্রেণীবিভাগ
ঋগ্বেদের প্রায় প্রতোক মন্ত্রই স্বয়ং-সম্পূর্ণ একক ; অধিকাংশ সূক্তই একটিমাত্র ছন্দোরীতি অনুসরণ করে, যদিও অন্তিম বা উপসংহারের কয়েকটি শ্লোক কখনও কখনও ভিন্ন ছন্দে রচিত হয়-পরবতী মহাকাব্যগুলিতেও সর্গের সমাপ্তি বোঝাতে এই রীতিই ব্যবহৃত হত। মাঝে মাঝে একই সূক্তে দুটি ভিন্ন ছন্দও ব্যবহৃত হয়েছে। গঠনকৌশলের দিক দিয়েও ষে কোনো সূক্ত সাধারণত একটি মাত্র বিষয়বস্তুকে অবলম্বন করেই রচিত ; তবে প্রসঙ্গ-বিচূতি ও বিষয়গত প্ৰক্ষেপ বহুস্থানেই পাওয়া যায়—এদের কিছু কিছু বেশ দীর্ঘািয়ত এবং এই প্ৰক্ষেপের জন্যে নুতন করে মূল বিষয়বস্তুতে প্ৰত্যাবর্তন করার প্রয়োজন হয়।
ভি. এম. আপ্টে ঋগ্বেদের সূক্তগুলিকে পরিপ্রেক্ষা অনুযায়ী পাঁচটি শ্রেণীতে ভাগ করেছেন—(১) ধর্মীয় অনুষ্ঠান বিষয়ক : বিবাহ, অন্তিম সংস্কার প্রভৃতি গৃহ্য অনুষ্ঠানে যে সব ব্যবহৃত ; (২) প্রার্থনা বিষয়ক : আশীর্বাদ, প্ৰায়শ্চিত্ত ইত্যাদি (৩) প্রত্নকথা বিষয়ক : প্রত্ন উপাখ্যান-সূচক সেইসব সূক্ত যেখানে প্রাসঙ্গিক অনুষ্ঠানসমূহে এদের প্রাসঙ্গিকতা নিহিত। (৪) আনুষ্ঠানিক উৎসর্গমূলক : যজ্ঞের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ না থাকলেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সঙ্গে যে সমস্ত সূক্তের যথেষ্ট প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে, (৫) যজ্ঞে প্ৰযুক্ত হলেও অনুষ্ঠানের সঙ্গে যে সমস্ত সূক্তের যোগ নিতান্ত শিথিল।
আমাদের বর্তমান আলোচনার জন্য অবশ্য আমরা অন্তরঙ্গ মানদণ্ড দিয়ে অর্থাৎ সূক্তগুলির বিষয়বস্তুর স্বভাববৈশিষ্ট্য অনুযায়ী শ্রেণী-বিভাগ করছি। যেহেতু অধিকাংশ মন্ত্রই প্রশস্তি বা প্রার্থনা জাতীয়, আলোচনার শুরুতেই আমরা সর্বপ্রথম তাদেরই গ্ৰহণ করছি। এই সমস্ত সূক্তে প্রশস্তি ও প্রার্থনা হয়তো বা অবিচ্ছেদ্যভাৱে মিশ্রিত নয়, তবে সাধারণত কোন দেবতাকে আহ্বান করে বিভিন্ন অর্ঘ্যের উপচার স্তব দ্বারা তার বন্দনা করা হয়। অন্যভাবে বলা যায়, দেববন্দনায় তার অবয়ব, পোশাক, অলঙ্কার, আয়ুধ, রথ ও অশ্বের উল্লেখ করে তারপর সাফল্য এবং পূর্ব প্রার্থীদের প্ৰতি প্রদত্ত দানের বর্ণনা করা হয় ; অনেকক্ষেত্রেই এই সব প্রার্থীদের নামে ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের পরিচয়ও নিহিত। এ ধরনের সূক্ত সমস্ত বৈদিক দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয়েছে।
প্ৰশস্তি অংশের পরে আসে প্রার্থনা ; এর বিষয়বস্তু সাধারণত আহুত দেবতার চরিত্র এবং দেবকল্পনায় তার ভূমিকার দ্বারা নির্ধারিত। স্বাস্থ্য, প্রাচুর্য, আরোগ্য, শক্তি, জয়, পরমায়ু, জীবনীশক্তি, সম্পদ, স্বর্ণ, গবাদি পশু, উর্বরতা, দাম্পত্য সুখ ও সস্তানের জন্য সৌর দেবতাদের নিকট প্রার্থনা জানানো হয়। মৃত্তিকার উর্বরতা, বিপদে সুরক্ষা ও দীর্ঘ জীবনের জন্য প্রার্থনা জানানো হয় পাতালের অধিষ্ঠাতৃ দেবতাদের কাছে। প্রার্থনাগুলি শুনে প্ৰাযই মনে হয় যে দেবতা ও তার উপাসকদের সম্পর্ক শুধু দাতা ও গ্রহীতার। দেবতাকে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করে মূল্যবান দানসামগ্ৰীর কথা, কখনও বা পরিমাণ উল্লেখ করেও স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় এবং সেই সঙ্গে এই তথ্যও জানিয়ে নেওয়া হয় যে প্রাথিত প্ৰাপ্তি যেন দানের সমানুপাতিক হয়। কবি ও সূক্তভেদে প্রার্থনার ভঙ্গী ভিন্ন-কিছু সূক্ত প্ৰসন্নতা ও শান্তি কামনায়, কিছু কিছু আবার অনুনয় ও স্তাবকতায় পূর্ণ, আবার কোথাও বা স্পষ্ট বলা হয়েছে যে উপাসক যদি নিজে দেবতা হতেন, তা হলে সমস্ত প্রার্থনাই তিনি যথাযথভাবে পূরণ করতেন।
প্রশস্তি ও প্রার্থনামূলক বিষয়বস্তু ছাড়াও ঋগ্বেদের মধ্যে বহুবিচিত্র বিষয়বস্তুর সমাহার লক্ষ্য করা যায়। এসবের মধ্যে রয়েছে বিচিত্র ধরনের গীতিকবিতা, বহু বীর ও বীরত্বের উপাখ্যান সম্বলিত গীতিকা, প্রণয়সঞ্চারী সম্মোহন ও উর্বরতা বর্ধক ইন্দ্ৰজাল বর্ণনা, অলৌকিক কাহিনী, বন্দনা-গীতি, নিসর্গকাব্য (যেমন রাত্রি সূক্ত বা অরণ্যানী সূক্ত), পানবিষয়ক গীতি, প্ৰেম-সঙ্গীত, শোক-গাথা, বিবাহ-গীতি এবং আক্ষেপ-গীতি ও অন্যান্য বহু বিষয়ে রচিত সূক্ত। বহু স্তোত্রকেই আমরা যুদ্ধগীতি রূপে চিহ্নিত করতে পারি। যেখানে আদিম জনগোষ্ঠীর উপর আর্যদের জয় বর্ণিত হয়েছে। বাইবেলের মধ্যেও এই জাতীয় স্তোত্র লক্ষ্য করা যায় ; যেমন দেবোরার গান, (বুক অব জাজেস, ৫ অধ্যায়) বিজয়গীতি (১ম স্যামুয়েল ১৮ : ৭ এবং জেনেসিস ৪ : ২৩)। বৈদিক যুদ্ধগীতিগুলির মধ্যে উৎসাহ ও আড়ম্বরের একটা বিশেষ বাতাববণ রয়েছে ; এছাড়া, এতে শত্রুর উল্লেখ্য, ইন্দ্রের বীরত্ব ও বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদি বার বার উল্লিখিত হয়েছে। এ ধরনের রচনায় আমরা একদিকে আক্রমণকারী আর্যজাতির সেনাপতিরূপে বন্দিত ইন্দ্র এবং অগ্নি, বায়ু, সোম, মরুদগণ ও বিষ্ণু এবং অন্যদিকে বৃত্ৰ, অহি, নমুচি, ধুনি, চুমুরি এবং অন্যান্য প্ৰাগাৰ্য জাতির গোষ্ঠীপতিদের মধ্যে ভয়ঙ্কর এক সংগ্রামের আভাস পাই। প্রতি পক্ষেই অনগামী সৈন্যদল বর্ণিত হয়েছে, শেষ পর্যন্ত ইন্দ্ৰ প্ৰাচীর-বেষ্টিত বসতিগুলির দুর্গ-প্রতিরোধ ভেদ ক’রে বিজিত জাতির গবাদি পশু, স্বর্ণ সম্পদ লুণ্ঠন করেন এবং বিজিত বন্দী শক্ৰদের দাস ও দস্যু বলে অভিহিত করে আর্য দেবতার ঐন্দ্ৰজালিক ক্ষমতাও উল্লিখিত তবু শত্রুর শক্তিকে প্রায়ই ‘মায়া’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। ইন্দ্রর বীরত্ব ছাড়াও আর্যপক্ষের জয়কে যা নিশ্চিত করেছে তা হল বজ্র। এর ঠিক পরেই রয়েছে আনন্দ অভিব্যক্তির মন্ত্র। যাযাবর আক্রমণ-কারীরা বসতি বিস্তারের বিশেষ প্রয়োজনে ভূমি অধিকারের জন্য নির্মম ও নিরবচ্ছিন্ন যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হয়েছিল। আক্রমণকারীদের ক্ৰোধ উদ্রেক করার জন্য আদিম অধিবাসীরা যদিও কোন অপরাধই করে নি এবং নিজেদের গোষ্ঠী ও বসতিকে রক্ষা করার জন্যই তারা যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছিল তবু তারাই পাপ ও অমঙ্গলের প্রতীক বর্বর জাতিরূপে অকারণে নিন্দিত। কিন্তু যুগে যুগে অনিবাৰ্যভাবেই আক্রমণকারীদের দৃষ্টিভঙ্গি এরকমই হয়ে থাকে। পূর্বোক্ত যুদ্ধগীতিগুলিতে ইন্দ্র ও তার সহায়কদের সম্পর্কে অসংখ্য গৌরবসূচক বিশ্লেষণ প্রয়োগ করা হয়েছে এবং অন্যদিকে অনার্যজাতি মাত্রকেই অন্ত্যজ ও ঘূণ্যরূপে চিত্রিত করা হয়েছে। প্রসঙ্গত বলা যায় যে, ইন্দ্রের বজ্রই সম্ভবত ভারতবর্ষে ব্যবহৃত প্ৰথম লৌহ-নির্মিত অস্ত্ৰ। সিন্ধু উপত্যকার অধিবাসীদের কাছে এই ধাতুটি ছিল সম্পূর্ণ অপরিচিত ; প্রত্নতাত্ত্বিকেরা বলেন, মোটামুটিভাবে খ্রিস্টপূর্ব একাদশ শতাব্দীতে তা সম্ভবত এদেশে প্ৰথম ব্যবহৃত হয়।