আলাসিঙ্গার ‘সী-সিকনেস্’ হল না। তু-ভায়া প্রথমে একটু আধটু গোল করে সামলে বসে আছেন। চারদিন—কাজেই নানা বার্তালাপে ‘ইষ্ট-গোষ্ঠী’তে কাটল। সামনে কলম্বো। এই সিংহল, লঙ্কা। শ্রীরামচন্দ্র সেতু বেঁধে পার হয়ে লঙ্কার রাবণ-রাজাকে জয় করেছিলেন। সেতু তো দেখেচি—সেতুপতি মহারাজার বাড়ীতে, যে পাথরখানির উপর ভগবান্ রামচন্দ্র তাঁর পূর্বপুরুষকে প্রথম সেতুপতি-রাজা করেন, তাও দেখেচি। কিন্তু এ পাপ বৌদ্ধ সিলোনি লোকগুলো তো মানতে চায় না! বলে—আমাদের দেশে ও কিংবদন্তী পর্যন্ত নাই। আর নাই বললে কি হবে?—‘গোঁসাইজী পুঁথিতে লিখছেন যে।’ তার ওপর ওরা নিজের দেশকে বলে—সিংহল। লঙ্কা বলবে না, বলবে কোত্থেকে? ওদের না কথায় ঝাল, না কাজে ঝাল, না প্রকৃতিতে ঝাল!! রাম বল—ঘাগরা-পরা, খোঁপা-বাঁধা, আবার খোঁপায় মস্ত একখানা চিরুনী দেওয়া মেয়েমান্ষী চেহারা! আবার—রোগা-রোগা, বেঁটে-বেঁটে, নরম-নরম শরীর! এরা রাবণ-কুম্ভকর্ণের বাচ্চা? গেছি আর কি! বলে—বাঙলা দেশ থেকে এসেছিল—তা ভালই করেছিল। ঐ যে একদল দেশে উঠেছে, মেয়েমানুষের মত বেশভূষা, নরম-নরম বুলি কাটেন, এঁকে-বেঁকে চলেন, কারুর চোখের উপর চোখ রেখে কথা কইতে পারেন না, আর ভূমিষ্ঠ হয়ে অবধি পিরীতের কবিতা লেখেন, আর বিরহের জ্বালায় ‘হাঁসেন-হোঁসেন’ করেন—ওরা কেন যাক না বাপু সিলোনে। পোড়া গবর্ণমেণ্ট কি ঘুমুচ্চে গা? সেদিন পুরীতে কাদের ধরাপাকড়া করতে গিয়ে হুলুস্থূল বাধালে; বলি রাজধানীতে পাকড়া করে প্যাক করবারও যে অনেক রয়েছে।
একটা ছিল মহা দুষ্টু বাঙালী রাজার ছেলে—বিজয়সিংহ বলে! সেটা বাপের সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ করে, নিজের মত আরও কতকগুলো সঙ্গী জুটিয়ে জাহাজে করে ভেসে ভেসে লঙ্কা নামক টাপুতে হাজির। তখন ওদেশে বুনো জাতের আবাস, যাদের বংশধরেরা এক্ষণে ‘বেদ্দা’ নামে বিখ্যাত। বুনো রাজা বড় খাতির করে রাখলে, মেয়ে বে দিলে। কিছুদিন ভাল মান্ষের মত রইল; তারপর একদিন মাগের সঙ্গে যুক্তি করে হঠাৎ রাত্রে সদলবলে উঠে বুনো রাজাকে সর্দারগণ সহিত কতল করে ফেললে। তারপর বিজয়সিংহ হলেন রাজা, দুষ্টুমির এইখানেই বড় অন্ত হলেন না। তারপর আর তাঁর বুনোর-মেয়ে রাণী ভাল লাগল না। তখন ভারতবর্ষ থেকে আরও লোকজন, আরও অনেক মেয়ে আনলেন। অনুরাধা বলে এক মেয়ে তো নিজে করলেন বিয়ে, আর সে বুনোর মেয়েকে জলাঞ্জলি দিলেন; সে জাতকে জাত নিপাত করতে লাগলেন। বেচারীরা প্রায় সব মারা গেল, কিছু অংশ ঝাড়-জঙ্গলে আজও বাস করছে। এই রকম করে লঙ্কার নাম হল সিংহল, আর হল বাঙালী বদমাশের উপনিবেশ! ক্রমে অশোক মহারাজার আমলে, তাঁর ছেলে মাহিন্দো আর মেয়ে সংঘমিত্তা সন্ন্যাস নিয়ে ধর্ম প্রচার করতে সিংহল টাপুতে উপস্থিত হলেন। এঁরা গিয়ে দেখলেন যে লোকগুলো বড়ই আদাড়ে হয়ে গিয়েছে। আজীবন পরিশ্রম করে, সেগুলোকে যথাসম্ভব সভ্য করলেন, উত্তম উত্তম নিয়ম করলেন; আর শাক্যমুনির সম্প্রদায়ে আনলেন। দেখতে দেখতে সিলোনিরা বেজায় গোঁড়া বৌদ্ধ হয়ে উঠল। লঙ্কাদ্বীপের মধ্যভাগে এক প্রকাণ্ড শহর বানালে, তার নাম দিলে অনুরাধাপুরম্, এখনও সে শহরের ভগ্নাবশেষ দেখলে আক্কেল হয়রান হয়ে যায়। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড স্তূপ, ক্রোশ ক্রোশ পাথরের ভাঙা বাড়ী দাঁড়িয়ে আছে। আরও কত জঙ্গল হয়ে রয়েছে, এখনও সাফ হয় নাই। সিলোনময় নেড়া মাথা, করোয়াধারী, হলদে চাদর মোড়া ভিক্ষু-ভিক্ষুণী ছড়িয়ে পড়ল। জায়গায় জায়গায় বড় বড় মন্দির উঠল—মস্ত মস্ত ধ্যানমূর্তি, জ্ঞানমুদ্রা করে প্রচারমূর্তি, কাত হয়ে শুয়ে মহানির্বাণ মূর্তি—তার মধ্যে। আর দ্যালের গায়ে সিলোনিরা দুষ্টুমি করলে নরকে তাদের কি হাল হয়, তাই আঁকা; কোনটাকে ভূতে ঠেঙাচ্চে, কোনটাকে করাতে চিরচে, কোনটাকে পোড়াচ্চে, কোনটাকে তপ্ত তেলে ভাজচে, কোনটার ছাল ছাড়িয়ে নিচ্চে—সে মহা বীভৎস কারখানা! এ ‘অহিংসা পরমো ধর্মে’র ভেতরে যে এমন কারখানা কে জানে বাপু! চীনেও ঐ হাল; জাপানেও ঐ। এদিকে তো অহিংসা আর সাজার পরিপাটি দেখলে আত্মাপুরুষ শুকিয়ে যায়। এক ‘অহিংসা পরমো ধর্মে’র বাড়ীতে ঢুকেচে—চোর। কর্তার ছেলেরা তাকে পাকড়া করে বেদম পিটছে। তখন কর্তা দোতলার বারাণ্ডায় এসে, গোলমাল দেখে, খবর নিয়ে চেঁচাতে লাগলেন, ‘ওরে মারিসনি, মারিসনি; অহিংসা পরমো ধর্মঃ।’ বাচ্চা-অহিংসারা মার থামিয়ে জিজ্ঞাসা করলে, ‘তবে চোরকে কি করা যায়? ‘কর্তা আদেশ করলেন, ‘ওকে থলিতে পুরে জলে ফেলে দাও।’ চোর জোড় হাত করে আপ্যায়িত হয়ে বললে, ‘আহা, কর্তার কি দয়া!’
বৌদ্ধরা বড় শান্ত, সকল ধর্মের উপর সমদৃষ্টি—এই তো শুনেছিলুম। বৌদ্ধ প্রচারকেরা আমাদের কলকেতায় এসে রঙ-বেরঙের গাল ঝাড়ে; অথচ আমরা তাদের যথেষ্ট পূজা করে থাকি। অনুরাধাপুরে প্রচার করছি একবার, হিঁদুদের মধ্যে—বৌদ্ধদের মধ্যে নয়—তাও খোলা মাঠে, কারুর জমিতে নয়। ইতোমধ্যে দুনিয়ার বৌদ্ধ ‘ভিক্ষু’-গৃহস্থ, মেয়ে-মদ্দ, ঢাক- ঢোল কাঁসি নিয়ে এসে সে যে বিটকেল আওয়াজ আরম্ভ করলে, তা আর কি বলব! লেকচার তো ‘অলমিতি’ হল; রক্তারক্তি হয় আর কি! অনেক করে হিঁদুদের বুঝিয়ে দেওয়া গেল যে, আমরা নয় একটু অহিংসা করি এস—তখন শান্ত হয়।
ক্রমে উত্তর দিক্ থেকে হিঁদু তামিলকুল ধীরে ধীরে লঙ্কায় প্রবেশ করলে। বৌদ্ধরা বেগতিক দেখে রাজধানী ছেড়ে, কান্দি নামক পার্বত্য শহর স্থাপন করলে। তামিলরা কিছুদিনে তাও ছিনিয়ে নিলে এবং হিন্দুরাজা খাড়া করলে। তারপর এল ফিরিঙ্গীর দল, স্পানিয়ার্ড, পোর্তুগীজ, ওলন্দাজ। শেষ ইংরেজ রাজা হয়েছেন। কান্দির রাজবংশ তাঞ্জোরে প্রেরিত হয়েছেন, পেনশন আর মুড়গ্তন্নির ভাত খাচ্ছেন।
উত্তোর সিলোনে হিঁদুর ভাগ অনেক অধিক; দক্ষিণ ভাগে বৌদ্ধ আর রঙ-বেরঙের দোআঁশলা ফিরিঙ্গী। বৌদ্ধদের প্রধান স্থান—বর্তমান রাজধানী কলম্বো, আর হিন্দুদের জাফনা। জাতের গোলমাল ভারতবর্ষ হতে এখানে অনেক কম। বৌদ্ধদের একটু আছে বে-থার সময়। খাওয়া-দাওয়ায় বৌদ্ধদের আদতে নেই; হিঁদুদের কিছু কিছু। যত কসাই, সব বৌদ্ধ ছিল। আজকাল কমে যাচ্ছে; ধর্মপ্রচার হচ্ছে। বৌদ্ধদের অধিকাংশ ইওরোপী নাম ইন্দ্রম-পিন্দ্রম এখন বদলে নিচ্ছে। হিঁদুদের সব রকম জাত মিলে একটা হিঁদু জাত হয়েছে; তাতে অনেকটা পাঞ্জাবী জাঠদের মত সব জাতের মেয়ে, মায় বিবি পর্যন্ত বে করা চলে। ছেলে মন্দিরে গিয়ে ত্রিপুণ্ড্র কেটে ‘শিব শিব’ বলে হিঁদু হয়! স্বামী হিঁদু, স্ত্রী ক্রিশ্চান। কপালে বিভূতি মেখে ‘নমঃ পার্বতীপতয়ে’ বললেই ক্রিশ্চান সদ্য হিঁদু হয়ে যায়। তাতেই তোমাদের উপর এখানকার পাদ্রীরা এত চটা। তোমাদের আনাগোনা হয়ে অবধি, বহুৎ ক্রিশ্চান বিভূতি মেখে ‘নমঃ পার্বতীপতয়ে’ বলে হিঁদু হয়ে জাতে উঠেছে। অদ্বৈতবাদ আর বীরশৈববাদ এখানকার ধর্ম। হিঁদু-শব্দের জায়গায় ‘শৈব’ বলতে হয়। চৈতন্যদেব যে নৃত্যকীর্তন বঙ্গদেশে প্রচার করেন, তার জন্মভূমি দাক্ষিণাত্য, এই তামিল জাতির মধ্যে। সিলোনের তামিল ভাষা খাঁটি তামিল। সিলোনের ধর্ম, খাঁটি তামিল ধর্ম—সে লক্ষ লোকের উন্মাদ কীর্তন, শিবের স্তবগান, সে হাজারো মৃদঙ্গের আওয়াজ আর বড় বড় কত্তালের ঝাঁজ, আর এই বিভূতি-মাখা, মোটা মোটা রুদ্রাক্ষ গলায়, পহলওয়ানি চেহারা, লাল চোখ, মহাবীরের মত, তামিলদের মাতোয়ারা নাচ না দেখলে বুঝতে পারবে না।
কলম্বোর বন্ধুরা নাববার হুকুম আনিয়ে রেখেছিল, অতএব ডাঙায় নেবে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে দেখাশুনা হল। স্যর কুমারস্বামী হিন্দুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি, তাঁর স্ত্রী ইংরেজ, ছেলেটি শুধু-পায়ে, কপালে বিভূতি। শ্রীযুক্ত অরুণাচলম্ প্রমুখ বন্ধু-বান্ধবেরা এলেন। অনেক দিনের পর মুড়গ্তন্নি খাওয়া হল, আর কিং-কোকোনাট। ডাব কতকগুলো জাহাজে তুলে দিলে। মিসেস হিগিন্সের সঙ্গে দেখা হল, তাঁর বৌদ্ধ মেয়েদের বোর্ডিং স্কুল দেখলাম। কাউণ্টেসের বাড়ীটি মিসেস্ হিগিন্সের অপেক্ষা প্রশস্ত ও সাজান। কাউণ্টেস্ ঘর থেকে টাকা এনেছেন, আর মিসেস্ হিগিন্স ভিক্ষে করে করেছেন। কাউণ্টেস্ নিজে গেরুয়া কাপড় বাঙলার শাড়ীর মত পরেন। সিলোনের বৌদ্ধদের মধ্যে ঐ ঢঙ খুব ধরে গেছে দেখলাম। গাড়ী গাড়ী মেয়ে দেখলাম, সব ঐ ঢঙের শাড়ী পরা।
বৌদ্ধদের প্রধান তীর্থ কান্দিতে দন্ত-মন্দির। ঐ মন্দিরে বুদ্ধ-ভগবানের একটি দাঁত আছে। সিলোনীরা বলে, ঐ দাঁত আগে পুরীতে জগন্নাথ-মন্দিরে ছিল, পরে নানা হাঙ্গামা হয়ে সিলোনে উপস্থিত হয়। সেখানেও হাঙ্গামা কম হয় নাই। এখন নিরাপদে অবস্থান করছেন! সিলোনীরা আপনাদের ইতিহাস উত্তমরূপে লিখে রেখেছে। আমাদের মত নয়—খালি আষাঢ়ে গল্প। আর বৌদ্ধদের শাস্ত্র নাকি প্রাচীন মাগধী ভাষায়, এই দেশেই সুরক্ষিত আছে। এ স্থান হতেই ব্রহ্ম শ্যাম প্রভৃতি দেশে ধর্ম গেছে। সিলোনী বৌদ্ধরা তাদের শাস্ত্রোক্ত এক শাক্যমুনিকেই মানে, আর তাঁর উপদেশ মেনে চলতে চেষ্টা করে; নেপালী, সিকিম, ভুটানী, লাদাকী, চীনে, জাপানীদের মত শিবের পূজা করে না; আর ‘হ্রীং তারা’ ওসব জানে না। তবে ভূতটুত নামানো আছে। বৌদ্ধেরা এখন উত্তর আর দক্ষিণ দু-আম্নায় হয়ে গেছে। উত্তর আম্নায়েরা নিজেদের বলে ‘মহাযান’; আর দক্ষিণী অর্থাৎ সিংহলী ব্রহ্ম সায়ামি প্রভৃতিদের বলে ‘হীনযান’। মহাযানওয়ালারা বুদ্ধের পূজা নামমাত্র করে; আসল পূজা তারাদেবীর, আর অবলোকিতেশ্বরের (জাপানী, চীনে ও কোরিয়ানরা বলে ক্বানয়ন্); আর ‘হ্রীং ক্লীং’ তন্ত্র-মন্ত্রের বড় ধুম। টিবেটীগুলো আসল শিবের ভূত। ওরা সব হিঁদুর দেবতা মানে, ডমরু বাজায়, মড়ার খুলি রাখে, সাধুর হাড়ের ভেঁপু বাজায়, মদ-মাংসের যম। আর খালি মন্ত্র আওড়ে রোগ ভূত প্রেত তাড়াচ্ছে। চীন আর জাপানে সব মন্দিরের গায়ে ‘ওঁ হ্রীং ক্লীং’—সব বড় বড় সোনালী অক্ষরে লেখা দেখেছি। সে অক্ষর বাঙলার এত কাছাকাছি যে, বেশ বোঝা যায়।
আলাসিঙ্গা কলম্বো থেকে মান্দ্রাজে ফিরে গেল। আমরাও কুমারস্বামীর (কার্তিকের নাম—সুব্রহ্মণ্য, কুমারস্বামী ইত্যাদি; দক্ষিণ দেশে কার্তিকের ভারী পূজা, ভারী মান; কার্তিক ওঁ-কারের অবতার বলে।) বাগানের নেবু, কতকগুলো ডাবের রাজা (কিং-কোকোনাট), দু বোতল সরবৎ ইত্যাদি উপহার সহিত আবার জাহাজে উঠলাম।