বর্তমানে আমার বয়স প্রায় ৮৩ বছর। কাজেই আজ আমি যে ‘সমাপ্তি নিবন্ধটি লিখছি, তা বাহ্যত এ পুস্তিকাখানার সমাপ্তি হলেও মূলত আমার জীবনেরও সমাপ্তি। তাই আমার জীবননাট্য সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ আলোচনা করছি।
বরিশাল শহরের অদূরে লামচরি গ্রামের এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম আমার ৩ পৌষ, ১৩০৭ সালে। চার বছর বয়সে আমার বাবা মারা যান (১৩১১)। অতঃপর বাকি করে জমি ও কৰ্জ-দেনার দায়ে বসতঘরখানা নিলাম করিয়ে নেন সদাশয় জমিদার ও মহাজনরা ১৩১৭ ও ১৮ সালে। তখন স্বামীহারা, বিত্তহারা ও গৃহহারা হয়ে মা আমাকে নিয়ে ভাসতে থাকেন অকূল দুঃখের সাগরে। সে সময় বেঁচে থাকতে হয়েছে আমাকে দশ দুয়ারের সাহায্যে।
তখন আমাদের গ্রামে কোনোরূপ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিলো না। শরীয়তী শিক্ষাদানের জন্য এক মুন্সী সাহেব একখানা মক্তব খোলেন তাঁর বাড়িতে ১৩২০ সালে। এতিম ছেলে বলে আমি তাঁর মক্তবে ভর্তি হলাম অবৈতনিকভাবে। সেখানে প্রথম বছর শিক্ষা করলাম স্বর ও ব্যঞ্জনবর্ণ তালপাতায় এবং বানান-ফলা কলাপাতায়। কেননা বই-শ্লেট কেনার সঙ্গতি আমার ছিলো না। অতঃপর এক আত্মীয়ের প্রদত্ত রামসুন্দর বসাকের ‘বাল্যশিক্ষা’ নামক বইখানা পড়ার সময় ছাত্রবেতন অনাদায়হেতু মুসী সাহেব তার মক্তবটি বন্ধ করে দিলেন ১৩২১ সালে। আর এখানেই হলো আমার আনুষ্ঠানিক বিদ্যাশিক্ষার সমাপ্তি বা সমাধি। এরপর কিছুদিন ঘোরাফেরা করে কৃষিকাজ শুরু করি ১৩২৬ সালে।
আমার মা ছিলেন অতিশয় নামাজী-কালামী একজন ধামিকা রমণী। তাঁর নামাজ-রোজা বাদ পড়া তো দূরের কথা, কাজা হতেও দেখিনি কোনোদিন আমার জীবনে। মাঘ মাসের দারুণ শীতের রাতেও তাঁর তাহাজ্জদ নামাজ কখনও বাদ পড়েনি এবং তারই ছোয়াচ লেগেছিলো আমার গায়েও কিছুটা। কিন্তু আমার জীবনের গতিপথ বেঁকে যায় মায়ের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে একটি দুঃখজনক ঘটনায়।
বিগত ইং ২৭.১০.৭৮ তারিখের ‘বিচিত্রা পত্রিকা, ১০.৬.৮১ তারিখের ‘সংবাদ পত্রিকা, ১৯.৭.৮১ তারিখের ‘বিপ্লবী বাংলাদেশ পত্রিকা, ৪.৯.৮১ তারিখের বাংলার বাণী পত্রিকা, ১২.১২.৮২ তারিখের সন্ধানী পত্রিকা ও আমার সম্পাদিত স্মরণিকা পুস্তিকাখানা যারা পাঠ করেছেন এবং যারা ১৭.৪.৮৩ তারিখে বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রচ্ছদ অনুষ্ঠানে আমার সাক্ষাৎকারের বাণী শ্রবণ করেছেন – তাঁরা হয়তো জানেন আমার দুঃখজনক ঘটনাটি। তবুও সেই অবিস্মরণীয় বিষাদময় ঘটনাটি সংক্ষেপে এখানে বলছি। সে ঘটনাটি আমাকে করেছে অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে দ্রোহী।
১৩৩৯ সালে আমার মা মারা গেলে আমি আমার মৃত মায়ের ফটাে তুলেছিলাম। আমার মাকে দাফন করার উদ্দেশ্যে যে সমস্ত মুন্সী, মৌলভী ও মুছল্লিরা এসেছিলেন, ফটাে তোলা হারাম বলে তারা আমার মা’র নামাজে জানাজা ও দাফন করা ত্যাগ করে লাশ ফেলে চলে যান। অগত্যা কতিপয় অমুছল্লি নিয়ে জানাজা ছাড়াই আমার মাকে সৃষ্টিকর্তার হাতে সোপর্দ করতে হয় কবরে। ধমীয় দৃষ্টিতে ছবি তোলা দূষণীয় হলেও সে দোষে দোষী স্বয়ং আমিই, আমার মা নন। তথাপি কেন যে আমার মায়ের অবমাননা করা হলো, তা ভেবে না পেয়ে আমি বিমূঢ় হয়ে মার শিয়রে দাড়িয়ে তাঁর বিদেহী আত্মাকে উদ্দেশ্য করে এই বলে সেদিন প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, “মা, আজীবন ছিলে তুমি ধর্মের একনিষ্ঠ সাধিকা। আর আজ সেই ধর্মের নামেই হলে তুমি শেয়াল-কুকুরের ভক্ষ্য। সমাজে বিরাজ করছে এখন ধর্মের নামে অসংখ্য অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার। তুমি আমায় আশীৰ্বাদ করো – আমার জীবনের ব্রত হয় যেনো কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস দূরীকরণ অভিযান। আর সে অভিযান সার্থক করে আমি যেনো তোমার কাছে আসতে পারি।
“তুমি আশীৰ্বাদ করো মোরে মা,
আমি যেনো বাজাতে পারি
সে অভিযানের দামামা।”
আমি জানতাম যে, অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার দূরীকরণ অভিযানে সৈনিকরপে লড়াই করবার যোগ্যতা আমার নেই। কেননা আমি একজন পঙ্গু (মূর্খ)। তাই সে অভিযানে অংশ নিতে হবে আমাকে ‘বাজনদার’রূপে। মাতৃশোকের তারুণ্যের উন্মাদনা কিছুটা লাঘব হলে আমি ভাবতে লাগলাম, শোকোমত্ত হয়ে প্রতিজ্ঞা তো করেছি যে, সে অভিযানে আমি দামামা বাজাবো। কিন্তু তা পাবো কোথায়? দামামা তৈরীর উপকরণ তো আমার আয়ত্তে নেই। তাই কৃষিকাজের ফাকে ফাকে আমাকে আত্মনিয়োগ করতে হলো উপকরণ সংগ্রহের কাজে। অর্থাৎ পড়াশুনার কাজে।
আমার মায়ের মৃত্যুর পর থেকে দীর্ঘ আঠারো বছর কঠোর সাধনা করে ধমীয় কতিপয় অন্ধবিশ্বাসকে দর্শনের উত্তাপে গলিয়ে তা বিজ্ঞানের ছাঁচে ঢেলে তার একটি তালিকা তৈরী করছিলাম প্রশ্নের আকারে ১৩৫৭ সালে। এ সময় স্থানীয় গোড়া বন্ধুরা আমাকে ধর্মবিরোধী ও ‘নাখোদা’ (নাস্তিক) বলে প্রচার করতে থাকে এবং আমার সে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে গ্রাম ছেড়ে শহর পর্যন্ত। লোক পরম্পরায় আমার নামটি শুনতে পেয়ে তৎকালীন বরিশালের ল-ইয়ার ম্যাজিষ্ট্রেট ও তাবলিগ জামাতের আমীর জনাব এফ, করিম সাহেব সদলে আমার সাথে তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ হন ১৩৫৮ সালের ১২ জ্যৈষ্ঠ তারিখে আমার বাড়িতে এসে, এবং যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বরিশালে গিয়ে তিনি আমাকে এক ফৌজদারী মামলায় সোপর্দ করেন ‘কমুনিষ্ট আখ্যা দিয়ে। সে মামলায় আমার জবানবদি তলব করা হলে পূর্বোক্ত তালিকার প্রশ্নগুলোর কিছু কিছু ব্যাখ্যা লিখে সত্যের সন্ধান নাম দিয়ে তা আমার জবানবন্দিরূপে কোর্টে দাখিল করি তৎকালীন বরিশালের পুলিশ সুপার জনাব মহিউদ্দিন সাহেবের মাধ্যমে, ২৭ আষাঢ় ১৩৫৮ সালে (ইং তাং ১২ ৭ ৫১)।
সত্যের সন্ধান-এর পাণ্ডুলিপিখানার বদৌলতে সে মামলায় আমি দৈহিক নিকৃতি পেলাম বটে, কিন্তু মানসিক শাস্তি ভোগ করতে হলো বহু বছর। কেননা তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের স্থানীয় কর্তৃপক্ষ আমাকে নির্দেশ দিলেন যে, “সত্যের সন্ধান’ বইখানা আমি প্রকাশ করতে পারবো না ও ধমীয় সনাতন মতবাদের সমালোচনামূলক অন্য কোনো বই লিখতে পারবো না এবং পারবো না কোনো সভা-সমিতিতে-বক্তৃতামঞ্চে দাঁড়িয়ে স্বমত প্রচার করতে। যদি এর একটি কাজও করি, তবে যে কোনো অজুহাতে আমাকে পুনঃ ফৌজদারীতে সোপর্দ করা হবে। অগত্যা কলমকালাম বন্ধ করে আমাকে বসে থাকতে হলো ঘরে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত। এভাবে নষ্ট হয়ে গেলো আমার কর্মজীবনের অমূল্য ২০টি বছর।
বাংলাদেশে কুখ্যাত পাকিস্তান সরকারের সমাধি হলে পর সত্যের সন্ধান বইখানা প্রকাশ করা হয় ১৩৮০ সালে, রচনার ২২ বছর পর। এর পরে লিখিত আমার পুস্তক হচ্ছে — সৃষ্টি-রহস্য, মুক্তমন, স্মরণিকা ও অনুমান। আমার প্রণীত বা সম্পাদিত আলোচ্য যাবতীয় পুস্তক-পুস্তিকাই হচ্ছে আমার মায়ের মৃত্যুদিনের বাঞ্ছিত দামামার অংশবিশেষ। এছাড়া আমার অন্যান্য কৃতকর্মেও রয়েছে ঐ একই প্রেরণা। যার উদ্দেশ্য হচ্ছে ‘মানবকল্যাণ।
১৩৫৮ সালে ‘সত্যের সন্ধান-এ আমার যে বাজনা শুরু হয়েছিলো, ১৩৯০ সালে অনুমানএ তার সন্ধ্যা-বিরতি, হয়তোবা সমাপ্তি। কিন্তু –
এসে জীবনের সন্ধ্যাবেলা,
দেখি এ জেহাদ নয়, খেলা।
যদি আবহাওয়া থাকে ভালো,
তবে নিশীথেও চলবে খেলা,
থাকবে যতোক্ষণ আলো।