সংবর্ত্তের মরু-পৌরোহিত্য-প্রত্যাখ্যান
“তখন মহর্ষি সংবর্ত্ত নরপতি মরুত্তকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘রাজন্! যদি তুমি আমার প্রিয়চিকীর্য়ু হও, তাহা হইলে তুমি কাহার নিকট আমার বৃত্তান্ত অবগত হইলে, তাহা যথার্থরূপে কীৰ্ত্তন কর। সত্যকথা কহিলে তোমার সমুদয় মনোরথ পরিপূর্ণ হইবে; আর যদি তুমি মিথ্যাবাক্য প্রয়োগ কর, তাহা হইলে নিশ্চয়ই তোমার মস্তক শতধা বিদীর্ণ হইয়া যাইবে।’
মরুত্ত কহিলেন, ‘ভগবন্! আমি পথিমধ্যে দেবর্ষি নারদের নিকট আপনার বৃত্তান্ত অবগত হইয়াছি। আপনি আমার গুরুপুত্র। আমি আপনাকে অবগত হইয়া পরম পরিতুষ্ট হইয়াছি।’
সংবৰ্ত্ত কহিলেন, ‘রাজন্! তুমি যথার্থ কহিয়াছ, নারদ তামাকে যজ্ঞকুশল বলিয়া অবগত আছেন, এক্ষণে নারদ কোন্ স্থানে অবস্থান করিতেছেন, তাহা আমার নিকট ব্যক্ত কর।
তখন মত্তরু কহিলেন, ‘ভগবন্! তিনি আমার নিকট আপনার বিষয় ব্যক্ত করিয়া আমাকে আপনার নিকট আগমন করিতে অনুজ্ঞা প্রদানপূর্ব্বক বহ্নিমধ্যে প্রবেশ করিয়াছেন।’
মহারাজ মরুত্ত এই কথা কহিলে মহর্ষি সংবৰ্ত্ত অতি কঠোরবাক্যে তাঁহাকে তিরস্কার করিয়া কহিলেন, ‘রাজন্! আমি যজ্ঞকার্য্যে সমর্থ বটে; কিন্তু আমি বায়ুরোগগ্রস্ত ও বিকৃতবেশধারী, আমার চিত্তের স্থৈর্য্য নাই; অতএব কিরূপে আমাদ্বারা যজ্ঞ সম্পাদন করিতে তোমার বাসনা হইতেছে? আমার জ্যেষ্ঠভ্রাতা বৃহস্পতি ইন্দ্রের যাজনক্রিয়ায় নিযুক্ত রহিয়াছেন। তিনি কার্য্যদক্ষ; অতএব তাঁহার দ্বারা যজ্ঞাদি কাৰ্য্যসমুদয় সম্পাদন করা তোমার কর্ত্তব্য। তিনি আমার পরম পূজ্য; সুতরাং যদি আমি তোমার যাজনক্রিয়ায় নিযুক্ত হই, তাহা হইলে তাঁহার অনুমতি ব্যতীত হইব না। অতএব যদি তোমার আমাদ্বারা যজ্ঞ করাইবার বাসনা থাকে, তাহা হইলে বৃহস্পতির অনুমতি গ্রহণ করিয়া প্রত্যাগমন কর। তাহা হইলে আমি তোমার যাজনক্রিয়া নির্ব্বাহ করিব।
সংবর্ত্তের যজ্ঞীয় নিয়মবন্ধন—পৌরোহিত্য-স্বীকার
“তখন মরুত্ত কহিলেন, “ব্ৰহ্মন! আমি ইতিপুর্ব্বে বৃহস্পতির নিকট গমন করিয়াছিলাম। ইন্দ্র যজমান হওয়াতে তিনি আমার যজ্ঞ সম্পাদন করিতে বাসনা করেন না। তিনি আমাকে প্রত্যাখ্যানপূর্ব্বক কহিয়াছেন যে, আমি দেবপুরোহিত; মনুষ্যের যজ্ঞসম্পাদন করা আমার কর্ত্তব্য নহে। বিশেষতঃ ইন্দ্র আমায় তোমার পৌরোহিত্য করিতে নিষেধ করিয়া কহিয়াছেন যে, মরুত্তরাজা সর্ব্বদাই আমার সহিত স্পর্দ্ধা করিয়া থাকে; অতএব তাহার যজ্ঞে দীক্ষিত হওয়া আপনার নিতান্ত অনুচিত! হে ব্রহ্মন্! আপনার ভ্রাতা ইন্দ্রের সেই বাক্যে সম্মত হইয়াছেন। আমি স্নেহপ্রযুক্ত তাঁহার নিকট গমন করিয়াছিলাম; কিন্তু তিনি ইন্দ্রের অনুরোধে আমার পৌরোহিত্য-সম্পাদনে সম্মত হয়েন নাই। এক্ষণে সর্ব্বাস্বান্ত করিয়াও আপনার দ্বারা যজ্ঞানুষ্ঠানপূৰ্ব্বক ইন্দ্রকে অতিক্রম করিতে আমার বাসনা হইতেছে। আর আমার বৃহস্পতির নিকট গমন করিবার অভিলাষ নাই। তিনি নিরপরাধে আমাকে প্রত্যাখ্যান করিয়াছেন।
তখন সংবর্ত্ত কহিলেন, ‘রাজন্! যদি তুমি আমার অভিপ্রায়ানুরূপ কাৰ্য্য করিতে সম্মত হও, তাহা হইলে আমি তোমার সমুদয় অভিলাষ পরিপূর্ণ করিব। আমি তোমার যাজনক্রিয়া আরম্ভ করিলে ইন্দ্র ও বৃহস্পতি ইঁহারা ক্রোধাবিষ্ট হইয়া আমার বিদ্বেষাচরণ করিবেন। সেই সময় আমার প্রতি তোমার দৃঢ়ভক্তি থাকে কি না, তদ্বিষয়ে আমার সন্দেহভঞ্জন কর। নতুবা আমি কুপিত হইলে তোমাকে সবান্ধবে ভস্মসাৎ করিব।’
মরুত্ত কহিলেন, ‘ভগবন্! আমি যদি আপনাকে কখন পরিত্যাগ করি, তাহা হইলে যত দিন সূৰ্য্য তাপপ্রদান করিবেন ও যত কাল পর্ব্বত সমুদয় বিদ্যমান থাকিবে, তত কাল যেন আমার নরকভোগ হয় এবং আমি যেন কদাচ সুমতিলাভে ও বিষয় বাসনা পরিত্যাগে সমর্থ না হই।’
তখন সংবর্ত্ত কহিলেন, ‘রাজন্! এক্ষণে আমি তোমার যজ্ঞকার্য্যে হিত উপদেশ প্রদান করিতেছি, শ্রবণ কর। আমি যেরূপ উৎকৃষ্ট অক্ষয় যজ্ঞোপকরণের উপদেশ প্রদান করি, তুমি সেইরূপ উপকরণ সংগ্রহ করিলে অনায়াসে গন্ধৰ্ব্বদিগের সহিত ইন্দ্রাদি দেবগণকে পরাভব করিতে পারিবে। ধন বা যজ্ঞীয় উপকরণে আমার কিছুমাত্র স্পৃহা নাই, কেবল যাহাতে আমার ভ্রাতা বৃহস্পতি ও সুররাজ ইন্দ্রের অপকার হয় এবং যাহাতে তুমি ইন্দ্রের সমকক্ষ হইতে সমর্থ হও, আমি তদ্বিষয়েই সবিশেষ চেষ্টা করিব।