রামের প্রসাদে বাড়ে সবা ঐশ্বর্য্য।
দরিদ্র হইল ধনী, শুনিতে আশ্চর্য্য।।
রাজ্যখণ্ড ছাড়ি রাম যান বনবাস।
শিরে হাত দিয়া কান্দে সবে নিজ বাস।।
মাঝে সীতা আগে পাছে দুই মহাবীর।
তিন জন হইলেন পুরীর বাহির।।
স্ত্রী পুরুষ কান্দে যত অযোধ্যানগরী।
জানকীর পাছে ধায় অযোধ্যার নারী।।
যে সীতা না দেখিতেন সূর্য্যের কিরণ।
হেন সীতা বনে যান দেখে সর্ব্বজন।।
যেই রাম ভ্রমেন সোণার চতুর্দ্দোলে।
হেন প্রভু রাম পথ বাহেন ভূতলে।।
কোথাও না দেখি হেন, কোথাও না শুনি।
হাহাকার করে বৃদ্ধ বালক রমণী।।
জগতের নাথ রাম যান তপোবনে।
বিদার হইতে যান পিতার চরণে।।
বুদ্ধি নাই ভূপতির, হরিয়াছে জ্ঞান।
রাম বনে গেলে তাঁর কিসে বাঁচে প্রাণ।।
রাজারে পাগল কৈল কৈকেয়ী রাক্ষসী।
রাম হেন পুত্রে হায় কৈল বনবাসী।।
মনে বুঝি রাজার যে নিকট মরণ।
বিপরীত বুদ্ধি হয় এই সে কারণ।।
জানকী সহিত রাম যান তপোবন।
রাজ্যসুখ ভোগ ছাড়ি চলিল লক্ষ্মণ।।
পুরীশুদ্ধ সবে যায় শ্রীরামের সনে।
চৌদ্দ বর্ষ এক ঠাঁই থাকি গিয়া বনে।।
অযোধ্যার ঘর দ্বার ফেলাই ভাঙ্গিয়া।
কৈকেয়ী করুক রাজ্য ভরতে লইয়া।।
শৃগাল ভল্লুক রহুক অযোধ্যানগরে।
মায়ে পোয়ে রাজত্ব করুক একেশ্বরে।।
এইরূপে শ্রীরামের সকলে বাখানে।
রাজার নিকটে যান দ্রুত তিন জনে।।
এক প্রকোষ্ঠ বাহিরে রহে তিন জন।
আবাস ভিতরে রাজা করেন ক্রন্দন।।
ভূপতি বলেন, রে কৈকেয়ী ভুজঙ্গিনি।
তোরে আনি মজিলাম সবংশে আপনি।।
রঘুবংশে নাশ হেতু আইলি রাক্ষসী।
রাম হেন পুত্রেরে করিলি বনবাসী।।
কেমনে দেখিব আমি রাম যায় বন।
রাম বনে গেলে আমি ত্যজিব জীবন।।
প্রাণ যাক্ তাহে মম নাহি কোন শোক।
আমারে স্ত্রীবশ বলি ঘুষিবেক লোক।।
বড় বড় রাজা আমি জিনিলাম রণে।
দেব দৈত্য গন্ধর্ব্ব কাঁপয়ে মোর বাণে।।
যেই রাজা জিনিলেক দৈত্য যে সম্বর।
যারে অর্দ্ধাসন স্থান দেন পুরন্দর।।
হেন দশরথ রাজা স্ত্রী লাগিয়া মরে।
এই অপকীর্ত্তি মম থাকিল সংসারে।।
স্ত্রীর বশ না হইবে অন্য কোন নর।
আমার মরণে লোক শিখিল বিস্তর।।
বর্জ্জিবে ভরত তোরে এই অনাচারে।
আমি বর্জ্জিলাম তোরে আর ভরতেরে।।
আজি হৈতে তোরে আমি করিনু বর্জ্জন।
ভরতের না লইব শ্রাদ্ধ বা তর্পণ।।
থাকি অন্য প্রকোষ্ঠেতে তাঁরা তিন জন।
শুনেন রাজার সর্ব্ব বিলাপ-বচন।।
রাজার দুঃখেতে দুঃখী শ্রীরাম লক্ষ্মণ।
রাজার ক্রন্দনেতে কান্দেন ভূপতি।।
হেনকালে উপনীত সুমন্ত্র সারথি।
যোড়হাতে বার্ত্তা কহে রাজার গোচর।
নিবেদন, অবধান কর নৃপবর।।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ সীতা যায় আজি বনে।
বিদায় হইতে আইছেন তিন জনে।।
ভূপতি বলেন, মন্ত্রী নাহি মম জ্ঞান।
সাতশত মহারাণী আন মোর স্থান।।
রাজার পাইয়া আজ্ঞা সুমন্ত্র সারথি।
সাতশত মহাদেবী আনে শীঘ্রগতি।।
সাতশত মহারাণী চারিদিকে বৈসে।
তারাগণ মধ্যে যেন চন্দ্রমা প্রকাশে।।
সুমন্ত্র রাজাজ্ঞা-মতে চলিল তখন।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ সীতা আনে তিন জন।।
কহেন বন্দিয়া রাম পিতার চরণে।
আজ্ঞা কর বনে যাই এই তিন জনে।।
কহিলেন নৃপতি করিয়া হাহাকার।
মম সঙ্গে দেখা বাছা না হইবে আর।।
হেথা না রহিব আমি, না রবে জীবন।
তোমার সহিত রাম যাব তপোবন।।
শ্রীরাম বলেন, পিতা এ নহে বিহিত।
পুত্র সঙ্গে পিতা যায় এই কি উচিত।।
ভূপতি বলেন, রাম থাক এক রাতি।
এক রাত্রি একত্র করিব নিবসতি।।
ভালমতে দেখিব তোমার সুবদন।
পুন আর না হইবে মুখচন্দ্র দরশন।।
শ্রীরাম বলেন, যদি নিশ্চিত গমন।
এক রাত্রি লাগি কেন সত্য উল্লঙ্ঘন।।
আজি আমি বনে যাব আছয়ে নির্ব্বন্ধ।
না গেলে বিমাতা মনে ভাবিবেন মন্দ।।
আজি হৈতে অন্ন করিলাম বিসর্জ্জন।
বনে গিয়া ফল-মূল করিব ভক্ষণ।।
তারে পুত্র বলি যে কুলের অলঙ্কার।
পিতৃসত্য পালিয়া শোধয়ে পিতৃধার।।
ভূপতি বলেন, শুন সুমন্ত্র বচন।
অশ্ব হস্তী সঙ্গে দেহ বহুমূল্য ধন।।
অরণ্যের মধ্যে আছে বহু পুণ্যস্থান।
ব্রাহ্মণ তপস্বী দেখি করিহ প্রদান।।
যদি ধন দিতে রাজা করেন আশ্বাস।
কৈকেয়ী অন্তরে দুঃখী ছাড়িল নিশ্বাস।।
সর্ব্বাঙ্গ হইল শুষ্ক ম্লান হৈল মুখ।
রাজারে পাড়িল গালি পেয়ে মনে দুখ।।
ভরতেরে রাজ্য দিতে করি অঙ্গীকার।
কুটিল-হৃদয় কর অন্যথা তাহার।।
তব বংশে ছিলেন সগর মহাশয়।
অসমঞ্জ পুত্রে বর্জ্জে প্রধান তনয়।।
রামেরে বর্জ্জিতে আজি মনে লাগে ব্যথা।
আপনি করিয়া সত্য করিলা অন্যথা।।
এত যদি ভূপতির বলিল কৈকেয়ী।
নৃপতি বলেন শুন পাপীয়সি কহি।।
সগরের পুত্র অসমঞ্জ দুরাচার।
গলা চাপি বালকের করিত সংহার।।
তার মাতা পিতা দুঃখ পায় পুত্রশোকে।
জানাইল সগর রাজারে প্রজালোকে।।
জানাইল সগর রাজারে প্রজালোকে।
জানাইল সগর রাজারে প্রজালোক।।
তব রাজ্য ছাড়ি রাজা যাব অন্য দেশ।
অসমঞ্জ প্রজাগণে দেয় বড় ক্লেশ।।
কেমনে থাকিবে প্রজা যে দেশে এমন।
প্রজা যদি চাহ, পুত্রে করহ বর্জ্জন।।
অসমঞ্জে বর্জ্জে আমি কোন্ অপরাধে।
শ্রীরামেরে বর্জ্জি আমি কোন্ অপরাধে।।
জগতের হিত রাম জগৎ জীবন।
হেন রামে কে বলিবে যাহ তুমি বন।।
তখন বলেন রাম পিতৃ বিদ্যমানে।
ভাল যুক্তি মাতা বলিলেন তব স্থানে।।
রাজ্য ছাড়ি যাহার যাইতে হয় বন।
অশ্ব হস্তী ধনে তার কোন্ প্রয়োজন।।
গাছের বাকল পরি দণ্ড করি হাতে।
জানকী লক্ষ্মণ মাত্র যাইবেক সাথে।।
বাকল পরিবে রাম, কৈকেয়ী তা শুনে।
বাকল রাখিয়াছিল দিল ততক্ষণে।।
বাকল আনিয়া দিল শ্রীরামের হাতে।
কান্দেন বাকল দেখি রাজা দশরথে।।
যদি ধন দিতে রাজা করেন আশ্বাস।
কৈকেয়ী অন্তরে দুঃখী ছাড়িল নিশ্বাস।।
সর্ব্বাঙ্গ হইল শুষ্ক ম্লান হৈল মুখ।
রাজারে পাড়িল গালি পেয়ে মনে দুঃখ।।
ভরতেরে রাজ্য দিতে করি অঙ্গীকার।
কুটিল হৃদয় কর অন্যথা তাহার।।
তব বংশে ছিলেন সগর মহাশয়।
অসমঞ্জ পুত্রে বর্জ্জে প্রধান তনয়।।
রামেরে বর্জ্জিতে আজি মন লাগে ব্যথা।
আপনি করিয়া সত্য করিলা অন্যথা।।
এত যদি ভূপতির বলিল কৈকেয়ী।
নৃপতি বলেন শুন পাপীয়সি কহি।।
সগরের পুত্র অসমঞ্জ দুরাচার।
গলা চাপি বালকের করিত সংহার।।
তার মাতা পিতা দুঃখ পায় পুত্রশোকে।
জানাইল সগর রাজারে প্রজালোকে।।
তব রাজ্য ছাড়ি রাজা যাব অন্য দেশ।
অসমঞ্জ প্রজাগণে দেয় দেড় ক্লেশ।।
কেমনে থাকিবে প্রজা যে দেশে এমন।
প্রজা যদি চাহ, পুত্রে করহ বর্জ্জিন।।
অসমঞ্জে বর্জ্জে রাজা লোক-অনুরোধে।
শ্রীরামেরে বর্জ্জি আমি কোন্ অপরাধে।।
জগতের হিম রাম জগৎ জীবন।
হেন রামে কে বলিবে যাহ তুমি বন।।
তখন বলেন রাম পিতৃ বিদ্যমানে।
ভাল যুক্তি মাতা বলিলেন তব স্থানে।।
রাজ্য ছাড়ি যাহার যাইতে হয় বন।
অশ্ব হস্তী ধনে তার কোন্ প্রয়োজন।।
গাছের বাকল পরি দণ্ড করি হাতে।
জানকী লক্ষ্মণ মাত্র যাইবেক সাথে।।
বাকল পরিবে রাম, কৈকেয়ী তা শুনে।
বাকল রাখিয়াছিল দিল ততক্ষণে।।
বাকল আনিয়া দিল শ্রীরামের হাতে।
কান্দেন বাকল দেখি রাজা দশরথে।।
লক্ষ্মণের সীতার বাকলি তিনখানি।
রোদন করেন দেখে সাতশত রাণী।।
অশ্রুজল সবাকার করে ছল ছল।
কেমনে পরিবে সীতা গাছের বাকল।।
হরি হরি স্মরণ করয়ে সর্ব্বলোকে।
বজ্রঘাত হয় যেন ভূপতির বুকে।।
সবে বলে কৈকেয়ী পাষাণ তোর হিয়া।
তিলেক না হয় দয়া রামেরে দেখিয়া।।
এক জনে দংশিয়া দংশিলি তিন জনে।
লক্ষ্মণ সীতারে কেন পাঠাইলি বনে।।
পিতৃসত্য পালিতে শ্রীরাম যান বন।
জানকী লক্ষ্মণ যান কিসের কারণ।।
বধূর বাকল দেখি রাজার ক্রন্দন।
পাত্র মিত্র বলে সীতা পরুন বসন।।
পিতৃসত্য পুত্র পালে বধূর কি দায়।
পতিব্রতা সীতাদেবী পশ্চাতে গোড়ায়।।
নানা রত্নে পূর্ণিত যে রাজার ভাণ্ডার।
সুমন্ত্র শুনিয়া আনে দিব্য অলঙ্কার।।
জানকী পরেন তাড় তোড়ন নূপুর।
মকর কুণ্ডল হার অপূর্ব্ব কেয়ূর।।
মণিময় মালা আর বিচিত্র পাশুলী।
হীরক অঙ্গুরী হেতু শোভিত অঙ্গুলী।।
দুই হাতে শঙ্খ তাঁর অদ্ভুত নির্ম্মাণ।
করিলেন ইত্যাদি ভূষণ পরিধান।।
পট্টবস্ত্র পরিলেন অতি মনোহর।
ত্রৈলোক্য জিনিয়া রূপ ধরিল সুন্দর।।
যেমন ভূষণ তাঁর, তেমনি আকার।
শ্বশুরে জানকী দেবী করে নমস্কার।।
বিদায় লইয়া সতী শ্বশুর-চরণে।
রহে যোড়হাতে শাশুড়ীর বিদ্যমানে।।
কৌশল্যা বলেন, সীতা শুন সাবধানে।
স্বামী-সেবা সতত করিবে রাত্রি দিনে।।
রাজার বহুয়ারী তুমি রাজার কুমারী।
তোমার আচারে আচরিবে অন্য নারী।।
নির্ধন হউক স্বামী অথবা সধন।
স্বামী বিনা স্ত্রীলোকের অন্য নহে মন।।
জানকী বলেন, গো কৌশল্যা ঠাকুরাণী।
স্বামীসেবা করিতে যে আমি ভাল জানি।।
স্বামীসেবা করি মাত্র এই আমি চাই।
তেকারণে ঠাকুরাণী বনবাসে যাই।।
যত ধর্ম্ম কর্ম্ম করিয়াছি পিতৃঘরে।
আর স্ত্রীর মত জ্ঞান না কর আমারে।।
মায়ের অধিক যে আমার ভাব ব্যথা।
হিত উপদেশ তেঁই শিখাইলা মাতা।।
তার কথা শুনিয়া কহেন মহারাণী।
তোমা হেন বধূ আমি ভাগ্য করি মানি।।
বধূরে প্রবোধ দিয়া বুঝান শ্রীরামে।
সতর্ক থাকিহ রাম মুনির আশ্রমে।।
জানকীর রূপে চমৎকৃত ত্রিভুবনে।
সাবধান হইও রাম ভয়ানক বনে।।
সুমিত্রা বলেন, শুন তনয় লক্ষ্মণ।
দেবজ্ঞান রামেরে করিহ সর্ব্বক্ষণ।।
জ্যেষ্ঠভ্রাতা পিতৃতুল্য সর্ব্বশাস্ত্রে জানি।
আমার অধিক তব সীতা ঠাকুরাণী।।
শ্রীরাম বলেন, শুন সুমিত্রা সতাই।
আশীর্ব্বাদ কর আমি বনবাসে যাই।।
বনেতে তিনেতে তিন থাকিব দোসর।
ত্রিভুবনে আমার কাহারে নাহি ডর।।
বন্দেন সবারে রাম যত রাজরাণী।
সবাকার ঠাঞি রাম মাগেন মেলানি।।
নমস্কার করিলেন কৈকেয়ী চরণে।
অনুমতি কর মাতা আমি যাই বনে।।
ভাল মন্দ বলিয়াছি দুরক্ষর বাণী।
মনে কিছু না করিহ দেহ গো মেলানি।।
পাপিষ্ঠা কৈকেয়ী তাহে অতি ক্রূরমতি।
ভাল মন্দ না বলিল শ্রীরামের প্রতি।।
মায়েরে সঁপেন রাম নৃপতির পায়।
যাবৎ না আসি পিতা পালিহ মাতায়।।
রাজা বলিলেন যদি রহে এ জীবন।
তবে ত তোমার মায়ে করিব পালন।।
আমার এ আজ্ঞা রাম না কর লঙ্ঘন।
তিন দিন রথে চড়ি করহ গমন।।
রাজাজ্ঞায় রথ আনে সুমন্ত্র সারথি।
তিন দিন রথে যাইবেন রঘুপতি।।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ সীতা উঠিলেন রথে।
তোলেন আয়ুধ নানা লক্ষ্মণ তাহাতে।।
রাজ্যখণ্ড ছাড়িয়া শ্রীরাম যান বনে।
পাছে পাছে কত ধায় স্ত্রী পুরুষগণে।।
ভাঙ্গিল সকল রাজ্য অযোধ্যানগরী।
শ্রীরামের পাছে ধায় সব অন্তঃপুরী।।
ডাক দিয়া সুমন্ত্রে বলিছে সর্ব্বজন।
রাখ রাখ দেখি শ্রীরামের চন্দ্রানন।।
কাঁটা খোঁচা ভাঙ্গি রাজা ঊর্দ্ধ্যশ্বাসে ধান।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ সীতা কত দূরে যান।।
শ্রীরাম বলেন, শুন সুমন্ত্র সারথি।
দেখিতে না পারি আমি পিতার দুর্গতি।।
রথের করাও তুমি ত্বরিত গমন।
পিতার সহিত যেন না হয় দর্শন।।
সুমন্ত্র বলিল, আজ্ঞা না করিব আন।
এক বাক্য বলি আমি কর অবধান।।
ভাঙ্গিল রাজার সঙ্গে অযোধ্যানগরী।
রথের পশ্চাতে এই দেখে সর্ব্বপুরী।।
রাজার সহিত যদি হয় দরশন।
তবে না দেশেতে লোক করিবে গমন।।
শ্রীরাম বলেন, বলি সুমন্ত্র তোমারে।
প্রয়োজন নাহি মোর রাজ্য পরিবারে।।
মম বাক্য আপনি না পার লঙ্ঘিবারে।
ঝাট রথ চালাহ না দেখা দিব কারে।।
শ্রীরামের আজ্ঞামতে সুমন্ত্র সারথি।
রথখান চালাইল পবনের গতি।।
কত দূরে গিয়া রথ হৈল অদর্শন।
ভূমিতে পড়েন রাজা হয়ে অচেতন।।
রাজারে ধরিয়া তোলে অমাত্য সকল।
শরীরের ধূলি ঝাড়ি মুখে দেয় জল।।
একদিন শোকে তাঁর মূর্ত্তি হৈল ম্লান।
রাজার জীবন নাই করে অনুমান।।
রাজারে ধরিয়া সবে লৈয়া গেল দেশ।
অন্তঃপুর মধ্যে তাঁরে করায় প্রবেশ।।
গড়াগড়ি দশরথ যান ভূমিতলে।
হেনকালে কৈকেয়ী রাজারে ধরি তোলে।।
নরপতি বলেন, না ছুঁস পাতকিনী।
স্ত্রী হইয়া স্বামীকে বধিলি চণ্ডালিনী।।
প্রথমে যখন ছিলি কৈকেয়ী যুবতী।
রাত্রিদিন থাকিতিস্ আমার সংহতি।।
তাহার কারণ এই হইল প্রকাশ।
রাম ছাড়া করিয়া করিলি সর্ব্বনাশ।।
গেলেন শোকার্ত্ত রাজা কৌশল্যার ঘর।
দোঁহার হইল শোক একই সোসর।।
রাত্রি দিন নাহি ঘুচে দোঁহার ক্রন্দন।
এক শোকে হইলেন কাতর দুজন।।
মুনি বেদ ছাড়িলেন, যোগী ছাড়ে যোগ।
পাবক আহুতি ছাড়ে, প্রজা ছাড়ে ভোগ।।
মাতঙ্গ আহার ছাড়ে, ঘোড়া ছাড়ে ঘাস।
প্রজার ভোজন নাই করে উপবাস।।
যামিনীতে কামিনী না যায় পতি পাশ।
সংসার হইল শূন্য সকলে নিরাশ।।
রাত্রি দিন কান্দে লোক করে জাগরণ।
গেলেন তমসাকূলে শ্রীরাম লক্ষ্মণ।।
নানা বনফুল দেখি সে নদীর কূলে।
রাজহংস ক্রীড়া করে তমসার জলে।।
সুমন্ত্রের প্রতি আজ্ঞা করিলেন রাম।
তমসার কূলে আজি করিব বিশ্রাম।।
রথ-অশ্ব স্নান করাইল তার জলে।
জল পান করাইয়া বান্ধে তার কূলে।।
অস্তগিরি গত রবি বেলার বিরাম।
তমসার জলে স্নান করেন শ্রীরাম।।
কমণ্ডলু ভরি জল আনিল লক্ষ্মণ।
রাম সীতা প্রক্ষালন করেন চরণ।।
লক্ষ্মণ বৃক্ষের তলে বিছাইলা পাতা।
করিলেন তাহাতে শয়ন রাম সীতা।।
হাতে ধনু লক্ষ্মণ রহিল জাগরণে।
প্রীতি পাইলেন রাম লক্ষ্মণের গুণে।।
তমসার কূলেতে বঞ্চেন এক রাতি।
প্রভাতে যোগায় রথ সুমন্ত্র সারথি।।
প্রাতঃস্নান আদি করি নিয়ম আচার।
হইলেন শ্রীরাম তমসানদী পার।।
যেখানে যেখানে শ্রীরামের রথ রয়।
তথাকার লোক আসি লয় পরিচয়।।
বৃদ্ধকালে দশরথ বাধ্য বনিতার।
হেন পুত্র পুত্রবধূ পাঠায় কান্তার।।
যেখানে শুনেন রাম পিতার নিন্দন।
করেন সে স্থান হতে ত্বরিত গমন।।
তমসা ছাড়িয়া আর গোমতী প্রভৃতি।
নদী পার হইলেন রাম মহামতি।।
জলে হংস কেলি করে অতি সুশোভন।
দেখি আপ্যায়িত হন শ্রীরাম লক্ষ্মণ।।
শ্রীরাম বলেন সীতে সর্ব্বত্র বিদিত।
ইক্ষ্বাকুর রাজ্য এই দেশ সুশোভিত।।
এই দেশে ইক্ষ্বাকু ধরিল ছত্রদণ্ড।
মম পূর্ব্বপুরুষের দেখ রাজ্যখণ্ড।।
যথা যথা যান রাম প্রসন্ন হৃদয়।
সে দেশের যত লোক আসি নিবেদয়।।
তোমার বিহনে রাম রাজ্যের বিনাশ।
কোন্ বিধি সৃজিল তোমার বনবাস।।
সবাকারে রামচন্দ্র দিলেন মেলানি।
ভালবাসে আমারে তোমরা ভাল জানি।।
করিয়া রাজার নিন্দা সবে যায় ঘরে।
পিতৃনিন্দা শুনি রাম গেলেন অন্তরে।।
পক্ষী হেন উড়ে রথ যায় নানা দেশ।
কোশলের রাজ্যে রাম করেন প্রবেশ।।
শ্রীরাম বলেন, শুন জানকী সুন্দরী।
মম মাতামহের আছিলে এই পুরী।।
পুত্রবৎ করিলেন প্রজার পালন।
গঙ্গাতীরে দিয়াছেন ব্রাক্ষণ-শাসন।।
গরের মধ্যে গঙ্গা শোভে কুতূহলে।
সারি সারি যজ্ঞকুণ্ড তার দুই কূলে।।
কদলী গুবাক্ নারিকেল আম্র আর।
দুই তীরে রোপিয়াছে শোভিত অপার।।
দুই কূলে বিপ্রগণ করে বেদধ্বনি।
দুই কূলে স্নান করে যত ঋষি মুনি।।
সুমন্ত্রের প্রতি তবে বলেন শ্রীরাম।
গঙ্গাতীরে রহি আজি করিব বিশ্রাম।।
সুমন্ত্র লক্ষ্মণ দোঁহে দিলা অনুমতি।
রথ হৈতে নামিলেন চারি মহামতি।।
রাম সীতা লক্ষ্মণ বৈসেন বৃক্ষমূলে।
সুমন্ত্র চালায় অশ্ব জাহ্নবীর কূলে।।
ভাস্কর পশ্চিমে যান বেলা অবশেষে।
তখন গেলেন রাম শৃঙ্গবের দেশে।।
শৃঙ্গবের দেশ দেখি রাম হৃষ্টমতি।
লাগিলেন বলিতে শ্রীলক্ষ্মণের প্রতি।।
গুহক চণ্ডাল হেথা আছে মম মিত্র।
আমারে পাইলে হবে প্রফুল্লিত চিত্ত।।
শ্রীরাম বলেন, শুন সুমন্ত্র সারথি।
মিত্রের বাটীতে আমি থাকি এক রাতি।।
কহিব শুনিব বাক্য দোঁহে দোঁহাকার।
বিশেষতঃ জানিব পথের সমাচার।।
নানাবিধ ফল খাব কদলী কাঁঠাল।
সুরঙ্গ নারঙ্গী আদি পাইব রসাল।।
রাম বনে যাইতে রহেন সেই দেশে।
গাহিল অযোধ্যাকাণ্ড কবি কৃত্তিবাসে।।