রাত কেটে গেলো নিরাপদেই, কিন্তু পরদিন—সেদিন শনিবার—কেনেডি উঠলেন বিষম জ্বর নিয়ে। প্রথমটায় ফাণ্ডসন ভেবেছিলেন, বুঝি-বা উষ্ণ জঙ্গলের জ্বর আক্রমণ করেছে তাকে, কিন্তু একটু পরেই যখন বুঝতে পারলেন যে জ্বর ততটা গুরুতর নয়, তখন স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। ওষুধের ব্যবস্থা করে কেনেডিকে যখন চাঙা করে তোলা হলো, তখন কিন্তু অস্বস্তি এলো নতুন দিক দিয়ে।
সূর্য ওঠবার খানিকক্ষণ পরেই আকাশের সকল কোণে কে যেন মিশকালো এক চাদর বিছিয়ে দিলে; প্রথমটায় ছিলো আলকাতার মতো কালো একটুকরো মেঘ, দেখতে-না-দেখতে তা সারা আকাশে ছড়িয়ে গেলো আর অন্ধকার করে এলো চারদিক। ঘন-ঘন চমকালো বিদ্যুৎ যেন আলোর এক-একটি আঁকাবাঁকা তীব্র সাপ পাকে পাকে জড়িয়ে ধরেছে মেঘকে; বিদ্যুৎ-দিয়ে-চেরা মেঘখানি ক্রমেই এমনভাবে এগিয়ে এলো যে মনে হলো বিরাট এক কালো রঙের ড্রাগন তার আগুনের দাঁত বার করে সারা আকাশকে কামড়ে, ছিড়ে, চিবিয়ে গিলে ফেলতে চাচ্ছে। অল্পক্ষণের মধ্যে সমস্ত আকাশ মেঘে মেঘে চাপা পড়ে গেলো, বাজ ফাটলো গুরুগুরু আর বাজের সেই গড়ানে আওয়াজ শুনে যেই ঝড়ের ঘুম ভাঙলো, অমনি বনের যত গাছপালা পাগল হয়ে তাণ্ডব নাচ শুরু করে দিলে।
দীর্ঘ একটি তীব্র আলোর রেখা তারপর জেগে উঠলো, কোনো মন্ত গাছের মতো ধীরে-ধীরে তা গজিয়ে উঠলো যেন আকাশে, আর আগুনের ডালপালা কেঁপে এঁকেবেঁকে চোখ ধাঁধিয়ে দিতে শুরু করে দিলে। মনে হলো তারা যেন কোনো অশরীরীর অদৃশ্য দেহের আগুনজ্বালা শিরা-উপশিরা। মেঘের রং যে এত কালো হতে পারে, আর বিদ্যুতের তীব্র তলোয়ার যে এত ক্ষিপ্র হতে পারে, আর এমন ভীষণ-গম্ভীর আওয়াজ করে যে আলো ফেটে পড়তে পারে ফার্গুসনরা কেউই তা আগে জানতেন না। কিন্তু এই ভয়ানক সুষমা উপভোগ করার সময় তখন ছিলো না। তক্ষুনি যদি নোঙর খুলে বেলুনকে আকাশে ওড়ানো না-যায়, তাহলে যে-কোনো মুহূর্তে বেলুনের ক্ষতি হতে পারে।
ফার্গুসনের নির্দেশে সেই বিষম ঝড়ের মধ্যেই নোঙর তুলে যাত্রা শুরু করে দেয়া হলো। প্রায় ছ-শো ফিট উঠে আসার পর পাওয়া গেলো প্রয়োজনীয় অনুকূল বাতাস, নিচে তখন রাগি ঝড় প্রচণ্ড আক্রোশে ফুঁসছে। উত্তর-পশ্চিমমুখো বাতাস বইছে, বেলুন তার পথ ধরে শূন্যে অগ্রসর হলো।
এবারে আমরা যার সম্মুখীন হচ্ছি, ফাণ্ডসন জানালেন, তার নাম রুবি-হো পর্বত–এ-দেশের লোকেরা তার নাম দিয়েছে হাওয়ার পথ। ঐ পাহাড়ের চুড়ো উঠে গেছে। শূন্যে, কাজেই সেটা পেরুতে হলে আমাদের অনেক উচ্চতায় ওঠবার ব্যবস্থা করতে হবে। আমার কাছে যে-মানচিত্র রয়েছে, তাতে যদি তথ্যসংক্রান্ত কোনো গলদ নাথাকে, তাহলে এখন প্রায় পাঁচ হাজার ফিট উঠতে হবে আমাদের; কাজেই সেই অনুযায়ী চুল্লির আগুনকে আবো গনগনে করে তুলতে হবে।
চুল্লির লাল ঘুলঘুলির ভেতর গিয়ে দেখা গেলো, ভেতরের স্বচ্ছ অগ্নিশিখা আরোস্বচ্ছ হয়ে এলো ক্রমশ, উত্তাপ বেড়ে চললো প্রবল হারে, আর তার ফলে হালকা হয়ে ছড়িয়ে গেলো গ্যাস, বেলুন ফুলে উঠলো আগের চেয়ে অনেক বেশি, আর তরতর করে উঠতে লাগলো ওপর দিকে। হাওয়ার জোরালো টানে অচিরেই সেই তুষার-ঢাকা পাহাড়ের তীক্ষ্ণ্ণ শ্বেত চুড়ো পেরিয়ে গেলো ভিক্টরিয়া, তারপর কিছুক্ষণের মধ্যেই রুবিহো-র অন্য দিকে উশাগারা প্রদেশের মাটিতে এসে নামানো হলো বেলুন। কাছেই কালো একটি বন দেখা যাচ্ছে। যদি সেখানে কোনো শিকার মেলে, তবে তা-ই দিয়েই রাতের খাবার চালানো যাবে। কেননা অকারণে সঙ্গের খাবার তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেলার কোনো মানে হয় না; তাছাড়া ক্রমাগত বাসি খাবার গলাধঃকরণ করা স্বাস্থ্যের পক্ষেও খারাপ, সেদিক দিয়ে টাটকা মাংসের চেয়ে উপকারী খাবার আর কী আছে।
ফার্গুসন তার পরিকল্পনার কথা কেনেডিকে খুলে বললেন। তুমি বরং জো-কে সঙ্গে নিয়ে বন্দুক কাঁধে বেরিয়ে পড়ো–যদি দু-একটা হরিণ শিকার করতে পারো, তাহলে তোফা নৈশভোজের ব্যবস্থা করা যায়। তাছাড়া তোমারও বন্দুকের হাত যাতে খারাপ না-হয়, সেজন্যও মাঝে-মাঝে শিকারের ব্যবস্থা করে চর্চার সাহায্যে তাকে শানিয়ে নেয়াও দরকার। আফ্রিকায় এসে যদি শিকারই না-করলে তো তোমাকে সঙ্গে নিয়ে আসার সার্থকতা কী রইলো?
আর দেরি করলেন না কেনেডি, তক্ষুনি জো-কে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। একটু দূরেই সেই কালো গভীর বন : মস্ত বাওবাব, রুপোলি ইউক্যালিপটাস আর হলদে পোডোকাপাস ছাড়া গাম নামক একজাতীয় গাছ সেখানে আছে, ঝোপঝাড়ও অসংখ্য। খুব সাবধানে হুঁশিয়ারভাবে কেনেডি জো-কে নিয়ে এগুতে লাগলেন। ভীষণ বন! ভালো করে ভেতরে ঢুকতে-না ঢুকতেই কাটাঝোঁপের তীক্ষ্ণ্ণ আক্রমণে কেনেডি আর জো-র পোশাক ছিঁড়ে সর্বাঙ্গ ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেলো। এমন অসময়ে এই দুর্গম বনে মানুষকে ঢুকতে দেখে বানর আর পাখির দল অবাক হয়ে আরো জোরে কলরব করে উঠলো।
গাছের ফাঁকে একটু ফাঁকা-মতো জায়গা; হলদে-কালোয় ডোরাকাটা একদল জিব্রা ছুটোছুটি করছিলো, হঠাৎ বেবুনদের তীব্র শোরগোল শুনে চমকে তারা দৌড় দিয়ে বনের দূর কিনারে উধাও হয়ে গেলো। কয়েকটা বেঢপ জিরাফ তাদের অদ্ভুত গলা বাড়িয়ে গাছের আগডাল থেকে পাতা ছিঁড়ে খাচ্ছিলো, জিব্রাদের তীব্র গতি দেখে তারাও ছুটে পালাতে শুরু করে দিলে। এই জিরাফদের ছুটে পালাবার ভঙ্গি এমন কিম্ভুত আর বেয়াড়া যে কেনেড়ি তা দেখে না-হেসে থাকতে পারলেন না।
হঠাৎ ঠোঁটের ডগায় আঙুল তুলে ডিক কেনেডি শ্-শ্-শ্ বলে আওয়াজ করে উঠে জো-কে কোনো আওয়াজ না-করতে ইশারা করলেন। গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা গেলো ছোটো-একটি জলস্রোত কালো মাটির ওপর আঁকাবাঁকা রুপোলি রেখা এঁকে ছলছল করে বয়ে চলেছে, আর সেখানে কতগুলি ছোটো-বড়ো হরিণ জল পান করছে।
নিঃশব্দে বন্দুক উঁচিয়ে ডিক গাছের ফাঁক দিয়ে লক্ষ্য স্থির করলেন। তারপরেই প্রবল আওয়াজ করে আগুন ফেটে পড়লো, তীব্র দ্রুত নীল একটি শিখা ক্ষীণ রেখা একে হরিণদের দিকে ছুটে গেলো। চক্ষের পলকে হরিণেরা সবাই উধাও হয়ে গেলো : ক্রাস, চমক, আতঙ্ক—সব তাদের মুহূর্তের জন্যে বিমূঢ় করে তুলেছিলো, কিন্তু বন্দুকের ঘোড়ায় আবার চাপ দেবার আগেই একটি হৃতপ্রাণ হরিণ ছাড়া সেই জলস্রোতের আশপাশে আর-কেউ রইলো না। হরিণটির কাঁধে গুলি বিঁধেছে, মাটিতে পড়ে চারপা শূন্যে তুলে একটু ছটফট করে সে নিঃসাড় হয়ে গেলো।
প্রশংসাভরা গলায় জো বলে উঠলো, চমৎকার গুলি করেছেন; অদ্ভুত টিপ-অব্যর্থ।
হরিণটির দিকে এগিয়ে গেলেন ডিক। তারপর যখন জো তার চামড়া ছাড়িয়ে কিছু মাংস কাটতে ব্যস্ত, এমন সময় অনেক দূর থেকে একটি বন্দুকের আওয়াজ ভেসে এলো। চটপট কিছু মাংস কেটে নিলে জো, তারপর দু-জনেই তাড়াহুড়ো করে বেলুনের দিকে ফেরবার জন্যে দৌড় শুরু করে দিলেন, আর এমন সময় আবার আরেকটি গুলির শব্দ দু-জনের কানে এসে পৌঁছুলো।
আরো তাড়াতাড়ি! ছুটতে-ছুটতে বলে উঠলেন ডিক, নিশ্চয়ই ফার্গুসনের কোনো বিপদ হয়েছে!
একটুক্ষণের মধ্যেই কালো বনের জটিলতা ছাড়িয়ে এলেন ডিক, জো এলো তার পেছন-পেছন; আর বন ছাড়িয়ে এসেই দু-জনের চোখে পড়লো বেলুনটি, ডিক দেখলেন ফার্গুসন কারএর ওপর দাঁড়িয়ে আছেন।
সর্বনাশ হয়েছে। সেদিকে তাকিয়েই আর্ত গলায় চেঁচিয়ে উঠলো জো।
কী হয়েছে? কী? রুদ্ধশ্বাসে জিগেস করলেন ডিক।
মস্ত একদল কালো মানুষ–কাফ্রি বলে তো ওদের, তা-ই না?–আমাদের বেলুন ঘিরে ফেলেছে।
বনের সীমান্ত থেকে বেলুনটি প্রায় মাইল-দুয়েক দূরে। দূর থেকে দেখা গেলো খুদে-খুদে একদল কাফ্রি চারদিক থেকে বেলুনটিকে ঘিরে ফেলেছে। যে-গাছে ভিক্টরিয়াকে নোঙর করা হয়েছিল, সে-গাছেও কয়েকজন লোক উঠে পড়েছে। মগডালেও দেখা যাচ্ছে কালো-কালো ফুটকির মতো কয়েকজনকে।
রুদ্ধশ্বাসে ছুটলেন ডিক। চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখার মতো এক মুহূর্তও সময় নেই। অল্পক্ষণের মধ্যেই মাইল-খানেক পথ ছুটে পেরিয়ে এলো দু-জনে, আর এমন সময় আবার চারদিক কাঁপিয়ে ফার্গুসনের হাতে বন্দুক গর্জন করে উঠলো। গুলির আওয়াজ শুনে ডিক তাকিয়ে দেখলেন গাছের মগডাল থেকে কালো একটি মানুষ ডাল থেকে ডালে ঘুরে-ঘুরে. নিচের দিকে পড়ে যাচ্ছে। মাটি থেকে যখন সে প্রায় কুড়ি ফিট উঁচুতে হঠাৎ ডিগবাজি খেয়ে সার্কাসের ওস্তাদ খেলোয়াড়ের মতো একটা ডাল ধরে সে ঝুলে পড়লো, আর তার পা দুটি শূন্যে ঝুলতে লাগলো।
হঠাৎ জো সশব্দে হেসে উঠলো। আরে দেখুন, দেখুন, মিস্টার কেনেডি, ওটা ল্যাজ দিয়ে ডালটা জড়িয়ে ধরে ঝুলছে! এ-যে দেখছি কালো মত একটা বাঁদর। আরে, তা-ই তো-ভারি অবাক কাণ্ড তো। সবগুলোই তো বাঁদর! ছি-ছি, আমরা কিনা তাদের কাফ্রি বলে ভুল করে বসেছিলুম।
আসলে ওগুলো ছিলো একপাল কুকুরমুখো বাঁদর যাদের বেবুন বলা হয়। ভীষণ হিংস্র স্বভাব-এরা দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে কেবল যে ভয়ই দেখায় তাই নয়, বাঁদুরে বুদ্ধির উৎকট ব্যবহারে অনেক সময় মানুষকে একেবারে নাজেহাল করে তোলে। দেখতে এত বিকট যে দস্তুরমতো ভয় করে। শেষকালে অবশ্য আরো কয়েকটি গুলি খেয়ে ঐ বেবুন-বাহিনী দাঁত-মুখ খিচিয়ে বিশ্রী আওয়াজ করতে-করতে পালিয়ে গেলো আর স্মৃতিচিহ্ন হিশেবে পেছনে কয়েকজন মৃত সঙ্গীকে রেখে গেলো তারা।
আর তার পরক্ষণেই জো-র সঙ্গে-সঙ্গে কেনেডিও ভিক্টরিয়ার কাছে এসে পৌঁছুলেন।
অল্পক্ষণ পরেই আবার নোঙর তুলে দেয়া হলো। আকাশে উঠে এসে অনুকুল বাতাস পেলে ভিক্টরিয়া, যথারীতি ভেসে চললো পশ্চিম দিকে। বেলা তখন গড়িয়ে এসেছে, প্রায় চারটে বাজে।
সন্ধে সাতটার সময় ভিক্টরিয়া কায়মি নদীর উপত্যকা পেরিয়ে এলো। সেই উপত্যকার পরেই মাইল-দশেক জুড়ে সমতল ভূমি : বেশ কতগুলো গ্রাম বাওবাব আর অন্যান্য গাছের ফাঁকে লুকিয়ে আছে। নোংরা এক-একটি গ্রাম, তাদের কুঁড়েঘরগুলি যেমন নড়বোড়ে তেমনি ভাঙাচোরা, বাসিন্দারাও তেমনি গরিব ও শ্রীহীন। ওরই মধ্যে একটা বাড়ির জৌলুশ আর জাঁকজমক আছে, উগোগোর সুলতান সেটায় থাকেন। অন্য অনেক অঞ্চলের চেয়ে এরা অপেক্ষাকৃত সুসভ্য, প্রাণপণে নিজেদের অবস্থা ফেরাবার চেষ্টা করছে।
কানেয়েসি উপত্যকা অতিক্রম করতেই সমতলভূমি শেষ হয়ে আবার শুরু হলো উঁচু-নিচু পাহাড়ি জায়গা। বেলুন কখনও চলেছে বনের ওপর দিয়ে, কখনও তার তলায় দেখা যাচ্ছে ছোটো-বড়ো পাহাড়ের কালো চূড়ো, কখনও-বা রেশমি শাদা সুতোর মতো আঁকাবাঁকা জলধারা, কখনও-বা কেবল ধূ-ধূ করা দিগন্তজোড়া মাঠ।সেই পাহাড়ি এলাকা শেষ হতেই আবার দেখা গেলো মাইল-মাইল জুড়ে পড়ে আছে সবুজ মাঠ, শ্যামলতায় ছাওয়া। ধীরে-ধীরে সন্ধে গাঢ় হয়ে রাত করে এলো। সে-রাত্রে আর বেলুন থামিয়ে কোথাও রাত্রিবাস করার চেষ্টা করলেন না ফার্গুসন, বেলুন একটানা উড়েই চললো।