মিস্টার আলাম্বার বয়স সত্তরের ওপরে। মাথায় পাকা চুল, রোগা এবং মুখে মিষ্টি হাসি লেগেই রয়েছে। আফ্রিকার মানুষ বলে গায়ের রং কালো কিন্তু আজ নিউ ইয়র্কে যেসব ভয়ঙ্কর চেহারার কালোকে অর্জুন দেখেছে, তাদের সঙ্গে কোনও মিল নেই। মিস্টার আলাম্বার পরনে ফুলপ্যান্ট এবং ফতুয়া গোছের রঙিন জামা। অত্যন্ত আন্তরিকভাবে তিনি ওদের বসতে বললেন।
মেজরের সঙ্গে পাশাপাশি সোফায় বসল অর্জুন। উলটোদিকে মিস্টার আলাদা। অর্জুন দেখছিল এই ঘরটি আফ্রিকার বিভিন্ন রকমের শিল্পদ্রব্যে সাজানো। কাঠের সরু অথচ প্রায় সাত ফুট দুটি নারী-পুরুষ মূর্তি চোখে পড়ার মতো।
মেজর পরিচয় করিয়ে দিলেন, এ হল আমার জুনিয়ার বন্ধু অর্জুন। ইন্ডিয়ার পূর্বপ্রান্তে হিমালয়ের নীচে একটি শহরে থাকে। অর্জুন একজন সত্যসন্ধানী। অনেকবার আমি ওর সঙ্গে কাজ করেছি।
মিস্টার আলাদা চোখ বড় করলেন, তাই নাকি? এ তো খুব ভাল খবর। আপনি ভগবানে বিশ্বাস করেন অর্জুন?
অর্জুন হাসল, যাঁরা বিশ্বাস করেন তাঁদের অমর্যাদা করি না।
ভদ্রলোককে খুব চিন্তিত দেখাল, ও, আই সি।
অর্জুন বলল, আমাকে আপনি ভুল বুঝবেন না। আমি নাস্তিক নই। যখন আমাদের পুজো হয় তখন ভগবানের প্রতীক হিসেবে যে মূর্তিগুলো পূর্বপুরুষরা তৈরি করেছেন তাঁদের দিকে হাতজোড় করে মস্কার করতে আমার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। কিন্তু কোনও কাজে সফল হওয়ার জন্যে নিজে উদ্যোগী না হয়ে ভগবানের ওপর ভরসা করে বসে থাকাটাকে আমি ঘৃণা করি। আপনি নিশ্চয়ই মাদার টেরিজার নাম শুনেছেন। অসহায় মানুষের উপকার করার জন্যে তিনি প্রতিনিয়ত ভগবানকে স্মরণ করেন। মানুষের উপকার যদি ভগবানকে স্মরণ করলে সম্ভব হয় আমি নিশ্চয়ই সেটা করতে রাজি আছি। তবে আমার কাছে মাদার ভগবান।
মিস্টার আলাম্বার মুখ এবার হাসিতে ভরে গেল। মাথা নাড়লেন তিনবার, তারপর বললেন, আপনি সত্যসন্ধানী। আফ্রিকা আমার মহাদেশ। একদিকে মোজাম্বিক আর জিম্বাবোয়ে, অন্যদিকে অ্যাঙ্গোলা, জাইরে আর তানজানিয়া, মাঝখানে আমার দেশ জাম্বিয়া। লিভিংস্টোন নামের এক শহরের কাছে আমার বাড়ি। প্রায় প্রতি বছর আমি আমার দেশের বাড়িতে গিয়ে এক মাস করে থাকতাম। কিন্তু গতবছর যেতে পারিনি। এবারও যাওয়া হবে না।
মেজর জিজ্ঞেস করলেন, কেন?
দুবছর আগে দিনপাঁচেক বাড়িতে থেকে বসওয়ানা গিয়েছিলাম। আফ্রিকার উপজাতিদের শিল্প নিয়ে অনেক পড়াশোনা করেছি। বসওয়ানার। গ্যাবর্নেতে পৌঁছে দুদিন ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। পাশেই কালাহারি মরুভূমি। মরুভূমি পেরিয়ে বেদুইন, যাযাবরের দল গ্যাবর্নে আসে বিশ্রামের জন্যে। সেই সুযোগে কেনাবেচা চলে। কালাহারিতে এখনও কিছু হিংস্র উপজাতি রয়েছে। তারা সাধারণত শহরে আসে না। একদিন বাজারে এলোমেলো ঘুরছি, একটি লোককে দেখলাম কাঁধে ব্যাগ নিয়ে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরা করতে। লোকটা যে মরুভূমির উপজাতিদের একজন তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। লোকটি একটি কিউরিও শপে ঢুকে যেতে আমি তাকে অনুসরণ করলাম। সম্ভবত দোকানদার তখন দোকানে ছিল না। একটি বাচ্চা ছেলে কাউন্টারে ছিল। লোকটি তাকে নিচু গলায় কিছু বললে সে জিনিসটা দেখতে চাইল। আমি তখন দোকানের অন্য জিনিস মন দিয়ে দেখার ভান করছিলাম। আড়চোখে দেখলাম লোকটা একটা কালো চকচকে জিনিস দেখাচ্ছে। ছেলেটার সেটা ঠিক পছন্দ হল না। লোকটা একটু অনুরোধ করায় ছেলেটা যা দাম বলল তা শুনে জিনিসটা ব্যাগে ঢুকিয়ে বেরিয়ে গেল রাস্তায়। আমি সঙ্গে-সঙ্গে ওকে অনুসরণ করে একটু নির্জন জায়গায় গিয়ে ধরে ফেললাম। বললাম, তুমি যে জিনিস বিক্রি করতে চাইছ তা যদি আমার পছন্দ হয় তা হলে কিনে নিতে পারি। জিনিসটা দেখাও।
লোকটা জিজ্ঞেস করল, আপনার পরিচয় জানতে পারি?
বললাম, আমার নাম আলাদা। আমি লিভিংস্টোন শহরের কাছে থাকি। বিরল জিনিস সংগ্রহ করার শখ আছে বলে দেখতে চাইছি।
লোকটা বলল, যে জিনিস আপনাকে দেখাব তা খুব মূল্যবান। শহরের লোক এর মূল্য ঠিক বুঝবে না। কিন্তু গ্রাম জঙ্গল, মরুভূমির লোক এই জিনিসকে ভয় যেমন করে, ভক্তিও।
সে ব্যাগ থেকে যা বের করল তাকে আমি সহজেই চিনতে পারলাম। ওটা একটা ব্ল্যাক কোবরার মাথা এবং শরীরের অংশ। বাকিটা, লেজের দিকটা নেই। কালো পাথরজাতীয় কোনও বস্তু খোদাই করে তৈরি করা হয়েছে। এক সময় এই অঞ্চলের মানুষের কাছে সাপ, বিশেষ করে এই সাপ ভগবানের প্রতিনিধি ছিল। যখন আমেরিকার জন্যে শ্রমিক সংগ্রহ করতে ক্রীতদাস করে এদের নিয়ে যাওয়া হয় তখন ওই ধারণাটাই চালু ছিল। পরবর্তীকালে স্বাধীন আমেরিকার কিছু কালো মানুষ ওই সাপকে কেন্দ্র করে একটি সঙ্ঘ তৈরি করে বলে শুনেছি। তা লোকটির সঙ্গে দরাদরি করে আমি পাথরের সাপটিকে কিনে ফেললাম। ইঞ্চি আটেকের ওই পাথুরে বস্তুটির ওজন বেশি নয়। বড়জোর দেড় পাউন্ড।
পরদিন কাগজে দেখলাম সেই লোকটি খুন হয়ে গেছে। যে ডেরায় সে উঠেছিল সেখানে এসে কেউ তাকে খুন করে গেছে। লোকটার ছবি ছাপিয়ে পুলিশ অনুরোধ করেছে কেউ যদি কোনও হদিস জানে তা হলে অবিলম্বে যোগাযোগ করলে ভাল হয়। লোকটির মৃতদেহের পাশে একটা কাগজে লেখা ছিল, ভগবানকে যে চুরি করে কাছে রাখবে তারই এই দশা হবে।
আমি সেদিনই বত্সওয়ানা ছেড়ে জাইরেয় ফিরে এলাম।
মিস্টার আলাম্বা থামতেই অর্জুন জিজ্ঞেস করল, ওরা কিছু জানতে পেরেছে?
আমি ঠিক জানি না। তবে সেবার দেশের বাড়িতে থাকার সময়েই টের পেলাম অচেনী কিছু লোক গ্রামের আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। গ্রামের লোকজন তাদের তাড়িয়ে দিলেও তারা শাসিয়ে গিয়েছে আবার ফিরে আসবে বলে। আমি আর ঝুঁকি নিলাম না। রাতের অন্ধকারে গাড়ি ভাড়া করে সোজা চলে এলাম লুসাকায়। সেখান থেকে হারারে পৌঁছে প্লেন ধরলাম। জাম্বিয়ার কোনও এয়ারপোর্টে যাওয়ার ভরসা পাইনি।
সেই সাপটি আপনার এ-ফ্ল্যাটে এখনও আছে?
হ্যাঁ আছে। আমি তোমাদের বিশ্বাস করেছি, কারণ তোমরা হিন্দু, ভারতবর্ষের মানুষ। তা ছাড়া তুমি সত্যসন্ধানী। আশা করি এসব কথা তোমরা গোপনেই রাখবে। আমি খুব বিব্রত হয়ে আছি। কারও সঙ্গে আলোচনা করার সুযোগ পাইনি। তোমাদের এ কথা বলার কারণ সেটাও। এসো আমার সঙ্গে।
মিস্টার আলাম্বা তাদের পাশের ঘরে নিয়ে গেলেন। ঘরে ঢুকতেই দৃশ্যটি দেখতে পেল ওরা। টেবিলের ওপর একটি কাচের বাক্সে আলো জ্বালা রয়েছে। তার মধ্যে সেই লেজ খসে যাওয়া সাপটিকে রেখেছেন মিস্টার আলাম্বা। সাপের মুখের কাছে একটা ছোট বাটিতে দুধ দেওয়া হয়েছে।
সাপটিকে খুঁটিয়ে দেখছিল অর্জুন। মেজর জিজ্ঞেস করলেন, পাথরের সাপকে দুধ দিয়েছেন কেন? ও দুধ খাবে নাকি? হা হা হা!
মেজরের হাসি থামলে মিস্টার আলাম্বা বললেন, বেশ কিছুদিন আগে টিভিতে দেখেছিলাম ভারতবর্ষের এক হিন্দু দেবতা যাকে হাতির মতো দেখতে তাঁর পাথরের মূর্তি নাকি দুধ খেয়ে নিচ্ছে অবলীলায়। এটা কি সত্যি?
মেজর হকচকিয়ে গেলেন, হ্যাঁ, আমিও শুনেছি। তবে ব্যাপারটা বুজরুকি।
আপনি বুজরুকি মনে করলেও যারা দুধ খাইয়েছিল তারা মনে করেছে যে, ভগবান তুষ্ট হয়ে দুধ খেয়েছেন। মরুভূমিতে সাপকে যারা ভগবান মনে করে তারা নিয়মিত উটের দুধ দিয়ে পুজো করে। এক বাটি দুধ দিলে যদি তাদের ওই সংস্কারটাকে মান্য করা যায় তাতে কোনও দোষ তো আমি দেখি না।
অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনি যে আমেরিকায় থাকেন তা নিশ্চয়ই আপনার গ্রামের মানুষজন জানেন। আপনার আত্মীয়স্বজনের ওপর চাপ দিলে এই ফ্ল্যাটের ঠিকানা পেতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। কিন্তু এই দু বছরে ওরা এখানে যখন পৌঁছয়নি তখন বোঝা যাচ্ছে সেই ক্ষমতা ওদের নেই।
আপনি ভুল করছেন মিস্টার অর্জুন। এই দু বছরে আমি ঠিক পাঁচবার ফ্ল্যাট পালটেছি। কোথায় কোন ফ্ল্যাটে যাচ্ছি তা বলে আসিনি। এখানে এসেছি মাস পাঁচেক হল। আমি এখন অবসরে আছি। কাগজে প্রবন্ধ লিখে যা পাই আর জমানো টাকার সুদে ভালই চলে যায় আমার। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে যাই না। ওঁর সঙ্গে আমার আলাপ হয় লিফটে। একটি সাদা ছেলে মাতাল হয়ে আমাকে খারাপ কথা বলছিল লিফটে ওঠার সময়। উনি সতর্ক করেন তাকে। সেকথা কানে না নিয়ে আরও খারাপ গালাগাল করলে উনি তাকে উত্তমমধ্যম দেন। শেষপর্যন্ত ছেলেটি ক্ষমা চাইলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ওই সময় আমাদের পরিচয় হয়। কোনও ভদ্রলোক দীর্ঘকাল এইভাবে প্যাঁচার মতো বাস করতে পারে না। আমরা দুবার পরস্পরের ফ্ল্যাটে গিয়েছি। উনি অভিযাত্রী। পৃথিবীর রহস্য উদ্ধার করতে এই বয়সেও কত আগ্রহ ওঁর। যাই হোক, ওদের ক্ষমতাকে ছোট চোখে দেখা ঠিক নয়। ধর্মবিশ্বাস যখন অন্ধ হয় তখন মানুষ পারে না এমন কাজ নেই।
মেজর জিজ্ঞেস করলেন, আপনি পুলিশকে জানাচ্ছেন না কেন?
আমি প্রথমে ভেবেছিলাম জানাব। কিন্তু পরে মনে হল, তাতে কোনও লাভ হবে না। পুলিশ আমাকে কতদিন পাহারা দিয়ে থাকবে? বরং, তারা উদ্যোগী হলে লোকে আমার অস্তিত্ব জেনে যাবে। হ্যাঁ, এখানে যদি ওরা এসে পড়ে তখন পুলিশকে জানাতেই হবে। মিস্টার আলাম্বাকে বিমর্ষ দেখাচ্ছিল।
মেজর ভরসা দিলেন, সেটা কখনওই ঘটবে না মিস্টার আলাম্বা। কালাহারি মরুভূমির কিছু মানুষের পক্ষে এই নিউ ইয়র্ক শহরে এসে আইনবিরুদ্ধ কাজ করা সম্ভব হবে না। এ নিয়ে কোনও দুশ্চিন্তা করবেন না।
মিস্টার আলাদা মাথা নাড়লেন, ওদের এখানে আসার দরকার নেই। এই আমেরিকায় খ্রিস্টান হয়ে যাওয়া অনেক কালো মানুষের রক্তে ওই ধর্মবিশ্বাস এখনও সক্রিয়। যে-সমস্ত কালো মানুষকে জাহাজে তুলে ক্রীতদাস হিসেবে এখানে নিয়ে আসা হয়েছিল তাদের উত্তরপুরুষদের কেউ কেউ এখনও মনে করে আফ্রিকাই তাদের দেশ। ক্রীতদাস প্রথা লোপ করে যখন কালোদের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেওয়া হল তখন অনেকেই পূর্বপুরুষের দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করে। এখানকার স্বাচ্ছন্দ্য ওখানে পাওয়া যাবে না, এখানকার রোজগার ওখানে হবে না, তাই আফ্রিকায় ফিরে যেতে অনেকেই চায়নি। যায়নি। কিন্তু আফ্রিকানদের যাওয়া-আসা আরম্ভ হয়ে গেল। এবার নিশ্চয়ই আপনারা আমার বক্তব্য বুঝতে পারছেন।
এবার অর্জুন মাথা নাড়ল, বুঝলাম। কিন্তু মিস্টার আলাদা, আপনি কালাহারি মরুভূমি থেকে বেশি দূরে থাকেন না। ওখানকার মানুষের ধর্মবিশ্বাস থেকে আপনি মুক্ত হয়ে আছেন কী করে?
আমি পড়াশোনা করেছি বিদেশে। ফিরে গিয়েছিলাম গবেষকের চোখ নিয়ে। যা দেখেছি তা বিশ্লেষণ করেছি বাস্তবের ওপর দাঁড়িয়ে। তারপর এখানে অধ্যাপনা করার সময় বারংবার গিয়েছি সেখানে। কুয়ো থেকে বেরিয়ে এসে পুকুরে স্নান করলেই বোঝা যায় পার্থক্য কী! সেটা বুঝেছিলাম বলেই ওই অন্ধবিশ্বাস আমাকে প্রভাবিত করতে পারেনি।
আছা, ওই সাপের মূর্তি যাদের সম্পত্তি তাদের কাছে ফেরত পাঠানো যায় না?
আমি সেকথাই বলতে চাইছি। স্রেফ কৌতূহলে আমি ওটা কিনেছিলাম। ভেবেছিলাম ওটাকে কিউরিও হিসেবে রাখব। পরে যখন পরিস্থিতি এরকম হল তখন ফিরিয়ে দিতে চেয়েছি। আমার কাছে ওটাকে রেখে জীবনের ঝুঁকি নেওয়া তো বোকামি। কিন্তু সমস্যা হল, কাকে ফেরত দেব? মরুভূমির কোন উপজাতি ওর সত্যিকারের মালিক? এ প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই।
মেজর বললেন, আপনি ওটাকে আমেরিকান মিউজিয়ামে দিয়ে দিতে পারেন। ওরা ইতিহাস জানলে সাগ্রহে নেবে।
মিস্টার আলাদা বললেন, ঠিক। কিন্তু চিরজীবনের জন্যে হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় আমার ওপর ওদের রাগ আরও বেড়ে যাবে। ভদ্রলোক হাসলেন, মিস্টার অর্জুন। আপনার বয়স অল্প? আফ্রিকা সম্পর্কে আপনার কতটুকু ধারণা আছে তা আমি জানি না। কিন্তু আপনি তো সত্যসন্ধানী। আমার জন্যে এই সত্যটির সন্ধান করে দিতে পারেন? ওই মূর্তির প্রকৃত মালিক কারা?
মেজর বললেন, তার জন্যে তো আফ্রিকায় যেতে হবে?
হ্যাঁ। সে সমস্ত খরচ আমি বহন করব। আর আপনি যদি সফল হন তা হলে উপযুক্ত পারিশ্রমিক থেকে বঞ্চিত হবেন না।
অর্জুন বলল, এই মুহূর্তে আপনাকে আমি কোনও কথা দিচ্ছি না। আমাকে ভাবতে হবে। অন্তত একটা দিন আমার সময় চাই।
বেশ। তাই হবে। এই নিন আমার কার্ড। আগামীকাল যে-কোনও সময়ে ফোন করবেন। নিতান্ত বাধ্য না হলে আমি বাইরে যাই না। যাক গে, অনেক কথা বলেছি। এবার বলুন, কী খাবেন? চা, না কফি?
অর্জুন কিছু বলার আগেই মেজর বললেন, অনেক ধন্যবাদ। অর্জুন আজ প্রথমবার আমার কাছে এসেছে। ওকে আমিই খাওয়াব। ইচ্ছে হলে আপনি আমাদের সঙ্গে আসতে পারেন।
মিস্টার আলাম্বা বললেন, আজ থাক। অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু, এই দেখুন, আসল কথাটাই আমি জিজ্ঞেস করিনি। আমার কাছে ওঁকে কীজন্যে নিয়ে এসেছিলেন? কোনও প্রয়োজন?
মেজর বললেন, সে তো বটেই। কিন্তু আপনার সমস্যা এত তীব্র যে, আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম কথাটা। অৰ্জুন বলো!
অর্জুন গলা থেকে লকেটটা খুলে সামনে ধরল, এরকম জিনিস আগে দেখেছেন?
মিস্টার আলাম্বার চোখ ছোট হয়ে এল। অর্জুন লক্ষ করল একটু-একটু করে তাঁর ঠোঁটে কাঁপুনি শুরু হল। শেষপর্যন্ত তিনি বলে উঠলেন, মাই গড!
মেজর জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার?
প্রায় ছোঁ মেরে লকেটটা হাতে নিয়ে ঝুঁকে পড়লেন ভদ্রলোক। উলটেপালটে খুঁটিয়ে দেখে তাকিয়ে উঠে গেলেন দেওয়ালজোড়া র্যাকে সাজানো বইয়ের সামনে। তিন-চারটে বই হাতড়ে পাতা ওলটাতে লাগলেন। তাঁকে খুব উত্তেজিত দেখাছিল। শেষপর্যন্ত একটি পাতায় তিনি স্থির হলেন। খানিকটা পড়ে আবার লকেট দেখে ঘুরে দাঁড়ালেন মিস্টার আলাম্বা, এই লকেট আপনি কোথায় পেয়েছেন?
অর্জুন গোরক্ষনাথের ব্যাপারটা বলল। গোরক্ষনাথের গুরুদেব আফ্রিকার কোনও বন্দর থেকে এই লকেটটি সংগ্রহ করে। সেটা জানাজানি হয়ে যাওয়ায় লোকটির প্রাণসংশয় হয়। কোনওমতে পালিয়ে জাহাজে ওঠে সে। কিন্তু সেই জাহাজ সমুদ্রে ড়ুবে যায়। তবে লোকটি কোনওরকমে বেঁচে যায়। ওর শিষ্য গল্প বলেছে যে, কাঠ ভেবে সাপকে জড়িয়ে ভেসে ছিল লোকটা। এটা আমি বিশ্বাস করি না। যা হোক তারপর থেকে এই লকেটটাকে খুব পুজো করেছে। লোকটা। এইটুকু আমি জানি।
মিস্টার আলাম্বা এগিয়ে এলেন বই আর লকেট নিয়ে। এই দেখুন, এই স্কেচটার সঙ্গে লকেটের কী মিল!
ওরা দেখল। সত্যি, এই লকেটের সাপের সঙ্গে স্কেচের সাপের পার্থক্য নেই বললেই চলে। মিস্টার আলাম্বা বললেন, অদ্ভুত ব্যাপার। আমার কাছে যে সাপের মূর্তি রয়েছে সেটাও এই শ্রেণীর সাপ। মুখের গঠন এক। কিন্তু ভঙ্গি আলাদা। এরা অত্যন্ত বিষধর সাপ।
অর্জুন বলল, কাল রাত্রে টিভিতে বারংবার সাপের কথা বলা হচ্ছিল। আমি যখন এয়ারপোর্টের কাস্টমসকে লকেটটা দেখাই তখন একটা লোক এটাকে দেখতে পায়। পরে লোকটা কাছে এসে ভাল করে দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। আমি জানি না তার কাছ থেকে খবর পেয়েই হয়তো টিভিতে বারংবার আবেদন করা হয়েছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যে।
হয়তো। কারণ এই বইতে লেখা হয়েছে আফ্রিকার নীচের দিকের দেশগুলোর উপজাতিরা একসময় এই সাপকে ভগবান বলে মনে করত। ওদের এক দলের সদার স্বপ্নে আদেশ পায় সর্পদেবতা মাটিতে পোঁতা আছেন। সেই সাপটিকে তিনি উদ্ধার করেন। অদ্ভুত ধাতব বস্তুতে তৈরি সেই সাপ। ওটা পাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে সেই সর্দার এবং তার দলের উন্নতি হতে শুরু করে। অন্য দলগুলো ঈর্ষা করছে বুঝে সদার ঠিক এর ড়ুপ্লিকেট সাপ তৈরি করে। কিন্তু সেটি স্লেট পাথরের তৈরি বলে পার্থক্য বোঝা যায়। মূল সাপের মূর্তির চোখের তলায় একটি গর্ত আছে, যার মধ্যে কোবরার বিষ সঞ্চিত ছিল। ওই আসল মূর্তি চুরি হয়ে যায় সর্দারের মৃত্যুর পর। নকলটির মালিকানা নিয়েও ঝামেলা হয়। কিন্তু আসলটিকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। তারা তখন আর একটি বড় পাথরের সাপ তৈরি করে পুজো শুরু করলেও আসলটিকে খুঁজে বের করার চেষ্টা অব্যাহত থাকে। পড়া শেষ করে লকেটটাকে ওপরে তুলে মিস্টার আলাম্বা বললেন, এই সেই আসল সাপ।