০৭. মিঠু খুব ধীরে তার বিষণ্ণ মুখখানা তুলল

নমস্কার।

মিঠু খুব ধীরে তার বিষণ্ণ মুখখানা তুলল। ব্যাঙ্ক এখন ফাঁকা। বেলা তিনটে বেজে গেছে। টেবিলের ওপাশে শবর দাঁড়িয়ে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিঠু বলল, বসুন।

শবর বসল।

কেমন আছেন?

মিঠু মৃদু একটু হাসবার চেষ্টা করে বলল, আছি।

আজ ঠিক জেরা করতে আসিনি।

তা হলে কি অ্যারেস্ট করতে?

এখনই নয়। আমি আর্লি অ্যারেস্টে বিশ্বাসী নই। বরং সন্দেহভাজনকে নড়াচড়া করতে দিলে এবং নজর রাখলে ভাল কাজ হয়।

তাই বুঝি। বলুন, কী করতে পারি আপনার জন্য?

আমার জন্য নয়, দেশ ও দশের জন্য। আমার একটা ইনফর্মেশন চাই।

কীসের ইনফর্মেশন?

রিগার্ডিং বরুণ ঘোষ।

অনেক কথাই তো হয়েছে।

শবর মাথা নেড়ে বলল, তা হলেও অনেক কিছু জানা যায়নি।

কী জানতে চান?

গত দু-তিন বছর ধরে ওঁর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে উইথড্রয়ালের পরিমাণ হঠাৎ অস্বাভাবিক বেড়ে গিয়েছিল কি না।

ওঁর অ্যাকাউন্ট চেক না করে তো বলা যাবে না।

চেক করুন। করছি। আর কিছু?

হ্যাঁ। উনি কেমন লোক ছিলেন?

সে কথা তো বলেইছি।

লোনলি, উইডোয়ার, মিডল এজেড?

হ্যাঁ।

শবর একটু হাসল। তারপর বলল, যতদুর জানি মিতালিদেবীর দু’বছর বয়সের সময় বরুণবাবুর স্ত্রী মারা যান।

হ্যাঁ।

তখন ওঁর দ্বিতীয়বার বিয়ে করার বয়স ছিল।

হ্যাঁ।

উনি মারা গেছেন চুয়ান্ন বছর বয়সে।

তা হবে।

বয়সটা খুব বেশি নয়, কী বলেন?

আপনি একটা কিছু ইঙ্গিত করতে চাইছেন।

হ্যাঁ। বুঝতে পারছেন কি?

না। আন্দাজ করছি।

তা হলে স্পষ্ট করেই বলি। ওয়াজ দেয়ার এ উওম্যান সামহোয়ার?

আমি ঠিক জানি না।

একটু ভাবুন। আপনার সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। আপনি তার অ্যাকাউন্ট হ্যান্ডেল করেছেন।

মিঠু ভ্রু কুঁচকে খানিকটা চুপ করে রইল।

শবর বলল, বলতে আপনার রুচিতে বাধছে কি?

তা নয়।

তা হলে?

এটুকু বলতে পারি যে, সম্ভাবনাটা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

আচ্ছা, উনি কি সবসময়ে নিজেই টাকা তুলতে আসতেন?

না। মাঝে মাঝে ওঁর রান্নার লোক হরেন বা ড্রাইভারও আসত।

আর কেউ?

ন্‌না।

দেখুন, কেসটা সিরিয়াস একটা টার্ন নিচ্ছে। এ সময়ে দ্বিধা করলে আমরা মুশকিলে পড়ব। ভাল করে ভেবে দেখুন।

দেখুন, বেয়ারার চেক তো যে কাউকেই দেওয়া যায়। উনি অনেককেই হয়তো চেক পেমেন্ট করতেন। সব মনে রাখা কি সম্ভব?

না। তবু কোনও অস্বাভাবিকতা ঘটে থাকলে সেটা মনে থাকতে পারে।

কিছু মনে পড়ছে না।

আচ্ছা, উনি কি অনেককেই চেক পেমেন্ট করতেন?

যতদূর মনে আছে, না।

ওঁর আরও তিনটে ফিকটিশাস অ্যাকাউন্ট আছে।

সে তো আপনি জানেন।

এই তিনটে অ্যাকাউন্ট থেকে উনি টাকা তুলতেন কি?

খুব কম।

মনে করে দেখুন তো, কখনও এ তিনটের কোনও একটা থেকে এমন কেউ টাকা তুলতে এসেছেন কি না, যে একটি মেয়ে, যার বয়স এখন বত্রিশ-তেত্রিশ, ছিপছিপে, ছোটখাটো, আনইমপ্রেসিভ চেহারা?

মিঠু একটু হাসল।

হাসলেন যে!

এই বিবরণটা আপনি আর একজনকেও দিয়েছেন।

হ্যাঁ। জয়িতাদেবীকে।

মনে পড়ছে না।

শুনুন মিঠুবাবু, মানুষের ব্রেন একটা অনন্ত স্টোরহাউস। তাতে সব জমা থাকে। ব্রেনটা একটু ট্যাপ করুন। চোখ বুজে মেডিটেট করুন।

মিঠু অসহায়ভাবে বলল, তার চেয়ে কম্পিউটারের শরণাপন্ন হওয়াই বোধহয় ভাল।

গুড আইডিয়া। কম্পিউটার অবশ্য কোনও মুখশ্রী দেখাবে না। তবু ইট মে হেলপ টু রিমেমবার।

টেবিলের একধারে রাখা মনিটরটা চালু করে কিছুক্ষণ নিবিষ্টভাবে দেখল মিঠু। তারপর বলল, পিনাকী শর্মার অ্যাকাউন্ট থেকে রেগুলার উইথড্রয়াল হয়েছে।

অ্যামাউন্টটা?

প্রতি মাসে তিন হাজার।

সেলফ চেক?

হ্যাঁ, উনি আমেরিকায় যাওয়ার আগে একটা বড় উইথড্রয়াল দেখছি।

কত?

ছত্রিশ হাজার।

কী মনে হয়?

বুঝতে পারছি না।

টাকাটা উনি কাকে দিতেন?

আপনি যা সাজেস্ট করছেন তা মেনে নিতে পারলে ভাল হত হয়তো। কিন্তু—

মনে পড়ছে না তো?

না।

তা হলে আমি একটু সাজিয়ে দিই। বিয়িং এ উইডোয়ার উনি একটা শুকনো জীবন কাটাতেন। মেয়েটাকে মানুষ করতে হবে বলে এবং সৎ মায়ের ভয়ে বিয়েও করেননি। কিন্তু লাইফ হ্যাজ ইটস ডিম্যান্ড। সুতরাং একটু বেশি বয়সে, ধরুন লেট ফর্টিজ-এ উনি একজন কাউকে পিক আপ করেন। তাকে কখনও নিজের বাড়িতে জায়গা দেননি। কিন্তু রেগুলার তাকে ভিজিট করতেন। মাসে মাসে তাকে মাসোহারা দিতে হত। পিনাকী শর্মা নামটাই হয়তো মেয়েটাকে বলেছেন। মেয়েটাও এক জায়গায় নিজেকে জুলেখা শর্মা বলে পরিচয় দিয়েছিল।

এরকম হতেই পারে।

খুব নির্দোষ ব্যাপার বলছেন?

তা বলিনি। তবে সারকামস্ট্যান্সেস মে কমপেল এ ম্যান—

হ্যাঁ হ্যাঁ। ঠিক কথা। চেকগুলো কি সবই সেলফ চেক?

দেখতে হবে।

দেখুন। তবে তাড়া নেই। মেয়েটাকে খুঁজে বের করাই এখন প্রথম কাজ।

**

হরেনবাবু, আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই।

যে আজ্ঞে। বলুন।

আপনি কতদিন বরুণবাবুর বাড়িতে কাজ করছেন?

তা পনেরো-ষোলো বছর হবে।

যখন আপনি কাজে ঢোকেন তখন তো বরুণবাবুর স্ত্রী বেঁচে নেই।

আজ্ঞে না। তার কয়েক বছর আগেই মারা যান।

একটা কথার জবাব ভেবেচিন্তে দিন। বরুণবাবুর চরিত্র কেমন ছিল?

আজ্ঞে, ভালই। চমৎকার মানুষ ছিলেন।

কিন্তু আমরা জানি গত কয়েক বছর হল বরুণবাবুর সঙ্গে একটি মেয়ের ঘনিষ্ঠতা হয়। মেয়েটিকে আপনি কখনও দেখেছেন?

আজ্ঞে না।

আরও স্পষ্ট করে বলি, মেয়েটিকে বরুণবাবু এ বাড়িতে কখনও আনতেন না। হয়তো নিজের আসল পরিচয়ও দেননি। কিন্তু তিনি মেয়েটির কাছে যেতেন। আপনার কি মনে পড়ে গত কয়েক বছর যাবৎ বরুণবাবু মাঝে মাঝে বাইরে রাত কাটাতেন কি না।

তা কাটাতেন।

গত ক’বছর ধরে?

হিসেব করিনি। সাত-আট বছর ধরে হবে।

এবার খুব হিসেব করে জবাব দেবেন। মেয়েটি ছোটখাটো চেহারার, মাজা রং, ছিপছিপে, কিন্তু রুগণ নয়। মেয়েটি কখনও রীতা দাস, কখনও জুলেখা শর্মা নামে পরিচয় দেয়।

নাম জানি না, তবে আপনি যেমন বলছেন তেমন একটা মেয়ে বাবুর সঙ্গে একবার দেখা করতে এসেছিল।

কবে?

বাবু আমেরিকা যাওয়ার মাত্র কয়েকদিন আগে। দিদিমণি চলে যাওয়ার পর এ বাড়িতে মেয়েছেলে বড় একটা আসে না। তাই এ মেয়েটিকে দেখে একটু ধন্দ লেগেছিল।

কেন এসেছিল?

তা জানি না। বাবুর খোঁজ করাতে আমি তাকে ঘরে বসিয়ে বাবুকে খবর দিই।

ওঁদের মধ্যে কী কথা হয়েছিল জানেন?

না। তবে বাবু যে মেয়েটিকে দেখে রেগে গিয়েছিলেন তা দূর থেকেও চেঁচামেচি শুনে বুঝেছি। বলতে ভুলে গেছি, মেয়েটার সঙ্গে একটা বাচ্চা ছেলেও ছিল।

ছেলে! কত বড় ছেলে?

চার-পাঁচ বছর হবে।

বরুণবাবু চেঁচিয়ে কী বলেছিলেন মেয়েটাকে?

একটা-দুটো কথা শুনেছি। একবার বললেন, এখানে আসার দরকার ছিল না। আর একবার যেন বললেন, টাকা কি গাছে ধরে?

আর কিছু শোনেননি?

না।

মেয়েটাকে আর কখনও দেখেছেন?

হ্যাঁ।

কবে এবং কোথায়?

দিদিমণি যেদিন খুন হন তার দুদিন আগে।

কোথায়?

ফটকের বাইরে।

কী করছিল?

চেয়ে ছিল। আমি বাজারে বেরোনোর সময়ে মুখোমুখি পড়ে যাই। কী চায় জিজ্ঞেস করায় বলল, কাজ খুঁজছে। আগে একবার দেখেছিলাম, তাই চেনা চেনা ঠেকছিল।

সঙ্গে ছেলেটা ছিল?

না।

কীরকম কাজ খুঁজছে বলল?

সে কথা আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। বলল গভর্নেন্স বা আয়া। আমি বললাম এখানে হবে না। তখন চলে গেল। চলে যাওয়ার অনেকক্ষণ বাদে কোথায় দেখেছি, কোথায় দেখেছি ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে পড়ল যে এই মেয়েটাই বাবুর কাছে একবার এসেছিল।

এ বাড়িতে সে ঢোকেনি, ঠিক জানেন?

না।

মিতালিদেবীর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেনি?

আমার তো চোখে পড়েনি। তবে আমাকে তো বাজারহাট রান্নাবান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। নয়নের মা বলতে পারবে হয়তো।

সে কে?

কাজের মেয়ে। ডেকে দিচ্ছি।

নয়নের মা রোগা, কালো, মধ্যবয়স্কা। খুব পান খায়। সব শুনেটুনে বলল, এসেছিল।

কবে?

ওই সব্বোনেশে ব্যাপার যেদিন হয় তার আগের দিন দুপুরে। দিদিমণি তাকে দুর-দূর করে তাড়িয়ে দেয়।

কোনও ঝগড়াঝাটি হয়েছিল?

না। মেয়েটা নীচের ঘরে বসেছিল। দিদিমণি নেমে এসে দেখা করলেন। দু’-চারটে কথার পরই ওপর থেকে শুনলাম দিদিমণি চিৎকার করে উঠলেন, বেরিয়ে যাও। বেরিয়ে যাও!

আপনি চেঁচামেচি শুনে নেমে এলেন না।

না। ঝাড়পোঁছ করছিলাম। ভাবলাম সাহায্যটাহায্য চাইতে এসেছে। কত লোকই তো আসে৷

দিদিমণি কিছু বলেছিলেন আপনাকে?

না। একটু থমথমে মুখ করে ছিলেন কিছুক্ষণ। তারপর আবার সব ঠিক হয়ে গেল।

আর কিছু মনে পড়ছে?

না।

মেয়েটা ধমক খেয়ে উলটে কিছু বলেছিল?

না। আমি দোতলা থেকে দেখলাম গটগট করে বেরিয়ে গেল।

পোশাকটা মনে আছে?

সাদা চুড়িদার।

**

আই অ্যাম ডিস্টার্লিং ইউ। কিন্তু কেসটা সিরিয়াস। কাজেই–

ইটস ওকে অফিসার। হাউ ক্যান উই হেলপ ইউ?

আমি একটি ছেলের সন্ধান করছি। এখন তার বয়স হবে ছয়-সাত। নাম জানি না। কিন্তু পদবিটা শর্মা হলেও হতে পারে। বাবার নামও জানি না। তবে দেয়ার ইজ এ পসিবিলিটি যে, বাবার নাম পিনাকী শর্মা। আপনাদের রেকর্ডটা কনসাল্ট করবেন?

নো প্রবলেম। আপনি বসুন, আমি আসছি।

হেড মিস্ট্রেস উঠে গেলেন। শবর বসে রইল। অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়া। তবু লেগেও যায় অনেক সময়ে। মেরিজ স্কুল নামটা যখন জুলেখার মুখে এসেছে তখন হলেও হতে পারে, ওর ছেলে এই স্কুলে পড়ে।

হেড মিস্ট্রেস পনেরো মিনিটের মধ্যেই ফিরে এলেন। মুখে একটু উদ্বেগ।

ইয়েস অফিসার, ক্লাস টু-তে দু’জন শর্মা আছে। টুইন ব্রাদার্স। কিন্তু ওদের বাবার নাম সুজিত শৰ্মা, এ মার্চেন্ট। মিস্টার শর্মা পেরেন্টস মিটিং-এ আসেন, আমরা তাঁকে চিনি।

শবর মাথা নেড়ে বলল, না, এরা নয়।

দেন উই আর সরি।

শবর উঠতে যাচ্ছিল। তারপর মাথায় বজ্রাঘাতের মতো একটা কিছু চমকে গেল তার। কী বোকা সে!

ম্যাডাম।

ইয়েস অফিসার।

আই অ্যাম মেকিং এ মেস অফ থিংস। কিন্তু দয়া করে আমাকে আর একটা ইনফর্মেশন দিন।

বলুন।

ছেলেটার পদবি সম্ভবত ঘোষ। বাবার নাম বরুণ ঘোষ।

নিশ্চয়ই। বসুন, আমি চেক করে আসছি।

পনেরো মিনিট যেন পনেরো ঘণ্টার মতো কাটল। হেড মিস্ট্রেস ফিরে এলেন।

ইয়েস অফিসার। হি ইজ ইন ক্লাস টু। প্রীতীশ ঘোষ। বাবা বরুণ ঘোষ, মা দোয়েল ঘোষ। ঠিকানা টুয়েন্টি এ বাই সিক্স হরিশ চ্যাটার্জি বাই লেন।

শবর চিরকুটটা পকেটে রেখে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাডাম।

ইউ আর অলওয়েজ ওয়েলকাম।

**

দরজা খুলল সেই মেয়েটাই। তাকে দেখে একটুও চমকাল না। চোখে চোখ রেখে একটু চেয়ে রইল। তারপর দরজাটা ছেড়ে দিয়ে বলল, আসুন।

চিনতে পারছেন?

পারছি। জানতাম আপনি আসবেন।

গলির মধ্যে একটা পুরনো বাড়ির একতলার ছোট্ট বাসা। ভিতরটা অপরিচ্ছন্ন নয়। বরং বেশ তকতকে ঝকঝকে। একটা ডিভান আছে, দুটো বেতের চেয়ার, কারে শোকেসের ওপর একটা রঙিন টিভিও পাশে ভিসিআর। এটা স্পষ্টতই বাইরের ঘর। ভিতরে একখানা শোয়ার ঘরও আছে। শবর বেতের চেয়ারটায় বসল।

জুলেখা পরদা সরিয়ে ভিতরে গেল। দু’মিনিটের মধ্যেই ফিরে এল।

বসুন। কথা আছে।

জুলেখা ওরফে রীতা ওরফে দোয়েল ডিভানটায় বসল। একটু জড়সড়।

আপনার আসল নামটা কী?

দোয়েল।

বরুণ ঘোষের সঙ্গে পরিচয় কবে হয়েছিল?

প্রায় নয় বছর আগে। উনি নার্সিং হোমে ভরতি হয়েছিলেন একটা চেক আপের জন্য। ব্রঙ্কিয়াল কারসিনোমা সাসপেক্টেড। খুব অসুস্থ ছিলেন। আমি তখন ওখানে আয়া ছিলাম।

তখনই ঘনিষ্ঠতা হয়?

হ্যাঁ। উনি আমাকে খুব পছন্দ করতেন, আমিও ওকে।

অ্যান্ড দ্যাটস দ্যাট?

তখন আমার বয়স চব্বিশটব্বিশ। ওঁর মিড ফর্টিজ। উইডোয়ার। উই ফেল্ট ফর ইচ আদার।

তারপর?

উনি ভাল হয়ে গেলেন। ক্যান্সার হয়নি।

তখন ওঁর মেয়ের বিয়ে কি হয়ে গেছে?

অসুখের পরই মেয়ের বিয়ে হয়, ডিভোর্স হয়, মেয়ে চলে যায় আমেরিকায়। তখন ভীষণ লোনলি। আমাকে ওঁর খুব দরকার হত।

বন্দোবস্তটা কীরকম ছিল?

উনি এ বাড়ির এই অংশটা লিজ নিয়েছিলেন আমার নামে। দশ বছরের লিজ। মাসে মাসে দু’হাজার টাকা মাসোহারা দিতেন।

এখানেই আপনাদের দেখাসাক্ষাৎ হত?

হ্যাঁ।

এর আগে আপনি কোথায় থাকতেন?

আমার মায়ের সঙ্গে, মোমিনপুরে।

আপনার মা এখনও সেখানে আছেন?

না। মারা গেছেন।

সেই বাড়িটা?

ওটা ভাড়া বাড়ি। আমার দাদা থাকে। তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক নেই।

আপনি ইংরিজি বলা কোথায় শিখলেন?

স্কুলে। বাবা যখন বেঁচে ছিলেন আমাদের অবস্থা ভাল ছিল। বাবা চাকরি করতেন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে। তিনি মারা যাওয়ার পর আমরা ভীষণ খারাপ অবস্থায় পড়ি। পড়াশুনো ছাড়তে হয়, চাকরি নিতে হয়। তাও আয়ার চাকরি এবং ক্যাজুয়াল। দাদা বাড়ি থেকে তাড়াতে পারলে বাঁচে। তারও অবশ্য অবস্থা খারাপ ছিল।

বরুণবাবুকে আপনি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন?

বহুবার।

বিয়ে হল না কেন?

উনি লোকনিন্দার ভয় পেতেন। একবার রাজি হতেন, আবার নানা টালবাহানা করে পিছিয়ে যেতেন।

বিয়ে না করেই সন্তান হল?

হ্যাঁ। উনি অ্যাবরশন করাতে চেয়েছিলেন। আমি রাজি হইনি। ভেবেছিলাম বাচ্চা হলে হয়তো বিয়েতে রাজি করাতে পারব।

উনি রাজি হননি?

না। ওই তো বললাম, খুব দোনোমোনো করতেন। আমি ওঁর ছেলের মা, আমি ভীষণ ইনসিকিউরিটি ফিল করতাম।

উনি টাকাপয়সা দিয়ে কমপেনসেট করতে পারতেন তো!

টাকাপয়সার ব্যাপারে উনি খুব উদার ছিলেন না। উনি যা দিতেন তাতে চলত না। ছেলে হওয়ার পর খরচ তো বেড়েছিল। বিয়ের জন্য চাপ দিতাম বলে উনি ক্রমে ক্রমে আমার ওপর বিরক্ত হয়ে উঠছিলেন।

আমি আপনার অবস্থাটা বুঝতে পারছি। উনি কি ছেলেকে ভালবাসতেন?

বাবা যেমন ছেলেকে ভালবাসে তেমন নয়। তবে বোধহয় মায়া একটু ছিল। আদরটাদর করতেন।

তারপর কী হল?

উনি মেয়ের কাছে আমেরিকা গেলেন। এক বছরের জন্য। আমাকে মাত্র কুড়ি হাজার টাকা দিয়ে গিয়েছিলেন। আমার ছেলের স্কুলের বেতনই মাসে দেড়শো টাকা। আরও খরচ আছে। আমি ফের আয়ার চাকরি শুরু করেছিলাম। কিন্তু বাজার খারাপ। আয় সামান্যই হত।

আপনি কি ওঁকে ব্ল্যাকমেল করতেন?

ব্ল্যাকমেল। না। কথাটা তখন মাথায় আসেনি।

উনি একটা ডায়েরিতে ব্ল্যাকমেল করার কথা লিখে গেছেন। অবশ্য তাতে আপনার নাম নেই।

ব্ল্যাকমেল নয়। তবে উনি আমেরিকা যাওয়ার অনেকদিন আগে থেকেই আমার কাছে আসা বন্ধ করেছিলেন। আমি ভয় পাচ্ছিলাম উনি হয়তো আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখবেন না। বাধ্য হয়ে আমি ওঁর কাছে যাই। ওঁর বাড়িতে যাওয়া বারণ ছিল আমার। বাধ্য না হলে যেতাম না। আমার একার জন্য তো নয়, ছেলেটাকে তো দেখতে হবে। উনি আমাকে দেখে খুব রেগে যান। আমি টাকাপয়সার কথা বলাতে উনি বলেন, তুমি আমাকে ব্ল্যাকমেল করতে এসেছ? এটা কি ব্ল্যাকমেল, আপনিই বলুন তো!

না। তারপর বলুন।

শেষ অবধি উনি কুড়ি হাজার টাকা দিয়েছিলেন।

তারপর?

উনি আমেরিকা চলে যাওয়ার পর আর যোগাযোগ ছিল না। উনি আমাকে চিঠি লিখতেন কখনও। আমার তো লেখা বারণই ছিল। এক বছর বাদে উনি ফিরে আসার পর আমার সঙ্গে দেখা করেন। দেখলাম খুব নরম হয়ে পড়েছেন। আমার প্রতি যেন একটা টানও হয়েছে। সেই দুর্বলতার সুযোগে আমি ফের বিয়ের কথা তুললাম। উনি নিমরাজি ছিলেন। তবে চিন্তা ছিল বিষয়সম্পত্তি নিয়ে। বিয়ে করলে প্রীতীশ ওঁর সম্পত্তির মস্ত ভাগীদার হয়ে দাঁড়াবে। সেটা উনি যেন খুব একটা পছন্দ করছিলেন না। তবে শেষ অবধি রাজি হয়েছিলেন। এমনকী ওঁর কথামতো আমি একজন ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের সঙ্গেও যোগাযোগ করে নিয়মকানুন জেনে আসি। কিন্তু উনি হঠাৎ করে মারা যাওয়ায় সব ভেস্তে যায়।

মিতালিদেবীর সঙ্গে আপনি যোগাযোগ করেছিলেন কি এসব কথা জানানোর জন্য?

হ্যাঁ। আর এক বছর পর এই বাড়ির লিজ শেষ হয়ে যাবে। আমার মাসোহারা বন্ধ। চাকরি থেকে হাতে টাকাপয়সা আসছে না। আমি কী করতে পারি বলুন তো! আমার ছেলে অবৈধ সন্তান আমি জানি, কিন্তু ধৰ্মত ওঁরই সন্তান। ও কেন অন্যায়ভাবে বঞ্চিত হবে? সেইজন্য আমি প্রথমে ওঁকে টেলিফোনে সব খুলে বলার চেষ্টা করি। উনি ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়েন। আমাকে উলটে গালাগাল করেন।

আপনি কলগার্লের জীবিকা কবে থেকে বেছে নেন?

মাথা নিচু করে একটু চুপ করে থেকে দোয়েল মাথা তুলে বলল, উনি আমেরিকা যাওয়ার প্রায় সাত আট মাস পরে। কলগার্ল নয়। আমি নার্সিং হোম থেকেই একজন মধ্যবয়স্ক পেশেন্টের সঙ্গে তার বাড়ি যাই। সেখানেই শুরু। তবে ইচ্ছে হত না। বাধ্য হয়েই

সমীরণ বা পান্টুর কেসগুলো কী?

পাটুর সঙ্গে এক রাত্রি ছিলাম। ফর অ্যাকসেস টু দ্যাট হাউস।

কী চেয়েছিলেন?

শেষবার চেষ্টা করেছিলাম মিতালির কাছ থেকে কিছু সাহায্য পেতে। ও আমাকে অপমান করে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। তখন ঠিক করি, চুরি করব।

চুরির পক্ষে কি পার্টির দিনটাই প্রশস্ত ছিল?

হ্যাঁ। অনেক লোকের ভিড়ে আমি ঢুকে যেতে পারব বলে বিশ্বাস ছিল।

পান্টু যে মিতালির প্রাক্তন প্রেমিক, জানতেন?

জানতাম। বরুণবাবুর কাছে সব শুনেছি।

সমীরণের সঙ্গে কীভাবে এবং কেন জুটে গিয়েছিলেন?

ক্ষণিকা–অর্থাৎ ওর গার্লফ্রেন্ডকে আমি অনেকদিন চিনি। কিছুদিন ওর বাচ্চার বেবি সিটিংও করেছি। ওই সময়ে আমি ওদের বাড়িতে ওর বাচ্চা রাখছিলাম। ক্ষণিকা সমীরণের ওপর রাগ করে চলে আসায় আমি ঠিক করি সমীরণের সঙ্গে থাকব। তাতে খানিকটা ইনফর্মড থাকা যাবে।

এবার আসল কথায় আসুন দোয়েলদেবী।

দোয়েল এই প্রথম একটু হাসল। হাসলে মুখখানা ভারী সুন্দর দেখায়, লক্ষ করল শবর।

পার্টির রাতে আমি দোতলায় উঠি।

কীভাবে?

পিছনের বাগান দিয়ে। খুব সোজা।

বলুন।

দোতলার ঘরে ঢুকে চারদিক খুঁজে হ্যান্ডব্যাগটা পেয়ে যাই।

রাত তখন কটা?

সাড়ে নটা থেকে দশটার মধ্যে।

খুব রিস্ক ছিল না? ছিল।

তারপর?

দশ হাজার ডলার ছিল। টাকাটা আর দুটো গয়না সরিয়ে ফেলি।

কিন্তু–

জানি আপনি কী শুনতে চান। কিন্তু আপনাকে হতাশ হতে হবে। রাত দশটার পর আর আমি ও বাড়িতে ছিলাম না। খুনটা আমি করিনি মিস্টার দাশগুপ্ত।

শবর স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইল দোয়েলের দিকে।

দোয়েল চোখ সরাল না, সমানে সমানে তাকিয়ে থেকে বলল, আমি আমার ছেলের স্বার্থে ওই অপরাধটুকু করেছি। চুরি বললে চুরি। আইন আমার পক্ষে নেই। কিন্তু ধর্মত ন্যায্যত আমার এবং আমার ছেলের কিছু পাওনা হয়। দশ হাজার ডলার এমন কিছু বেশিও নয়। বরুণবাবুর স্ত্রী হতে পারলে আমার পাওনা অনেক বেশি হতে পারত। আপনি কি আমাকে অ্যারেস্ট করবেন?

আপনার অ্যালিবাই আছে? খুনের সময়ে রাত একটা থেকে—

দুটোর মধ্যে? ও সময়ে সবাই ঘুমোয়। কে সাক্ষী দেবে বলুন।

আপনি কোথায় ছিলেন?

দোয়েল একটা শ্বাস ফেলে বলল, আপনাকে আবার হার মানতে হবে। কারণ আমার ফুলপ্রুফ অ্যালিবাই আছে।

কীরকম?

সেই দিন দশ হাজার ডলার পেয়ে আমার খুব আনন্দ হয়েছিল। ফিরে এসে আমি পাশের ফ্ল্যাটের বউদির সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করি। ওরা মাঝে মাঝে আমার ফ্ল্যাটে ভিসিআর-এ ছবি দেখতে আসে। সেই রাতে ওদের পুরো পরিবার আর আমি এই ঘরে বসে রাত এগারোটা থেকে ভোর চারটে অবধি দুটো বাংলা আর একটা হিন্দি সিনেমা দেখেছি। আপনি খোঁজ করলেই জানতে পারবেন। আরও বলি, পাড়ার আরও দুটো মেয়েও সেই রাতে আমার ঘরে বসে ছবি দেখেছে। কোয়াইট এ ক্রাউড।

শবর মাথা নেড়ে বলল, বুঝেছি।

চুরির জন্য আপনি আমাকে অ্যারেস্ট করতে পারেন, কিন্তু খুনের জন্য নয়। খুনিকে আপনার আরও একটু খুঁজতে হবে।

আমি আপনাকে অ্যারেস্ট করছি না।

তা হলে?

আমি আপনার সঙ্গে একটা বাণিজ্য করতে চাই। সিম্পল বার্টার।

কী বলুন?

লিভ এ ক্লিন লাইফ। যা করেছেন করেছেন, আর নয়।

দোয়েলের চোখ ভিজে গেল, কে নোংরা জীবন কাটাতে চায় বলুন! যা করেছি ছেলের স্বার্থে, মা হয়ে। ছেলের জন্য মা সব পারে। পারে না বলুন। তবে আর নয়, কথা দিচ্ছি।

এবার আরও একটু কথা আছে। হয়তো আপনিই পারেন ধাঁধাটা কাটাতে।