জালাল খাঁ মাহতাব উদ্দিন সাহেবের বাগানবাড়ির বসার ঘরে সোফায় বসে আছেন। তাঁর সামনে বেতের চেয়ারে খলিলুল্লাহ বসে আছে। সব মিলিয়ে পানিতে দুঘণ্টা ছাব্বিশ মিনিট ছিল। এক ঘণ্টা হলো সে পানি থেকে উঠে এসেছে। সামান্য কিছু খাওয়া-দাওয়া করে সে এসে বসেছে বসার ঘরে। জালাল খাঁ তাঁর সঙ্গে কিছু কথা বলতে চান। মাহতাব উদ্দিনেরও এই আসরে থাকার কথা ছিল। তাঁর হঠাৎ প্ৰবল মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়েছে বলে তিনি অন্য একটা ঘরে দরজা জানালা বন্ধ করে শুয়ে আছেন। তাঁর মাইগ্রেনের সমস্যা আছে। হঠাৎ হঠাৎ মাইগ্রেনের ব্যথা উঠে তাঁর জগৎ সম্পূৰ্ণ এলোমেলো করে দেয়। আজকের মাথা ব্যথার ধরন সেরকম।
জালাল খাঁ অরণ্যের দিকে তাকিয়ে বললেন, কেমন আছ?
অরণ্য বলল, ভালো আছি।
পানির নিচে থাকতে কেমন লাগে?
ভালো লাগে।
শুকনায় থাকতে ভালো লাগে না-কি পানিতে থাকতে ভালো লাগে?
দুটাই ভালো।
তোমাকে আমি কিছু প্রশ্ন করব, জবাব দেবে?
জ্বি, দেব।
তোমার কিছু অস্বাভাবিক ক্ষমতা যে আছে এটা তুমি জানো?
আগে জানতাম না। এখন জানি।
তুমি পানিতে ডুবে থাকতে পারো এটা দেখলাম। এছাড়া আর কী পারো? শূন্যেও ভেসে থাকতে পারো?
পারি।
জালাল খাঁ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকলেন। নিজেকে সামলে নিয়ে আবারো বললেন, তুমি শূন্যে ভেসে থাকতে পারো?
পারি।
তাহলে ভেসে দেখাও।
এখন পারব না।
কখন পারবে?
যখন আশেপাশে কেউ থাকে না তখন পারি।
কতক্ষণ ভেসে থাকতে পারো?
অনেকক্ষণ পারি।
তুমি কে এটা বললা।
আমি জানি না আমি কে।
তোমার কি জানতে ইচ্ছা হয় তুমি কে?
না।
কিন্তু আমি জানতে চাই তুমি কে? তুমি আমাকে সাহায্য করো। তুমি সাহায্য করলেই আমি তোমার ব্যাপারে জানতে পারব। তুমি সাহায্য না করলে পারব না। আচ্ছা শোননা, তুমি কি রোবট?
রোবট কী?
রোবট হলো যন্ত্ৰমানব। যাদের ক্ষুধাতৃষ্ণা নেই, আবেগ নেই। তোমার ক্ষুধাতৃষ্ণা আছে?
আছে।
আবেগ আছে? কষ্ট পেলে কাঁদো?
না।
কষ্ট পেলে কাঁদো না? কখনো তোমার চোখে পানি আসে নি?
একবার এসেছে।
সেটা কখন?
আম্মাজি তার মার কথা বলছিল। তার মাকে সে কখনো দেখে নাই। মার কথা বলতে গিয়ে সে এত মন খারাপ করল যে আমার চোখে পানি এসে গেল।
এর অর্থ হচ্ছে তোমার আবেগ আছে। আচ্ছা, তুমি তোমার বাবা-মাকে মনে করতে পারো? তারা কোথায়?
জানি না।
বাবা-মার কথা কিছুই জানোনা?
আমার কিছু মনে নাই। একবার আমার খুব বড় অসুখ হয়েছিল। অসুখ হবার পর অসুখের আগের সবকিছু ভুলে গেছি।
কী অসুখ হয়েছিল? মাথায় যন্ত্রণা।
দুঃস্বপ্ন দেখতাম।
কী দুঃস্বপ্ন?
নানান রকম কলকজা ঘুরছে। অদ্ভুত অদ্ভুত যন্ত্র। অসুখের সময় বড় কষ্ট করেছি।
জালাল খাঁ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, যন্ত্রের কথায় মনে পড়ল তুমি নষ্ট যন্ত্রপাতি ঠিক করতে পারে। এই প্রমাণ আমরা দেখেছি। যে নষ্ট যন্ত্র ঠিক করতে পারে সে যন্ত্র বানাতেও পারে। তুমি যন্ত্র তৈরি করতে পারবে?
কী যন্ত্র?
আমাদের জানা নেই এমন।
আপনি বলেন কী যন্ত্র বানাতে চান।
জালাল খাঁ আগ্রহ নিয়ে বললেন, একটা টাইম মেশিন কি বানোননা যায় এইচ জি ওয়েলস-এর টাইম মেশিন।
সেই মেশিনে কী হয়?
সেটা একটা অদ্ভুত মেশিন। এই মেশিনে করে মানুষ অতীত থেকে বর্তমানে আসতে পারে। বর্তমান থেকে ভবিষ্যতে যেতে পারে।
আপনার কথা বুঝতে পারছি না।
জালাল খাঁ উত্তেজিত ভঙ্গিতে হাত পা নেড়ে এমন ভঙ্গিতে বলা শুরু করলেন যেন টাইম মেশিন বানাতে পারে এমন একজন ইনজিনিয়ার ভার সামনে বসে আছে। ব্যাপারটা শুধু বোঝানোর অপেক্ষা, বোঝানো হয়ে গেলে টাইম মেশিন তৈরি হয়ে যাবে। তাৎক্ষণিক ডেলিভারি।
মেশিনটা হবে এরকম—মনে করে আমি মেশিনটায় বসলাম, সুইচ টিপলাম। অমনি আমি চলে গেলাম অতীতে, যখন আমার বাবার বয়স মাত্ৰ সাত বছর।
এই যন্ত্র তৈরি করা যাবে না।
কেন তৈরি করা যাবে না?
নিয়মের মধ্যে পড়বে না।
কিসের নিয়ম?
জগতের নিয়ম। এই যন্ত্র তৈরি হলে জগতের নিয়মে গণ্ডগোল হয়ে যাবে। জগতের নিয়মে গণ্ডগোল হয় এমন কিছু জগৎ তৈরি করতে দেয় না।
জালাল খাঁ নিশ্বাস ফেলে বললেন, তুমি ঠিকই বলেছ। টাইম মেশিন ফিজিক্সের সূত্র গ্রহণ করে না। ধররা আমি যদি অতীতে ফিরে গিয়ে আমার সাত বছর বয়সী বাবাকে মেরে ফেলি তাহলে কী হবে? তাহলে আমি কীভাবে বেঁচে থাকব? আমার বাবাই তো সাত বছর বয়সে মারা গেছেন। তিনি বড় হয়ে বিয়ে করতে পারেন নি। কাজেই আমার জন্ম হয় নি। তাহলে আমি কোত্থেকে এলাম?
অরণ্য এক দৃষ্টিতে জালাল খাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে চাপা কৌতূহল। যেন সে কিছু বলতে চায়। জালাল খাঁ বললেন, তুমি কিছু বলবে?
আমি আম্মাজির জন্যে একটা যন্ত্র বানাব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
কার জন্যে যন্ত্র বানাবে, টুনটুনির জন্যে?
জি।
কী যন্ত্র?
আম্মাজি এই যন্ত্রে তার মায়ের কথা শুনতে পাবে। অনেক কাল আগে যে সব কথা বলেছিল সে সব কথা।
কীভাবে?
মানুষের কথা নষ্ট হয় না। মানুষের কথা থেকে যায়। ঘরের দেয়ালে থাকে, বাতাসে থাকে। সেখান থেকে কথা বের করে আনা যাবে।
কীভাবে?
সেটা আপনাকে বুঝিয়ে বলতে পারব না। আমি বুঝতে পারছি কিন্তু আপনাকে বোঝাতে পারব না।
যন্ত্রটা তৈরি করতে তোমার কী লাগবে?
কলমের মতো একটা যন্ত্র যে আপনার আছে সেটা লাগবে। আরো কিছু জিনিস লাগবে।
তোমার যা যা লাগবে সবই আমি জোগাড় করে দেব। তুমি যন্ত্রটা বানাও। আমরা এই যন্ত্রের নাম দেব Past Rocorder, PR। বাংলায় তার নাম হবে অতীত-কথন। আচ্ছা তুমি কি যন্ত্রটা একা একা তৈরি করতে পারবে? তোমাকে সাহায্য করার লোক লাগবে না?
আমাকে সাহায্য করার লোক আছে। কোথায় আছে?
অরণ্য জবাব দিল না। চুপ করে বসে থাকল। সে এখন তাকিয়ে আছে তার পায়ের বুড়ো আঙুলের দিকে। বুড়ো আঙুল উঠানামা করছে।
জালাল খাঁ তার দিকে ঝুঁকে এসে বললেন, তুমি কে?
অরণ্য বলল, আমি জানি না আমি কে? বলেই সেও জালাল খাঁর দিকে ঝুঁকে এসে বলল, আপনি কি জানেন আপনি কে? জালাল খাঁ হতাশ গলায় বললেন, আমিও জানি না আমি কে।