০৭. মাসুদ মুখ শুকনো করে

মাসুদ মুখ শুকনো করে বসে আছে।

রাগে তার শরীর জ্বলে যাচ্ছে।রাগের কারণ হচ্ছে দরজায় নক না করে ডাক্তার সাহেবের চেম্বারে লেঙ্গয় ডাক্তার সাহেব খুব বিরক্ত হয়েছেন। অন্য সময় হলে বিরক্ত হতেন না, আজ হয়েছেন। কারণ ঐ মেয়ে ঘরে বসে আছে। মেয়েটা বড়ো যন্ত্রণা করছে। কাজের সময় যদি এভাবে বসে থাকে। তাহলে কীভাবে কাজ হয়? সব কিছুর সময়-অসময় আছে। প্রেম খুবই ভালো জিনিস। তাই বলে কাজের সময় কেন? রুগীরা বসে আছে, এক্সরে রিপোর্ট নিয়ে যাবে। ডাক্তার সাহেবের সময় হচ্ছে না।

মাসুদ ডাক্তার সাহেবের চেম্বারে ইচ্ছা করেই শব্দ না করে ঢুকেছে, যাতে সে অস্বস্তিকর কোনো পরিস্থিতিতে দুজনকে দেখতে পায়, মেয়েটা যেন লজ্জায় পড়ে। লজ্জায় পড়লে আসা-যাওয়া কমাবে। আসা-যাওয়াটা যেন একটু কমায়। কোনো কিছুরই বাড়াবাড়ি ভালো নয়। প্রেমের মতো ভালো যে জিনিস তারও বাড়াবাড়ি খারাপ।

মাসুদ অবশ্যি তাদের কোনো অস্বস্তিকর অবস্থায় দেখল না। দুজনই মুখখামুখি বসে গল্প করছে। খুব সিরিয়াস ধরনের কোনো গল্প হবে, কারণ দু জনের মুখই বেশ গম্ভীর।

ডাক্তার সাহেব মাসুদের দিকে তাকিয়ে বললেন, কী চাও?

রিপোর্টগুলি কি হয়েছে স্যার?

হ্যাঁ হয়েছে। নিয়ে যাও। শোন মাসুদ–ঘরে ঢুকবার সময় নক করে তারপর ঢুকবে। এটা হচ্ছে সাধারণ ভদ্রতা।

ডাক্তার সাহেবের কথার জবাবে কিছু না বলে চুপ করে থাকলে ঝামেলা চুকে যেত, মাসুদ তা পারল না। সে বলে ফেলল, কাজের সময় এত কিছু মনে থাকে না, স্যার। রুগী বসে আছে। কতক্ষণ বসে থাকবে বলেন, ওদের তো কাজকর্ম আছে। সারা দিন বসে থাকলে তো তাদের চলে না।

রুগী বসে থাকবার সঙ্গে দরজায় নক করার সম্পর্ক কী? রুগী বসে থাকলে কি দরজা নক করা যায় না?

মনে থাকে না, স্যার।

সাধারণ জিনিস মনে থাকে না, বাকি সব তো মনে থাকে। তোমার আচার-ব্যবহার আমার পছন্দ হচ্ছে না।

অপছন্দের কি করলাম, স্যার?

অপছন্দের কী করেছ তুমি জান না?

জ্বি না।

ডাক্তার সাহেবের মুখ রাগ এবং অপমানে কালো হয়ে গেল। তিনি চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, রুগীদের সঙ্গে তুমি খুব খারাপ ব্যবহার কর। তোমার বিরুদ্ধে অনেকেই কমপ্লেইন করেছে।

এই পর্যায়ে মাসুদ একটা বড়ো ভুল করল, না ভেবেচিন্তে বলে বল, কমপ্লেইন তো স্যার আপনার বিরুদ্ধেও আছে। সব কমপ্লেইন ধরলে কি আর চলে? কিছু লোক আছে যারা আল্লাহর বিরুদ্ধেও কমপ্লেইন করে, করে না?

ডাক্তার সাহেব থমথমে গলায় বললেন, আমার বিরুদ্ধে কী কমপ্লেইন আছে?

বাদ দেন।

বাদ দেব কেন? শুনি কি কমপ্লেইন।

আমাকে আপনি তুমি করে বলেন কেন? ছোট চাকরি করি বলেই তুমি বলতে হবে? আমি স্যার বি. এসসি পাস একটা ছেলে।

ঠিক আছে। তুমি যাও।

মাসুদ বের হয়ে এল। তার কিছুক্ষণ পরই সে যে চিঠি পেল তার বক্তব্য হচ্ছে–নোভা পলিক্লিনিকে তোমার চাকরির প্রয়োজন নেই। আগামী দিনের ভেতর তুমি তোমার দায়িত্ব বুঝিয়ে দেবে।

এক কথায় চাকরি নট। মাসুদের মনটা খুবই খারাপ হয়েছে। এই সময়ে চাকরি চলে যাওয়া একটা ভয়াবহ ব্যাপার। নতুন চাকরি তার পক্ষে জোগাড় করা সম্ভব নয়। বদমেজাজের জন্যে এর আগেও দুবার চাকরি গেছে। এই নিয়ে তৃতীয় বার হল।

ডাক্তার সাহেবের কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইলে হবে কিনা কে জানে? ক্ষমা চাইতে ইচ্ছা করছে না। মাসুদ হেল্লার ছেলেটাকে চা আনতে পাঠাল।

হাত-ভাঙা এক রুগী এসেছে। কিছুক্ষণ পর পর হাউমাউ করে পেঁচিয়ে উঠছে।

মাসুদ তার দিকে তাকিয়ে বলল, খবরার, নো সাউন্ড। চিল্কার। করলে ব্যথা কমে না, উল্টো হার্টের ক্ষতি হয়।

হাত-ভাঙা রুগীর সিরিয়াল তেত্রিশ। মাসুদ তাকে ছ নম্বরে নিয়ে এল। অন্য রুগীরা হৈ-চৈ শুরু করেছে। মাসুদের মুখটাই তেতো হয়ে গেল। ব্যথায় এক জন মরে যাচ্ছে তাকে আগে যেতে দেবে না। এটা কি রকম বিচার?

চ্যাংড়া-মতো এক ছোকরা ফুসফুসের এক্সরে করতে এসেছে। সে তেরিয়া হয়ে বলল, পেছনের জনকে আগে দিচ্ছেন, ব্যাপার কি?

মাসুদ গম্ভীর গলায় বলল, আমার ইচ্ছা।

আপনার ইচ্ছা মানে?

ও আমার ইচ্ছা মানে আমার ইচ্ছা। পছন্দ না হলে যান, ডাক্তার সাহেবের কাছে গিয়ে কমপ্লেইন করেন। ঐ যে ডাক্তার ঐ ঘরে বসে। দরজা নক করে তারপর যাবেন ভাই, ভেতরে লেডিজ আছে।

চ্যাংড়া রাগে কাঁপতে কাঁপতে ডাক্তারের ঘরে ঢুকল। মাসুদ মনে মনে বলল, হারামজাদা।

ঠিক এই সময় ঘরে ঢুকলেন নিশানাথ বাবু। মাসুদ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। সে চিনতে পেরেছে। না পারলেই বোধ হয় ভাল হত। এ কী অবস্থা হয়েছে মানুষটার।

নিশানাথ বাবু মাসুদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ভালো আছেন?

মাসুদ জবাব দিল না। জবাব দেবার মতো অবস্থা তার নেই। সে স্তম্ভিত। তার চোখে পলক পড়ছে না।

নিশানাথ বাবু বললেন, আমাকে তো চিনতে পেরেছেন, তাই না?

জি! আপনার অবস্থা তো এখান থেকে যাবার পর কী যে হল! মাথার সব চুল পড়ে গেল। দাঁতও সব পড়ে যাচ্ছে। তার ওপর মাথায় যন্ত্রণা হয়।

বসেন ভাইজান, বসেন। আপনাকে দেখে মনটাই খারাপ হয়ে গেল। খুবই খারাপ। বিশ্বাস করেন, মনটা খুব খারাপ হয়েছে।

লোকটির মনের অবস্থা নিশানাথ বাবু পরিষ্কার বুঝতে পারছেন। সে খুবই দুঃখিত। তার চোখে পানি এসে যাচ্ছে। একটা মানুষ তার জন্যে এতটা মন খারাপ করে কীভাবে তা তিনি ঠিক বুঝতে পারছেন না। তবে এই মানুষটা তাঁর কাছে কোনো একটা ব্যাপার লুকোতে চেষ্টা করছে। এক্সরে সংক্রান্ত ব্যাপার। তিনি ইচ্ছা করলেই লুকোন ব্যাপারটা ধরতে পারেন। মাথার আর একটু গভীরে ঢুকলেই হয়। নিশানাথের মনে হচ্ছে এটা ঠিক নয়। অনধিকার চর্চা। একজন মানুষের ব্যক্তিগত জগতে ঢুকে পড়া। এটা অন্যায়। বড় ধরনের অন্যায়।

মাসুদ বলল, ভাইজান, আপনাকে দেখে আমার মনটা ভেঙে গেছে। আপনি যান, ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে দেখা করেন। উনি যদি কোনো ওষুধপত্র দেন।

নিশানাথ বাবু নিচু গলায় বললেন, অসুখটা আবার এক দিক দিয়ে ভালো। এখন আমি অনেক কিছু বুঝতে পারি।

কী বুঝতে পারেন?

এই যে ধরুন আপনার আজাঁকরি চলে গেছে, এটা আমি জানি।

মাসুদের চোখ বড় বড় হয়ে গেল। তার বেশ কিছু সময় লাগল ব্যাপারটা বুঝতে। সে গম্ভীর গলায় বলল, আর কী জানেন?

আর জানি যে আপনি মানুষটা খুবই বদরাগী কিন্তু আপনার মনটা কাচের মতো পরিষ্কার। আপনার বড় ভাই মারা গেছেন। বড় ভাইয়ের পুরো সংসার দীর্ঘদিন ধরে আপনি টানছেন। এই কারণে বিয়েও করেন নি। আরো জানি যে খুবই যারা গরিব রুগী তাদের কাছ থেকে এক্সরের টাকা নিয়ে ভাতি ফেরত দেবার সময় ইচ্ছা করে বেশি টাকা ফেরত দেন।

মাসুদ স্তম্ভিত হয়ে গেল। এই লোক এসব কথা কীভাবে বলছে? সে ক্ষীণ স্বরে বলল, আপনি একটু ডাক্তার সাহেবের কাছে যান। তাঁর সঙ্গে কথা বলেন। আপনাকে এতক্ষণ আমি বলি নি, কিন্তু না বলে পারছি না। আমাদের এখানে এক্সরে মেশিনে একটা গণ্ডগোল হয়েছিল, তার থেকে আপনার এইসব হচ্ছে। আপনি যান, ডাক্তার সাহেবের কাছে যান। এই লোকটা খুব খারাপ, তবে ডাক্তার ভালো। সব খারাপ মানুষেরই দু-একটা ভালো ব্যাপার থাকে।

 

নিশানাথ বাবু ডাক্তার সাহেবের কামরায় ঢুকলেন। ডাক্তার সাহেব বিরক্ত মুখে তাকালেন। শীতল গলায় বললেন, কি ব্যাপার। কী চান আপনি?

নিশানাথ বাবু জবাব দিলেন না। তিনি নিমেষের মধ্যে ঢুকে গেলেন ডাক্তার সাহেবের মাথার ভেতরে। তার দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল। তিনি শিউরে উঠলেন। এই ডাক্তারের মনে এত ঘৃণা কেন? এত লোভ কেন? মানুষটার চেহারা কী সুন্দর! কত জ্ঞান, কত পড়াশোনা অথচ তার মন ঘৃণায় নীল হয়ে আছে! ঘৃণার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তীব্র লোভ। সব কিছুর জন্যেই লোভ। এই মুহূর্তে তার লোভ সামনে বসে থাকা স্নিগ্ধ চেহারার মেয়েটির প্রতি। কত বয়স মেয়েটির? খুব বেশি হলে সতেরো-আঠারো।

নিশানাথ বাবু ডাক্তার সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, কেমন আছেন?

ডাক্তার সাহেব বললেন, আমি কেমন আছি সেই তথ্যের আপনার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। আপনি আমার কাছে কী চান সেটা বলুন।

কিছুই চাই না।

কিছুই চান না, তাহলে এসেছেন কেন?

নিশানাথ বাবু মেয়েটির দিকে তাকালেন। এই তো সেই মেয়ে যাকে এত বার স্বপ্নে দেখেছেন। নাসিমা নাম। নিশানাথ বাবু বললেন, কেমন আছ, মা?

মেয়েটি চমকে উঠে বল, আমাকে বলছেন?

হ্যাঁ, তোমাকেই বলছি। ঐ দিন তুমিই তো এখানে ছিলে। ঐ যে তোমার জন্মদিন ছিল। অথচ তোমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। তুমি একটা ট্রাকের সামনে দৌড়ে চলে গেলে। যদি ট্রাকটা না থামত?

ডাক্তার সাহেব চেঁচিয়ে উঠলেন, পাগল না-কি এই লোক? হু আর ইউ। গেট আউট, গেট আউট।

নাসিমা কাঁপা গলায় বলল, না, উনি পাগল নন। উনি ঠিকই বলছেন। খুব ঠিক বলছেন।

ডাক্তার সাহেব বললেন, আপনি কে?

আমি আপনার একজন রুগী।

আমার রুণী মানে? রুগীদের সঙ্গে আমার কোনো ব্যাপার নেই। আমি রেডিওলজিস্ট। এক্সরে প্লেট দেখে রিপোর্ট লিখে দিই। সোজাসুজি বলুন তো আপনি কে?

আমার মাথার ভেতর দিয়ে প্রচুর এক্সরে চলে গিয়েছিল। মনে নেই আপনার? তারপর থেকে দেখুন না কী হয়েছে। মাথার চুল পড়ে গেছে। দাঁত পড়ে গেছে। হাতের নখগুলিও মরে যাচ্ছে। এই দেখুন না কেমন কালচে হয়ে গেছে।

আপনি সেই রুগী?

জ্বি, আমিই সেই।

ডাক্তার সাহেব নিজের বিস্ময় গোপন করে ঠাণ্ডা গলায় বললেন, কি উল্টোপাল্টা কথা বলছেন? আমাদের এখানে কারো মাথার ভেতর দিয়ে বেশি এক্সরে পাস করানো হয় না। যতটুকু দরকার ততটুকুই করা হয়। আজেবাজে এলিগেশন এনে আপনার লাভ হবে না।

আপনার ভয় নেই। আমি কোনো অভিযোগ করছি না। নিশানাথ বাবু বুঝতে পারছেন ডাক্তার তাঁর কথা কিছুই বিশ্বাস করছে। না। সে অবিশ্বাসী চোখে তাকিয়ে আছে। এই লোকটির মন অবিশ্বাস এবং সন্দেহে পরিপূর্ণ। আচ্ছা, কিছু কি করা যায় না?

এর মাথায় ঢুকে সামান্য কিছু ওলটপালট কি করে দেওয়া যায় না? তিনি যদি তুষারের মাথায় ঢুকে কিছু পরিবর্তন করতে পারেন, তিনি যদি আলোর মতো একটি মূক ও বধির মেয়েকে শেখাতে পারেন, তাহলে এই লোকটিকে কেন পারবেন না? চেষ্টা করতে তো ক্ষতি নেই। চেষ্টা করে দেখাই যাক না।

ডাক্তারের মাথার ভেতর ঢুকে নিশানাথ বাবু প্রায় দিশা হারিয়ে ফেললেন। কী অসম্ভব জটিলতা! মস্তিষ্কের কুয়োর ভেতর যত নামছেন জটিলতা ততই বাড়ছে। কুয়োর গহিন তলদেশের দিকে তিনি প্রবল টান অনুভব করছেন। যতই নিচে নামছেন আকর্ষণ ততই বাড়ছে। লোকটির চিন্তা-ভাবনার শিকড় অনেক দূর পর্যন্ত গেছে। ততটা নামাও কষ্ট। বেশ কষ্ট।

একজনের মাথার ভেতর প্রবেশ করবার সঙ্গে সব পরিষ্কার বোঝা যায়। একজন মানুষের মানসিকতা কেমন। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্ৰ ইটের বিশাল বিশাল। ইমারত। সেইসব ইমারতে বিচিত্র সব প্যাটার্ন। অদ্ভুত সব নকশা। একজন মানুষের মানসিকতা বদলানর মানে হচ্ছে ঐ সব নকশায় পরিবর্তন নিয়ে আসা। যার জন্য পুরো ইমারতই ভেঙে নতুন করে বানানো দরকার হয়ে পড়ে। নিশানাথ বাবু তা পারলেন। তবে তাঁর অসম্ভব কষ্ট হতে লাগল। মনে হল যেন শরীর অবশ হয়ে আসছে। ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছেন। এর মধ্যেও কিছু কিছু পরিবর্তনের চেষ্টা করলেন। কাজটা কঠিন, তবে পুরোপুরি অসম্ভব নয়। তার কারণ মানসিকতা পরিবর্তনের ব্যাপারটা কীভাবে করতে হয় তা তিনি জানেন। কেউ তাঁকে শিখিয়ে দেয় নি। তবু তিনি জানেন। কী করে জানেন সেও এক রহস্য।

এক সময় কাজ শেষ হল। নিশানাথ বাবু উঠে দাঁড়ালেন। ক্ষীণ স্বরে বললেন, যাই, ডাক্তার সাহেব। আমার শরীরটা ভালো লাগছে না। সম্ভবত বাঁচব না।

ডাক্তার সাহেব চুপ করে রইলেন। মুখে কিছু বললেন না, তবে নিশানাথ বাবু পরিষ্কার বুঝতে পারলেন ডাক্তার লজ্জিত বোধ করছেন, কারণ নিশানাথ বাবুর এই সমস্যার মূলে তার এক্সরে মেশিন এবং তিনি ভালো করেই জানেন রেডিয়েশন সিকনেসের সব লক্ষণ নিশানাথ বাবুর মধ্যে প্রকট হয়েছে। তাঁর আয়ু শেষ হয়ে আসছে। কুড়ি মিলিরেমের বেশি রেডিয়েশন এক জনের শরীরের ভেতর দিয়ে চালানো যায় না অথচ এই লোকটির মাথার ভেতর দিয়ে খুব কম করে হলেও দশ হাজার রেম রেডিয়েশন গিয়েছে। হয়তো এই লোকটির থাইরয়েড গ্লা্যান্ড ইতোমধ্যেই নষ্ট হয়ে গেছে। মস্তিষ্কের নিওরোনের বড় ধরনের কোনো পরিবর্তনও নিশ্চয় হয়েছে।

ডাক্তার সাহেব কেমন যেন লজ্জিত বোধ করতে লাগলেন। তাঁর মনে হতে লাগল, এই মানুষটির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত। লোকটির প্রতি তাঁর খানিকটা মায়াও হতে লাগল। কেন এরকম হচ্ছে তাও বুঝতে পারলেন না।

তিনি বললেন, আমরা খুবই লজ্জিত। মানে যন্ত্রটা হঠাৎ ম্যালফাংশান করল। কোনো কারণ ছিল না হঠাৎ সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেল।

নিশানাথ বাবু হেসে বললেন, আমার জন্যে ভালোই হয়েছে। বয়স হয়েছে, এমনিতেই তো মরে যেতাম। অদ্ভুত কিছু জিনিস জেনে গেলাম।

ডাক্তার সাহেব বললেন, কী জানলেন আমাকে কি ভালো করে গুছিয়ে বলবেন? টেলিপ্যাথিক কিছু ক্ষমতা আপনার ডেভেলপ করেছে তা বুঝতে পারছি। ক্ষমতাটা কী ধরনের এটা জানা দরকার।

অন্য একদিন জামবেন। আজ যাই। শরীরটা এত খারাপ লাগছে, বলার না।

নিশানাথ বাবু ঘর থেকে বেরুবার আগে কয়েক মুহূর্তের জন্যে নাসিমা মেয়েটির মাথার ভেতরেও গেলেন। অতি অল্প সময় কাটালেন সেখানে। সামান্য কিছু পরিবর্তন করলেন। বড় কিছু করার সময় তাঁর নেই। কষ্ট হচ্ছে, বড়োই কষ্ট হচ্ছে।

মেয়েটি একদৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। বুঝতে চেষ্টাও করছে না। এই কুৎসিত লোকটি তার সব খবর জানে–এটা কী করে সম্ভব তা সে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না। সে ভীষণ ভয় পেয়েছে। ব্যাখ্যার অতীত কোনো কিছুর সামনে দাঁড়ালে আমরা যেমন ভয়ে কুঁকড়ে যাই এও সেরকম।

নিশানাথ বাবু ঘর থেকে বেরোবার সঙ্গে সঙ্গে নাসিমা উঠে চলে গেল। ডাক্তারের দিকে তাকাল পর্যন্ত না। অন্ধ ভয় তাকে গ্রাস করে ফেলছে। সে দ্রুত বাসায় চলে যেতে চায়। বিবাহিত বয়স্ক এই মানুষটিকে তার ভালো লাগে। ভালো লাগে বললে কম বলা হবে। ভালো লাগার চেয়েও বেশি। সে জানে, গোপনে এখানে আসা অন্যায়। খুবই অন্যায়। তবু সে নিজেকে সামলাতে পারে না। আজ এই বুড়ো লোকটির কথা তাকে বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছে। শুধু কি কথা? এই বুড়ো লোেকটি কি কথার বাইরেও কিছু করে নি? তার তো মনে হচ্ছে করেছে। কীভাবে করেছে কে জানে? আচ্ছা এই মানুষটা কি কোনো দরবেশ? কোনো বড় ধরনের পীর ফকির?

নাসিমা চলে যাবার পর ডাক্তার সাহেব খানিকক্ষণ একা একা বসে রইলেন। তার পর পরপর দুটো সিগারেট খেয়ে মাসুদকে ডাকলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, বস।

মাসুদ আশ্চর্য হয়ে তাকল। ডাক্তার সাহেবের গলা অন্য রকম লাগছে। গলার স্বরে মমতা মাখানো।

বসতে বললাম তো, বস।

মাসুদ বসল। ডাক্তার সাহেব বললেন, তুমি বয়সে আমার অনেক ছোট, এই জন্যে তুমি বলি। কিছু মনে কর না।

জ্বি না, কিছু মনে করি নি।

তোমাকে বরখাস্ত করার যে চিঠিটা দিয়েছিলাম ওটা ফেলে দাও।

জ্বি আচ্ছা।

রাগের মাথায় আমরা অনেক সময় এটা-ওটা বলি বা করি। এটা মনে। রাখা ঠিক নয়।

জ্বি স্যার।

তুমি যেমন ভুল কর, আমিও করি। হয়তো তোমার চেয়ে বেশিই করি। যেমন এই যে নাসিমা মেয়েটাকে প্রশ্রয় দেওয়া—বিরাট অন্যায়।

বাদ দেন, স্যার।

ভালো একটা মেয়ে অথচ প্রশ্রয় দিয়ে দিয়ে–

শুধু আপনার তো দোষ না স্যার। মেয়েটারও দোষ আছে–ও আসে কেন?

না-না, মেয়েটার কোনো দোষ নেই। বাচ্চা মেয়ে। এদের আবেগ থাকে বেশি। আবেগের বশে–

মাসুদ বলল স্যার, উঠি? সাত-আট জন রুগী এখনো আছে।

তুমি আরেকটু বস। তোমার সঙ্গে আমার কিছু জরুরি কথা আছে।

মাসুদ কৌতূহলী চোখে তাকাচ্ছে। অনেকক্ষণ ইতস্তত করে ডাক্তার সাহেব বললেন, তুমি কত দিন ধরে আমাকে চেন?

প্রায় সাত বৎসর।

এই সাত বৎসরে তুমি নিশ্চয় আমার আচার-আচরণ আমার মানসিকতা খুব ভালো করেই জান। জান না?

জানি, স্যার।

আমার আজকের ব্যবহার কি তোমার কাছে সম্পূর্ণ অন্য রকম মনে হচ্ছে না।

হচ্ছে।

এর কারণটা কি?

মাসুদ তাকিয়ে রইল। কিছু বলল না। ডাড়ার সাহেব বললেন, আমার কি মনে হচ্ছে জান? আমার মনে হচ্ছে বুড়ো লোকটি আমাকে কিছু একটা করেছে।

হিপনোটাইজ।

হিপনোটাইজের চেয়েও বেশি। আমার ধারণা, খুব উঁচু মাত্রার ট্যালিপ্যাথিক ক্ষমতা সে ব্যবহার করেছে। নিতান্তই অবিশ্বাস্য ব্যাপার। তবে আমার এ রকম মনে হচ্ছে। আচ্ছা, এই লোকটির মাথার ভেতর দিয়ে কী পরিমাণ রেডিয়েশন গিয়েছে।

আমি তো স্যার বলতে পারব না। টেকনিশিয়ান বলতে পারবে। জেনে আসব।

যাও, জেনে আস।

ডাক্তার সাহেব আবার একটি সিগারেট ধরালেন। তিনি সিগারেট ছাড়ার চেষ্টা করছেন, অথচ আজ এই অল্প সময়ের ভেতর তিনটে সিগারেট ধরিয়ে ফেললেন। মনে মনে ঠিক করে ফেললেন কাল-পরশুর মধ্যে একবার মেডিক্যাল কলেজ লাইব্রেরিতে যাবেন। মস্তিষ্কের উপর রেডিয়েশনের প্রভাব এই জাতীয় কোনো বই পান কি-না তা খোঁজ করবেন। এর উপর কোনো কাজ কি হয়েছে? নিউরো-সার্জনরা বলতে পারবেন। এটা তাঁদের এলাকা। হিটলারের সময় কন্সেনট্রেশন ক্যাম্পের কিছু বন্দীকে নিয়ে পরীক্ষা চালান

ঠিক এক্সরে না হলেও মোটামুটি ধরনের শক্তিশালী ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ দীর্ঘ সময় ধরে মাথার ভেতর দিয়ে চালানো হয়েছিল। এই পরীক্ষার ফলাফল কখনো প্রকাশ করা হয় নি। অথচ জোর করে বন্দীদের উপর অন্য যে সব পরীক্ষা চালানো হয়েছে তার সব ফলাফলই সযত্নে রাখা আছে। মস্তিষ্কের উপর রেডিয়েশনের প্রভাবের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হল না কেন? রহস্যটা কোথায়?

 

ডাক্তারের কাছ থেকে বের হয়ে নিশানাথ বাবু একটা রিকশা নিলেন। রিকশায় ওঠার পরপরই তাঁর মনে পড়ল যে কারণে ডাক্তারের কাছে এসেছিলেন সেটাই পুরোপুরি ভুলে গেছেন। তাঁর স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, অতি দ্রুত নষ্ট হচ্ছে। এর কারণ কী?

এই ডাক্তারের কাছে আসার একমাত্র উদ্দেশ্য হল দাঁতের মাড়ির এক্সরে কপি তোলা। নিশানাথ একজন ডেন্টিস্টের কাছে গিয়েছিলেন। সব দাঁত কেন হঠাৎ করে পড়ে যাচ্ছে এটাই দেখতে চান। ডেন্টিস্ট ব্যাপার দেখে হকচকিয়ে গেল। নিশানাথকে বলল একটা এক্সরে করাতে। যদি তাতে কিছু ধরা পড়ে। সেই উদ্দেশ্যেই এবারে তিনি পলিক্লিনিকে এসেছিলেন, অথচ আসল কথাটিই ভুলে গেলেন।

রিকশা দ্রুত যাচ্ছে। এই রিকশাওয়ালা বেশ বলশালী। সে ঝড়ের বেগে রিকশা নিয়ে যাচ্ছে। নিশানাথ বললেন, আস্তে চলুন ভাই।

রিকশাওয়ালা বলল, টাইট হইয়া বহেন। চিন্তার কিছু নাই।

তিনি রিকশাওয়ালার মনে কী হচ্ছে পরিষ্কার বুঝতে পারছেন। সে খুব ফুর্তিতে আছে। আনন্দে আছে। তার আনন্দের কারণটিও স্পষ্ট। আজ দেশ থেকে তার স্ত্রী এসেছে। অনেক দিন সে খোঁজখবর নিচ্ছিল না। ভয় পেয়ে তার স্ত্রী (যার নাম মনু) একা একা ঢাকা শহরে চলে এসেছে এবং ঠিকানা ধরে ঠিকই তাকে খুঁজে বের করে ফেলেছে। রিকশাওয়ালা মুখে খুবই রাগ করেছে। মনুর এক-একা চলে আসাটা যে কীরকম বোকামি এবং ঢাকা শহরটা যে কী পরিমাণ খারাপ তা সে তার স্ত্রীকে বলেছে। তবে মনে মনে সে দারুণ খুশি হয়েছে। এই মুহূর্তে সে ভাবছে ঢাকা শহর পুরোটা সে তার স্ত্রীকে দেখাবে। রিকশায় বসিয়ে বিকাল থেকেই ঘুরবে। হাতে সময় নেই। জমার টাকা তুলে ফেলতে হবে।

নিশানাথ রিকশা থেকে নামবার পর ভাড়ার সঙ্গে আরো ত্রিশ টাকা দিলেন বখশিশ।

রিকশাওয়ালা অবাক হয়ে তাকাল। তিনি বললেন, মীরপুরের চিড়িয়াখানাটা তোমার স্ত্রীকে দেখিও। খুশি হবে। এখন স্ত্রীর কাছে চলে যাও। জমার টাকা নিশ্চয়ই উঠে গেছে। তাই না? এই টাকাটা হল বাড়তি।

রিকশাওয়ালা ক্ষীণ স্বরে বলল, আপনে লোকটা কে?

নিশানাথ নিচু গলায় বললেন, কেউ না, আমি কেউ না।

রিকশাওয়ালার বিস্ময় আরো গাঢ় হল। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে অতীন্দ্রিয় কোনো রহস্য চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছে।