সপ্তম পরিচ্ছেদ – মধুমথন
স্থির জলাশয়ের মাঝখানে লোষ্ট্র নিক্ষেপ করিলে তরঙ্গচক্র উত্থিত হইয়া চারিদিকে ছড়াইয়া পড়ে; শৈবালদল তালে তালে নাচিতে থাকে, কুমুদ কহ্লার দুলিয়া দুলিয়া হাসে। তারপর আবার শান্ত হয়।
বজ্রের জন্ম-সংবাদ তেমনি ক্ষুদ্র বেতসগ্রামে আন্দোলন তুলিল বটে, কিন্তু তাহা স্থায়ী হইল না। রাজ-সমাগম এবং রঙ্গনার বিবাহের ইতিহাস ইতিপূর্বেই পুরানো হইয়া গিয়াছে, বজ্রের জন্মেও অপ্রত্যাশিত নূতনত্ব কিছু নাই। তাই এই ঘটনা লইয়া গ্রামের জল্পনা-কল্পনা শীঘ্রই শান্ত হইল।
গোপার মৃত্যুর পর গ্রামরমণীদের মন রঙ্গনার প্রতি অনুকূল হইয়াছিল; কিন্তু একটি কারণে এই অনুকূলতা ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হইল না। যে মেয়েরা রঙ্গনার সঙ্গে সখিত্ব স্থাপন করিতে আসিল, রঙ্গনা তাহাদের সহিত সরলভাবে হাসিয়া কথা কহিল, তাহাদের ছেলে দেখাইল, লজ্জিত নতমুখে তাহাদের রঙ্গ-পরিহাস গ্রহণ করিল; কিন্তু তবু গ্রামের মেয়েরা অনুভব করিল রঙ্গনার গোটা মনটা যেন উপস্থিত নাই; যেন প্রত্যক্ষ জগতের সহিত তাহার নাড়ির যোগ ছিঁড়িয়া গিয়াছে; সর্বদাই যেন সে অন্যমনস্ক হইয়া আছে, উৎকর্ণ হইয়া আছে, দূরাগত পদধ্বনি শুনিবার চেষ্টা করিতেছে। যখন সে একাগ্র তন্ময় হইয়া ছেলের পানে চাহিয়া থাকে তখনও মনে হয় সে ছেলেকে দেখিতেছে না, ছেলের মুখে চোখে অঙ্গপ্রত্যঙ্গে আর একজনের পরিচয়-চিহ্ন খুঁজিতেছে। গ্রামের মেয়েরা বুঝিল রঙ্গনা থাকিয়াও নাই। রঙ্গনার প্রতি তাহাদের আকর্ষণ শিথিল হইয়া পড়িল। পূর্বেকার বিদ্বেষভাবে ফিরিয়া আসিল না বটে, কিন্তু অন্তরঙ্গ হইবার চেষ্টাও আর রহিল না। হংসী যেমন জলে বাস করিয়াও জলের নয়, রঙ্গনা তেমনি নির্লিপ্তভাবে গ্রামে রহিল।
বজ্র বড় হইতে লাগিল। মাতৃক্রোড় হইতে কুটির-কুট্টিমে নামিল, সেখান হইতে প্রাঙ্গণে, প্রাঙ্গণ হইতে গ্রামের মাঠে-ঘাটে। মাতৃস্তন ছাড়িয়া গো-দুগ্ধ, তারপর অন্ন। বজ্রের প্রকৃতি যে সাধারণ শিশু হইতে পৃথক, তাহা তাহার জন্মকাল হইতে লক্ষিত হইয়াছিল। সে বেশি কাঁদে না, আঘাত লাগিলে বা ক্ষুধা পাইলেও কাঁদে না। যখন কথা বলিতে শিখিল, তখনও অধিক কথা বলে না, যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু বলে। সে চঞ্চল নয়, চুপ করিয়া একস্থানে বসিয়া থাকে এবং অন্য শিশুদের ছুটাছুটি লক্ষ্য করে, কিন্তু অকারণে ছুটাছুটি করে না। যখন একাকী থাকে তখন একদৃষ্টে একদিকে চাহিয়া বসিয়া থাকে, কি চিন্তা করে তাহা তাহার মুখ দেখিয়া অনুমান করা যায় না।
অথচ সে মেধাবী; তাহার মন সর্ববিষয়ে সজাগ ও সচেতন। দেহের দিক দিয়া যেমন সমবয়স্ক বালকদের তুলনায় অধিক বৃদ্ধিশীল, মনের দিক দিয়াও তেমনি। বজ্রের যখন পাঁচ বছর বয়স, চাতক ঠাকুর তখন তাহার বিদ্যাশিক্ষা আরম্ভ করিলেন। গ্রামের কেহই লিখিতে পড়িতে জানিত না, চাতক ঠাকুরও না। মুখে মুখে শিক্ষা। চাতক ঠাকুর তাহাকে মুখে মুখে অঙ্ক শিখাইলেন; কড়া গণ্ডা পণ, যোগ বিয়োগ হরণ পূরণ। বজ্র দ্রুত শিখিল এবং যাহা শিখিল তাহা মনে করিয়া রাখিল।
চাতক ঠাকুর যখন বজ্রকে শিক্ষা দিতেন রঙ্গনা কাছে বসিয়া থাকিত। কখনও গুরু-শিষ্যের প্রশ্নোত্তর মন দিয়া শুনিত, কখনও সব ভুলিয়া তন্ময় দৃষ্টিতে পুত্রের মুখের পানে চাহিয়া থাকিত।
বজ্রের বয়স সাত-আট বছর হইলে চাতক ঠাকুর তাহাকে ছিপ দিয়া মাছ ধরিতে শিখাইলেন। বজ্র একেই আত্মসমাহিত শান্তস্বভাব বালক, সে ছিপ লইয়া সারাদিন মৌরীর তীরে বসিয়া থাকিত; সন্ধ্যার সময় মাছ লইয়া হাসিমুখে মায়ের কাছে গিয়া দাঁড়াইত। ইহার পর এমন একদিনও যাইত না যেদিন রঙ্গনাকে নিরামিষ খাইতে হইত। কোনও দিন পুঁটি-খয়রা, কোনও দিন শোলের পোনা, কোনও দিন মৌরলা।
মাছ ধরা ছাড়া আর একটি কাজও বজ্র ভালবাসিত, সাঁতার কাটা। সাঁতার কাটিতে কেহ তাহাকে শিখায় নাই, সে নিজেই শিখিয়াছিল। একদিন সে মৌরীর তীরে একাকী খেলা করিতে করিতে উঁচু পাড় হইতে জলে পড়িয়া যায়। সাহায্য করিবার কেহ নাই, সে নিজেই হাত-পা ছুঁড়িয়া তীরে উঠিয়াছিল। তারপর সাঁতার শেখা তাহার পক্ষে কঠিন হয় নাই। ইচ্ছা হইলেই সে সাঁতার কাটিয়া মৌরী এপার ওপার হইত, বলিষ্ঠ বাহুর তাড়নে নদীর জল তোলপাড় করিত।
ভিল্ল জাতীয় এক বনচর মাঝে মাঝে গ্রামে আসিত। উত্তরের জঙ্গল হইতে হরিণ বা ময়ূর মারিয়া গ্রামে লইয়া আসিত; মাংসের বিনিময়ে গুড় ও তণ্ডুল লইয়া যাইত। মসীকৃষ্ণ দেহের বর্ণ, পরিধানে পশুচর্ম, কেশের মধ্যে কঙ্কপত্র, মুখে সরল হাসি। ধনুক কাঁধে লইয়া সে যেদিন বজ্রের সম্মুখে দাঁড়াইল, বজ্র অপলক নেত্রে তাহার পানে চাহিয়া রহিল। বজ্রের বয়স তখন নয়-দশ বৎসর, ভিলকে সে পূর্বে কখনও দেখে নাই।
ভিল একটি হরিণ মারিয়া আনিয়াছিল। গ্রামের কয়েকজন হরিণ কিনিয়া লইল, পরিবর্তে ভিলকে গুড় ও শস্য দিল।
ভিল যখন ফিরিয়া চলিল বজ্রও তাহার পিছন পিছন চলিল। গ্রামের উত্তরে বাথান পার হইয়া ভিল পলাশবনে প্রবেশ করিল, তখনও বজ্র তাহার পিছন ছাড়িল না। ভিল তাহাকে লক্ষ্য করিয়াছিল, হঠাৎ ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল— ‘কি চাও?’
বজ্র বলিল— ‘তুমি কি করে হরিণ মারো?’
ভিল হাসিয়া উঠিল— ‘এই তীরধনুক দিয়ে।’
তীরধনুক কিছুক্ষণ উৎসুক চক্ষে নিরীক্ষণ করিয়া বজ্র বলিল— ‘ও দিয়ে হরিণ মারা যায়?’
ভিল আবার হাসিল। শুভ্রকান্তি বলিষ্ঠ দেহ বালককে তাহার ভাল লাগিল। সে বলিল— ‘মারা যায়। দেখবে?’
অদূরে উচ্চ বৃক্ষচূড়ে একগুচ্ছ ফুল ফুটিয়া ছিল। ভিল ধনুতে তীর সংযোগ করিয়া পুষ্পগুচ্ছের প্রতি লক্ষ্য করিল; আকৃষ্ট ধনু হইতে টঙ্কার শব্দে তীর ছুটিয়া গেল। রক্তবর্ণ কিংশুকগুচ্ছ মাটিতে পড়িল।
ভিল ফুলের গুচ্ছটি বজ্রের হাতে দিল, তারপর নিজের তীর তুলিয়া লইয়া হাসিতে হাসিতে বনের পথে চলিল। কিছুদূর গিয়া ভিল দেখিল তখনও বজ্র তাহার পশ্চাতে আসিতেছে। সে বলিল— ‘আবার কি?’
বজ্র বলিল— ‘আমাকে শেখাবে?’ ভিল বলিল— ‘শেখাতে পারি। কিন্তু তুমি আমায় কি শেখাবে?’
বজ্র চিন্তা করিয়া বলিল— ‘আমি তোমাকে বঁড়শি দিয়ে মাছ ধরতে শেখাব।’
ভিল হৃষ্ট হইয়া বলিল— ‘আচ্ছা। এবার আমি তাড়াতাড়ি আসব। তোমার জন্যে নতুন তীরধনুক তৈরি করে আনব।’
কিংশুকগুচ্ছটি লইয়া বজ্র ছুটিতে ছুটিতে কুটিরে ফিরিয়া আসিল। এত আহ্লাদ ও উত্তেজনা তাহার জীবনে এই প্রথম। মা’কে সম্মুখে পাইয়া সে দুই বাহু দিয়া মায়ের গলা জড়াইয়া ধরিল। রঙ্গনা তাহার মুখ তুলিয়া ধরিয়া বলিল— ‘কি রে!’
লজ্জা পাইয়া বজ্র একটু শান্ত হইল; মায়ের চুলে রাঙা ফুলগুলি গুঁজিয়া দিতে দিতে বলিল— ‘আমি তীরধনুক শিখব।’
রঙ্গনা ছেলের মুখখানি দুই হাতে ধরিয়া বিস্ময়-বেদনাভরা চোখে নিরীক্ষণ করিতে লাগিল। মানব চলিয়া গিয়াছে, কিন্তু তবু যেন সম্পূর্ণ চলিয়া যায় নাই; নিজের খানিকটা রঙ্গনার কাছে গচ্ছিত রাখিয়া গিয়াছে। আবার সে আসিবে, যত বিলম্বেই হোক আবার সে ফিরিয়া আসিবে। রঙ্গনার প্রতীক্ষা বিফল হইবে না।
যারা সংসারী তাহাদের যৌবন অধিক দিন থাকে না। কিন্তু রঙ্গনা সংসারের ফাঁদে ধরা দেয় নাই, নিজের অন্তরের কল্পলোকে বাস করিয়াছে; তাই কালের নখরাঘাত তাহার অঙ্গে লাগে নাই। এখনও তাহাকে দেখিলে মনে হয়, সে নববধূ; অনাঘ্রাত পুষ্প, অনাস্বাদিত মধু। দশ বৎসর পূর্বের সেই একটি হৈমন্তী রজনী যেন তাহার রূপ-যৌবনকে বাঁধিয়া রাখিয়া গিয়াছে, দেহে মনে সে আর একটি দিনও বাড়ে নাই।
কিন্তু কালচক্র ঘুরিতেছে। কাহারও পক্ষে মন্থর, কাহারও পক্ষে দ্রুত। রঙ্গনার প্রতীক্ষায় এখন আর ত্বরা নাই, অধীরতা নাই। কিন্তু বজ্রের জীবনে এই প্রথম এক নূতন আকর্ষণ আসিয়াছে, তাহার স্থির স্বভাবকেও চঞ্চল করিয়া তুলিয়াছে। কৈশোরের স্বাভাবিক অসহিষ্ণুতায় সে সারাদিন বনের কিনারায় ঘুরিয়া বেড়ায়; মধ্যরাত্রে ঘুম ভাঙ্গিয়া ভাবে, কাল নিশ্চয় ভিল আসিবে।
প্রায় এক মাস পরে ভিল আসিল। নূতন তীরধনুক পাইয়া বজ্রের আনন্দের সীমা নাই। ভিল তাহাকে হাতে ধরিয়া তীর ছুঁড়িতে শিখাইল; কি করিয়া তীরের পিছনে পুঙ্খ লাগাইয়া তীরের গতি সিধা করিতে হয় তাহা দেখাইয়া দিল। পরিবর্তে বজ্র ভিলকে বঁড়শি দিল এবং নদীতে মাছ ধরিবার কৌশল শিখাইল। দিনের শেষে বিদ্যার আদান-প্রদান সম্পূর্ণ হইলে ভীল মহামূল্য বঁড়শি লইয়া চলিয়া গেল। আর বজ্র সে-রাত্রে তীরধনুক পাশে লইয়া শয়ন করিল।
অতঃপর বজ্র উত্তরের বনে মৃগ অন্বেষণে ঘুরিয়া বেড়ায়। ক্রমে তাহার লক্ষ্য স্থির হইল; সে ময়ূর মারিল, হরিণ মারিল, উড়ন্ত পাখি তীর দিয়া মাটিতে ফেলিতে সমর্থ হইল। তারপর ভিল যখন মাঝে মাঝে আসিত, বজ্রের অব্যর্থ লক্ষ্যবেধ দেখিয়া প্রশংসা করিত, আরও নূতন কৌশল শিখাইয়া দিত।
এইরূপ বিচিত্র পথে বজ্রের শিক্ষাদীক্ষা অগ্রসর হইল। দেহ ও মন দ্রুত পরিপুষ্টি লাভ করিতে লাগিল, কিন্ত ইষদ্গম্ভীর সঙ্গাকাঙক্ষাহীন শান্ত স্বভাবের পরিবর্তন হইল না।
বজ্রের যখন বারো বছর বয়স তখন একটি ব্যাপার ঘটিল। গ্রামে মধু নামে এক বালক ছিল; কুর্চ্চশিখর বৃহৎমুণ্ড কৃষ্ণকায় বালক, বয়সে বজ্র অপেক্ষা দুই এক বৎসরের জ্যেষ্ঠ। মধু’র স্বভাব অতিশয় দুরন্ত ও কলহপ্রিয়; তাহার পিতা তাহাকে শাসন করিতে পারিত না। মধু তাহার সমবয়স্ক ও কনিষ্ঠ বালক-বালিকাদের উপর অশেষ দৌরাত্ম্য করিত। তাহার দেহও বয়সের অনুপাতে বলিষ্ঠ, কেহ তাহার সহিত আঁটিয়া উঠিত না।
বজ্রের সহিত গ্রামের কোনও বালকেরই বিশেষ ঘনিষ্ঠতা ছিল না, মধু’রও ছিল না। মধু মনে মনে বজ্রকে ঈর্ষা করিত, কিন্তু তাহাকে ঘাঁটাইতে সাহস করিত না। দূর হইতে নিজের সাঙ্গোপাঙ্গদের মধ্যে বজ্রকে ব্যঙ্গভরে ‘রাজপুত্তুর’ বলিয়া উল্লেখ করিত। বজ্র কদাচিৎ শুনিতে পাইলেও তাহা গায়ে মাখিত না। রাজপুত্র সম্বোধনে কোনও গ্লানির ইঙ্গিত আছে তাহা সে বুঝিতে পারিত না।
মধু’র অত্যাচার উৎপীড়নের বিশেষ পাত্রী একটি মেয়ে ছিল, তাহার নাম গুঞ্জা। গুঞ্জা মধু’র দূরসম্পর্কের ভগিনী, শৈশবে পিতামাতাকে হারাইয়া সে মধুদের গৃহেই আশ্রয় পাইয়াছিল। গুঞ্জার বয়স সাত বৎসর, কিন্তু তাহাকে দেখিলে আরও অল্পবয়স্ক মনে হইত। ক্ষীণাঙ্গী, মলিন, তামার ন্যায় বর্ণ; মুখখানি তরতরে, চোখ দুটি বড় বড় ভাসা-ভাসা। কিন্তু চোখে সর্বদাই প্রচ্ছন্ন আতঙ্ক। এই পরপালিতা অনাদৃতা মেয়েটিকে মধু নানাভাবে নিগ্রহ করিত। সে ছিল মধু’র আজ্ঞাকারিণী দাসী; রাগ হইলে মধু তাহাকে মারিত, চুল ছিঁড়িয়া দিত। গুঞ্জা নীরবে সহ্য করিত; মধু’র ক্রোধ হইতে তাহাকে রক্ষা করিবার কেহ ছিল না।
একদিন সন্ধ্যাবেলা মধু তাহার অনুচর বালক-বালিকাদের লইয়া মৌরীর উঁচু পাড়ের উপর খেলা করিতেছিল। হঠাৎ কি কারণে ঝগড়া হইল; মধু গুঞ্জাকে সম্মুখে পাইয়া মারিতে আরম্ভ করিল, তারপর তাহার চুল ধরিয়া টানিতে টানিতে পাড়ের কিনারায় লইয়া গিয়া ঠেলা দিয়া নদীতে ফেলিয়া দিল।
বজ্র অদূরে মৌরীর জলে ছিপ ফেলিয়া বসিয়া ছিল! সে জলে লাফাইয়া পড়িয়া গুঞ্জাকে টানিয়া তুলিল। গুঞ্জার একটা হাত ভাঙ্গিয়া গিয়াছে, কপাল কাটিয়া রক্ত পড়িতেছে; ভয়ে ও যন্ত্রণায় মূর্ছিতপ্রায় অবস্থা। সে এক হাতে বজ্রের গলা জড়াইয়া ফুঁপাইয়া ফুঁপাইয়া কাঁদিতে লাগিল।
বজ্র তাহাকে তুলিয়া লইয়া পাড়ের উপর উঠিয়া আসিল। দলের ছেলেমেয়ে অধিকাংশই পলাইয়াছিল, দুই একজন মাত্র ছিল। বজ্র গুঞ্জাকে মাটিতে নামাইয়া মধু’র দিকে অগ্রসর হইল। তাহার গৌরবর্ণ মুখ লাল হইয়া উঠিয়াছে, দেহের স্নায়ুপেশী কঠিন। সে মধু’র সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইল।
মধু হটিল না, ক্ষুদ্র আরক্ত চোখে হিংস্রতা ভরিয়া বিদ্রূপ করিল— ‘রাজপুত্তুর! রাজপুত্তুর!’
বজ্র মধু’র গালে একটি বজ্রসম চড় মারিল!
তারপর যে যুদ্ধ আরম্ভ হইল তাহাকে মল্লযুদ্ধ বলা চলে, আবার ষাঁড়ের লড়াই বলিলেও অন্যায় হয় না। মধু বয়সে বড়, তার উপর বন্য স্বভাব; সে নখদন্ত দিয়া শ্বাপদের ন্যায় লড়াই করিল, বজ্রের দেহ ক্ষতবিক্ষত করিয়া দিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বজ্রের সহিত পারিল না। বজ্রের দেহে পিতৃদত্ত অটল শক্তি ছিল, তাহাই জয়ী হইল। একদণ্ড যুদ্ধের পর মধু ভূমিশয্যা গ্রহণ করিয়া আর উঠিল না, তাহার দেহে আর নড়িবার শক্তি নাই। বজ্র তখন যুদ্ধের মদান্ধতায় জ্ঞানশূন্য, সে মধু’র একটা পা ধরিয়া টানিতে টানিতে নদীর পাড়ের দিকে লইয়া চলিল। উদ্দেশ্য জলে ফেলিয়া দিবে।
ইতিমধ্যে গ্রামের কয়েকজন বয়স্ক ব্যক্তি উপস্থিত হইয়াছিল, চাতক ঠাকুরও আসিয়াছিলেন। তিনি গিয়া বজ্রের হাত ধরিলেন। বলিলেন— ‘ছেড়ে দাও। যথেষ্ট হয়েছে।’
বজ্র মধুকে ছাড়িয়া দিল। চাতক ঠাকুর তাহাকে হাত ধরিয়া সরাইয়া লইয়া গেলেন। গুঞ্জা অদূরে মাটিতে পড়িয়া কাঁদিতেছিল, তাহার কাছে গিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন— ‘কি হয়েছিল?’
বজ্র ও গুঞ্জা ঘটনা বিবৃত করিল। সকলে শুনিয়া বজ্রের সাধুবাদ করিল। মধু’র দুঃশীল দুর্দান্ত স্বভাবের জন্য কেহই তাহার প্রতি প্রসন্ন ছিল না, তাহার শাস্তিতে সকলে সন্তুষ্ট হইল।
গুঞ্জার কান্না কিন্তু থামে না। চাতক ঠাকুর তাহাকে ও বজ্রকে লইয়া দেবস্থানে গেলেন; বুড়ির গুয়া পান পাতা দিয়া গুঞ্জার ভাঙ্গা হাত বাঁধিয়া দিলেন। হঠাৎ হাসিয়া বলিলেন— ‘মধুমথন। বজ্র, আজ থেকে তোমার একটা নাম হল মধুমথন।’
বজ্র কিন্তু হাসিল না। তাহার রক্ত অনেকটা ঠাণ্ডা হইয়াছে কিন্তু মনের উষ্ণতা দূর হয় নাই। সে বলিল— ‘ও আমাকে রাজপুত্তুর বলে কেন?’
চাতক ঠাকুর চকিত হইয়া তাহার পানে চাহিলেন, তারপর সহজ সুরে বলিলেন— ‘তুমি রাজার ছেলে, তাই রাজপুত্র বলে।’
কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকিয়া বজ্র প্রশ্ন করিল— ‘আমার পিতা কোথায়?’
চাতক ঠাকুর তাহার স্কন্ধে হাত রাখিয়া বলিলেন— ‘বজ্র, তুমি এখন ছেলেমানুষ, তোমার পিতৃ-পরিচয় এখন জানতে চেও না। যখন বড় হবে, জানতে পারবে।’
বজ্র জিজ্ঞাসা করিল— ‘কবে বড় হব? কতদিনে জানতে পারব?’
চাতক ঠাকুর বলিলেন— ‘তোমার যখন কুড়ি বছর বয়স হবে তখন জানতে পারবে। তোমার মা তোমাকে বলবেন।’
বজ্র আর প্রশ্ন করিল না; কথাটি মনের মধ্যে সঞ্চয় করিয়া রাখিল।
সন্ধ্যার পর বজ্র গুঞ্জার হাত ধরিয়া নিজ কুটিরে লইয়া গেল; মা’কে বলিল— ‘মা, আজ থেকে গুঞ্জা আমাদের কাছে থাকবে।’
রঙ্গনা দুই হাত বাড়াইয়া গুঞ্জাকে কোলে টানিয়া লইল। সে-রাত্রে রঙ্গনার এক পাশে বজ্র, অন্য পাশে গুঞ্জা শয়ন করিয়া ঘুমাইল।
গুঞ্জা বজ্রের গৃহেই রহিয়া গেল। তাহার মাতুল আপত্তি করিল না; চাতক ঠাকুর ব্যাপারটিকে সহজ ও স্বাভাবিক করিয়া দিলেন।
আদর যত্ন ও ভালবাসা পাইয়া গুঞ্জার শ্রী দিনে দিনে পরিস্ফুট হইয়া উঠিল। তাহার ভাঙ্গা হাত জোড়া লাগিল; মলিন তামার মত বর্ণ উজ্জ্বল মার্জিত তাম্রবর্ণে পরিণত হইল, চোখের শঙ্কাকাতর দৃষ্টি দূর হইল।
একদিন কুটির প্রাঙ্গণে বসিয়া বজ্র ধনুকে নূতন ছিলা পরাইতেছিল, গুঞ্জা আসিয়া পিছন হইতে তাহার গলা জড়াইয়া ধরিল; কানে কানে বলিল— ‘মধুমথন।’
বজ্র তাহাকে টানিয়া সম্মুখে আনিল— ‘কি বললে?’
গুঞ্জা বলিল— ‘আমি তোমাকে মধুমথন বলে ডাকব।’
বজ্র হাসিল। বলিল— ‘আমিও তোমাকে অন্য নামে ডাকব, গুঞ্জা বলে ডাকব না।’
উৎসুক চক্ষে চাহিয়া গুঞ্জা জিজ্ঞাসা করিল— ‘কি বলে ডাকবে?’
গুঞ্জার মেঘবরণ চুল ধরিয়া টানিয়া বজ্র তাহার কানে কানে বলিল— ‘কুঁচবরণ কন্যা।’