৭. মউল থেকে সের্সান্তে
তেরোই জানুয়ারি ভোরবেলা ভার্গাস মউলকে খুঁটিয়ে পরীক্ষা ক’রে জানালে যে, এই ঝড়ে স্কুনারটির যা ক্ষতি হয়েছে, তা গুরুতর। এটাকে যদি মেরামত করতে হয় তবে তাদের সবাইকে মিলে খুবই খাটতে হবে। গুহায় জরুরি যন্ত্রপাতির কোনো অভাব না-থাকায় ছুতোর ভার্গাস ঘোষণা করলে যে জাহাজটির ক্ষয়ক্ষতি সারানো সম্ভব, কিন্তু সবাই মিলে একসাথে কাজে হাত না-লাগালে তাতে অনেক সময় লেগে যাবে। আর জাহাজটি না-সারিয়ে নিলে এই জাহাজ নিয়ে সাগরপাড়ি দেয়া অসম্ভব।
কিন্তু মেরামত করতে হ’লে প্রথমে তাদের স্কুনারটিকে চড়ায় ভিড়িয়ে নিতে হবে। ভরা জোয়ারের সময় ছাড়া তার কোনো সুবিধে ছিলো না ব’লে বিনা কাজেই আরো দুটি দিন কেটে গেলো। এই সুযোগে কন্গ্রে আর সের্সান্তে একবার পুরোনো গুহায় গিয়েছিলো। বাতিঘরের ডিঙিটা তুলনায় একটু বড়ো ব’লে সেইটেতে ক’রেই তারা গিয়েছিলো। সোনারুপো, ধনরত্ন এবং অন্যান্য দরকারি জিনিশ এবার নৌকো-বোঝাই-ক’রে এনে ভাঁড়ারে তোলাই ছিলো তাদের মলব। চোদ্দই জানুয়ারি সকালবেলায় সেই উদ্দেশ্যেই তারা নৌকো ছেড়েছিলো। আবহাওয়া শান্ত ছিলো তখন, আকাশ ছিলো স্বচ্ছ নির্মল, সমুদ্রের নীল জলে সূর্যের সোনালি আলো ঝিকমিক করছিলো, দেখে কে বলবে যে দু-দিন আগেই এমন প্রচণ্ড ঝড় হ’য়ে গিয়েছে।
যাত্রার আগে আলোকস্তম্ভের লণ্ঠন-ঘরে উঠে চারপাশে তাকিয়ে দেখেছিলো সের্সান্তে। না, দুর্ভাবনার কিছুই নেই। কোনোখানে জনমানবের কোনো চিহ্ন-ই নেই।
স্রোতের মুখে নৌকো ছেড়েই তারা যাত্রা করেছিলো। যেতে-যেতে সারাক্ষণ পথের দু-পাশে সতর্ক চোখে তাকিয়ে দেখেছিলো কন্গ্রে। তৃতীয় আলোকরক্ষী কোথায় যে আত্মগোপন ক’রে আছে, তার কোনো হদিশ পাওয়া যায় কিনা তা-ই সে দেখতে চাচ্ছিলো। যদিও তাকে নিয়ে কন্গ্রের তেমন মাথা-ব্যথা ছিলো না, তবু মিছেমিছি মাছের কাঁটার মতো গলায় সেটা বিঁধে থাকলে কী লাভ? একবার তার দেখা পাওয়া গেলে তাকে খতম ক’রে দেয়া যেতো।
উভয় তীরেই জনমানবের কোনো চিহ্নই ছিলো না। শুধু কিছু-কিছু পাখ-পাখালির কিচিরমিচির কানে আসছিলো।
বেলা প্রায় এগারোটার সময় তারা গুহার কাছে এসে পৌঁছেছিলো। তীরে নৌকো বেঁধে, দুটি লোকের ওপর পাহারার ভার দিয়ে শুধু কন্গ্রে আর সের্সান্তেই গুহার দিকে পা চালিয়েছিলো।
গুহার ভেতরটা যেমন ছিলো, তেমনি আছে। কোনোখান থেকেই কিছু খোয়া যায়নি—দেখে অন্তত তা-ই মনে হচ্ছিলো। কেননা গুহার ভেতরে এত মালপত্র ঠাশা ছিলো যে বাতিঘরের লণ্ঠনের আলো জ্বেলেও বোঝা সম্ভব হ’তো না কিছু খোয়া গেছে কি না।
দরকারি জিনিশপত্তর নৌকোয় তুলে তারা যখন রওনা হবে, তখন হঠাৎ কন্গ্রে জানিয়ে দিলো যে সে একবার চারদিকটা দেখে আসতে চায়।
সের্সান্তেও অন্তরীপের এক মাথায় চ’লে গেলো। একটা টিলার ওপর উঠে কন্গ্রে ভালো ক’রে তাকালে চারদিকে। অনেক দূর অব্দি দেখা যাচ্ছে : চারদিকই নিষ্প্রাণ, নির্জন—শুধু সমুদ্রের ঢেউই এক মুহূর্তের জন্যেও চুপ ক’রে ব’সে থাকছে না।
কোথাও সন্দেহজনক কিছু দেখতে না-পেয়ে তারা ফের নৌকোয় ফিরে এলো। যখন তারা বাতিঘরের কাছে ফিরে এলো, তখন বেলা প’ড়ে এসেছে, তিনটে বাজে।
দু-দিন বাদে ভরা জোয়ারের সময় তারা মউলকে চড়ায় ভেড়ালে, অবশ্য এজন্যে তাদের বিস্তর মেহনত করতে হয়েছিলো। এটা ষোলোই জানুয়ারির কথা।
জাহাজটাকে চড়ায় এনে ভেড়াবার সঙ্গে-সঙ্গে ভার্গাস কাজে লেগে গেলো। রোজ কিন্তু কয়েক ঘণ্টা ক’রে সময় খামকা নষ্ট হ’তো। জোয়ারের সময় চড়া ডুবে যেতো ব’লে তখন আর কোনো কাজ করা যেতো না। কিন্তু সেটা মেনে না-নিয়ে কোনো উপায় ছিলো না। এটা তো আর সত্যি-সত্যি জাহাজ সারাইয়ের কোনো কারখানা নয়, মাথা পেতে প্রকৃতির বিধান মেনে নেয়া ছাড়া আর কীই বা করা যেতো এখানে?
পরের পক্ষকাল ধ’রে চমৎকারভাবে কাজ এগুলো। আবহাওয়া শান্ত ব’লে কাজ করতে মোটেই কোনো অসুবিধে হচ্ছে না। ভার্গাস সহজেই তার কাজের প্রথম পর্বটা নিখুঁতভাবে সমাধা ক’রে দিলে। কোনো বাধা ছাড়াই জানুয়ারির শেষ অব্দি পুরোদমে কাজ চললো। আবহাওয়া বেশ ভালো থাকে, মাঝে-মাঝে খুব অল্প সময়ের জন্যে কয়েক পশলা বৃষ্টি অবশ্য থেকে-থেকে হ’তো, তবে কোনো ঝড়তুফান ওঠেনি।
এই সময়ের মধ্যে স্টটেন আইল্যাণ্ড থেকে দুটো জাহাজ দেখা গিয়েছিলো। প্রথমটা ইংরেজদের। দুপুরবেলার দিকে একদিন সে স্টটেন আইল্যাণ্ডকে পাশ কাটিয়ে দিকচক্রবালে মিলিয়ে গিয়েছিলো; সুতরাং বাতিঘর ঠিকঠাক কাজ করছে কি না, সেটা বোঝবার বা খেয়াল করবার কোনো কথাই ওঠেনি। দ্বিতীয়টা ছিলো এক মস্ত জাহাজ, পেল্লায়, রাতের অন্ধকারে বোঝা যায়নি সেটা কোন দেশের। লণ্ঠনঘর থেকে সের্সান্তে শুধু তার সবুজ আলোটাকেই দেখতে পেয়েছিলো। জাহাজটি হয়তো কয়েক মাস ধ’রে সাগর পাড়ি দিচ্ছিলো, তাই বাতিঘর শেষ হয়েছে কি না সেটা সম্ভবত জানে না। উপকূলের ধার ঘেঁষেই গিয়েছিলো জাহাজটি। কাজেই বাস্কেথ দৃষ্টি আকর্ষণ করবার বিশেষ চেষ্টা করলে জাহাজের লোকে তা নিশ্চয়ই দেখতে পেতো। কিন্তু বাস্কেথ তাদের নজরে পড়বার জন্যে আদপেই কোনো চেষ্টা করেনি। ভোর হবার ঠিক আগটায় জাহাজটি দিগন্তে অদৃশ্য হ’য়ে গিয়েছিলো। দূরে, দিগন্তে, আরো-যে কয়েকটা জাহাজ দেখা যায়নি তা নয়, তবে সেগুলো এত দূর দিয়ে গিয়েছিলো যে তাদের কথা বলবার মতো কিছু ছিলো না।
একত্রিশে জানুয়ারি আবহাওয়া আবার খারাপ হ’য়ে গেলো। কিন্তু বোম্বেটেদের বরাৎটা ভালো, স্কুনারের মেরামতির কাজ তখন মোটামুটি হ’য়ে গিয়েছে। তাই এবারকার ঝড়ে কন্গ্রে আর তার দলবলের হুঁশিয়ারিতে মউলের নতুন-কোনো ক্ষতি হ’তে পারেনি। তাছাড়া, ঝোড়ো আবহাওয়া বেশিক্ষণ থাকেওনি, দোসরা ফেব্রুয়ারি থেকেই হাওয়ার উদ্দাম গতি শান্ত হ’য়ে এসেছিলো বলে ততটা ভয় হয়নি তাদের।
এবারে একটু-একটু ক’রে জাহাজে মালপত্র বোঝাই করার কাজ শুরু হ’লো। ভার্গাস যাদের জাহাজের কাজে লাগায়নি তারা বার-কতক পুরোনো গুহায় যাতায়াত করেছে, কখনও-কখনও কন্গ্রে স্বয়ং কখনও-বা সের্সান্তে তাদের সঙ্গে গিয়েছে। প্রতিবারই বেশ খানিকটা ক’রে মালপত্র তারা নিয়ে এসেছে। সেগুলোকে গোড়ায় সাময়িকভাবে বাতিঘরের ভাঁড়ারেই তোলা হয়েছে। বাতিঘরের ভাঁড়ারটাকেই এ-অবস্থায় কাজে লাগানো সুবিধের ব’লে তাদের মনে হয়েছে।
দিন কয়েক বাদে মউলের মেরামতিকাজ শেষ হ’য়ে গেলো, সবকিছু সরেজমিন খতিয়ে দেখে মনে হ’লো এবারে সমুদ্রযাত্রা সম্ভব। কাজেই আস্তে- আস্তে জাহাজে মাল তোলা শুরু হয়ে গেলো।
গুহায় ঠাশাঠাশি সব মালের ভেতর একদিন হঠাৎ কতগুলো রঙের পাত্রও তারা আবিষ্কার করেছিলো। সেগুলোকে দেখেই কন্গ্রের মাথায় এক চমৎকার ফন্দি খেলে গিয়েছিলো। সে জাহাজের গায়ে নতুন ক’রে রঙের প্রলেপ চড়াতে হুকুম করলে, ঠিক করলে জাহাজটার নামও বদলে দেবে। জাহাজটার নতুন নাম দেয়া হ’লো : ‘সের্সান্তে’।
চোদ্দোই ফেব্রুয়ারি ভরা জোয়ারের সময় চড়া থেকে খাড়ির মধ্যে আগের জায়গাটাতেই নিয়ে-যাওয়া হ’লো ‘সের্সান্তে’কে। তারপর শুরু হলো নতুন উদ্যমে মালপত্র বোঝাই করা। সকলের মনেই খুশি আর উৎসাহ, অবশেষে এতদিন বাদে তাদের স্বপ্ন সফল হ’তে চলেছে। এখন তারা একটি জাহাজের মালিক, এবার নীল সমুদ্রে পাড়ি দেয়া হবে। বেশ চনমনে লাগছিলো সবাইকার। ফলে মাল বোঝাই করার কাজও হুড়মুড় ক’রে এগুচ্ছিলো। আর ক-দিন বাদেই নোঙর তুলবে নতুন জাহাজ ‘সের্সান্তে’, তারপর ইগোর উপসাগর পেরিয়ে, লেময়র প্রণালী ধ’রে, বারদরিয়ায় প’ড়ে পুরো দমে ছুটে চলবে প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে। আর মাত্র কয়েকটা দিন, তারপরেই সফল হবে কন্গ্রের এতদিনের স্বপ্ন।