ভোরবেলা ঘুম ভাঙতেই সন্তু তড়াক করে খাট থেকে নেমে সিঁড়ি দিয়ে হুড়মুড়িয়ে নেমে এল দোতলায়।
কাকাবাবুর ঘরে ঢুকে দেখল, বিছানার চাদরে একটুও ভাঁজ পড়েনি। দেখলেই বোঝা যায়, রাত্তিরে ফেরেননি কাকাবাবু।
সন্তু ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে রইল।
এরকম তো হয় না। কাকাবাবু কাল ব্যস্তভাবে বেরিয়ে গেলেন, সন্তুকে কিছুই বললেন না। না খেয়েদেয়ে কোথায় চলে গেলেন অত রাত্রে?
সে টেবিলটা খুঁজে দেখল, যদি তার প্রতি কোনও নির্দেশ লিখে রাখা থাকে। তাও নেই।
আর দুদিন বাদেই কাকাবাবুর সঙ্গে তার ইজিপ্ট যাওয়ার কথা। মনে হচ্ছে, তা আর যাওয়া হবে না। বাচ্চা ছেলেগুলোকে উদ্ধারের চিন্তায় কাকাবাবু এখন অন্য সবকিছু ভুলে গেছেন। কাল তিনি সন্তুকে সঙ্গে নিলেন না কেন?
অবশ্য সন্তুর এখন কলেজ খোলা। তাই তিনি সন্তুকে এই ব্যাপারটায় জড়াতে চাইছেন না। ইজিপ্টে গেলে এমনিতেই চার-পাঁচদিন ক্লাস নষ্ট হত।
এর পর মুখটুখ ধুয়ে সন্তু পড়তে বসল।
কিছুতেই মন বসছে না। সিঁড়িতে একটু আওয়াজ হলেই সে উঁকি দিয়ে দেখে আসছে, কাকাবাবু ফিরলেন কি না। প্রত্যেকবারই নিরাশ হতে হচ্ছে।
কাকাবাবু যে রাত্তিরে ফেরেননি, এটা আলমদাকে জানানো উচিত কিনা সে বুঝতে পারছে না। কাকাবাবু যদি রাগ করেন? যখন-তখন পুলিশের সাহায্য নেওয়া তিনি পছন্দ করেন না।
রঘু ওপরে জলখাবার দিতে এসে জানাল, এর মধ্যে দুজন লোক কাকাবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এসে ফিরে গেছে। টেলিফোনেও খোঁজ করছে কয়েকজন, তাদের কী বলব? শুধু বলছি, বাড়ি নেই।
সন্তু বলল, তা ছাড়া আর কী বলবে? বাড়িতে নেই, এটাই তো সত্যি কথা!
রঘু বলল, একজন খুব নাছোড়বান্দা। দুবার ফোন করেছে। সে বলল, কাল রাত্তিরেও ফোনে পাইনি, আজ সকালেও নেই, উনি কি বাইরে গেছেন? আমি বলে ফেলেছি, তা জানি না, রাত্তিরে ফেরেননি, কবে ফিরবেন জানি না।
সন্তু বলল, অত কথা বলার দরকার কী? শুধু বলবে, কখন ফিরবেন জানি না।
কে কে ফোন করেছিল, তা জানার খুব কৌতূহল হল সন্তুর, কিন্তু রঘু নাম জিজ্ঞেস করে না।
পড়বার সময় সন্তু নিজে ফোন ধরতে যাবে না, এটা বাবার হুকুম। কর্ডলেস ফোনটাও কাছে রাখতে পারবে না।
কলেজ যাওয়ার সময় হয়ে এল, তবু কাকাবাবুর পাত্তা নেই।
সন্তু স্নানটান করে তৈরি হয়ে নিল। তারপর নীচে এসে ঝট করে টেলিফোনে রফিকুল আলমকে ধরার চেষ্টা করল।
তাঁর বাড়ি থেকে জানানো হল, রফিকুল আলম কাল রাত্তির থেকে বাড়িতে নেই, কখন ফিরবেন ঠিক নেই।
দুজনেই রাত্তিরে ফেরেননি, তা হলে কি দুজনেই একসঙ্গে কোথাও গেছেন? নিশ্চয়ই তাই।
রফিকুল আলমের মোবাইল ফোনে কোনও সাড়াশব্দ নেই। ফোনটা বন্ধ আছে? কিংবা কলকাতা থেকে অনেক দূরে চলে গেলে ওই ফোন কাজ করে না।
দুজনেই কলকাতার বাইরে, তা হলে কি মুম্বই চলে গেলেন নাকি?
বাসে চেপে কলেজের সামনে এসেও নামতে পারল না সন্তু। এখন শান্তভাবে ক্লাস করা তার পক্ষে অসম্ভব। মনের মধ্যে সবসময় প্রশ্নটা ঘুরছে, কোথায় গেলেন কাকাবাবু?
বাস বদল করে সে চলে এল বারাসত হাসপাতালের সামনে। এই জায়গাটাই একমাত্র যোগসূত্র।
ভাতের হোটেলটি বন্ধ। দরজায় বাইরে থেকে তালা ঝুলছে।
একটা হাতে লেখা নোটিশে লেখা আছে যে, ভেতরে মেরামতির কাজ চলছে। বলে এক সপ্তাহ হোটেল খোলা হবে না।
সন্তু একবার হেঁটে গেল হাসপাতাল পর্যন্ত। তারপর ময়নার বাড়ির চারপাশে দুবার ঘুরল। সে বাড়িতে কোনও জনপ্রাণী আছে বলে মনে হয় না।
হতাশ হয়ে সন্তু বাসস্টপে এসে দাঁড়াল। আর তো কোনও সূত্র নেই।
বাস আসতে দেরি করছে। হঠাৎ সন্তু লক্ষ করল, খানিকটা দূরে একটি লোক যেন তার দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখে চোখ পড়তেই সে চোখ ফিরিয়ে নিল। সিগারেট ধরাল মুখ নিচু করে।
সন্তুর মনে হল, একটু আগেও এই লোকটি তার পিছু পিছু হাঁটছিল।
একটা ছাই রঙের শার্ট আর একই রঙের প্যান্ট পরা, বেশি লম্বাও না, বেঁটেও, মাথায় অল্প টাক। লোকটির বয়েস চল্লিশের কাছাকাছি।
লোকটি তাকে অনুসরণ করছে নাকি?
বাস আসার পর সন্তু উঠেই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিল, অন্য দরজা দিয়ে উঠেছে। সেই ছাইরঙা পোশাক পরা লোকটি। অবশ্য কাকতালীয় হতে পারে।
এসপ্লানেডে এসে সন্তু তক্ষুনি অন্য বাসে না উঠে একটা আইসক্রিম কিনে খেতে লাগল ধীরেসুস্থে। সেই লোকটিও এখানে নেমেছে, খানিক দূরে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে।
এর পরের বাসেও সন্তুর সঙ্গে-সঙ্গে উঠে পড়ল সে।
এবারে সন্তু নেমে পড়ল কলেজের সামনে।
এই সময়টায় একটা পিরিয়ড অফ থাকে, সবাই টিফিন খায়। সন্তু দোতলায় উঠে এসে বারান্দা থেকে উঁকি মেরে দেখল, সেই লোকটি কলেজের গেটের উলটো দিকে, পার্কের রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
কলেজের পেছনদিকের মাঠ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার একটা গেট আছে। সন্তু এখন ইচ্ছে করলেই লোকটাকে ওখানে দাঁড় করিয়ে রেখে কেটে পড়তে পারে। কিন্তু লোকটা কেন তাকে অনুসরণ করছে, তা জানা দরকার।
জোজোকে পাওয়া গেল কলেজ ক্যান্টিনে।
সে কয়েকজন সহপাঠীর সঙ্গে জমিয়ে গল্প করছে। বাবার সঙ্গে সে গত বছর গিয়েছিল দক্ষিণ আমেরিকার গালাপাগোস দ্বীপে, সেখানে সব অদ্ভুত-অদ্ভুত জন্তু জানোয়ার আছে, সেখানে সে এমন এক ধরনের কচ্ছপ আবিষ্কার করেছে, যার সন্ধান ডারউইন সাহেবও পাননি। সেই কচ্ছপের পিঠের খোলায় নানারকম আকিবুকি কাটা, ভাল করে ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে দেখলে বোঝা যায়, সেগুলো আসলে সাঙ্কেতিক ভাষায় লেখা গুপ্তধনের হদিস। বহুকাল আগেকার জলদস্যুরা লিখে রেখে গেছে। জোজোর বাবা সেই সাঙ্কেতিক ভাষার মানে উদ্ধার করছেন–
একটুক্ষণ পাশে দাঁড়িয়ে সন্তু বুঝল, জোজোর গল্প সহজে শেষ হবে না, ঘণ্টা বাজলে সে উঠবেও না।
একমাত্র উপায় জোজোর সঙ্গে কথা না বলা।
সে জোজোর সামনে দিয়ে হেঁটে গেল অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে। দরজার কাছে পৌঁছতেই জোজো ডেকে উঠল, এই সন্তু, সন্তু—
সন্তুর ভাল নাম সুনন্দ, কিন্তু তার ডাকনাম কলেজে সবাই জেনে গেছে। সে জোজোর ডাক শুনেও সাড়া না দিয়ে বেরিয়ে গেল।
এবারে গল্প থামিয়ে ছুটে এল জোজো।
সন্তুর হাত ধরে সে বলল, কীরে, তুই আমার ওপর রাগ করেছিস নাকি? কী ব্যাপার? এত দেরি করে এলি?
সন্তু জিজ্ঞেস করল, তুই যে গল্পটা শুরু করেছিস, সেটা পরে অন্যদিন শেষ করলে চলবে?
জোজো বলল, হ্যাঁ, চলবে। গল্প নয়, সত্যি ঘটনা, তবে অনেক লম্বা।
সন্তু আবার জিজ্ঞেস করল, এর পরের ক্লাসগুলো কাট মারতে পারবি?
জোজো বলল, নিশ্চয়ই পারব। পরীক্ষায় আমি তো ফার্স্ট হবই, যতটা পড়েছি তাই যথেষ্ট। তুইও কাট মারবি তো?
সন্তু বলল, আমাকে একটা লোক ফলো করছে। তাকে জব্দ করতে হবে।
জোজো বলল, ফলো করছে? ভেরি ইন্টারেস্টিং।
সন্তু বলল, আমি আগে একা বেরোব। লোকটা যদি আমায় ফলো করে, তুইও পেছন থেকে ওকে ফলো করবি। তুই আমার কাছে আসবি না, ও লোকটা থাকবে মাঝখানে, তোকে যেন দেখতে না পায়–
বারান্দায় এসে দেখা গেল, লোকটি এখনও একই জায়গায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে।
জোজো বলল, ওই টাকমাথা লোকটা! ওকে তো একটা ল্যাং মারলেই কাত হয়ে যাবে!
সন্তু বলল, না, না, ওসব করিস না। আগে দেখতে হবে, ও ফলো করছে কেন!
সন্তু কলেজ থেকে বেরিয়ে হাঁটতে লাগল আস্তে-আস্তে। পেছন ফিরে তাকাল একবারও।
কাছাকাছি বাসস্টপে এসেও বাসে না উঠে সে এগিয়ে গেল অনেকখানি। তারপর একটা ট্রামে উঠল। আড়চোখে দেখে নিল, সেই লোকটি আর জোজো উঠেছে সেকেন্ড ক্লাসে।
আবার ট্রাম বদল করে, সন্তু নেমে পড়ল ময়দানে বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়ামের কাছে। হাঁটতে-হাঁটতে চলে এল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল পর্যন্ত। এখন দুপুর, অনেকে ভেতরে দেখতে যায়, সন্তু গেটের কাছে গিয়েও ভেতরে ঢুকল না।
উলটোদিকে গিয়ে হাঁটতে লাগল মাঠের মধ্যে। রোদুর গনগন করছে, মাঠে আর একটাও লোক নেই। একপাল ভেড়া ঘাস খাচ্ছে।
ভেড়াগুলোকে পেরিয়ে গিয়ে সন্তু হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়েই পেছন ফিরল।
লোকটিও দাঁড়িয়ে পড়েছে, খানিকটা দূরে দেখা যাচ্ছে জোজোকে।
সন্তু এবার ওর দিকে এগিয়ে যেতেই সে পেছন ফিরে দৌড়ল। আর জোজোও দুহাত ছড়িয়ে ধরতে এল তাকে।
লোকটি বিভ্রান্তের মতন একবার সামনে আর একবার পেছনে তাকিয়ে দেখে নিল জোজো আর সন্তুকে। অরপর দৌড়ল ডানদিকে।
কিন্তু সন্তুদের সঙ্গে পারবে কেন? ওরা দুজনে লোকটাকে প্রায় ঘিরে ফেলেছে। তবু ফাঁদে পড়া ইঁদুরের মতন.এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতে লাগল, ওরা দুজন শেষপর্যন্ত জাপটে ধরল তাকে।
লোকটি কোনওক্রমে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ফস করে একটা রিভলভার বার করে বলল, খবরদার, আমার গায়ে হাত দেবে না। আমি যা বলতে চাই, আগে শোনো।
সন্তু লোকটির চোখে চোখ রেখে বলল, ওটা তো মনে হচ্ছে খেলনা রিভলভার। মাঝখানটা ফাটা। ও দিয়ে গুলি বেরবে না!
লোকটি বলল, অ্যাঁ? ফাটা?
লোকটি যেই রিভলভারটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে গেল, সন্তু অমনই এক লাফে ঝাঁফিয়ে পড়ল ওর ওপরে। জোজোও ওর পা ধরে একটা টান দিল। এবারে লোকটি একেবারে চিতপটাং!
সেই অবস্থাতেই সে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, আমাকে মেরো না, মেরো না। আমি কোনও ক্ষতি করতে আসিনি!
জোজো রিভলভারটা তুলে নিয়ে বলল, এটা তো সত্যিই খেলনা রে!
সন্তু মাটিতে বসে পড়ে বলল, এবারে বলুন, কী ব্যাপার? আমাকে ফলো করছিলেন কেন?
লোকটি আপন মনে বলল, এখন বুঝছি ভুলই করেছি।
সন্তু বলল, কী ভুল করেছেন?
লোকটি বলল, এভাবে তোমাকে ফলো করা আমার উচিত হয়নি। কী যে করব, বুঝতে পারছিলাম না।
জোজো বলল, আমরাও তো কিছু বুঝতে পারছি না।
লোকটি বলল, মিস্টার রাজা রায়চৌধুরীর সঙ্গে আমার দেখা করার বিশেষ দরকার। কাল রাত্রে ফোন করে জানলাম, তিনি বাড়ি নেই। আজ সকালে ফোন করে শুনি, তিনি বাড়িই ফেরেননি রাতে। অথচ আমার খুব জরুরি কথা আছে। তাই ভাবলাম, তোমাকে ফলো করি, তুমি নিশ্চিত জানবে, তোমার কাকাবাবু কোথায় আছেন।
সন্তু বলল, এতক্ষণ ধরে আমাকে ফলো না করে, আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেই হত!
লোকটি বলল, তা ঠিক, কিন্তু আবার ভাবছিলাম, তুমিও যদি আমার কথায় বিশ্বাস না করো। যদি কাকাবাবুর সঙ্গে দেখা করতে না দাও!
জোজো বলল, কাকাবাবুর সঙ্গে আপনার কীসের জন্য এত জরুরি দরকার? আমাদের বলতে পারেন। তার আগে বলুন, আপনি কে?
লোকটি বলল, আমার নাম আবু হোসেন, ডাকনাম মামুন। তোমরা আমাকে মামুন বলতে পারো। আমি একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ! বাংলাদেশ থেকে আসছি।
জোজো ভুরু তুলে বলল, প্রাইভেট ডিটেকটিভ? আমি এর আগে কোনও প্রাইভেট ডিটেকটিভকে স্বচক্ষে দেখিনি। গল্পের বইতেই পড়েছি।
মামুন বলল, ঢাকা শহরে অনেকেই আমাকে চেনে। আমি অনেক বড় মার্ডার কেস, ডাকাতির কেস ধরে ফেলেছি। শোনো ভাই, তোমরা দুজনে কিন্তু এত সহজে আমাকে কাবু করতে পারবে না। আমি অনেক তাগড়া জোয়ানকেও ক্যারাটের প্যাঁচ দিয়ে কুপোকাত করে দিতে পারি। তোমরা তো বয়েসে ছোট, আমার শত্রুও নও, তাই মন দিয়ে লড়িনি।
সন্তু বলল, তা বেশ করেছেন। কিন্তু আপনি একটা খেলনা পিস্তল নিয়ে ঘুরছেন কেন?
মামুন বলল, আমার তো আসল পিস্তল রাখার লাইসেন্স নাই। বিশেষত ইন্ডিয়ায় এসেছি, ধরা পড়লে মুশকিল। তবে এটা দেখালেই অনেক সময় কাজ হয়। কখন ফাটল ধরেছে, খেয়াল করিনি।
জোজো জিজ্ঞেস করল, মামুনসাহেব, কী উদ্দেশ্যে আপনার এখানে আগমন, তা তো এখনও বললেন না?
মামুন বলল, আমি একটা কেস হাতে নিয়ে এসেছি। তোমরা হয়তো জানো, বাংলাদেশ থেকে অনেক শিশু চুরি হয়ে ভারতে চালান আসে। কলকাতা থেকে মুম্বই হয়ে সেই শিশুগুলিকে আবার চালান দেয় আরব দেশে।
সন্তু আর জোজো চোখাচোখি করল।
সন্তু বলল, হ্যাঁ, শুনেছি।
মামুন বলল, অতি জঘন্য অপরাধ, ঠিক কি না? এ ব্যাটাদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া উচিত। আমি জেনেছি, বাংলাদেশে এই শিশু চুরির পাণ্ডা শেখ নিয়াম, সে শিশুগুলিকে তুলে দেয় বর্ডারের এদিকে নিতাই মণ্ডলের হাতে। এইসব কাজে মুসলমান আর হিন্দুদের মধ্যে কোনও ভেদ নাই, একেবারে গলাগলি। ওদের ফলো করে আমি দেখে এসেছি শিশুগুলিকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছে। বেশি দেরি করলে মুম্বই চালান হয়ে যাবে, তখন আর করার কিছু থাকবে না। কিন্তু আমার একার পক্ষে তো উদ্ধার করা সম্ভব না।
জোজো বলল, আপনি পুলিশের সাহায্য নিলেন না কেন?
মামুন বলল, চেষ্টা তো করেছি অনেক। লালবাজার হেড কোয়ার্টারে গেছি। প্রথমে তো কেউ দেখাই করতে চায় না। শেষ পর্যন্ত এক অফিসারকে ধরলাম, আমি প্রাইভেট ডিটেকটিভ শুনে তিনি পাত্তাই দিলেন না। বললেন, আমরা প্রাইভেট ডিটেকটিভের সঙ্গে কারবার করি না। আপনাদের গভর্নমেন্টকে চিঠি লিখতে বলুন!
সন্তু জিজ্ঞেস করল, বাচ্চাগুলোকে কোথায় আটকে রেখেছে, আপনি জানেন?
মামুন বলল, হ্যাঁ, লুকিয়ে গিয়ে দেখে এসেছি। পুলিশ আমার কথা বিশ্বাস করল না। তাই ভাবলাম, মিস্টার রাজা রায়চৌধুরী যদি সাহায্য করতে পারেন। ওঁর কথা অনেক বইতে পড়েছি। উনি একবার চিটাগাঙ কক্সবাজার গিয়েছিলেন, তখন দূর থেকে দেখেছি, কিন্তু আলাপ করতে পারিনি!
সন্তু আবার জিজ্ঞেস করল, বাচ্চাদের কোথায় লুকিয়ে রেখেছে?
মামুন বলল, সুন্দরবনে। ছোট মোল্লাখালির কাছে একটা দ্বীপে।
সন্তু উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চলুন, সেখানে যেতে হবে। এক্ষুনি!
জোজো বলল, এখন সুন্দরবন যাব? সে তো অনেক দূর।
সন্তু বলল, খুব দূর নয়, আমি আগে গেছি। ক্যানিং থেকে লঞ্চে দু-তিন ঘণ্টা লাগবে।
মামুনের দিকে ফিরে বলল, শুনুন মামুনসাহেব, কাকাবাবু কোথায় গেছেন, আমি জানি না। কিন্তু তিনিও এই শিশু চুরি নিয়ে দারুণ রেগে আছেন, এই ক্রিমিনাল গ্যাংটাকে ধরবার চেষ্টা করছেন। বাচ্চাগুলো কোথায় আছে, সেটা জানতে পারলে খুবই খুশি হবেন কাকাবাবু। উনি তো ফিরবেনই। আমি সেখানে বসে থাকব, আপনারা ফিরে এসে কাকাবাবুকে খবর দেবেন।
জোজো বলল, আলমদাকে খবর দিলে হয় না?
সন্তু বলল, আলমদাও তো কলকাতায় নেই। তাঁকে পাওয়া গেলে খুব সুবিধে হত।
মামুন জিজ্ঞেস করল, আলমদা কে?
জোজো বলল, রফিকুল আলম, খুব বড় পুলিশ অফিসার, আমাদের খুব চেনা।
মামুন বলল, হ্যাঁ, নাম শুনেছি। দেখুন না, যদি তাঁকে পাওয়া যায়। পুলিশ সঙ্গে থাকলে আমরাই উদ্ধার করে আনতে পারি।
সন্তু বলল, টেলিফোনে ধরার চেষ্টা করব। কিন্তু সেজন্য দেরি করে লাভ নেই। আপনি লুকোনো জায়গাটার কথা জেনে এসে দারুণ কাজ করেছেন। আর এক মিনিটও সময় নষ্ট করলে চলবে না।
জোজো বলল, মামুনভাই, আপনাকে মনে হচ্ছে দেবদূত। কাকাবাবু আর আমরা এই ব্যাপারটা নিয়েই মাথা ঘামাচ্ছি। আর আপনিও সেই ব্যাপারে এসে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় খবরটাই দিলেন। তা হলে এবারে শুরু হোক, অপারেশন ছোট মোল্লাখালি!
তিনজনে দৌড়তে শুরু করল।